ঢাকা ৩০ আশ্বিন ১৪৩১, মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪

কালিদামার খোঁজে কালাই রুটির দেশে

প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৪, ০৪:৪৪ পিএম
আপডেট: ১৭ আগস্ট ২০২৪, ০৫:২২ পিএম
কালিদামার খোঁজে কালাই রুটির দেশে

ধলাপাখ-কালিদামা পাখিটি আমাদের দেশে খুব একটা দেখা যায় না। তবে সম্প্রতি এর উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। আর তাই একে দেখার জন্য গত ফেব্রুয়ারি মাসের এক সকালে হাজির হই রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পদ্মার তীরবর্তী প্রেমতলী বনে। সঙ্গী আছেন বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্য মানিক ভাই এবং এখানকার গাইড নূর ইসলাম। প্রচুর গাছপালায় ভরা বিশাল এ বনের কোথায় পাখিটি আছে, সেটি জানেন নূর ইসলাম। তিনি এ বনে তিনি নিয়মিত পাখি দেখতে বা দেখাতে আসেন। আমরা তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে হাঁটি।

হাঁটতে হাঁটতে বনের একটা জায়গায় এসে থামি। নূর জানান, সম্প্রতি এখানেই দেখা গেছে পাখিটিকে। আমরা তাই তাকে দেখার উদ্দেশে চোখ রাখি বনের গাছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও পাখিটির দেখা নেই। এরপর আসি আরেক স্থানে। এখানেও অনেকক্ষণ অপেক্ষা। অবশেষে পাখিটির দেখা পাই কিছু সময়ের জন্য। তবে মনমতো ছবি তুলতে পারিনি। তাই আরও অপেক্ষা করি। ইতোমধ্যে আরও কয়েকজন এসেছেন এ পাখির খোঁজে। কেউ এসেছেন ঢাকা থেকে, কেউ রাজশাহী থেকে। বেশ কিছুক্ষণ পর আবার পাখিটির দেখা পাই। ছবিও তুলি মনমতো। আমরা পুরুষ পাখিটি দেখি। মেয়ে পাখিটির খোঁজ পাইনি। অবশ্য রাজশাহীর পাশাপাশি পাখিটি সম্প্রতি হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান এবং কক্সবাজারের টেকনাফে দেখা গেছে বলে জেনেছি।

ইংরেজিতে পাখিটির নাম- গ্রে উইংড ব্ল্যাকবার্ড। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ‘উদ্ভিদ ও প্রাণিকোষ’ বইয়ে এর বাংলা নাম- ধলাপাখ-কালিদামা। কালো বর্ণের এ পাখি আকারে শালিকের চেয়ে একটু বড়। পাখিটির ডানা ফিকে ধুসর। এর ঠোঁট গাঢ় কমলা। চোখ বাদামি এবং চোখের বলয় হলুদ। সাধারণত পাখিটি বনে বা বনের ধারে বিচরণ করে। ভূমিতে হেঁটে হেঁটে খাবার খুঁজে খায়। খাবারের তালিকায় আছে পোকা, কেঁচো, অমেরুদণ্ডী ছোট প্রাণী ও রসালো ফল। মার্চ থেকে আগস্ট প্রজননকাল। জমির আইলে, পতিত গাছে বা গাছের উঁচু ডালে ঘাস, শেওলা বা পাতা দিয়ে বাটির মতো বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। ৩ থেকে ৪টি ডিম দেয়। মেয়েপাখি ডিমে একা তা দেয়।

ধলাপাখ-কালিদামা ছাড়াও বাাংলাদেশে দামা প্রজাতির আরও কয়েকটি পাখি আছে। নীল-শিলাদামা, নীল-শিসদামা, কমলা-দামা, আঁশটে-দামা, কালাপাশ-দামা, খয়রাপিঠ-দামা, লম্বাঠোঁট-দামা, ধলাঘাড়-দামা, কালাবুক-দামা, পাতি-কালিদামা, কালচে-দামা, ভ্রমণ লেখা-দামা, লালগলা-দামা এবং টিকেলের-দামা। এর মধ্যে দুর্লভ আবাসিক কমলা-দামা ও বিরল পরিযায়ী নীল-শিসদামা মাঝে মাঝে দেখা যায়। তবে দুর্লভ পরিযায়ী নীল-শিলাদামা বা বিরল পরিযায়ী কালাবুক-দামা, লালগলা-দামা ও টিকেলের-দামা খুব কম দেখা যায়। এ ছাড়া অন্য দামাগুলো অনিয়মিত হওয়াতে একেবারেই কম দেখা মেলে।

ধলাপাখ-কালিদামা দেখে বনে আরও কিছুক্ষণ ঘুরে আরও কিছু পাখি দেখি। বিকেলে ফিরি শহরে। রেলওয়ে স্টেশনের হোটেলে উঠি। ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খাই এখানকার একটা রেস্টুরেন্টে। এরপর আসি এখানকার সিঅ্যান্ডবি মোড়ে গরম গরম ছানার রসগোল্লা আর পুরি খেতে। রানার মিষ্টিখ্যাত এ স্পঞ্জ রসগোল্লা প্রতিটি ২০ টাকা। পুরি প্রতিটি ১০ টাকা। গরম গরম রসগোল্লার সঙ্গে গরম গরম পুরি, দারুণ স্বাদ। দোকানে বেশ ভিড়। বোঝা গেল রাজশাহী শহরে এ মিষ্টির বেশ সুনাম রয়েছে। একদিকে মিষ্টি বিক্রি হচ্ছে, অন্যদিকে মিষ্টি বানানো হচ্ছে। মিষ্টি খেয়ে আমরা রাতের শহর ঘুরি। ইতোমধ্যে এ শহর পরিচ্ছন্ন নগর হিসেবে দেশে খ্যাতি পেয়েছে। খ্যাতি পাওয়া শহরে কিছুক্ষণ ঘুরে হোটেলে ফিরি।

পরের দিন খুব সকালে আসি পবা উপজেলার দামকুড়ার ভিমের ডাইং এলাকায়। উদ্দেশ্য ক্রেস্টেড বান্টিং দেখার জন্য। বাংলায়-ঝুঁটিয়াল-চটক। বিরল প্রজাতির এ পাখি আমাদের দেশের নতুন পাখি বলা যায়। পরিযায়ী এ পাখি এর আগে বাংলাদেশের পাখির তালিকায় ছিল না। সম্প্রতি এ পাখিটি রাজশাহী অঞ্চলের খেতখামারে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

পাখিটিকে দেখার জন্য আমরা সরিষা খেতের আইলে বসি। আমাদের চারপাশেই খেত। সরিষা, ভুট্টা, গম, আখসহ বিভিন্ন ফসলে ভরা এসব খেত। শীতের সকাল হওয়াতে খেতের ফসলের বা জমিনের আইলের ঘাসের ওপর জমে থাকা শিশিরকণা তখনো শুকায়নি। সূর্যেরও তেজ বাড়েনি। অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যে আরও ১০-১২ জন এসে হাজির হয়েছেন এ পাখি দেখার জন্য।

আমরা সবাই যেখানে বসি, এর আশপাশেই পাখিটিকে সম্প্রতি বেশি দেখা গেছে। সেজন্যই আমরা এখানে বসি। পাখিটি সরিষা খেতের ভেতরে লুকিয়ে আছে। মাঝে মধ্যে উপরে উঠে একনজর দেখা দিয়ে আবার হারিয়ে যায়। এভাবেই চলে বেশ কিছুক্ষণ। এর মধ্যে যে যতটুকু পেরেছেন ছবি তুলেছেন। মানিক ভাইও ক্লিক করেছেন বেশ। আমরা দেখি স্ত্রী পাখিটি। যদিও স্ত্রী-পুরুষ দুটোই থাকার কথা। তবে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও পুরুষটিকে দেখিনি। এখানে ছাড়াও পাখিটি সম্প্রতি শেরপুর, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া, মৌলভীবাজারের কুড়মা চা বাগান ও জামালপুরে কেউ কেউ দেখেছেন বলে জেনেছি।

চড়ুই আকারের সুদর্শন পাখিটির মাথায় ঝুঁটি রয়েছে। সেজন্য নামের আগে ঝুঁটিয়াল বসানো হয়েছে। গায়ের রং অনেকটা হালকা বাদামি। আমাদের দেশে আরও চার প্রজাতির চটক দেখা যায়। লালকান-চটক, খুদে-চটক, হলদেবুক-চটক এবং কালামুখ-চটক। এর মধ্যে কালামুখ-চটক মাঝে মধ্যে দেখা যায়। আর বাকিগুলো কমই দেখা যায়। অনেকক্ষণ ধরে পাখিটিকে পর্যবেক্ষণ করার পর আমরা আবার রওনা হই ধলাপাখ-কালিদামার উদ্দেশে।
প্রেমতলী বাজার হয়ে আমরা নদীর দিকে আগাই। এরপর খেয়াপার হই। আগের দিনও এ খেয়াপার হই। নদীর নাম পদ্মা। নদীতে পানি কম। পলি জমে ভরাট হয়েছে। তেমন কোনো খেয়াঘাট নেই। দু-একটি নৌকা পাড়ে আছে। কেউ পার হতে চাইলে মাঝি পার করে দেন। আবার যখন মাঝি থাকেন না, তখন কেউ কেউ নিজেরাই বইঠা বেয়ে পার হন। খেয়াপার হয়ে একটু হাঁটলেই বন।

