ঢাকা ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫
English
মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

কালিদামার খোঁজে কালাই রুটির দেশে

প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৪, ০৪:৪৪ পিএম
আপডেট: ১৭ আগস্ট ২০২৪, ০৫:২২ পিএম
কালিদামার খোঁজে কালাই রুটির দেশে

ধলাপাখ-কালিদামা পাখিটি আমাদের দেশে খুব একটা দেখা যায় না। তবে সম্প্রতি এর উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। আর তাই একে দেখার জন্য গত ফেব্রুয়ারি মাসের এক সকালে হাজির হই রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পদ্মার তীরবর্তী প্রেমতলী বনে। সঙ্গী আছেন বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্য মানিক ভাই এবং এখানকার গাইড নূর ইসলাম। প্রচুর গাছপালায় ভরা বিশাল এ বনের কোথায় পাখিটি আছে, সেটি জানেন নূর ইসলাম। তিনি এ বনে তিনি নিয়মিত পাখি দেখতে বা দেখাতে আসেন। আমরা তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে হাঁটি।

হাঁটতে হাঁটতে বনের একটা জায়গায় এসে থামি। নূর জানান, সম্প্রতি এখানেই দেখা গেছে পাখিটিকে। আমরা তাই তাকে দেখার উদ্দেশে চোখ রাখি বনের গাছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও পাখিটির দেখা নেই। এরপর আসি আরেক স্থানে। এখানেও অনেকক্ষণ অপেক্ষা। অবশেষে পাখিটির দেখা পাই কিছু সময়ের জন্য। তবে মনমতো ছবি তুলতে পারিনি। তাই আরও অপেক্ষা করি। ইতোমধ্যে আরও কয়েকজন এসেছেন এ পাখির খোঁজে। কেউ এসেছেন ঢাকা থেকে, কেউ রাজশাহী থেকে। বেশ কিছুক্ষণ পর আবার পাখিটির দেখা পাই। ছবিও তুলি মনমতো। আমরা পুরুষ পাখিটি দেখি। মেয়ে পাখিটির খোঁজ পাইনি। অবশ্য রাজশাহীর পাশাপাশি পাখিটি সম্প্রতি হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান এবং কক্সবাজারের টেকনাফে দেখা গেছে বলে জেনেছি।

ইংরেজিতে পাখিটির নাম- গ্রে উইংড ব্ল্যাকবার্ড। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ‘উদ্ভিদ ও প্রাণিকোষ’ বইয়ে এর বাংলা নাম- ধলাপাখ-কালিদামা। কালো বর্ণের এ পাখি আকারে শালিকের চেয়ে একটু বড়। পাখিটির ডানা ফিকে ধুসর। এর ঠোঁট গাঢ় কমলা। চোখ বাদামি এবং চোখের বলয় হলুদ। সাধারণত পাখিটি বনে বা বনের ধারে বিচরণ করে। ভূমিতে হেঁটে হেঁটে খাবার খুঁজে খায়। খাবারের তালিকায় আছে পোকা, কেঁচো, অমেরুদণ্ডী ছোট প্রাণী ও রসালো ফল। মার্চ থেকে আগস্ট প্রজননকাল। জমির আইলে, পতিত গাছে বা গাছের উঁচু ডালে ঘাস, শেওলা বা পাতা দিয়ে বাটির মতো বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। ৩ থেকে ৪টি ডিম দেয়। মেয়েপাখি ডিমে একা তা দেয়।

ধলাপাখ-কালিদামা ছাড়াও বাাংলাদেশে দামা প্রজাতির আরও কয়েকটি পাখি আছে। নীল-শিলাদামা, নীল-শিসদামা, কমলা-দামা, আঁশটে-দামা, কালাপাশ-দামা, খয়রাপিঠ-দামা, লম্বাঠোঁট-দামা, ধলাঘাড়-দামা, কালাবুক-দামা, পাতি-কালিদামা, কালচে-দামা, ভ্রমণ লেখা-দামা, লালগলা-দামা এবং টিকেলের-দামা। এর মধ্যে দুর্লভ আবাসিক কমলা-দামা ও বিরল পরিযায়ী নীল-শিসদামা মাঝে মাঝে দেখা যায়। তবে দুর্লভ পরিযায়ী নীল-শিলাদামা বা বিরল পরিযায়ী কালাবুক-দামা, লালগলা-দামা ও টিকেলের-দামা খুব কম দেখা যায়। এ ছাড়া অন্য দামাগুলো অনিয়মিত হওয়াতে একেবারেই কম দেখা মেলে।

ধলাপাখ-কালিদামা দেখে বনে আরও কিছুক্ষণ ঘুরে আরও কিছু পাখি দেখি। বিকেলে ফিরি শহরে। রেলওয়ে স্টেশনের হোটেলে উঠি। ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খাই এখানকার একটা রেস্টুরেন্টে। এরপর আসি এখানকার সিঅ্যান্ডবি মোড়ে গরম গরম ছানার রসগোল্লা আর পুরি খেতে। রানার মিষ্টিখ্যাত এ স্পঞ্জ রসগোল্লা প্রতিটি ২০ টাকা। পুরি প্রতিটি ১০ টাকা। গরম গরম রসগোল্লার সঙ্গে গরম গরম পুরি, দারুণ স্বাদ। দোকানে বেশ ভিড়। বোঝা গেল রাজশাহী শহরে এ মিষ্টির বেশ সুনাম রয়েছে। একদিকে মিষ্টি বিক্রি হচ্ছে, অন্যদিকে মিষ্টি বানানো হচ্ছে। মিষ্টি খেয়ে আমরা রাতের শহর ঘুরি। ইতোমধ্যে এ শহর পরিচ্ছন্ন নগর হিসেবে দেশে খ্যাতি পেয়েছে। খ্যাতি পাওয়া শহরে কিছুক্ষণ ঘুরে হোটেলে ফিরি।

পরের দিন খুব সকালে আসি পবা উপজেলার দামকুড়ার ভিমের ডাইং এলাকায়। উদ্দেশ্য ক্রেস্টেড বান্টিং দেখার জন্য। বাংলায়-ঝুঁটিয়াল-চটক। বিরল প্রজাতির এ পাখি আমাদের দেশের নতুন পাখি বলা যায়। পরিযায়ী এ পাখি এর আগে বাংলাদেশের পাখির তালিকায় ছিল না। সম্প্রতি এ পাখিটি রাজশাহী অঞ্চলের খেতখামারে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

পাখিটিকে দেখার জন্য আমরা সরিষা খেতের আইলে বসি। আমাদের চারপাশেই খেত। সরিষা, ভুট্টা, গম, আখসহ বিভিন্ন ফসলে ভরা এসব খেত। শীতের সকাল হওয়াতে খেতের ফসলের বা জমিনের আইলের ঘাসের ওপর জমে থাকা শিশিরকণা তখনো শুকায়নি। সূর্যেরও তেজ বাড়েনি। অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যে আরও ১০-১২ জন এসে হাজির হয়েছেন এ পাখি দেখার জন্য।

