
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনন্য সাহিত্যকর্ম সৃষ্টিতে কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়ির রয়েছে বিশেষ অবদান । ঠাকুর পরিবারের জমিদারি পরিচালনার জন্য এখানে এসে তিনি ভালোবেসে ছিলেন ছায়াঘেরা নিভৃত পল্লি শিলাইদহকে। এ ছাড়া আকৃষ্ট হয়েছিলেন এখানকার নৈসর্গিক দৃশ্য এবং প্রমত্তা পদ্মা নদী ও পদ্মার বুক থেকে বেরিয়ে আসা গড়াই নদীর প্রতি। ছায়াঘেরা নিভৃত পল্লির এই কুঠিবাড়ি এবং পদ্মা ও গড়াই নদীর বুকে রচিত হয়েছে কবির সাহিত্য কর্মের শ্রেষ্ঠাংশ। শিলাইদহের কুঠিবাড়ি কবির সাহিত্য কীর্তি ও নানা রচনার সঙ্গী। কবিগুরুর পদস্পর্শে শিলাইদহ গ্রামটি বিশেষ মর্যাদা ও পরিচিতি লাভ করে।
যাপিত জীবনের ব্যস্ততা ঝেরে ফেলে অনেক দিন ধরে পরিকল্পনা করছিলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত শিলাইদহ কুঠিবাড়ি ঘুরে আসার। কিন্তু ব্যাটে-বলে মেলাতে পারছিলাম না। অন্য দিকে অনেক দিন ধরে কুদ্দুস মামা বলছিলেন কুষ্টিয়া এসে ঘুরে যেতে। শেষ পর্যন্ত আমি আর আমার সবসময়ের ভ্রমণ সঙ্গী মা পা বাড়ালাম কুষ্টিয়ার পথে। ভোরের মিষ্টি আলো গায়ে মেখে আমরা শিলাইদহের উদ্দেশে বের হলাম।
ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৮টা। আমরা আসি কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে। এসবি পরিবহনের বাসটি নির্ধারিত সময়েই গন্তব্যে ছুটে নিয়ে চলল আমাদের। যান্ত্রিক নগর জীবনের কোলাহলকে ছেড়ে আমাদের বাহন এগিয়ে চলছে। টেকনিক্যাল রোড, মাজার রোড পাড়ি দিয়ে আমরা এখন গাবতলী ব্রিজের ওপর দিয়ে এগিয়ে চলছি। ব্রিজের ওপর আসার পরপরেই ছোট একটি জ্যামের দেখা পেলাম। এর মাঝে বৃষ্টির ছোঁয়া মহাসড়ককে সতেজ করে তুলল।
ধামরাই, কামালপুর পার হওয়ার পর সবুজের সমারহ আপনাকে মুগ্ধ করবে। সময়ের সঙ্গে আমাদের বাস এগিয়ে চলছে ধলেশ্বরী ব্রিজ দিয়ে। সেই সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেছি তাই শীতলতার পরশ আমাকে ঘুমের রাজ্যে নিয়ে গেল। পাটুরিয়া ফেরি ঘাটে গিয়ে আমার ঘুম ভেঙে গেল। একটা সময় মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো ফেরির জন্য। আর এখন ফেরিকে অপেক্ষা করতে হয় বাসের জন্য। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চার চাকার বাহন চলে এল কুষ্টিয়ার গড়াই ব্রিজ ও মধুমতি রেল সেতুর কাছে। কুষ্টিয়া পৌঁছে আমরা মজমপুর গেটে নেমে পড়লাম।
সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন কুদ্দুস মামা আমাদের জন্য। গাড়ি থেকে নেমেই আমরা চেপে বসলাম তিন চাকার বাহনে। মামা বললেন চল আগে তোমাদের কুঠিবাড়ি দেখিয়ে নিয়ে আসি। দূর থেকে পিরামিড আকৃতির ছাদের একটি বাড়ি দেখতে পেলাম, যেটিকে অন্যসব বাড়ি থেকে সহজেই আলাদা করা যায়। মনে মনে ভাবলাম আমরা তাহলে চলে এসেছি আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। কুঠিবাড়ির বাইরে কুলফি মালাই বিক্রেতাদের দেখা পেলাম। লোভ সামলাতে না পেরে নিয়েই নিলাম কুলফি মালাই ৫০ টাকার বিনিময়ে। কুঠিবাড়িতে প্রবেশের আগে চোখে পড়ল দেয়ালে টাঙানো থাকা একটা প্রদর্শনী চার্ট। চার্টে টিকিটের মূল্যসহ আরও কিছু দিকনির্দেশনা দেওয়া ছিল। চার্ট পড়ে বুঝতে পারলাম ভেতরে ঢুকতে অবশ্যই কাউন্টার থেকে টিকিট সংগ্রহ করতে হবে।
৬০ টাকা দিয়ে আমি তিনটি প্রবেশ টিকিট সংগ্রহ করে নিই। পদব্রজে আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই দেখাতে পেলাম বিশাল মাঠের একপাশে মুক্তমঞ্চ, অন্যপাশে একটি অডিটোরিয়াম। কুঠিবাড়ির মূল ভবন সংলগ্ন অংশে প্রবেশের আগে পাশেই চোখে পড়ল সোনার তরী ও গীতাঞ্জলি ডাকবাংলো।