আমরা বনের একটা জায়গায় এসে দাঁড়াই। কিছুক্ষণ পরই পাখিটির দেখা পাই। মানিক ভাই আয়েশ করে ছবি তোলেন। এরপর বনের আরও কিছু জায়গা ঘুরি। বের হওয়ার সময় বনের পাশের একটা খেতে দেখি দেশি-মোটাহাঁটু। ইংরেজিতে- ইন্ডিয়ান থিকনি। পাখিটি আকারে মুরগির ছানার মতো। শরীর বাদামি রঙের। ডানার প্রান্ত কালো এবং সাদাটে পেট। হলুদ চোখের চারপাশে কালচে রিং এবং রিংয়ের ওপরে ও নিচে রেখা। পা হলদে। কালচে ঠোঁটের গোড়া হলদে। বিরল প্রজাতির এ পাখি মাঝে মধ্যে দেখা যায়। এটা ছাড়াও বাংলাদেশে আরও দুটি প্রজাতির মোটাহাঁটু রয়েছে। এর মধ্যে ইউরেশীয়-মোটাহাঁটু আমাদের অনিয়মিত পাখি। আর বড়-মোটাহাঁটু বিরল আবাসিক পাখি। ফলে এগুলোও খুব কম দেখা যায়।

পাখি দেখে নদীর তীরে এসে দেখি নৌকা আছে কিন্তু মাঝি নেই। তাই নূর মাঝি হন। শহরে যাওয়ার আগে এখানকার বাজারে খাই দুপুরের খাবার। যদিও বিকেল হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় আসি শহরে। শহরে নদীর পাড়ে কিছুক্ষণ বসি। রাতে রেলওয়ে স্টেশনের পাশে ফুটপাতের দোকানে খাই কালাইরুটি। সঙ্গে পেঁয়াজ দিয়ে বেগুনভর্তা। এটা রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবার।

একসময় ফুটপাতে শীত মৌসুমে বেশি বিক্রি হলেও এখন রেস্টুরেন্টেও মেলে। এ ছাড়া শীত ছাড়া অন্য সময়ও পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, এখন এ রুটির নামে অনেক রেস্টুরেন্টও আছে এ শহরে। সাধারণত এ রুটি গরুর মাংস, হাঁসের মাংস, বেগুনভর্তা, শুঁটকিভর্তা বা ধনিয়াভর্তা দিয়ে খায়।

প্রথমে তিনভাগ  মাষকলাইয়ের গুঁড়ার সঙ্গে একভাগ চালের আটা মেশাতে হয়। এরপর পানি দিয়ে খামির বানিয়ে গোল বল তৈরি করতে হয়।  এরপর পানি দিয়ে খামির বানিয়ে গোল বল তৈরি করতে হয়।  এরপর বল দুই হাতের তালুর চাপে চাপে তৈরি হতে থাকে রুাট। এরপর মাটির খোলায় বা তাওয়াতে  এপিট ওপিঠ সেঁকে তৈরি হয় রুটি। 

প্রতি রুটি ৩০ টাকা। তবে স্পেশাল ৫০ টাকা। সঙ্গে ভর্তা ফ্রি। রুটির পর রেলওয়ে স্টেশনের সামনে খাই গরুর দুধের চা। ১২ টাকা কাপ। পরপর কয়েকটি চায়ের দোকান। সবগুলোতেই ভিড়।

ছবি: লেখক

 কলি

তিন শ বছরের পুরনো কালভৈরব মন্দির

প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৩৬ পিএম
আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৪০ পিএম
তিন শ বছরের পুরনো কালভৈরব মন্দির
ছবি: লেখক

অনেক দিন হয় কোথাও বের হওয়া হয় না। তাই মন চাইছিল কোথাও ছুট লাগাই। শুক্রবার তাই সূয্যি মামা নয়ন মেলার পরই ফোন দিলাম আমাদের চার চাকার পাইলট পলাশ ভাইকে। বেশ কয়েকবার ফোন দিলাম কোনো সাড়া-শব্দ নেই। যার মানে দাঁড়ায় পলাশ ভাই এখনো নিদ্রায় আছেন। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সকাল নয়টার দিকে ফোন ব্যাক করলেন। ফোন ধরেই পলাশ ভাইকে বললাম আপনি ফ্রেশ হয়ে বাসায় চলে আসেন। বাইরে বের হব। স্বল্প সময় পরই পলাশ ভাই বাসায় এসে উপস্থিত। সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়লাম। গাড়িতে উঠতেই পলাশ ভাই বলে উঠলেন কোথায় যাব। আমি বললাম, কোথায় যাব তা তো জানি না। ঢাকামুখী চলেন- দেখি কোথায় গিয়ে থামা যায়। তপ্ত রোদে মহাসড়ক পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি।

চলতি পথে জাদুর বাক্স ঘাঁটছিলাম। আমি মোবাইল ফোনকে জাদুর বাক্স বলি। কেননা এই জাদুর বাক্সের নেশা থেকে বের হওয়া খুব কঠিন। যাই হোক, জাদুর বাক্সের কল্যাণে চোখে পড়ল ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মেড্ডায় অবস্থিত ৩০০ বছরের পুরনো শ্রীশ্রী কালভৈরব মন্দিরের কথা। পলাশ ভাইকে বললাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে যাওয়ার জন্য। 

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কালভৈরব মন্দিরে গিয়েছেন কি না জানতে চাইলে পলাশ ভাই বললেন, যাই নাই কখনো; তবে নেটে সার্চ দিয়ে বের করা যাবে। পলাশ ভাইয়ের কথা শুনে মনে হলো আসলেই আমরা ডিজিটাল যুগে আছি। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে আমরা মহাসড়কে আছি। নির্মীয়মাণ ছয় লেনের সড়ক ধরে এগিয়ে চলছি। ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চলায় গাড়ি একটু ধীরগতিতেই চলছিল। পলাশ ভাই বললেন, সড়কটি আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে আখাউড়া হয়ে আগরতলায় ঢুকেছে। আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে সরাইল বিশ্বরোড মোড়, সেখান থেকে আখাউড়ার ধরখার। পরে ঢুকেছে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায়। সড়কটির কাজ সম্পন্ন হলে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহনে উন্মুক্ত হবে নতুন দিগন্ত। 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের মেড্ডা এলাকায় যখন আমাদের গাড়ি থামল তখন সূর্য হেলান দিয়েছে পশ্চিম কোণে। সড়ক থেকেই চোখে পড়ে মন্দিরটির বিশাল তিনটি মঠ। একটু সামনে এগোতেই গেট ঠেলে পা রাখতে রাখতেই দৃষ্টি পড়ল খোদাই করা লেখার দিকে। লেখা ‘শ্রীশ্রী কালভৈরব নাটমন্দির’। নেট ঘেঁটে পলাশ ভাই নিয়ে এলেন শত বছরের পুরনো কালভৈরব মন্দিরের প্রবেশদ্বারে। খালি পায়ে আমরা এগিয়ে চললাম মন্দির পানে। দর্শন পেলাম ২৮ ফুট উঁচু শ্রীশ্রী কালভৈরব মূর্তির। মাথা ঠেকে আছে মন্দিরের ছাদে। প্রশস্ত মধ্যপ্রদেশ উঁচিয়ে পায়ের ওপর হাত রেখে বসে আছেন শিব। জটা বিছিয়ে কাঁধজুড়ে। হাতের ডানপাশে বিশাল এক ত্রিশূল। সামনে থেকে না দেখলে মূর্তিটির বিশালতা আন্দাজ করা যায় না। আগরবাতির সুবাসিত গন্ধে মন নিয়ে গেল এক অপার্থিব জগতে।

কথা হচ্ছিল ওই এলাকার প্রবীণ শিবু বাবুর সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ১৯০৫ সালে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন ২৮ ফুট উচ্চতার কালভৈরব বা শিবমূর্তি ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বাধিক উচ্চতার মূর্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশালাকার মূর্তির ডান দিকে কালী এবং বাম দিকে দেবী পার্বতীর প্রতিমা রয়েছে। সরাইলের বিখ্যাত জমিদার নূর মোহাম্মদ কালভৈরব মন্দিরের জমি দান করেন। প্রচলিত আছে, কাশীশ্বর দেবাদিদেব মহাদেব নিজ শরীরের অংশ থেকে কালভৈরবের সৃষ্টি করে তাকে কাশীধাম রক্ষার ভার দেন। শ্রীশ্রী কালভৈরবের আবির্ভাবের পর স্থানীয় দুর্গাচরণ আচার্য স্বপ্নে প্রাপ্ত নির্দেশ অনুসারে মাটি দিয়ে বিশালাকার কালভৈরবের বিগ্রহ (মূর্তি) তৈরি করেন।