আমরা সবাই যেখানে বসি, এর আশপাশেই পাখিটিকে সম্প্রতি বেশি দেখা গেছে। সেজন্যই আমরা এখানে বসি। পাখিটি সরিষা খেতের ভেতরে লুকিয়ে আছে। মাঝে মধ্যে উপরে উঠে একনজর দেখা দিয়ে আবার হারিয়ে যায়। এভাবেই চলে বেশ কিছুক্ষণ। এর মধ্যে যে যতটুকু পেরেছেন ছবি তুলেছেন। মানিক ভাইও ক্লিক করেছেন বেশ। আমরা দেখি স্ত্রী পাখিটি। যদিও স্ত্রী-পুরুষ দুটোই থাকার কথা। তবে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও পুরুষটিকে দেখিনি। এখানে ছাড়াও পাখিটি সম্প্রতি শেরপুর, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া, মৌলভীবাজারের কুড়মা চা বাগান ও জামালপুরে কেউ কেউ দেখেছেন বলে জেনেছি।

চড়ুই আকারের সুদর্শন পাখিটির মাথায় ঝুঁটি রয়েছে। সেজন্য নামের আগে ঝুঁটিয়াল বসানো হয়েছে। গায়ের রং অনেকটা হালকা বাদামি। আমাদের দেশে আরও চার প্রজাতির চটক দেখা যায়। লালকান-চটক, খুদে-চটক, হলদেবুক-চটক এবং কালামুখ-চটক। এর মধ্যে কালামুখ-চটক মাঝে মধ্যে দেখা যায়। আর বাকিগুলো কমই দেখা যায়। অনেকক্ষণ ধরে পাখিটিকে পর্যবেক্ষণ করার পর আমরা আবার রওনা হই ধলাপাখ-কালিদামার উদ্দেশে।
প্রেমতলী বাজার হয়ে আমরা নদীর দিকে আগাই। এরপর খেয়াপার হই। আগের দিনও এ খেয়াপার হই। নদীর নাম পদ্মা। নদীতে পানি কম। পলি জমে ভরাট হয়েছে। তেমন কোনো খেয়াঘাট নেই। দু-একটি নৌকা পাড়ে আছে। কেউ পার হতে চাইলে মাঝি পার করে দেন। আবার যখন মাঝি থাকেন না, তখন কেউ কেউ নিজেরাই বইঠা বেয়ে পার হন। খেয়াপার হয়ে একটু হাঁটলেই বন।

আমরা বনের একটা জায়গায় এসে দাঁড়াই। কিছুক্ষণ পরই পাখিটির দেখা পাই। মানিক ভাই আয়েশ করে ছবি তোলেন। এরপর বনের আরও কিছু জায়গা ঘুরি। বের হওয়ার সময় বনের পাশের একটা খেতে দেখি দেশি-মোটাহাঁটু। ইংরেজিতে- ইন্ডিয়ান থিকনি। পাখিটি আকারে মুরগির ছানার মতো। শরীর বাদামি রঙের। ডানার প্রান্ত কালো এবং সাদাটে পেট। হলুদ চোখের চারপাশে কালচে রিং এবং রিংয়ের ওপরে ও নিচে রেখা। পা হলদে। কালচে ঠোঁটের গোড়া হলদে। বিরল প্রজাতির এ পাখি মাঝে মধ্যে দেখা যায়। এটা ছাড়াও বাংলাদেশে আরও দুটি প্রজাতির মোটাহাঁটু রয়েছে। এর মধ্যে ইউরেশীয়-মোটাহাঁটু আমাদের অনিয়মিত পাখি। আর বড়-মোটাহাঁটু বিরল আবাসিক পাখি। ফলে এগুলোও খুব কম দেখা যায়।

পাখি দেখে নদীর তীরে এসে দেখি নৌকা আছে কিন্তু মাঝি নেই। তাই নূর মাঝি হন। শহরে যাওয়ার আগে এখানকার বাজারে খাই দুপুরের খাবার। যদিও বিকেল হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় আসি শহরে। শহরে নদীর পাড়ে কিছুক্ষণ বসি। রাতে রেলওয়ে স্টেশনের পাশে ফুটপাতের দোকানে খাই কালাইরুটি। সঙ্গে পেঁয়াজ দিয়ে বেগুনভর্তা। এটা রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবার।

একসময় ফুটপাতে শীত মৌসুমে বেশি বিক্রি হলেও এখন রেস্টুরেন্টেও মেলে। এ ছাড়া শীত ছাড়া অন্য সময়ও পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, এখন এ রুটির নামে অনেক রেস্টুরেন্টও আছে এ শহরে। সাধারণত এ রুটি গরুর মাংস, হাঁসের মাংস, বেগুনভর্তা, শুঁটকিভর্তা বা ধনিয়াভর্তা দিয়ে খায়।

প্রথমে তিনভাগ  মাষকলাইয়ের গুঁড়ার সঙ্গে একভাগ চালের আটা মেশাতে হয়। এরপর পানি দিয়ে খামির বানিয়ে গোল বল তৈরি করতে হয়।  এরপর পানি দিয়ে খামির বানিয়ে গোল বল তৈরি করতে হয়।  এরপর বল দুই হাতের তালুর চাপে চাপে তৈরি হতে থাকে রুাট। এরপর মাটির খোলায় বা তাওয়াতে  এপিট ওপিঠ সেঁকে তৈরি হয় রুটি। 

প্রতি রুটি ৩০ টাকা। তবে স্পেশাল ৫০ টাকা। সঙ্গে ভর্তা ফ্রি। রুটির পর রেলওয়ে স্টেশনের সামনে খাই গরুর দুধের চা। ১২ টাকা কাপ। পরপর কয়েকটি চায়ের দোকান। সবগুলোতেই ভিড়।

ছবি: লেখক

 কলি

ঘুরে দেখি মক্কা

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৫, ০১:১১ পিএম
ঘুরে দেখি মক্কা
ছবি: হুসাইন বিন আশ্রাফ রিয়াদ

হাজিদের হজব্রত পালনের জন্য পবিত্র নগরী মক্কায় অবস্থান করতে হয়। মক্কা নামের মধ্যেই অন্যরকম এক বিশুদ্ধতা। সৌদি আরবের একটি শহর মক্কা। মুসলিম জাতির শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মভূমি। ইসলামের বহু সমৃদ্ধ ইতিহাস ও মুহাম্মদ (সা.)-এর অনেক অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে এ নগরকে ঘিরে। রয়েছে কুরাইশ বংশধরদের আভিজাত্য, আবু জাহেলের অত্যাচারের করুণ চিত্র। মহানবী (সা.) ইসলাম প্রচারে বাধাগ্রস্ত হয়ে এ মক্কা থেকেই ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে হিজরত করে মদিনা গিয়েছিলেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আসমানি কিতাব কোরআন শরিফের আয়াত এ শহরের জাবালে নূর পাহাড়ে প্রথম নাজিল হয়েছিল।