সুদৃশ্য বাগানের মাঝখান দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। সুন্দর পায়ে চলা পথ চলে গেছে কুঠিবাড়ির দিকে। এই জায়গাটি গড়ে উঠেছে আড়াই বিঘা জমির ওপর। কুঠিবাড়ির একদম কাছাকাছি যেতেই বামপাশে চোখে পড়ল একটি উন্মুক্ত পাঠশালা মঞ্চ, যেখানে রবি ঠাকুর নিজ কর্মচারীদের ছেলেমেয়েদের পাঠদান করাতেন। আমরা মূলভবন পানে এগিয়ে চললাম। লক্ষ করলাম তিনতলা বিশিষ্ট মূল ভবনটিতে মোট কক্ষ রয়েছে ১৮টি। এগুলোয় প্রবেশ ও প্রস্থানের জন্য দরজা রয়েছে মোট ১৭টি। নিরবচ্ছিন্নভাবে সূর্যের আলো ঢোকার জন্য রয়েছে মোট ৩০টি জানালা।
বিশ্বকবির লেখার ঘর ছিল ভবনের তৃতীয় তলায়। সঙ্গে লাগোয়া বারান্দা এবং ছাদ থেকে প্রকৃতিপ্রেমী কবি সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত এবং জ্যোৎস্নার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করতে পারতেন। ভবনের নিচ ও দ্বিতীয় তলার ১৬টি কক্ষ জুড়ে রয়েছে কবি, শিল্পী, জমিদার ও কৃষক বন্ধু হিসেবে রবীন্দ্রনাথের জীবনের বিভিন্ন সময়ের বিচিত্র ভঙ্গিমার ছবি। তার ব্যবহার্য জিনিসপত্রের মধ্যে দেখা যায় চঞ্চলা ও চপলা নামের দুটি স্পিডবোট।
কবিগুরুর অসংখ্য স্মৃতিবিজড়িত প্রাচীন ছবির অ্যালবাম। যে অ্যালবামগুলো সমৃদ্ধ করা হয়েছে বিশ্বকবির বিভিন্ন ব্যবহৃত জিনিসপত্র দিয়ে। তার মধ্যে কয়েকটি হলো তার ঘুমানোর খাট, খাজনা আদায়ের চেয়ার-টেবিল, পদ্মা নদীতে চলাচল করা কাঠের নৌকা, হাত পালকি, আট ও ষোলো বেহারার পালকি, হাতের লেখা ইংরেজি চিঠিপত্রসহ আরও অসংখ্য কবিতা-গানের খণ্ডিত অংশের দেয়ালিকা। এ ছাড়া আমরা দেখতে পেলাম কবির আত্মীয়-পরিজন ও তার নিজের হাতে আঁকা বিভিন্ন চিত্রকর্ম। পশ্চিমপাশে গাছ-গাছালি ঘেরা উদ্যানটি চলে গেছে বকুল তলার পুকুর ঘাটের দিকে।
এই সেই নামকরা পুকুর ঘাট, যেখানে বসে কবিগুরু লিখেছিলেন ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’ গানটি। পুরো বাড়ির আঙিনাজুড়ে আছে অনেক গাছ। এই গাছগুলোর অবয়ব তাদের বয়সের সাক্ষী দিচ্ছে। একেকটি বৃক্ষ যেন দাঁড়িয়ে আছে একেকজন জাতিস্মরের ভূমিকায়। এই গাছগুলোর মধ্যে আম ও পাইনের সংখ্যাই বেশি। পাশাপাশি আছে কাঁঠাল, নিম কাঠবাদামসহ আরও অনেক প্রজাতির গাছ। দীঘির দুই পাড়ে আছে দুটি শান বাঁধানো ঘাট। সেখানে বসে আপনি বিশ্রাম নিয়ে নিতে পারেন। অনেকেই এই শানের ওপর শুয়ে তার শীতল পরশে শরীরের ক্লান্তি জুড়িয়ে নেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাকুর্দা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮০৭ সালে কুষ্টিয়া অঞ্চলের জমিদারি পান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি দেখাশোনার জন্য ১৮৮৯ সালের নভেম্বর মাসে সর্বপ্রথম শিলাইদহে আসেন।
১৯০১ সাল পর্যন্ত তিনি নিয়মিত বিরতিতে এখানে জমিদারি পরিচালনা করেন। এই কুঠিবাড়ি থেকে তিনি পতিসর ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের জমিদারি দেখাশোনা করতেন। শিলাইদহে দীর্ঘ ১২ বছরের যাতায়াতে কবিগুরুর অনেক স্মৃতি এখানে তৈরি হয়েছে, যেগুলো আজও দৃশ্যমান। কবি এখানে কাটিয়েছেন দিনের পর দিন, নির্জনে নিভৃতে লিখেছেন অসংখ্য কবিতা আর গান। এখানে বসে তিনি রচনা করেছেন সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালীর মতো বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। ১৯১২ সালে এখানে বসেই ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কারণে শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে পায়ের ধুলা পড়েছে জগদীশ চন্দ্র বসু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, প্রমথ চৌধুরীর মতো বিখ্যাত মানুষের। এই কুঠিবাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত মানুষ মীর মশাররফ হোসেনের। ভ্রমণপিপাসু যে কারও কাছে শিলাইদহের কুঠিবাড়ি এক আরাধ্য বস্তু।