নির্মাণের পর থেকে স্থানীয় ভক্তবৃন্দের সহায়তায় ১৯৭১ সাল পর্যন্ত নিয়মিতভাবে পূজা-অর্চনা হয়ে আসছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কালভৈরবের বিগ্রহটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ক্ষতিগ্রস্ত করে। পরবর্তী সময়ে ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী মহারাজ ও স্থানীয় মানুষের সহযোগিতায় আবারও ২৮ ফুট উঁচু শ্রীশ্রী কালভৈরব মূর্তি ও মন্দির পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।

শ্রীশ্রী কালভৈরব মন্দিরের বাম পাশে আলাদা ভবনে ১০৫ বছরের পুরনো ১১ কেজি ওজনের কষ্টিপাথরের শ্রীশ্রী কৈলাসেশ্বর শিবলিঙ্গ রয়েছে। শ্রীশ্রী কালভৈরব বিগ্রহ ছাড়াও প্রাচীনতম এই মন্দিরে আরও আছে দেবী পার্বতী, শ্রীশ্রী কৈলাসেশ্বর শিবলিঙ্গ, কালীমূর্তি, দুর্গামন্দির, সরস্বতী দেবী, শ্রীশ্রী কালভৈরব নাটমন্দির এবং দুইটি মঠ। প্রতিবছর বাংলা সালের ফাল্গুনী শুক্লা সপ্তমী তিথিতে এখানে ৪ দিনব্যাপী পূজা, হোমযজ্ঞ, মেলাসহ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। তখন শ্রীলঙ্কা, ভারত, মালদ্বীপ, চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পূজারি, ভক্ত এবং দর্শনার্থীদের ভিড়ে মুখর হয়ে ওঠে কালভৈরব মন্দির প্রাঙ্গণ।

মন্দিরটি পরিদর্শনের সময় দেখতে পেলাম দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন এসেছেন কালভৈরব মন্দির দর্শনে। কেউ-বা এসেছেন মনোবাঞ্ছা পূরণের নিমিত্তে, আবার কেউ-বা এসেছেন মনোবাঞ্ছা পূরণের পর পূজা দিতে।

 আরো পড়ুন: কবিগুরুর ছোঁয়া পেতে শিলাইদহের কুঠিবাড়ি

সনাতন ধর্মে বিশ্বাসীদের মতে, কালভৈরব হচ্ছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দেবতা বিশেষ। সংস্কৃত শব্দ 'ভৈরব'-এর অর্থ ভয়ংকর বা ভয়াবহ। যা শিবের একটি হিংস্র প্রকাশ। এর সঙ্গে মৃত্যু ও বিনাশ সম্পর্কিত। তাই কালভৈরবকে মনে করা হয় মহাদেব শিবের রুদ্ররূপ। দুষ্ট শক্তির বিনাশ করতে মহাদেব এই রুদ্ররূপ ধারণ করেন। হিন্দু পুরাণ, বজ্রযানী বৌদ্ধ শাস্ত্র এবং জৈন ধর্মগ্রন্থগুলোর বক্তব্য অনুযায়ী, 'মহাজগতের বিশেষ স্থানগুলো ভৈরব রক্ষা করেন। ভৈরবের মোট সংখ্য ৬৪। তাদের আটটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। প্রতিটি শ্রেণির আবার একজন করে প্রধান ভৈরব রয়েছেন। প্রধান আট ভৈরবকে 'অষ্টাঙ্গ ভৈরব' বলা হয়। এই আটজন মহাবিশ্বের আটটি দিকের অধিপতি। এই আটজন আবার নিয়ন্ত্রিত হন মহাস্বর্ণ কালভৈরবের দ্বারা। তিনি সাধারণভাবে কালভৈরব নামেই পরিচিত।

কিভাবে যাবেন
ঢাকার সায়েদাবাদ কিংবা যাত্রাবাড়ী থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রুটে চলাচলকারী বাসে চড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলাস্থ বিশ্বরোড আসবেন। সেখান থেকে রিকশা বা সিএনজির মতো স্থানীয় পরিবহনে মেড্ডা এলাকায় অবস্থিত কালভৈরব মন্দির যেতে পারবেন।

 কলি

 

সমুদ্র জল ছুঁয়ে গল্প বোনা দিন

প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:৫৯ পিএম
আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৩০ পিএম
সমুদ্র জল ছুঁয়ে গল্প বোনা দিন
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত , ছবি: সংগৃহীত

যখন আকাশজুড়ে থই থই জ্যোৎস্না থাকবে, তখন একবার লঞ্চের ছাদে চড়ে বরিশালে যাব- এমন ইচ্ছে ছিল অনেক দিনের। হঠাৎ একদম অপরিকল্পিতভাবে সেই সুযোগ এসে গেল।সেপ্টেম্বরের শেষ দিকের কথা। ১৭ জনের টিম যাবে কুয়াকাটায়। একদম রওনা দেওয়ার দিন আমাকে এক প্রকার কিডন্যাপ করে ধরেবেঁধে তাদের সঙ্গে নিয়ে গেল। দুই দিনের ভ্রমণ। ব্যাগ গোছানোর জন্য সময় পেলাম পাঁচ মিনিট। আমাকেসহ টিমের সদস্য সংখ্যা দাঁড়াল ১৮ জন এবং পুরো টিমের ভেতর আমিই সবচেয়ে সিনিয়র সদস্য। সবার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বয়সের কারণে পরে মনে হলো, আমিই যেন দায়িত্ব নিয়ে সবাইকে নিয়ে যাচ্ছি ঘুরতে।

সদরঘাট থেকে আমরা লঞ্চে উঠে বসলাম সন্ধ্যার আগে আগে। একাধিক কেবিন আর কিছু ডেকের সিট নেওয়া হয়েছে। যথাসময়ে লঞ্চ ছেড়ে দিল। আস্তে আস্তে শহর পেরিয়ে গেলাম। সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে রাত নামল। কেবিন ভাড়া করা হলেও সবাই মিলে ছাদে চলে গেলাম। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাঁদ আড়মোড়া ভেঙে জ্যোৎস্না ছড়াতে শুরু করল। শহর পেরিয়ে গ্রামের দিকে যেতে শীত অনুভূত হলো। এমনিতেই নদীর বাতাস, তার ওপর গ্রামের দিকে যেন শীতের অঙ্কুর গজাচ্ছে। সব মিলিয়ে মোহনীয় এক অনুভূতি।

ক্ষুধা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার পর আমরা সবাই রাতের খাবার খেলাম। টিমের একজন সদস্য সবার জন্য বিরিয়ানি রান্না করে এনেছিল। জ্যোৎস্নাপ্লাবিত আকাশের নিচে বসে আয়েশ করে খেলাম পছন্দের খাবার। গল্পে গল্পে রাত বাড়তে লাগল।

সকালের আলো যখন চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে তখন পটুয়াখালী পৌঁছালাম। তারপর অটোতে করে বাসস্ট্যান্ডে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে সেখানেই সকালের নাশতা সেরে বাসে চড়ে বসলাম। গন্তব্য সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটা। কুয়াকাটায় পৌঁছাতে আমাদের সময় লাগল প্রায় দুই ঘণ্টা। আগে হোটেল বুকিং দেওয়া ছিল না। তাই পৌঁছেই হোটেল খুঁজতে শুরু করলাম। সমুদ্রতীর থেকে পায়ে হাঁটা পথে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে পেয়ে গেলাম বাজেটের মধ্যে হোটেল। হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম।

দুপুরে গোসলের জন্য সবাই সমুদ্রে গেলাম। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছিল। সেই ঢেউয়ের সঙ্গে মিতালি করে দুপুরের রোদ গায়ে মেখে তুমুল আনন্দে গোসল করছিলাম আমরা। সমুদ্রতীরে ভেজা শরীর এলিয়ে দিয়ে সানগ্লাস চোখে বিশাল আকাশ আর সমুদ্র দেখতে দেখতে নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিল। সমুদ্রের কাছে এলে সবারই নিজেকে খুব ক্ষুদ্র লাগে বোধহয়।

গোসল শেষে হোটেলে ফিরে গিয়ে সবাই পোশাক বদলে নিলাম। সমুদ্রে দাপাদাপি করে গোসল করাতে সবাই খুব ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিল। আবাসিক হোটেলের কাছেই একাধিক খাবারের হোটেল রয়েছে। সেখান থেকে সবাই পেটপুরে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম।

রোদ একটু কমে এলে ঘোরার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। সেখানে পর্যটন স্পটগুলো ঘুরে দেখানোর জন্য পর্যাপ্ত মোটরসাইকেল আর ভ্যানগাড়ি আছে। আমরা কতগুলো বাইক ভাড়া করলাম সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত ঘোরার জন্য। তাদের কাছে কুয়াকাটার দর্শনীয় স্থানের একটি তালিকা থাকে। তারা সেসব তালিকা দেখিয়ে পর্যটকদের ইমপ্রেস করতে চায়। সেখানে বেশকিছু স্পটের কথা উল্লেখ থাকলেও কিছু কিছু স্পট শুধু নামে মাত্রই, দেখার তেমন কিছু নেই।