জাবালে নূর-এর অর্থ আলোর পাহাড়। ওহি নাজিল হওয়ার আগে যখন মহানবী (সা.) জাবালে নূর পাহাড়ে ধ্যানে বসতেন তখন তাঁর বিবি খাদিজা (রা.) প্রতিদিন তিনবেলা করে, সেই উঁচু পাহাড়ে উঠে খাবার দিয়ে আসতেন। যা এ যুগের নারীদের জন্য অনুপম শিক্ষণীয় বিষয়। প্রতি বছর আরবি মাসের ৮ জিলহজ শুরু হয়ে ১২ জিলহজ পর্যন্ত চলে মুসলমানদের হজের আনুষ্ঠানিকতা। সারা পৃথিবী থেকে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ৩ মিলিয়ন মুসল্লি আসেন পবিত্র হজ পালনের জন্য। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এত এত মানুষের আনাগোনা তার পরও সবকিছুই থাকে সুশৃঙ্খল। বিশেষ করে তাওয়াফের দৃশ্য দেখলে কেউ আশ্চর্য না হয়ে পারবে না। আনুগত্য, ভক্তি, আল্লাহভীরু ও শৃঙ্খলার অনন্য দৃষ্টান্ত তাওয়াফকালীন মুহূর্ত। প্রত্যেককেই নিজ নিজ দেশ থেকে যাওয়ার পর হজ শুরুর আগেই মক্কা শহরের পবিত্র কাবা ঘিরে ওমরাহর তাওয়াফ ও সাফা-মারওয়ায় সায়ি করতে হয়। কাবা শরিফেই বেহেশতি পাথর হাজরে আসওয়াদ রুপার ফ্রেমে সাঁটানো রয়েছে। হজরত মুহাম্মদ (সা.) ৬০৫ সালে কাবার দেয়ালে হাজরে আসওয়াদ পাথরটি স্থাপন করেছিলেন। ইসলাম-পূর্ব পৌত্তলিক যুগ থেকেই পাথরটি সম্মানিত হয়ে আসছে।

তাওয়াফের শুরুতেই হাজরে আসওয়াদে চুমু দিয়ে, অবশ্য ভিড়ের কারণে কাছ থেকে না পারলেও দূর হতে দুই হাত তুলে তালুতে চুমু দিতে হয়। যা বর্তমানে হাজি ও ভ্রমণপিপাসুদের জন্য অনন্য আকর্ষণ। আরেক বেহেশতি পাথর মাকামে ইব্রাহিম কাবাসংলগ্ন। মাকামে ইব্রাহিম ওই পাথর, যে পাথরে দাঁড়িয়ে হজরত ইব্রাহিম (আ.) পবিত্র কাবাঘর নির্মাণ করেছিলেন। সহিহ হাদিসে বর্ণিত আছে, কাবাঘর নির্মাণের সময় আল্লাহর হুকুমে পাথরটি প্রয়োজন অনুযায়ী হজরত ইব্রাহিম (আ.) কে নিয়ে ওপরে-নিচে ওঠা-নামা করতেন। পাথরটিতে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর পা মুবারকের চিহ্ন রয়েছে।

এর সামনে দুই রাকাত নামাজ পড়ে দোয়া করলে তা কবুল হওয়ার জোর সম্ভাবনা রয়েছে। এটিও হাজি ও পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ। যতদূর জানি, পবিত্র বায়তুল্লাহ শরিফ পৃথিবীর মধ্যভাগে প্রতিষ্ঠিত। সারা দুনিয়ার মধ্যে মুসলমানদের সবচাইতে পবিত্রতার প্রথম স্থানে থাকা বায়তুল আল-হারাম মসজিদ এ মক্কাতেই। প্রায় ১০ লাখ নামাজি একত্রে জামাতে নামাজ আদায় করতে পারেন। হজ মৌসুমে প্রায় ৪০ লাখ মুসল্লির স্থান সংকুলান হয়। এর রয়েছে সুউচ্চ ৯টি দৃষ্টিনন্দন মিনার। আল-হারাম মসজিদের মোট ৮১টি দরজা রয়েছে, যা সব সময় প্রার্থনাকারীদের জন্য খোলা থাকে।

হজ করতে ইচ্ছুক আর ভ্রমণপিপাসুরা ভাবুন তো একবার, এরকম একটি মসজিদে নামাজ পড়াটা কতটা সৌভাগ্যের। ২০১২ সালের হিসাব অনুসারে মক্কায় ২ মিলিয়ন মানুষের বসতি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এ শহরের উচ্চতা ৯০৯ ফুট। আধুনিক মক্কা শহর এখন আরও নান্দনিক। প্রশস্ত সড়ক, নয়নাভিরাম সব স্থাপনা পর্যটকদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। বাড়তি সৌন্দর্য প্রাকৃতিক নিদর্শন শত শত পাহাড় তো রয়েছেই। পুরো শহরটাই পাহাড়বেষ্টিত। পবিত্র হারাম শরিফের পাশেই আবরাজ আল বাইত হোটেলের ওপর স্থাপন করা হয়েছে বিশ্বের সবচাইতে বড় ঘড়ি। যার নির্মাণকাজ ২০০২ সালে শুরু হয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ২০১২ সালে উদ্বোধন করা হয়েছে। পুরো মক্কা শহর থেকে রাতে ১৭ ও দিনের বেলা ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত এর সময় স্পষ্ট দেখা যায়।

ঘড়িটিতে সাদা ও সবুজ রঙের প্রায় ২১ হাজার বাতি ব্যবহার করা হয়েছে। মুসলমানদের বিশেষ দিনগুলোতে ঘড়ির ওপর আকাশের দিকে ১০ কিমি পর্যন্ত ১৬ রঙের আলোর বিচ্ছুরণ ঘটায়। প্রতি ৫ ওয়াক্ত নামাজের সময় ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত ফ্ল্যাশ লাইটের মাধ্যমে নামাজের ইঙ্গিত দেওয়া হয়। ঘড়িটির ওপর বড় করে আল্লাহু লেখা রয়েছে। যা চারপাশ থেকে একই রকম দেখা যায়। ঘড়িটির সময় গ্রিনিচ সময় থেকে তিন ঘণ্টা এগিয়ে। এ শহরের প্রতি পৃথিবীর সব মুসলমানের রয়েছে এক অন্যরকম অনুভূতি ও ভালোবাসা। জীবদ্দশায় একবার হলেও মক্কা শহরে অবস্থিত পবিত্র কাবা শরিফ দেখার আকুল বাসনা থাকে সব মুসলিমের হৃদয়ে। সেই বাসনা থেকেই আমিও এবার পবিত্র হজ পালনের জন্য ছুটে গিয়েছিলাম পবিত্র মক্কা শহরে।

