
মৌলভীবাজারের উদ্দেশে রাজধানীর ফকিরাপুল থেকে রাতের শেষ বাসে চড়ে বসলাম। ভ্রমণের সময় সাধারণত রাতের শেষ বাস বা ট্রেনে যেতেই বেশি ভালো লাগে আমার। সকালে বাস থেকে নেমেই গরম গরম পরোটা আর ডিম ভাজি দিয়ে নাশতা সেরে নিলাম।
আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল দেওয়ানছড়া জমিদারবাড়ি। সিএনজি নিয়ে চলে গেলাম সেখানে। এ বাড়িটির কথা অনেকেই জানেন না। পর্যটকের আনাগোনাও তেমন চোখে পড়ল না। সাদামাটা ছিমছাম সুন্দর সবুজ বাড়ি। এরিয়াও মোটামুটি বড়। বাড়ির সামনে ছোট একটা দীঘি আছে। বাড়িটি সঠিক পরিচর্যার কারণে খুব পরিপাটি হয়ে আছে। আমরা ঘুরে দেখলাম। সাধারণত বাড়ির অন্দরমহলে দর্শনার্থীদের প্রবেশ করতে দেয় না। আমরাও প্রবেশ করতে পারিনি। তাহলে আরও বিশদভাবে দেখার সুযোগ পেতাম। তবে পুরো বাড়িতে এত ফুল-ফলের গাছ, সবুজ ঘাসের মাঠ, তা দেখে যে কারও মন শান্ত হয়ে যাবে। আর দীঘির কাছে বসলে মনে হবে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানেই বসে থাকি।
এরপর চলে গেলাম বর্ষিজোড়া ইকোপার্কে। ইকোপার্কটা অনেক বছর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। তবু গেট খোলা থাকে বিধায় অল্পবিস্তর মানুষ ঘুরতে যায়। অনেকটা এলাকাজুড়ে সেখানে সবুজ বনাঞ্চল। একসময় পার্কটি জনপ্রিয় ছিল, দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর থাকত। তার নমুনা মিলবে ইকোপার্কজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন জায়গায়। বেশি নিরিবিলি থাকায় খুব ভেতরে প্রবেশ না করাটাই নিরাপদ। ভ্রমণে সবসময় নিরাপত্তার কথা সবার আগে মাথায় রাখতে হয়।
সদরের একটা হোটেল থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে গেলাম ক্যামেলিয়া লেক দেখতে। সেই যাত্রায় আমাদের সঙ্গে আরও তিনজন যুক্ত হলো। চা বাগান বেষ্টিত ক্যামেলিয়া লেক দেখতে অপূর্ব সুন্দর। ক্যামেলিয়া লেকে যাওয়ার পথেও রয়েছে সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি। চারপাশে দারুণ সব ল্যান্ডস্কেপ। বিকেল কাটানোর জন্য ক্যামেলিয়া লেক দারুণ একটা জায়গা। সেখানে গেলে মনে হবে, জীবনের অসংখ্য কোলাহলমুখর দিন পেছনে ফেলে চলে এসেছেন এক ভিন্ন পৃথিবীতে। এত নীরব নিঝুম চারপাশ। সেই নীরবতা আর সবুজ ল্যান্ডস্কেপ ক্লান্তি মুছে দেয়।
এরপর গেলাম মনুব্যারেজ। মনুব্যারেজ উল্লেখযোগ্য কোনো জায়গা মনে হয়নি আমার কাছে। তবে সেখানে রোজ বিকেলে অনেক দর্শনার্থী আসে। মনুব্যারেজে কিছুটা সময় কাটিয়ে, সবুজ ঘাসের ওপর বসে খাওয়া-দাওয়া করে আমরা চলে যাই রাঙাউটি রিসোর্টে। মনোরম পরিবেশে জলস্থল মিলে খুব সুন্দর একটা রিসোর্ট। ৪০০ টাকা প্রবেশমূল্য। রাত্রিযাপনের জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত সুব্যবস্থা, তবে তার জন্য গুনতে হবে মোটা অঙ্কের টাকা। আমরা সুন্দর একটা বিকেল আর সন্ধ্যা কাটালাম সেখানে। তারপর চলে এলাম মৌলভীবাজার। সেখানের স্পঞ্জের মিষ্টির সুনাম আগেই শুনেছিলাম। তাই মিস করলাম না খেতে। আসলেই মিষ্টিটা খেতে খুব সুস্বাদু ছিল। পরিচিত একজনের বাসায় গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিলাম।
ওই দিন রাতেই ঢাকা ফেরার জন্য শ্যামলী বাসের টিকিট কেটে রেখেছি। রাত সাড়ে ১২টায় বাস। প্রচুর বৃষ্টি শুরু হলো, থামার নামগন্ধ নেই।
ভাবছিলাম, আজ হয়তো ফেরাই হবে না আর। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভাগ্য সহায় হলো। বৃষ্টি কিছুটা ঝরার পর বাসস্ট্যান্ডে চলে গেলাম। বৃষ্টির জন্য বাস আসতে একটু দেরি হলো। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে বৃষ্টিভেজা মৌলভীবাজারকে বিদায় জানালাম। বাস ছেড়ে দিল। মন যেন পড়ে রইল মৌলভীবাজারের অনিন্দ্য সৌন্দর্যের কাছে।
মৌলভীবাজার জেলায় আরও যা দেখার আছে
মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, হাকালুকি হাওর, হামহাম জলপ্রপাত, হাইল হাওর, আতর ও আগর শিল্প বাগান, চা কন্যা মনুমেন্ট, বাইক্কা বিল, পাখিবাড়ি, নবাব আলী আমজাদের বাড়ি, কমলারানীর দীঘি, কালাপাহাড়, আদমপুর বন, মণিপুরী গ্রাম, পাথারিয়া পাহাড়, গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট ও গলফ ক্লাব, মাধবপুর লেক, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, বধ্যভূমি ৭১, লালপাহাড়, রাবার বাগান, বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানের সমাধি, নূরজাহান টি এস্টেট, আদি নীলকন্ঠি টি কেবিন, ঐতিহাসিক গয়ঘর খাজার মসজিদ, পদ্মছড়া লেক, লাসুবন গিরিখাদ, সীতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা, মাথিউড়া চা বাগান লেক, পাঁচগাও বধ্যভূমি, কাদিপুরের শিববাড়ি, চাতলগাঁও বধ্যভূমি, গগনটিলা, শাহবাজপুর বধ্যভূমি, ডিনস্টন সিমেট্রি, ইকো রিসোর্ট ইত্যাদি।
কীভাবে যাবেন
রাজধানী ঢাকার ফকিরাপুল বা মহাখালী থেকে হানিফ এন্ট্রারপ্রাইজ, শ্যামলী, এনা প্রভৃতি বাস চলাচল করে। ভাড়া নন এসি ও এসি মিলিয়ে ৫৭০ থেকে ৭০০ টাকা। এ ছাড়া চাইলে রেলপথেও যেতে পারেন। সকালে পারাবাত এক্সপ্রেস, দুপুরে জয়ন্তিকা, বিকেলে কালনী এক্সপ্রেস আর রাতে উপবন এক্সপ্রেস চলাচল করে। ভাড়া ৩৫০ টাকা থেকে শুরু।
কোথায় থাকবেন
মৌলভীবাজার জেলা সদরেই থাকার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট হোটেল রয়েছে।
সতর্কতা
কোনো পর্যটন স্পট বর্জ্য ফেলে নোংরা করবেন না। মনে রাখবেন, পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার।
কলি