প্রথম দিনে আমরা লেবুর বন, ফিস মার্কেট, শুঁটকিপল্লী, ঝাউবন আর তিন নদীর মোহনা দেখলাম। সমুদ্রতীর থেকে ঝিনুক কুড়ালাম। যেসব জায়গা ভালো লাগছিল, বাইক থামিয়ে সেসব জায়গায় কিছুক্ষণ করে ঘুরে বেড়িয়েছি। শুঁটকিপল্লীতে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত শুঁটকি তৈরির কার্যক্রম চলে। তাই আমরা সেসব কার্যক্রম দেখতে পারিনি। তবু ঘুরে এসেছি। তিন নদীর মোহনায় দাঁড়িয়ে অন্য রকম ভালোলাগা কাজ করছিল। সূর্যাস্তের আগে আমরা সেখানটায় ফিরে এসেছিলাম, দুপুরে যেখানে গোসল করেছিলাম। সূর্যাস্তের সময়টায় বুকের ভেতর কেমন বিষাদ ভর করে। তাই সূর্যাস্ত দেখার জন্য কালো রঙের শাড়ি পরেছিলাম। সমুদ্র তখন বেশ শান্ত ছিল। সমুদ্রতীরে বসে ছিলাম গোধূলির অনেকটা সময়। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর সমুদ্রজলে পা ভিজিয়ে তাকিয়ে ছিলাম আকাশের দিকে। সে এক মন-কেমন করা অনুভূতি।

রাতে আমরা আবার সমুদ্রতীরে গেলাম। মাছের বারবিকিউ করার জন্য বড় দুটো সামুদ্রিক মাছ কিনলাম। বারবিকিউর প্রস্তুতি চলছিল, এমন সময় ভাটা পড়ে যাওয়া সমুদ্র যেন আমাকে দুই হাত বাড়িয়ে ডাকছিল। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছিল সমুদ্রাঞ্চল। চরাচরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সেই জ্যোৎস্না গায়ে মেখে হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলাম সমুদ্রের গহীন প্রকোষ্ঠে। তারপর আবার ফিরে এলাম বারবিকিউর উৎসবে। চারপাশে গোল হয়ে চৌকিতে বসলাম সবাই। মাঝখানে আগুন জ্বলছিল আর তার পাশে বারবিকিউ হচ্ছিল। সবাই গান-গল্পে মেতে রইলাম। বারবিকিউ হয়ে গেল। সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার অভ্যেস কম। তাই অন্য সবার মতো আয়েশ করে খেতে পারলাম না। অল্প করে খেলাম।

রাতে হোটেলে ফিরে গিয়েও যেন আমাদের গল্প আর ফুরোয় না। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে কেবল একটু ঘুমিয়েছি, তখনই আবার উঠে পড়ার তাড়া। সূর্যোদয় দেখতে হবে। আগের দিনই বাইক ঠিক করা ছিল। বাইকওয়ালারা হোটেলের সামনে এসে তাড়া দিচ্ছে। সেদিন জীবনে প্রথম দুই মিনিটে শাড়ি পরলাম। সবুজ সতেজতার প্রতীক। তাই সূর্যোদয় দেখার জন্য সবুজ রঙের শাড়ি নিয়ে এসেছিলাম।

সূর্যোদয় দেখার জন্য বাইক ছুটতে শুরু করল দ্রুত গতিতে। ভোরের সমুদ্র যে কী অদ্ভুত সুন্দর, তা বলার মতো নয়। চলতে চলতে একবার ছোট একটা খালের মতোও পার হতে হলো নৌকায়। নৌকাতে বাইক তুলে দিয়ে আমরাও নৌকায় চড়ে বসলাম। নামার পর আবার বাইক চলতে শুরু করল। যেই স্পটে আমাদের সূর্যোদয় দেখার কথা ছিল, সেখানে পৌঁছানোর আগেই সূর্য উদয় হলো। তবু আমরা মুগ্ধ চোখে দেখলাম। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সূর্য তার সোনালি আলো ছড়িয়ে দিল খানিকটা। দ্বিতীয় দিনে আমরা দেখলাম গঙ্গামতির চর, লাল কাঁকড়ার চর, রাখাইন পল্লী, রাখাইন মার্কেট, বৌদ্ধমন্দির, ২০০ বছরের পুরোনো নৌকা, বিখ্যাত কুয়া ইত্যাদি। বাইকে চড়ে সমুদ্র আর গ্রামাঞ্চল ছুঁয়ে এসব জায়গা দেখতে বেশ ভালোই লাগছিল।

দুপুরে হোটেলে ফিরে এলাম। হোটেলে আসার আগে হোটেলের পাশেই আরেকটা বৌদ্ধমন্দির দেখে নিলাম। দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই বিশ্রাম নিলাম। এবার ফেরার পালা। ফেরার সময় আমরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেলাম। এক দল রাতের বাসে ঢাকা ফিরবে। আর আমরা কয়েকজন বরিশাল থেকে লঞ্চে উঠে ফিরব। দুপুরের পরই আমরা বরিশালে যাওয়ার জন্য বাসে করে রওনা হলাম। প্রায় ৪ ঘণ্টা লাগল পৌঁছাতে। বরিশাল পৌঁছে বাঁধল বিপত্তি। লঞ্চে একটা কেবিনও ফাঁকা নেই। সেই লঞ্চ মালিকরা আমাদের পরিচিত ছিল। অনেক চেষ্টার পরে কোনো একভাবে একটা কেবিনের ব্যবস্থা করে দিলেন তারা। ফেরার সময়ও সবাই ছাদে বসে জ্যোৎস্না দেখতে দেখতে ফিরেছি। কেউ কেউ কিছুটা সময়ের জন্য কেবিনে গিয়ে বিশ্রাম নিয়েছে।
ভোরবেলা সদরঘাটে এসে নামলাম। পেছনে ফেলে এলাম কিংবা হয়তো সঙ্গে করেই নিয়ে এলাম সমুদ্রজল ছুঁয়ে গল্প বোনা দিনের স্মৃতি।

কীভাবে যাবেন
বাসে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে কুয়াকাটা যেতে সময় লাগবে ৬-৭ ঘণ্টা। সায়েদাবাদ, আব্দুল্লাহপুর, আরামবাগ অথবা গাবতলী থেকে শ্যামলী, গ্রীন লাইফ, হানিফ এবং আরও কিছু বাস এই রুটে চলাচল করে। ভাড়া ৯০০-১৬০০ টাকা।

নদীপথে যেতে চাইলে সদরঘাট থেকে বরিশাল বা পটুয়াখালীগামী লঞ্চে উঠতে হবে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় লঞ্চ ছেড়ে যায়। ভোর বা সকালে পৌঁছায়। পটুয়াখালী বা বরিশাল নেমে বাসে করে যেতে হবে কুয়াকাটা। ডেকের ভাড়া ৪০০-৫০০ টাকা, কেবিন ভাড়া ১০০০-৭০০০ টাকা। তবে ভাড়া পরিবর্তনশীল।

কুয়াকাটা গিয়ে যে বাইকে করে দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখবেন, সেই বাইক সবগুলো স্থান ঘুরে দেখাতে ১০০০-১৫০০ টাকা পর্যন্ত নেবে।

কোথায় থাকবেন
কুয়াকাটায় প্রতি বছর অনেক পর্যটকই ঘুরতে যান। তাই সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে বাজেট হোটেল রয়েছে। সমুদ্র থেকে কাছেই হোটেল পেয়ে যাবেন।

সতর্কতা
সাঁতার না জানলে সমুদ্রে গোসল না করাই ভালো। বিশেষ করে জোয়ারের সময় সতর্ক থাকতে হবে। সমুদ্র কিংবা অন্য কোনো স্থানে আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন।

কলি

ঈশ্বরের নিজের বাগানে একদিন

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৩৭ পিএম
আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৩৯ পিএম
ঈশ্বরের নিজের বাগানে একদিন
রুট ব্রিজ

অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার ‘ঈশ্বরের নিজের বাগান’ বলে খ্যাত মওলিননং গ্রামটি দেখার জন্য আমি আর আমার মা রওনা দিয়েছি। আজ আমাদের মেঘালয় (শিলং) ভ্রমণের তৃতীয় দিন। আমাদের সঙ্গী আমাদের চার চাকার মহাজন বাপ্পিদা। উত্তর-পূর্ব ভারতে ‘সেভেন সিস্টারস স্টেটস’ বলে খ্যাত সাতটি রাজ্যের মধ্যে একটি মেঘালয় রাজ্য। এই রাজ্যের পূর্ব খাসি পাহাড়ের কোলে অবস্থিত ছোট্ট একটি গ্রাম মওলিননং। চলতি পথে বাপ্পিদা জানালেন, এই উপজাতি অধ্যুষিত ছোট্ট গ্রামটিই ‘এশিয়ার পরিচ্ছন্নতম গ্রাম’-এর  মর্যাদা পেয়েছে ২০০৩ সালে। ‘ডিসকভার ইন্ডিয়া ম্যাগাজিন’-এর সদস্যদের বিশেষ পর্যবেক্ষণের পর এই সম্মান পেয়েছিল গ্রামটি। তারপর ‘ভারতের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম’-এর মর্যাদা পেয়েছে ২০০৫ সালে।