ইসলামি মতে, একজন হাজির হজ কবুল হলে তিনি শিশুর মতো পবিত্র হয়ে যান। এরকম সুযোগ কে চাইবে মিস করতে। কবুল হবে- এরকম আশা রাখাটাই উত্তম। স্বভাবসুলভভাবে হজ পালন শেষে ঘুরে বেড়িয়েছি শহরের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোতে। ভ্রমণ যেহেতু আমার নেশা, সেহেতু ঘুরে ঘুরে ইসলামের নিদর্শনগুলো দেখার সুযোগ হাতছাড়া করিনি। তাছাড়া ভ্রমণ করা সুন্নতও বটে। বর্তমানে পবিত্র বায়তুল্লাহর সীমানা প্রাচীরের মধ্যেই রয়েছে একদা জালিম হিসেবে পরিচিত আবু জাহেলের বসতবাড়ি।

যেটিকে এখন তার প্রতি সম্ভবত ঘৃণাস্বরূপ মুসল্লিদের জন্য টয়লেট তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। একটু দূরেই মহানবী (সা.)-এর বসতভিটা রয়েছে। যা এখন লাইব্রেরি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বায়তুল্লাহর আরেক পাশে একখণ্ড জমি, তাইসির যাওয়ার পথে পড়ে। এখনো তা অন্ধকার আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগের করুণ স্মৃতির সাক্ষী। এখানেই জীবন্ত কন্যাশিশু পুঁতে ফেলা হতো। উড়াল সড়ক হতে জায়গাটা বেশ ভালোভাবে দেখা যায়।

ইসলামের সুমহান বাণী সেই অন্ধকার হতে মানুষকে আলোকিত করেছে। নারীদের দেওয়া হয়েছে বিশেষ মর্যাদা। শহরের মধ্যভাগে রয়েছে মক্কা মিউজিয়াম। সেখানে রক্ষিত রয়েছে আদি কাবাঘরের নমুনা, জমজম কূপের পূর্বেকার নিদর্শন ও যন্ত্রপাতিসহ নানান দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার প্রতিকৃতি। মিউজিয়ামের পাশেই কাবাঘরের গিলাপ তৈরির কারখানা।

আরেকটু এগোলেই চোখ পড়বে, যেখান থেকে জমজম পানি মদিনা এবং বিভিন্ন দেশ থেকে আগত হাজিদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় জারে করে সাপ্লাই দেওয়া হয়। জিয়ারত করার জন্য হাজিরা মক্কার জান্নাতুল মাওয়ায় গিয়ে থাকেন। যেখানে হাজার হাজার সাহাবিসহ মহানবী হজুর (সা.) প্রথম বিবি খাদিজা (রা.)-এর সমাধি রয়েছে। ইতিহাসের আরেক সাক্ষী সাফা ও মারওয়া পাহাড়। যে দুই পাহাড় ঘিরে হজরত ইব্রাহিম (আ.) তাঁর বিবি হাজেরা (আ.) এবং তাঁদের ছেলে ইসমাঈল (আ.)-এর জীবনী রয়েছে। আল্লাহর দরবারে বিবি হাজেরা (আ.) তৃষ্ণার্ত শিশুপুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.)-এর জন্য পানি পান করানোর জন্য দোয়া করলে, আল্লাহপাকের নির্দেশে জিব্রাইল (আ.) পায়ের গোড়ালির মাধ্যমে কূপ খনন করেন। সে সময় থেকেই সৃষ্টি হয় জমজম পানির কুয়া। পবিত্র কাবাঘর হতে জমজম কূপের দূরত্ব মাত্র ৩৮ গজ। বর্তমানে সাফা-মারওয়া পাথুরে পাহাড় দুটো কেটেছেঁটে কাচের গ্লাস দিয়ে ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। তবে এর গুরুত্ব অসীম। হজ ও ওমরাহ পালন করতে হলে এই দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে সায়ি করতে হয়। সীমানা বৃদ্ধি করায় সাফা-মারওয়া এখন হারাম শরিফের মক্কা মসজিদের ভেতরেই পড়েছে। ঐতিহাসিক জমজমের কূপ এখন আর উন্মুক্ত নয়। তবে এর পানি পানের যথেষ্ট ব্যবস্থা রয়েছে। জমজমের পানি পান বিশেষ বরকতময়। যেসব হাজি ও ভ্রমণপিপাসু এর গুরুত্ব জানেন তাঁরা তৃপ্তিসহকারে পান করেন এবং সঙ্গে করে নিয়েও যান। জমজমের পানি রোগীদের জন্য বিশেষ শিফা। যা পরম করুণাময়ের দেওয়া বিশেষ নেয়ামত। জমজম পানির বৈশিষ্ট্য বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরীক্ষিত। পবিত্র হারাম শরিফের সামনেই রয়েছে কবুতরের মাঠ নামক একটি জায়গা।

কিন্তু ওটা কোনো মাঠ নয়, চলাচলের প্রশস্ত সড়ক। সম্ভবত বাংলাদেশিরাই এর নামকরণ করেছে। সেখানে রয়েছে হাজার হাজার জালালি কবুতর। খুবই দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য। আগত বহু দর্শনার্থী নিজ খরচে খাবার কিনে অবিরাম বিলিয়ে দিচ্ছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা, চলে ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতরের আনাগোনা। এক কথায় অসাধারণ সব মুহূর্ত। মক্কাতেই রয়েছে জাবালে সাওর পর্বত। মহানবী (সা.), হজরত আবুবকর (রা.) নিয়ে মদিনা মুনাওয়ারায় হিজরতের সময় এ পর্বতের গুহায় আত্মগোপন করেছিলেন। বর্তমানে সেখানে পর্যটকদের প্রজেক্টরের মাধ্যমে, ছাওর পর্বতের দৃশ্যাবলি দেখানো হয়। ইচ্ছে করলে অফিস কক্ষ হতে, বিনামূল্যে বাংলাদেশি পরিচয় দিয়ে সিডি নিয়ে আসতে পারেন। আর যদি আপনি অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় হয়ে থাকেন তাহলে পর্বত আহরণের মাধ্যমে স্বচক্ষে দেখে আসতে পারেন।

এর পর আরেকদিন সকাল সকাল এক বাংলাদেশি চালক জহিরের গাড়িতে করে চলে যাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনন্য লীলাভূমি তায়েফ। আজ না হয় এ পর্যন্তই থাক। অন্য আরেকদিন হাজির হব তায়েফ ভ্রমণের গল্প নিয়ে ইনশাআল্লাহ।