কুঠিবাড়ির দেয়াল থেকে শুরু করে সবকিছুই আপনার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করবে। বাংলাদেশের পুরোনো অভিজাত সাংস্কৃতিক অবকাঠামোগুলোর মধ্যে অন্যতম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহ কুঠিবাড়ি। এর মাধ্যমে ১৯ শতকের শেষের দিকের স্থাপত্যশৈলীর প্রমাণ পাওয়া যায়। এটিকে সংরক্ষণের জন্য সরকারি মহলের যতটুকু দায়বদ্ধতা রয়েছে, তেমনি দায়িত্ব রয়েছে এখানে ঘুরতে আসা প্রতিটি পর্যটকেরও। এখানে ঘুরে বেড়ানোর ক্ষেত্রে স্থানীয় লোকজনসহ দেশের অন্যান্য প্রান্তের ভ্রমণপিপাসুদের অবশ্যই এখানকার পরিবেশগত পরিচ্ছন্নতার প্রতি খেয়াল রাখা জরুরি। কুষ্টিয়ার শিলাইদহ রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি ঘুরে দেখার সময় দেশীয় পর্যটকরা এই নিয়মনীতিগুলো যথাযথভাবে মেনে চললে বিদেশি পর্যটকদের কাছেও তা অনুসরণীয় হবে। একই সঙ্গে পরিষ্কার ও গোছানো স্থাপনা হিসেবে দেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হবে বিশ্বের কাছে।
যাবেন কীভাবে
ঢাকা থেকে শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে অনেকভাবেই যাওয়া যায়। কল্যাণপুরে কুষ্টিয়াগামী বাসগুলোর টিকিট কাউন্টার আছে। আপনি চাইলে আগে থেকেই অনলাইনেও টিকিট কিনে রাখতে পারেন। এরপর বাসে যাবেন কুষ্টিয়া শহরে। তাছাড়া চাইলে আপনি ট্রেনে করেও যেতে পারেন কুষ্টিয়াতে। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সুন্দরবন ও ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে চিত্রা ট্রেনে যেতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে কুষ্টিয়ার অদূরে অবস্থিত পোড়াদহ রেল স্টেশনে নেমে বাস কিংবা অটোরিকশায় চড়ে শহরে আসতে হবে। কুষ্টিয়া শহরে আছে চমৎকার কিছু হোটেল। আর কুষ্টিয়ার যেকোনো রেস্তোরাঁয় আপনি খেয়ে নিতে পারেন। এরপর কুষ্টিয়া থেকে অটোতে করে শিলাইদহে আসতে পারেন।
রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি দর্শনের সময়সূচি ও প্রবেশমূল্য
গরমের মাসগুলোয় রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি জাদুঘর খোলা থাকে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। আর শীতের সময় সকাল ৯টায় খুলে বিকেল ৫টায় বন্ধ হয়ে যায়। এর মাঝে দুপুর ১টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত জাদুঘর বন্ধ থাকে। এ ছাড়া শুক্রবার সাড়ে ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত বন্ধ থাকে জুমার নামাজের জন্য। সপ্তাহে এক দিন রবিবার জাদুঘর সারা দিন বন্ধ থাকে, আর সোমবার বন্ধ থাকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত। পুরো কমপ্লেক্সটিতে ঢোকার মুহূর্তে টিকিট কাটতে হয়। প্রবেশমূল্য প্রাপ্তবয়স্ক দর্শনার্থীদের জন্য জনপ্রতি ২০ টাকা, যেটি মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য রাখা হয়েছে ৫ টাকা। সার্কভুক্ত দেশ থেকে আগত দর্শনার্থীদের এই টিকিটের জন্য খরচ করতে হবে ৫০ টাকা। আর অন্যান্য বিদেশি পর্যটদের ক্ষেত্রে টিকিট মূল্য ১০০ টাকা।
কলি