প্রকৃত অর্থেই নির্মল গ্রাম। নিঃশ্বাসে বিষ ঢোকে না। নেই কোনো কোলাহল। প্রকাশ্যে মানুষ বা জন্তুর বর্জ্য পড়ে থাকে না। মানুষ স্বাস্থ্যসচেতন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় সরকারি কর্মচারীরা চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখেন গ্রামটির ওপর। ইউরোপীয় অ্যাংলিকান চার্চের মিশনারিরাই ‘মওলিননং’ গ্রামে প্রথম শ্বেতাঙ্গ আগন্তুক। তারা যিশুর বাণী প্রচারের জন্য ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো উত্তর-পূর্ব ভারতের নানা রাজ্যেও ঘুরছিলেন। মেঘালয়ের নানা জায়গা ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসেছিলেন ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে।

একদিকে ধূসর পাহাড়শ্রেণির গা থেকে শুরু করে চারদিকে সবুজের সমারোহের মাঝখানে অবস্থিত গ্রামটি। পরিচ্ছন্নতা এখানকার গ্রামবাসীর ঐতিহ্য। ভারত-বাংলাদেশ সীমানার ধারঘেঁষে পাহাড়ের কোলে অবস্থিত গ্রামটি শিলং থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে। আমরা চলছি এক স্নিগ্ধ সকালে প্রকৃতির হাওয়ার তালে। পথিমধ্যে বৃষ্টি আমাদের বরণ করে নিল। পথেই দেখা মিলল গোছা গোছা ফুলঝাড়ু পিঠে নিয়ে হেঁটে চলেছেন খাসিয়া রমণীরা৷ কোথাও এক টুকরো কাগজও পড়ে থাকতে দেখা যাবে না ৷ আর রাস্তায় এক টুকরো কাগজ পড়ে থাকতে দেখলেই তা শঙ্কু আকৃতির ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছেন৷ গ্রামকে কোনোভাবেই অপরিচ্ছন্ন হতে দেন না এই খাসিয়া উপজাতিরা৷ গ্রামের চারদিকে সবুজের সমারোহ। কালচে সবুজ, টিয়া সবুজ, পান্না  সবুজ, নানারকম সবুজ গাছপালায় সাজানো ছবির মতো একটি গ্রাম। কালো পিচঢালা রাস্তার একপাশে গাড়ি পার্কিং করার জায়গা।

রাস্তাঘাট ঝকঝকে। কোথাও পানের পিক, থুতু, ছেঁড়া কাগজের টুকরো বা পলিথিনের আবর্জনার কোনো অস্তিত্ব নেই রাস্তায় বা গ্রামের ত্রিসীমায়। রাস্তায় কোনো আবর্জনা পড়লে, গাছের পাতা ঝরে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তুলে ফেলে দেয় গ্রামের বাচ্চা-বুড়ো যেকোনো মানুষ। রাস্তার মাঝে মাঝেই রয়েছে ময়লা ফেলার পাত্র। সবই জৈব পদার্থে তৈরি। কাঠ বা বাঁশের তিনটি খুঁটির ওপর রাখা আছে বাঁশের  চাঁচাড়ি থেকে তৈরি ত্রিকোণা ডাস্টবিন। সেখানেই ফেলে দেয় রাস্তার আবর্জনা। এসব ডাস্টবিন থেকে জৈব আবর্জনাগুলো  সংগ্রহ করে সেগুলো দিয়ে গ্রামবাসী জৈবসার তৈরি করে ব্যবহার করেন চাষের খেতে।

ঢালু জমির পূর্বদিকে ক্রমশ উঁচু হয়ে চলা পাথুরে এলাকাজুড়ে গ্রামের বাড়িঘর। গ্রামে ঢোকার মুখেই একটি বাগান, বেড়া দিয়ে ঘেরা। তাতে আছে নানা জাতের গাছ। গোলকধাঁধার মতো রাস্তা চলে গেছে নানা দিকে। একটি রাস্তা ধরে চলতে থাকলে দুপাশেই দেখা যাবে বাড়িঘর। ঢালু রাস্তা ক্রমশ উঁচু হতে হতে ঢুকে গেছে গ্রামের ভেতরে। নানা দিকে রাস্তা গেছে। আর দুই ধারে বাড়িঘর। বাগান আছে প্রতি বাড়িতে। গ্রামের বাড়িঘর বাঁশ ও টিনের তৈরি। চেরা বাঁশের পাটাতনে ঘরের মেঝে। সেও বাসিন্দারা মুছে পরিষ্কার করে রাখেন। প্রতিটি বাড়িতেই আছে বিরাট বিরাট পাথরের চ্যাপ্টা চাঁই। প্রায় প্রতিটি চাঁইতেই আছে তিনটি করে ছোট্ট গর্ত, কোনোটিতে আবার দুটো গর্ত। যে গর্তগুলো একটু বড়ো, সেগুলোতে জল ধরা আছে। এখনো হয়তো এগুলো হাত ধোয়ার জলের জন্য এরা ব্যবহার করে।

গর্তগুলো দেখে প্রথমে মনে হয়েছিল- আদিমকালে যে মানুষেরা এখানে বসবাস করত, হয়তো ঘসে ঘসে এই গর্তগুলো তৈরি করেছিল নিজেদের প্রয়োজনে। পরে শুনেছি এগুলো আগ্নেয়গিরি থেকে উৎক্ষিপ্ত বিশাল বিশাল পাথরের গর্ত। হয়তো একের পর এক বিস্ফোরিত আগ্নেয় পদার্থের আঘাতেই এই গর্তগুলো তৈরি। কিন্তু প্রতি গর্তে দুটি বা তিনটি প্রায় সমান আকারের গর্ত মনে প্রশ্ন রেখেই যায়, এগুলো মানুষের তৈরি বলে মনে হয়।  গ্রামের ভেতরের দিকে জমি ক্রমশ উঁচু হয়ে গেছে। বিরাট বিরাট পাথরের নানা আকারের চাঁইয়ের সঙ্গে আছে এক বিরাট ‘ব্যালান্সিং রক’। একটি বিরাট পাথরের ওপর আর একটি বিরাট পাথর আশ্চর্যভাবে ভারসাম্য বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে, কোন অজানা কাল থেকে কেউ জানে না। তবে এখন সেটির নিচে ঠেকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

গ্রামের মধ্যে কোনো গাড়ি চলে না। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা নির্বিঘ্নে রাস্তায় খেলা করছে। আমরা গ্রামের ভেতর দিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ করে চোখে পড়ল গ্রামের মাঝে এক জায়গায় আর একটি নতুন স্কুলবাড়ি তৈরি হচ্ছে, জানালা-দরজা এখনো তৈরি হয়নি। সেখানেই ক্লাস চলছে। বাপ্পিদা বললেন, এখানে শিক্ষিতের হার বুঝি ১০০ শতাংশ। আমিও কথা বলে দেখলাম, সবাই ইংরেজিতে কথা বলছে পর্যটকদের সঙ্গে। বর্তমানে এই গ্রামে ৯৫টি পরিবার মিলিয়ে প্রায় ৫০০ জন মানুষের বসবাস। চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে উপলব্ধি করলাম, এখানে শব্দদূষণও নেই। সবাই মৃদুভাষী। শুধু আছে পাখির কাকলি, বাতাসে গাছের পাতার দোলন আর শুকনো পাতা ঝরার শব্দ। আমরা বাংলাদেশের ল্যান্ডস্কেপ দেখার জন্য স্কাই ভিউ পয়েন্টের বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে গাছের ডাল আর গাছের গুঁড়ির তৈরি দোতলা বা তিনতলার মাচানে গেলাম৷ মওলিননং-এ গেলে তার ঠিক পাশের গ্রাম নাহোয়েট-এর প্রধান আকর্ষণ লিভিং রুট ব্রিজ না দেখে ফেরা মানে নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছু না৷ বলা ভালো, এর জন্যই আমাদের সবাই মওলিননং-এ পাড়ি দেয় ৷

আমি আর মা লিভিং রুট ব্রিজ দেখার জন্য নিচে নামা শুরু করলাম। একদিকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে; সেই সঙ্গে পাহাড়ি নদীর স্রোতের আওয়াজ কানে ভেসে আসছে। বৃষ্টির ফলে রাস্তা একটু পিচ্ছিল। অনেকে আবার হাতে লাঠি নিয়েছে হাঁটার সুবিধার জন্য। আমরা এসে পৌঁছালাম লিভিং রুট ব্রিজে। বিশাল আকারের কয়েকটা গাছের শিকড় আর ডালপালা মিলেমিশে এক অদ্ভুত বুনট তৈরি হয়েছে, যার নাম জীবন্ত সেতু৷ প্রকৃতির লীলাখেলা একেই বলে! সেতুর ওপরে-নিচে ছড়িয়ে আছে ছোট-বড় মাপের পাথর৷ চারদিকে সবুজ ঘন জঙ্গল৷ নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে পাহাড়ি খরস্রোতা থাইলং নদী।