তথ্যঃ- প্রথম দিকে যাদের ফ্লাইট হয় তাদের কাফেলা বেশির ভাগ সময় পবিত্র মদিনায় অবস্থান করে। সুতরাং সেখানেও কাছে-ধারে ঘুরে বেড়াবেন। তবে অবশ্যই বাদ ফজর। কোনো অবস্থাতেই যেন ঘুরতে গিয়ে মসজিদে নববিতে জামায়াতে নামাজ আদায়ের ব্যাঘাত না ঘটে।

 কলি

       

কবি তীর্থ দৌলতপুরে

প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৫, ০১:৪৬ পিএম
আপডেট: ২৫ মে ২০২৫, ০১:৪৭ পিএম
কবি তীর্থ দৌলতপুরে
কাজী নজরুল ইসলাম প্রতিদিনই এখানে বসে কলেজপড়ুয়া তরুণদের নিয়ে কবিতা ও গানের আসর জমাতেন। ছবি:সুমন্ত গুপ্ত

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কুমিল্লার দৌলতপুরে এসেছিলেন ১৯২১ সালের ৬ এপ্রিল বা ২৩ চৈত্র ১৩২৭ বঙ্গাব্দে। এই গ্রামে কবির জীবনের শ্রেষ্ঠ কিছু সময় কেটেছিল। এখানকার নারীর মমত্ববোধ ও ভালোবাসা তার বিদ্রোহী মানসপটে প্রেমিক কবির বিমূর্ত ছবি এঁকে দিয়েছিল। দৌলতপুরে না এলে নজরুলের কবি জীবন ও প্রেমিক জীবন হয়তো পরিপূর্ণ হতো না। দৌলতপুর আসার কারণে নজরুলের জীবনে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছিল, তার সাহিত্যচর্চায় যোগ হয়েছিল নতুন মাত্রা।

এখানে এসেই বিদ্রোহী কবি হয়েছিলেন প্রেমের কবি। কবি তীর্থ দৌলতপুর দর্শনের নিমিত্তে আজ আমাদের যাত্রা সিলেট থেকে কুমিল্লার পথে। ঠিকঠাক সময়ে পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ছুটে চলল গন্তব্য পথে। দিনের আলোয় আমি উপভোগ করছিলাম জ্যৈষ্ঠের শেষ সময়ে প্রকৃতির অসম রূপ।

কোথাও মেঘের ছটা, কোথাও আবার রৌদ্রতাপ। এভাবেই ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে এগিয়ে চলছে আমাদের ট্রেন। সূর্যদেব পাটে যাওয়ার আগে আমরা এসে পৌঁছালাম কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশনে। সেখানে আগে থেকেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন প্রদীপ মামা। আমরা ভেবেছিলাম ঠিক সময়ে পৌঁছালে দিনের আলোয় শহরটা দেখে নেব। কিন্তু তা আর হলো না। ব্যাটারিচালিত ত্রিচক্র যানে করে আমরা চলে এলাম কান্দিরপারে। সেখানে আগের থেকে আমাদের জন্য হোটেল ঠিক করে রাখা ছিল। অস্থায়ী ডেরাতে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে আমি বের হয়ে গেলাম শহরটা ঘুরে দেখার জন্য। ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম কুমিল্লা নগরীর প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড় থেকে ২০০ গজ পূর্বদিকে মনোহরপুরে।

কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে যাওয়ার পথে নজরুল তোরণ।

মনোহরপুরের একটি টিনশেড ঘরে তৈরি ও বিক্রি হয় আসল মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই। অনেক মানবজট পেরিয়ে রসমালাইয়ের স্বাদ গ্রহণ করলাম। আগামীকাল সকালে নতুন গন্তব্যে যাব তাই দ্রুত শুয়ে পড়লাম। পাখির কিচিরমিচির শব্দে আমার ঘুম ভাঙল। সকালের পেট পূজা শেষ করেই বেরিয়ে পড়লাম দৌলতপুরের উদ্দেশে। কুমিল্লা শহর থেকে দৌলতপুরের দূরত্ব প্রায় ৪৫ কিলোমিটার।

বলে রাখা ভালো ১৯২১ সালে  নজরুল ইসলাম কুমিল্লা হয়ে মুরাদনগরের দৌলতপুরে আসেন এবং ৭১ দিন অবস্থান করেন। নজরুল দৌলতপুরে বসেই ১৬০টি গান এবং ১২০টি কবিতা রচনা করেন। উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলোর মধ্যে- ‘বেদনা-অভিমান’, ‘অবেলা’, ‘অনাদৃতা’, ‘পথিক প্রিয়া’, ‘বিদায় বেলা’ প্রভৃতি। কবির দীপ্ত পদচারণা কুমিল্লাকে করেছে মহিমান্বিত। ১৯২৪ সাল পর্যন্ত কবি পাঁচবার কুমিল্লায় আসেন। এ পাঁচবারে তিনি ১১ মাসের বেশি সময় কাটান কুমিল্লা শহর ও জেলার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুরে। প্রথমবার ছিলেন ৮ জুলাই পর্যন্ত। দ্বিতীয়বার আসেন ১৯২১ সালের নভেম্বরে, ছিলেন ডিসেম্বর পর্যন্ত।

এই খাটে রাতে ঘুমাতেন কবি নজরুল

তৃতীয়বার আসেন ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ছিলেন জুন পর্যন্ত, চতুর্থবার ১৯২২ সালের অক্টোবর থেকে ২৩ নভেম্বর, পঞ্চমবার অর্থাৎ শেষবার কবি এসেছিলেন ১৯২৩ সালের ডিসেম্বরে তবে চলে যাওয়ার তারিখ অজ্ঞাত। তার এই সফরের সাক্ষ্য হয়ে আছে দোলনচাপা, অগ্নিবীণা, ছায়ানট, ঝিঙ্গেফুল, পুবের হাওয়া প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ। কবির বিয়ে থেকে শুরু করে দুই দফায় গ্রেপ্তার হন এ জেলায়। মুরাদনগরের কোম্পানীগঞ্জ-নবীনগর সড়ক ধরে আমরা এসে পৌঁছালাম দৌলতপুর গ্রাম। গ্রামের প্রবেশপথেই চোখে পড়ল নজরুল তোরণ। তোরণের দুই পাশে ইট-সিমেন্টের তৈরি কালো রঙের টুকরা টুকরা বোর্ডে সাদা কালিতে লেখা কবির পঙ‌্ক্তিমালা।