প্রসঙ্গত, মেঘালয়ের প্রাচীন খাসি উপজাতির মানুষদের চোখে প্রথম পড়ে ফাইকাস ইলেকটাস নামে এক প্রজাতির রবার গাছ ৷ খাসি এবং জয়ন্তিয়া পাহাড়ের দক্ষিণের বনজঙ্গলে জন্মানো এই গাছের মূল শিকড় মাটির নিচে থাকলেও পরে শিকড়গুলো আড়াআড়িভাবে মাটির ওপর বেড়ে ওঠে৷ আর এই শিকড়েই রয়েছে জীবন্ত সেতুর প্রযুক্তির ইতিহাস৷ এখানকার মানুষ সুপারি গাছের কাণ্ড ফাঁপা করে কেটে দেন৷ তার ভেতর জীবন্ত রবার কাছের শিকড় ঢোকানো হয়৷ এরপর তারা নিজের ছন্দে বেড়ে চলে৷ শিকড় নদী পেরিয়ে গেলে ফাঁপা সুপারি গাছ কেটে ফেলা হয়৷ রবারের শিকড় সহজেই মাটিতে ঢুকে যায়৷ সেতুর ভিতও শক্ত হয়৷ এমন একখানা প্রাকৃতিক ঝুলন্ত সেতু তৈরি হতে সময় নেয় প্রায় ১৫ বছর৷ দৈর্ঘ্য ৫০ মিটারের বেশিও হয় অনেক সময়৷ একসঙ্গে ৫০-৬০ জন চলতে পারে এই সেতুপথে৷ প্রকৃতি আর স্থানীয় মানুষের কারিকুরিতে জীবন্ত সেতু অন্যতম দর্শনীয় স্থান মওলিননংয়ের।

আমরা ফিরে চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যে। ফিরতি পথে চোখে পড়ল প্রতি বাড়িতেই বৃষ্টির জল ধরে রাখার (রেন হার্ভেস্টিং) ব্যবস্থা আছে। পরিচ্ছন্নতা রক্ষার আদর্শের সঙ্গে এরা জল সংরক্ষণ বিষয়েও সচেতন। বাপ্পিদা বললেন, এখানকার ‘খুরি’ নদীর জলসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের ক্রমোন্নতি হলে গ্রামে জল সরবরাহের সুবিধা হবে। বিদ্যুতের ব্যাপারেও গ্রামের মানুষ স্বনির্ভর থাকার চেষ্টা করছেন। এরা প্রধানত সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। প্রতিটি বাড়িতেই আলাদা আলাদা সোলার প্যানেল বসানো আছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। সরকারি সংস্থা আরডি এনার্জি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহায়তা নিয়েই এই ব্যবস্থা হয়েছে।
      
জেনে রাখা ভালো
মওলিননং বেড়ানোর সময় মে থেকে নভেম্বর মাস। মেঘালয়ে সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষা খাসিয়া। পরদেশিদের সঙ্গে অবশ্য হিন্দি-ইংরেজি মেশানো এক মিশ্র ভাষায় কথা বলে স্থানীয়রা। তামাবিল সীমান্তে ভ্রমণ কর দেওয়ার মতো ব্যাংক নেই। এ জন্য বেশ খানিকটা দূরে যেতে হতে পারে। তাই ঢাকা থেকেই ভ্রমণ কর পরিশোধ করে যাওয়া ভালো। এ ছাড়া সীমান্ত পার হওয়ার পর মুদ্রা বিনিময়ের সুযোগও খুব সীমিত। তাই প্রাথমিক ঘোরাফেরার জন্য যতদূর সম্ভব সীমান্ত এলাকায়ই বেশকিছু ডলার ভাঙিয়ে নিন। তবে শিলং শহরে পুলিশ বাজারে গোল্ডের অ্যারো ট্রাভেলসে ডলার ভাঙাতে পারবেন।

কিভাবে যাবেন
প্রথমত আপনাকে ইন্ডিয়ার ভিসা করতে হবে। রুট দিতে হবে ডাউকি বর্ডার আর আপনি চাইলে একদিনেই গিয়ে ঘুরে আসতে পাড়বেন। সময় কম থাকলে সেক্ষেত্রে আপনাকে সিলেটে এসে পৌঁছাতে হবে সকালে। এর পর সরাসরি সিএনজি অথবা মাইক্রোবাস করে তামাবিল বর্ডার। ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে সেখান থেকে জিপ অথবা ট্যাক্সি করে সোজা মওলিননং যাওয়া যাবে। ভাড়া দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার রুপি। তবে মওলিননং-এ থাকার কোনো হোটেল নাই। তাই থাকতে হলে শিলং শহরে গিয়ে থাকতে হবে।

ছবি :লেখক

 কলি

পাখির বিলে মেছো বিড়াল

প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৪৩ পিএম
পাখির বিলে মেছো বিড়াল

বাইক্কা বিল জলাভূমি অভয়াশ্রমে আসি বিকেলের দিকে। বিলের প্রবেশমুখে মনি লালের ঘরে ব্যাগ রাখি; তিনি বিলের পাশের মাছ চাষ প্রকল্পের কেয়ারটেকার। এরপর প্রবেশ করি বিলে। বিলের প্রবেশপথেই আছে এ অভয়াশ্রমের পরিচিতিমূলক বর্ণনা; যেন দর্শনার্থীরা বিলের উদ্ভিদ ও প্রাণিজগৎ সম্পর্কে একটা ধারণা পেতে পারেন। এ ছাড়া বিলে প্রবেশ করেই দেখা মেলে কিছু নির্দেশনার সাইনবোর্ড। যেমন- বিলের পর্যবেক্ষণ টাওয়ারগুলোর অবস্থান, হাঁটার পথ, নৌকা ভ্রমণ, শব্দ না করা, বর্জ্য না ফেলা ইত্যাদি।

আমরা বিলের কিনার দিয়ে মাটির পথ ধরে হাঁটি। মূলত বিলের কিনারে হিজল, করচ, বরুন, ঢোল কলমি, গুল্মসহ নানা উদ্ভিদ বা গাছগাছালি আছে। বর্ষা মৌসুমে এসব উদ্ভিদ বা গাছগাছালির অধিকাংশসহ পুরো বিল পানিতে ডুবে থাকে। এরপর শীত মৌসুমে বিলের মাঝে কিছু পানি থাকে এবং বিলের কিনার থাকে শুকনো। আর এ কিনারেই রয়েছে বিভিন্ন গাছগাছালি, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ও দর্শনার্থীদের জন্য হেঁটে ঘুরে দেখার প্রাকৃতিক পথ বা মাটির পথ। আমরা এ প্রাকৃতিক পথ ধরেই হাঁটি। কিছুক্ষণ হাঁটার পর আসি পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে। টাওয়ারে উঠে দূরবিন দিয়ে পাখি দেখি। বিলের মাঝে নানা প্রজাতির পাখির ওড়াওড়ি দেখে ভালো লাগছে।

পাখি পর্যবেক্ষণের জন্য বিলে দুটি টাওয়ার আছে। একটি বিলের প্রবেশমুখ থেকে এক কিলোমিটার দূরে, অন্যটি বিলের প্রবেশমুখ থেকে ১০০ মিটার দূরে। আমরা আছি প্রবেশ মুখ থেকে এক কিলোমিটার দূরেরটিতে। বিলের মাঝে একাধিক উঁচু খুঁটি বা চৌকি বসানো আছে। মূলত এসব খুঁটি ঈগলের বিশ্রাম ও বাসা তৈরির জন্য করা হয়েছে।

বিলের মাঝে চমৎকার সূর্যাস্ত দেখে টাওয়ার থেকে নামি। ফেরার পথে চমক হিসেবে দেখি একটি মেছো বিড়াল। অবশ্য বেশিক্ষণ দেখার সুযোগ হয়নি। আসলে এ বিলের ঝোপঝাড়ে মেছো বিড়ালের বসবাস আছে। বিপন্নের তালিকায় থাকা এ বুনো বিড়ালের ইংরেজি নাম- ফিশিং ক্যাট। নিশাচর এ প্রাণীর অন্যতম খাবার মাছ। সেজন্য হাওরের জলাশয় বেষ্টিত এলাকায় ঝোপঝাড়ে বা প্রাকৃতিক মৎস্যকেন্দ্রের কাছে এর বেশি বসবাস। তবে এখন খুবই কম দেখা যায়। এর অন্যতম কারণ, বিড়ালটিকে আমরা ভুল করে মেছো বাঘ ভেবে ‘বাঘ’ প্রজাতির হিংস্র প্রাণী মনে করে মেরে ফেলি। এ ছাড়া হাওরাঞ্চলের প্রাকৃতিক জলাভূমি ও ঝোপঝাড় পরিষ্কার বা বিল ভরাট করে কৃত্রিম মাছের খামার বা অন্য চাষাবাদ বা বসবাস করার ফলেও বিড়ালটি তার খাদ্য ও আবাসস্থল হারাচ্ছে। আবার এরা খাদ্যের খোঁজে লোকালয়ে চলে এলেও মানুষের হাতে মারা পড়ে। সব মিলিয়ে বিড়ালটি হারিয়ে যাচ্ছে।