তোরণ পেরিয়ে গ্রামের ভেতরে যে পাকা রাস্তাটা গেছে, সেটা দিয়ে একটু সামনে এগিয়ে চোখে পড়ে একটা মাঠ, নজরুল মাঠ। আসলে দৌলতপুরে যা কিছু চোখে পড়ে সবই নজরুলের নামে নামকরণ করা। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা চলে যাই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের শ্বশুরবাড়ির কাছে। দেখা পেলাম বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মোরাল তাঁতে লেখা ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য’। এর পাশেই দেখা পেলাম নজরুল মঞ্চের তাতে লেখা কবি নজরুল মঞ্চ, কবিতীর্থ দৌলতপুর, মুরাদনগর, কুমিল্লা। নজরুল মঞ্চের পাশ ধরে আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম। ঝিঁঝি পোকার ডাক আর গাছগাছালির ছায়া মাখা পথ ধরে আমরা এগিয়ে চললাম।

এই পুকুরপাড়ে কবি গোসল করতেন এবং সাঁতার কাটতেন

আমরা এসে উপস্থিত হলাম কবিতীর্থ দৌলতপুরে নজরুল মঞ্চের এলাম খাঁ বাড়ির প্রাঙ্গণে। এই আলী আকবর খানের সুনিপুণ কারুকাজে শোভিত দ্বিতল বাড়ি, এ বাড়িতেই কবি ছিলেন। পদব্রজে আমরা এগিয়ে চললাম ভেতর পানে। পেছনের দরজা দিয়ে আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম। চড়ুইপাখির অবিরাম ডাক আমাদের মনে করিয়ে দিল তারা হয়তো আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে কবি তীর্থের এই প্রাঙ্গণে। আমরা সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয়তলার দিকে এগিয়ে গেলাম। বাড়িটির জরাজীর্ণ অবস্থা দেখে খারাপ লাগল। বাড়িটির কারুকাজ দেখে প্রতীয়মান হয় যে বাড়িটি অতীত সময়ে বিলাসবহুল একটি বাড়ি ছিল।

বাড়িটির স্থাপত্যশৈলী, দরজা-জানালা বা রেলিংয়ের নজরকাড়া কারুকাজ আজও সমীহ জাগায়। সময়ের আঁচড়ে মলিন হয়েছে এর সৌন্দর্য, খসে পড়েছে পলেস্তারা। কিন্তু এককালে যারা ছিলেন এ বাড়ির বাসিন্দা, তাদের বিত্তবৈভব আর সমৃদ্ধির সাক্ষী হয়ে যেন দাঁড়িয়ে আছে দৌলতপুরের খাঁ মঞ্জিল। তবে কী আশ্চর্য, বিত্তবান বাসিন্দাদের কারণে নয়, বাড়িটি আজও স্মরণীয় হয়ে আছে বহুকাল আগে এ বাড়িতে আসা এক অতিথির কারণে। তিনি এসেছিলেন এখানে, জয় করেছিলেন এক নারীর হৃদয়- আবার ফিরেও গিয়েছিলেন।

নজরুল মঞ্চ

পেছনে পড়ে থাকে এক অনন্ত হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাসের ইতিহাস। ছাদ থেকে পাশের পুকুর ঘাটের দেখা পেলাম। এই পুকুর পাড়ে বসে কাজী নজরুল ইসলাম লেখাজোকা করতেন। এ বাড়ির পেছনে বাঁশঝাড়, সেটা পার হলেই কবির বাসরঘর। প্রদীপ মামা বলছিলেন, ১৯৬২ সাল পর্যন্ত কবির বাসরঘরটি আটচালা ছিল। পরে চৌচালা হলেও আয়তন ও ভিটার কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। ওই ঘরেই ছিল কবির স্ত্রী নার্গিসের ব্যবহার করা কাঠের সিন্দুকটি। দেখভালের অভাবে সিন্দুকটি হারিয়ে গেছে। সেটি এখন কোথায় আছে, তা আর ওই বাড়ির কেউই বলতে পারেন না।

এক সময় ওই ঘরে বাসর খাটটিও ছিল। এখন সেটি পাশের একটি আধা পাকা ঘরে রাখা হয়েছে। কবিপত্নী নার্গিসের বংশের উত্তরসূরি বলেন, ‘এ বাড়ির পুকুরঘাটের আম গাছতলায় কবি দুপুরে শীতল পাটিতে বসে গান ও কবিতা লিখতেন। খানবাড়ির ছেলেমেয়েদের নাচ, গান ও বাদ্যযন্ত্র শেখাতেন। পুকুরের পানিতে সাঁতার কাটতেন। শখ করে পুকুরে জাল আর পলো দিয়ে মাছ শিকার করতেন।

আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম বাড়ির চারপাশ। বর্তমান-বিস্মৃত হয়ে মাঝে মাঝে যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম আগেকার কোনো দিনে। যেন এখনই আমতলা থেকে ভেসে আসবে কবির বাঁশির সুর। যেন এখনই কোনো এক জানালায় দেখতে পাব লাজনম্র নার্গিসের মুখ। ফিরে আসার পথে কোকিলের ডাক শুনতে পেলাম। বহুকাল আগে হয়তো এ রকমই এক নিদাঘ দুপুরে কোকিলের ডাকে প্রিয়-বিরহে বেদনার্ত হয়ে উঠেছিলেন নার্গিস, তার সেই বিখ্যাত বেদনার স্মৃতি ধরে আছে এই বাড়ি। যাবেন কীভাবে- প্রথমে আপনাকে বাস অথবা ট্রেন করে আসতে হবে কুমিল্লা শহরে। সেখান থেকে বাস/সিএনজি করে খুব সহজেই পৌঁছাতে পারবেন কবিতীর্থ দৌলতপুরে।

/ কলি

নেপালের পাটন দরবার স্কোয়ার

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৫, ০২:৫৫ পিএম
নেপালের পাটন দরবার স্কোয়ার
ছবি: সংগৃহীত

আমাদের প্রতিবেশি দেশ নেপাল অনন্য সৌন্দর্যের এক দেশ। যাকে হিমালয়কন্যা বলা হয়। পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিমে ভারত আর উত্তরে চীন দেশের ভূখণ্ডে ঘেরা নেপালের পাহাড়ি পথ, চঞ্চলা নদনদী, নিবিড় অরণ্য, পাহাড়ি ঝরনা সবই আপনাকে মোহিত করবে। উঁচু-নিচু এই পাহাড়ই দেশটির মূল স্তম্ভ ও চালিকাশক্তি। যার বেশির ভাগই পাহাড় আর অরণ্য। আর এই পাহাড় ও অরণ্যকে ঘিরেই তাদের বসতি, প্রাকৃতিক লেক, আঁকাবাঁকা সড়ক ও জনপদ গড়ে উঠেছে। এ যেন পাহাড়ের ভূখণ্ডে এক অবিনশ্বর পৃথিবী।