মাছ এ বিড়ালের প্রধান খাবার হলেও শামুক, ঝিনুক বা ছোট স্তন্যপ্রাণীও খায়। একটু নীরব ও রাগী প্রকৃতির এ বিড়াল ভালো সাঁতার জানে। মোটাসোটা এ বিড়ালের পা খাটো। মাথা দীর্ঘ ও লেজ ছোট। শরীর গাঢ় ধূসর দাগ ও ডোরার সমন্বয়ে সজ্জিত। লোম মোটা এবং স্পষ্ট কালো দাগসহ হালকা বাদামি ধূসর। মার্চ থেকে জুন এদের প্রজননকাল। বিপন্ন এ বিড়ালকে বাঁচাতে এ বিলে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে গবেষণা চলছে। শুধু মেছো বিড়াল নয়, এ বিলের পাখি, মাছ বা অন্য জলজ উদ্ভিদ বা প্রাণী নিয়েও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে একাধিক গবেষণা কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

মূলত, হাইল হাওর বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি জলাভূমি। বর্ষার সময় এ হাওরের জলায়তন প্রায় ১৪ হাজার হেক্টরজুড়ে বিস্তৃত হয়। শুষ্ক মৌসুমে এসে দাঁড়ায় ৪ হাজার হেক্টরের কম। এ হাইল হাওরের মাছ, পাখি, জলজ উদ্ভিদ বা অন্যান্য প্রাণী সংরক্ষণ ও প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যেই ভূমি মন্ত্রণালয় ২০০৩ সালে বাইক্কা বিলকে স্থায়ী অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করে। এ অভয়াশ্রম চামরা, মাগুরা, জাদুরিয়া বিল ও এর আশপাশের জলাভূমির সমন্বয়ে গঠিত, যা একত্রে ‘বাইক্কা বিল’ নামে পরিচিত। বিলটির আয়তন প্রায় ১৭০ হেক্টর। এ বিল নানা প্রজাতির মাছ, পাখি, জলজ উদ্ভিদ, মেছো বিড়াল, বন বিড়াল, শেয়াল, বেজিসহ বিভিন্ন প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল।

বিলটির মাঝে সারা বছরই পানি থাকে। আর এ জলাবিল চিতল, রাম টেংরা, শোল বা চ্যানা, শাল বাইম, তেলচিটা পাথরচাটা, কাকিলা, বর্মী পুইয়া বা গুতুম, টাকি, করিকা পুইয়া, বটিয়া পুইয়া, আনন পুইয়া, চ্যাং, শিং, কৈ, পাঙাশ, গুচি বাইম, হলদে ডোরা তারা বাইম, বোয়াল, মহাশোল, রানীমাছ, টেরি পুঁটি, নারকেলি চেলা, জেব্রা, মোরারি, এলাং, ঘনিয়া, ঢেলা, দারকিনা, আইড়, মেনি, ফলি, পাবদাসহ ৯৮ প্রজাতির মাছের নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র বা ‘মাতৃ মৎস্যভাণ্ডার’। এসব মাছ এখানে বংশবৃদ্ধি করে, যা পুরো হাওরে ছড়িয়ে পড়ে।

বিলটির অন্যতম আকর্ষণ নানা প্রজাতির পাখি। বিশেষ করে এ বিল ১৭০ প্রজাতির জলচর পাখির নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে বিবেচিত। ফলে বিলটি আন্তর্জাতিকভাবেও বিশেষ পরিচিত। এজন্য এ বিলের পাখি নিয়ে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান-সংগঠন নিয়মিত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব (বিবিসি) প্রতি শীতে পাখিশুমারি, পাখির পায়ে রিং পরানোসহ নানা কার্যক্রম করে থাকে। এ ছাড়া গবেষণার অংশ হিসেবে বিলের যাদুরিয়া প্রান্তে পাখির জন্য ৩০টি কৃত্রিম বাসা তৈরি করা হয়েছে। এসব বাসায় অনেক পাখি বাসা তৈরি করে বসবাস করছে।

দেশি-বিদেশি সংস্থার সহযোগিতায় বর্তমানে অভয়াশ্রমটি সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে বড়গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থপনা সংগঠন। আর সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের লক্ষ্যে বিলটিতে প্রবেশের জন্য প্রতিজন দর্শনার্থীর কাছ থেকে পাঁচ টাকা ফি নেওয়া হয়। পাশাপাশি দর্শনার্থীদের জন্য বিলটিতে দুটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণসহ বিভিন্ন সুবিধা প্রদানেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। মূলত শীতের সময় পাখি দেখার জন্যই দর্শনার্থীরা এখানে বেশি আসেন।

বিলের জলাভূমিতে দর্শনার্থীদের জন্য নৌকা ভ্রমণেরও ব্যবস্থা আছে। নৌকা ভাড়া নেওয়া যাবে ঘণ্টা হিসাবে। এ ছাড়া পদ্মফুলের জন্য এ জলাভূমি বেশ পরিচিত। নৌকায় ঘুরলে এসব ফুল দেখা যাবে খুব কাছ থেকে। কেবল পদ্মফুল নয়, শাপলা, হিজল-করচ, ফোকল, সিংড়া, পানিকলা, ওকল, ঢোল কলমী, কচুরিপানাসহ নানা জলজ উদ্ভিদে ভরপুর এ বিল।

সন্ধ্যার পর বিলের প্রবেশ মুখের মাছচাষ প্রকল্পের পাশে তাঁবু ফেলি। একটাতে সফিক ভাই, অন্যটিতে আমি আর ফেরদৌস ভাই। রাতের খাবার খাই মনি লালের ঘরে। শীতের রাতে বিলের মাঝে তাঁবুতে ঘুমানোর অভিজ্ঞতা দারুণ। অবশ্য এর আগেও উপকূলের চরে বা হাওরের বিলে তাঁবুতে ঘুমিয়েছি। এ ছাড়া দেশের বাইরে ভুটানেও পাখি দেখতে গিয়ে বনের মাঝে তাঁবুতে ঘুমানোর অভিজ্ঞতা আছে।

পরের দিন খুব সকালে আবার প্রবেশ করি বিলে। মাটির পথ ধরে ঝোপঝাড়-গাছগাছালি পেরিয়ে আসি এক কিলোমিটার দূরের পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে নানা প্রজাতির পাখি দেখে টাওয়ার থেকে নামি। এরপর বিলের একেবারে কিনার ধরে হাঁটি। সকাল হওয়াতে কোনো দর্শনার্থী নেই। বিলের কিনারে হেঁটে হেঁটে আরও কাছ থেকে আরও কিছু পাখি দেখি। সেই সঙ্গে দেখি শাপলা, পদ্ম, কচুরিপানাসহ বিভিন্ন বুনোফুল এবং প্রচুর ফড়িংয়ের ওড়াওড়ি। হেঁটে আসি বিলের অন্য টাওয়ারের কাছে। তবে টাওয়ারে উঠিনি। অবশ্য এর আগে এ বিলে যখন পাখি দেখতে আসি তখন এ টাওয়ারে উঠেছি। ২০০৬ সালে নির্মাণ করা এ টাওয়ারে ওঠার জন্য দর্শনার্থী ফি প্রতিজন ২০ টাকা। চারতলা সমান এ টাওয়ারের তৃতীয় ও চতুর্থ তলার গ্যালারিতে সাজানো আছে বাইক্কাবিলে বসবাস করা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, জলজ উদ্ভিদ ও পাখির ছবিসহ বর্ণনা। দর্শনার্থীদের বিল সম্পর্কে ধারণা দিতেই এ ব্যবস্থা।

দুদিনে এ বিলে যেসব পাখি দেখি, এর মধ্যে আছে বাচাল নলফুটকি, বেগুনি কালেম, নেউ পিপি, পাতি পানমুরগি, গয়ার, বড় পানকৌড়ি, ছোট পানকৌড়ি, খুদে বক, ধুপনি বক, লালচে বক, চিনা কানিবক, ছোট বগা, বড় বগা, গো বগা, ছোট ডুবুরি, এশীয় শামখোল, পাতি শরালি, উত্তরে খুন্তেহাঁস, পাতি তিলিহাঁস, পিয়াং হাঁস, গিরিয়া হাঁস, ধলা বালিহাঁস, মরচে রং ভুতিহাঁস, পাতি কুট, কালামাথা কাস্তেচরা, খয়রা কাস্তেচরা, মেটেমাথা টিটি, বন বাটান, বাংলা রাঙাচ্যাগা, শঙ্খ চিল, ভুবন চিল, পাকরা কাপাসি, ইউরেশীয় কণ্ঠীঘুঘু, তিলা ঘুঘু, পাতি চোখগ্যালো, করুণ পাপিয়া, বাংলা কুবো, পাতি-আবাবিল, পাতি হুদহুদ, পাতি মাছরাঙা, ধলাগলা মাছরাঙা, মাছমুরাল, বাতাবি কাঠকুড়ালি, বাংলা কাঠঠোকরা, কালামাথা বেনেবউ, কালা ফিঙে, ল্যাঞ্জা লাটোরা, খয়রা লাটোরা, পাকরা শালিক, খয়রালেজ কাঠশালিক, ভাত শালিক, ঝুঁটি শালিক, দাঁড় কাক, বাংলা বুলবুল, বন ছাতারে, উদয়ী দোয়েল, পাতি টুনটুনি, দাগি ঘাসপাখি, তাইগা চুটকি, ধানি ফুটকি, মোটাঠোঁট ফুটকি, ব্লাইদের নলফুটকি, কালচৈ ফুটকি, ধানি তুলিকা।

১০টায় বিল থেকে বের হই। নাশতা করি মনি লালের ঘরে। এরপর তাঁবু গুছিয়ে রওনা হই মাধবকুণ্ডের উদ্দেশে। পথে মাথিউরা চা বাগানের মাঝে খাই রং চা। চা বাগানের মাঝে চা খাওয়ার স্বাদ সত্যিই অন্যরকম।

নোট: ঢাকা থেকে বাসে অথবা ট্রেন পারাবত, জয়ন্তিকা বা উপবন এক্সপ্রেসে শ্রীমঙ্গল। এরপর সিএনজিতে বাইক্কা বিল আসা যাবে। এ বিলের অন্যতম আকর্ষণ নানা প্রজাতির জলচর পাখি, যা শীতের সময় বেশি দেখা যায়।

ছবি :লেখক

কলি 

হেঁটে হেঁটে হামহাম

প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২৪, ০৬:০০ পিএম
হেঁটে হেঁটে হামহাম

মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার একটি রেস্টুরেন্টে সকালের নাশতা সেরে যাত্রা করি হামহাম ঝরনার উদ্দেশে। ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল ছয়টা পেরিয়ে গেছে। সঙ্গী অনুজ বন্ধু সাজেদ, গুলজার, মাসুম, মাহবুব ও জামিল। এর মধ্যে সাজেদ আমার পরিচিত। বাকিরা সাজেদের বন্ধু। আমি এসেছি ঢাকা থেকে। বাকিরা যুক্ত হন বড়লেখা থেকে। আমরা একটা প্রাইভেট কারে রওনা হই। কারটি গুলজারের। চালকও সে।

প্রথমে আসি কমলগঞ্জ উপজেলা সদরে। এখান থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার দূরে হামহামের অবস্থান। কমলগঞ্জ থেকে আদমপুর বাজার হয়ে আমরা এগিয়ে চলি হামহামের দিকে। দুই পাশে সারি সারি চা-বাগান আর আঁকাবাঁকা মেঠো পথ পাড়ি দিয়ে আসি চাম্পারায় চা-বাগানে। এ পর্যন্ত পথটুকু ভালোই ছিল। গাড়িও চলছিল ঠিকঠাক। কিন্তু এরপর শুরু হয় মাটির পথ। গাড়ি চলার উপযুক্ত নয়। গুলজার ধীরে ধীরে গাড়ি চালায়। এভাবে কুরমা বন বিটের কুরমা চা-বাগান পাড়ি দিয়ে আসি কলাবন পাড়া। এ এলাকাটি রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অংশ। কলাবন পাড়ায় আদিবাসী ও চা শ্রমিকদের বসবাস রয়েছে।

কলাবন আসার সঙ্গে সঙ্গে আদিবাসী কয়েকজন তরুণ-যুবক আমাদের ঘিরে ধরেন। মূলত তারা হামহাম ঝরনা দেখানোর গাইড। আমরা বিকাশ নামের এক যুবককে গাইড হিসেবে সঙ্গে নিই। সঙ্গে আরও আছে টমি নামের একটি কুকুর। কুকুরটি বিকাশের পরিচিত। স্থানীয় কিশোরদের কাছ থেকে আমরা একটা করে বাঁশের চলা কিনে নিই হাতের লাঠি হিসেবে। এরপর সবাই হাফপ্যান্ট, টি-শার্ট পরে রওনা হই ঝরনার উদ্দেশে।

 

সঙ্গে পানির বোতল ও স্যালাইন নিই। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে হাঁটি নির্জন পাহাড়ি বনের ভেতর দিয়ে। পাহাড়ের চারপাশেই ঘন গাছগাছালি। এরই মাঝে হাঁটি। কখনো নিচু থেকে ওপরে উঠি, আবার কখনো ওপর থেকে নিচে নামি। আবার কখনোবা পাড়ি দিই ছোট্ট ছড়া। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হই, বিশ্রাম নিই, এরপর আবার হাঁটি। অবশ্য উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে দলের সবারই কষ্ট হচ্ছে। কেউ কেউ তো কষ্টের ভয়ে ফিরে যেতেও চাইছে। এভাবে দেড় ঘণ্টায় প্রায় ছয় থেকে সাত কিলোমিটার পথ হেঁটে অবশেষে পৌঁছি ঝরনার ছড়ায় বা ঝিরিতে। এ ছড়া দিয়ে হামহাম ঝরনারই পানি প্রবাহিত হয়ে চলছে। ছড়ায় এসে সাজেদ আর মাসুম শুয়ে পড়ল ক্লান্তিতে। আমরাও যোগ দিই তাদের সঙ্গে। আরামের জন্য শরীরটা একটু ভিজিয়ে নিই ছড়ার পানিতে। বেশ আরামই লাগছে। ছড়ার পানি আসলেই বেশ শীতল। এখানে একটু বিশ্রাম শেষে ছড়া ধরে আবার রওনা হই ঝরনার উদ্দেশে। কিছুক্ষণ হাঁটার পরই দেখি হামহাম। সত্যিই দারুণ বুনো পাহাড়ের এ ঝরনা বা জলপ্রপাত।

ঝরনাটির উচ্চতা প্রায় ১৪০ ফুট। কেউ কেউ আরও বেশিও বলেন। ২০১০ সালের দিকে এটি আবিষ্কার করেন বাংলাদেশের একদল অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পর্যটক। ঝরনাটি রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতরেই অবস্থিত। স্থানীয়দের কাছে এটি ‘চিতা ঝরনা’ নামেও পরিচিত। স্থানীয়দের দাবি, একসময় এ বনে চিতাবাঘ দেখা যেত। অবশ্য বন বিভাগের রেকর্ড আছে কি না সেটা জানা নেই। মূলত বর্ষা মৌসুমেই এ ঝরনার প্রকৃত সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। সেই তুলনায় শীতের সময় পানি কম থাকে।

গরমের মধ্যে দীর্ঘ পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে আমরা বেশ ক্লান্ত। তাই দেরি না করে সবাই ঝরনার পানিতে নেমে পড়ি। সত্যিই, দারুণ শীতল। ভুলে যাই কষ্ট করে আসা পথের সব ক্লান্তি। বেশ কিছুক্ষণ ঝরনার পানিতে শরীর ভেজাই।

ঝরনার পাদদেশে একটি চায়ের দোকান হয়েছে। আমরা সবাই এ দোকানে চা-বিস্কুট খাই। ঝরনার পাদদেশেরে আশপাশের পরিবেশটা দারুণ মায়াময়। এ মায়ায় পড়ে বেশ কিছুক্ষণ শুনি ঝরনার পানি পড়ার শব্দ। এরপর রওনা হই ফেরার উদ্দেশে। গাইড বললেন, এবার অন্য পথ দিয়ে ফিরব, তাহলে পাহাড় পাড়ি দিতে হবে কম। তার কথায় অন্যপথ ধরি। এ পথে পাহাড় পাড়ি দিই কিছুটা কম, তবে পথ কম নয়। অবশ্য এ পথে রোমাঞ্চটা একটু বেশি উপভোগ্য। কারণ পথটি ঝরনারই ছড়াপথ বা ঝিরিপথ। এ পথের দুই পাশে পাহাড়, আর মাঝখানে ছড়া। নির্জন-ছমছম ভাব। বেশ উপভোগ্য। তবে ছড়াগুলোয় জোঁকের উপদ্রব অনেক। দলের প্রায় সবাইকে জোঁকে ধরেছে, ভাগ্যক্রমে আমি ছাড়া। মূলত কলাবন পাড়া থেকে হামহাম যাওয়া-আসার দুটি ট্রেইল আছে। একটি পাহাড়ি পথ, অন্যটি ঝিরি পথ। ঝিরি পথে সময় একটু বেশি লাগে, তবে পথটি বেশ সুন্দর। অবশ্য ঝিরি পথে বর্ষাকালে জোঁকের উপদ্রবও বেশি থাকে।

কলাবন হয়ে আদমপুর আসতে আসতে বেলা প্রায় শেষ। এখানকার একটি রেস্টুরেন্টে খাই দুপুরের খাবার। এরপর ধরি কুলাউড়ার পথ। মাঝে শমসেরনগর বধ্যভূমি ও সম্মুখযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভে কিছুক্ষণ দাঁড়াই। শ্রদ্ধা জানাই মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের প্রতি। এরপর আবার রওনা হই। আসি বড়লেখায় সাজেদের গ্রামের আজিমগঞ্জ বাজারে।

নোট: ঢাকা থেকে বাসে শ্রীমঙ্গল। অথবা ট্রেন পারাবত, জয়ন্তিকা বা উপবন এক্সপ্রেসে শ্রীমঙ্গল। এরপর কমলগঞ্জ, চাম্পারার চা বাগান হয়ে কলাবন। এরপর হেঁটে হামহাম।

ছবি লেখক

কলি