বিমানের জানালা দিয়ে হিমালয়ের অপূর্ব দৃশ্য নয়নভরে দেখছি। চেষ্টা করছি মোবাইলের ফ্রেমে বন্দি করে রাখতে। আগে নানাভাবে হিমালয় দেখেছি। প্রত্যেকটা পাহাড় চূড়ার দৃশ্যই হৃদয়ে লেগে থাকার মতো। পাখির চোখে হিমালয়ের দৃশ্য দেখে আমি অভিভূত। এত সুন্দর হিমালয়ের রূপ, চোখের পাতা পড়ছিল না। নভেম্বরের শুরুর দিকে বরফ জমাট বাঁধতে শুরু করে। তাই এ সময় কোথাও সাদা বরফে ঢাকা, কোথাও আবার বরফের চাদরে ঢেকে দেওয়ার প্রস্তুতি দেখতে পেলাম। ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ২টা, উড়োজাহাজে চেপে আমরা এসে পৌঁছালাম হিমালয় কন্যার দেশে নেপালে-বাংলাদেশ ইয়ুথ কনক্লেভের অনুষ্ঠানে।

বিমানবন্দরে আমাদের বরণ করে নিলেন নেপাল-বাংলাদেশ ইয়ুথ কনক্লেভ অনুষ্ঠানের প্রধান সমন্বয়ক অভিনব দাদা। বাংলাদেশ থেকে অনেকেই এসেছেন এই আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত হতে। অভিনব দাদা বললেন, আমরা চাইলে এখন কাছাকাছি ভ্রমণ গন্তব্যে ঘুরে হোটেলে উঠতে পারি নতুবা হোটেলে গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে বের হতে পারি। সবাই একবাক্যে বলল আগে ঘুরে নিই আর হোটেলে ঢুকলে পরে বের হতে দেরি হবে। আমরা চার চাকার বাহনে উঠে পড়লাম। প্রকৃতির উষ্ণ ছোঁয়া বেশ ভালোই লাগছিল।

আগের থেকে সবাই বলছিল নেপালে বুঝি বেশ ভালোই ঠাণ্ডা পড়ে। সেই তথ্যানুযায়ী ঠাণ্ডাকে মোকাবিলা করার জন্য আমার ভ্রমণসঙ্গী সানন্দা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। কিন্তু যেমন ঠাণ্ডা পড়ে  বলে মনে হয়েছিল ঠিক ততটা ঠাণ্ডা পড়েনি। পথিমধ্যে আমরা পেটপূজা সেরে নিলাম। আমাদের বাহন একটি গলির সামনে নামিয়ে দিল সেখানে দেখা পেলাম নেপাল-বাংলাদেশ ইয়ুথ কনক্লেভের আরেক সদস্য সুমিত দাদার সঙ্গে। তিনি বললেন সংক্ষিপ্ত রাস্তা দিয়ে আমরা যাব নেপালের ঐতিহাসিক স্থান পাটন দরবার স্কোয়ারে।

আমরা পদব্রজে সবাই এগিয়ে যেতে লাগলাম। সূর্যদেব পাটে যাওয়ার পথে। পর্যটকদের পদচারণে গলিগুলো বেশ জমজমাট। কাঠমান্ডু মন্দিরের শহর বললে ভুল হবে না। পুরো শহর জুড়ে ছোট-বড় অনেক মন্দির। কাঠমান্ডু এমন একটি শহর, যেখানে প্রতি ইঞ্চিতে মিশে রয়েছে ইতিহাস। নেপাল অনেকটা নিঃশব্দ শহর। একই সঙ্গে নিরাপদ। হর্ন না দিয়ে শত শত মোটরবাইক চলছে রাস্তা পারাপারের সময় পথচারীকে গুরুত্ব দিয়ে থেমে যায়।

বিষয়টি আমাকে মুগ্ধ করে। যাত্রাপথে দেখতে পেলাম একজন পানিপুরি বিক্রি করছেন। আমার সহযাত্রী সানন্দা লোভ সামলাতে না পেরে নিয়ে নিলেন পানিপুরি। আমি ও স্বাদ আস্বাদন করলাম। সুমিতদা বললেন পাটন দরবার স্কোয়ার যা ললিতপুর নামে খ্যাত। অসাধারণ স্থাপত্য কর্ম এখানে স্থান পেয়েছে। এই স্থানটি হিন্দু ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির মিলিত নিদর্শন। আমরা এগিয়ে চলছি কিন্তু চোখের পলক ফেলতে পারছি না। অসাধারণ কারুকাজ সংবলিত সব ভবন। এদিকে সন্ধ্যার আরতি চলছে বিভিন্ন মন্দিরে মন্দিরে, কেউ আছেন প্রার্থনায় মগ্ন। আমাদের সব সঙ্গী ছবি তোলায় মগ্ন।

আমি ও স্মৃতিটুকু মোবাইলে ধারণ করে রাখার চেষ্টা করছি। কবুতর স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি আর সানন্দা ঢুকে পড়লাম একটি মন্দিরের ভেতর। পাথরের ওপর খোদাই করা বিভিন্ন শৈল্পিক কর্ম। নগ্ন পায়ে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে গেলাম। চারপাশের আগরবাতির ঘ্রাণ আমাদের মোহিত করল। সেখানে কিছু সময় অতিবাহিত করে আমরা এগিয়ে চললাম সামনের দিকে। পাটান দরবার স্কয়ারকে বলা চলে পর্যটকদের প্রিয় স্থান। চলতি পথে সুমিতদা বলছিলেন পাটান তার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর জন্য বেশ জনপ্রিয়। এখানকার রঙিন বাড়িঘর এবং অসাধারণ স্থাপত্য ভ্রমণকারীদের মুগ্ধ করে। এই প্রাচীন মন্দিরগুলোর শিল্পকর্ম যুগ যুগ ধরে প্রশংসিত হয়ে আসছে।

পাটান একটি ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ শহর। যার উৎপত্তি খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে। কাঠমান্ডু এবং ভক্তপুরের পরে পাটান নেপালের তিনটি রাজকীয় শহরগুলোর মধ্যে একটি। চতুর্দশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত, পাটান মল্ল রাজ্যের রাজধানী হিসেবে পরিচিত ছিল। এটি মল্ল শাসকদের অধীনে সমৃদ্ধ হয়েছিল। মল্লরা শিল্প ও স্থাপত্যের প্রতি তাদের ভালোবাসার জন্য পরিচিত ছিল। সেই ভালোবাসা আজও এখানকার প্রাসাদ এবং মন্দিরগুলোতে দেখা যায়। পাটান বিশ্বের কিছু দর্শনীয় স্থাপত্য বিস্ময়ের আবাসস্থল। ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার তালিকায় স্থান পেয়েছে এই পাটান দরবার স্কয়ার। খোদাই করা কাঠের একটি প্রাসাদ।

এখানে রয়েছে প্রাচীন একটি বৌদ্ধ মন্দির। যা দেখতে লাখ লাখ পর্যটক এখানে আসেন। পাটানের কৃষ্ণ মন্দির আরও একটি জনপ্রিয় পর্যটক আকর্ষণ। আমরা পদব্রজে এগিয়ে চলছি। শত বছর আগের কারিগরদের কাজ দেখে আমরা সবাই অবাক। পাথরে খোদাই করে এই মন্দিরের সোনালি রঙের চূড়া শহরের অন্যতম বিশিষ্ট স্থাপত্য বিস্ময়। পাটান মিউজিয়াম এই শহরের আরও একটি রত্ন। স্থানটি ধর্মীয় নিদর্শন, ভাস্কর্য এবং শিল্পকর্মের সংগ্রহের জন্য বিখ্যাত। এ ছাড়া স্বর্ণ মন্দির, রুদ্র বর্ণ মহাবিহার এবং ভীমসেন মন্দির শহরের অন্যান্য বিশিষ্ট স্থাপত্য আকর্ষণগুলোর মধ্যে কয়েকটি। আপনি যদি নেপালের শিল্প ও কারুশিল্পের অভিজ্ঞতা নিতে আগ্রহী হন তবে অবশ্যই পাটানে আসতে হবে। যারা নেপালি অভিজ্ঞতা নিতে চান তাদের এই সাংস্কৃতিক জায়গাটি অবশ্যই পরিদর্শন করা উচিত।

কীভাবে যাবেন
বাংলাদেশ থেকে নেপালে বিমানযোগে যাওয়া যায় এবং কাঠমান্ডুতে যেতে হলে সেখানকার ত্রিভুবন এয়ারপোর্টের টিকিট কাটতে হবে। খরচ যাওয়া আসার টিকিট নিয়ে ১৮ থেকে ২৫ হাজার টাকার মতো পড়বে। আগেভাগে টিকিট কাটতে পারলে ১৭ হাজার টাকার মতো খরচ হতে পারে। বাই রোডে নেপাল যেতে হলে খরচ কমে যাবে অনেকটা। সেক্ষেত্রে ভারতের ট্রানজিট ভিসা নিতে হবে যেখানে পোর্টের নাম দিতে হবে চ্যাংরাবান্ধা বা রানীগঞ্জ। এখানে বা বিমানে কোনোটাতেই নেপালের ইমিগ্রেশনে কোনো ভিসা ফি এর দরকার নেই যদি না আপনি একই বছরে দুবার ভ্রমণ করতে চান। চাইলে ভেঙে ভেঙে ভারতের বর্ডার পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে নেপালের কাঁকড়ভিটা পর্যন্ত যেতে পারেন। 

কোথায় থাকবেন
থাকতে হলে থামেলের চেয়ে উপযুক্ত স্থান আর দ্বিতীয়টি নেই কারণ পুরো থামেলের গলি ঘুপচিতে অসংখ্য হোটেল/ ব্যাকপ্যাকার হোস্টেল রয়েছে। ১০০০ থেকে ১৮০০ রুপির মধ্যে ভালো ডাবল রুমের বাজেট হোটেল এখানে পাওয়া সম্ভব। ৬০০ রুপিতে সিঙ্গেল রুমের হোটেলও এখানে আছে। বাজেট আরেকটু বেশি যেমন ৩০০০ রুপি বা তার বেশি হলে ডিলাক্স রুমের খাবারসহ অনেক ভালো হোটেল পাওয়া যায়। তবে থামেল এর হোটেল এবং তাদের দরদাম ও চেহারা এত বেশি বৈচিত্র্যময় যে আগে থেকে বুকিং না দিয়ে বরং হেঁটে কয়েকটি হোটেল ঘুরে যাচাই-বাছাই করলে সস্তায় ভালো হোটেল পাওয়া সম্ভব।

কি খাবেন
নেপালের লোকাল খাবার হিসেবে তারা ভাতের থালিকেই প্রাধান্য দেয়। তাই কাঠমান্ডুর যেখানেই যাওয়া হোক না কেন ভাত না খেয়ে থাকা অসম্ভব। ভাতের সঙ্গে মাছ, মুরগি, সালাদ, রায়তা, শাক ও পাঁপড় থালিতে থাকে। নেপাল শীতপ্রধান দেশ বলে সেখানে মোমোর প্রচলন আছে। থামেল ও কাঠমান্ডুর অন্যান্য জায়গায় অসংখ্য মোমোর দোকান আছে। এ ছাড়া আছে নানা স্বাদের নানা রঙের চা ও কফি। ফুলের পাপড়ি থেকেও চা তৈরি করে তারা বিক্রি করে রাস্তার মোড়ে মোড়ে। এ ছাড়া আধুনিক খাবার-দাবার সবই এখন কাঠমান্ডুতে পাওয়া যায়।

কাঠমান্ডু ভ্রমণ টিপস
বিমানে যাত্রার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে কাঠমান্ডু যাওয়ার সময় বোর্ডিং অফিসারকে বলে যদি বিমানের বা সারির সিট নেওয়া যায় তাহলে কাঠমান্ডুর এয়ারপোর্টে নাম্বার আগেই হিমালয়ের আইসপিক বিমান থেকে দেখতে পারবেন। তেমনিভাবে সেখান থেকে আসবার পথে চাইলে আপনি ডান দিকের সিট রিজার্ভ করতে পারেন। নেপালিরা ভীষণভাবে অতিথিপরায়ণ ও সাহায্যকারী। যেহেতু তারা হিন্দুরাজ্য তাই সেখানে গিয়ে খাবার-দাবার বা তাদের মন্দির ঘুরবার সময় ধর্মীয় রীতিনীতির সঙ্গে যথাসম্ভব সম্মান দেখান।

টাকা এয়ারপোর্ট থেকে না ভাঙিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ভাঙালে রেট বেশি পাওয়া যায়। তবে মোবাইল সিমটি এয়ারপোর্ট থেকে কেনাই ভালো যদি কেউ কিনতে চান। যেহেতু নেপাল ঠাণ্ডার দেশ তাই হোটেল নেওয়ার আগে গরম পানির ব্যবস্থা কেমন তা ভালোভাবে জেনে হোটেল নেওয়া ভালো। অন অ্যারাইভাল ভিসার জন্য পাসপোর্ট, পাসপোর্টের ফটোকপি, রঙিন পাসপোর্ট সাইজ ছবি, রিটার্ন টিকিট ও হোটেল বুকিং তথ্য (অনেক সময় লাগতে পারে), ডলার এনডোর্সমেন্ট, চাকরিজীবী হলে NOC এবং স্টুডেন্ট হলে আইডি লাগে। কিছু প্রয়োজনীয় ফোন নাম্বার: পুলিশ (ইমারজেন্সি) ১০০, ট্যুরিস্ট পুলিশ ৪২৪৭০৪১, ডিপার্টমেন্ট অব ইমিগ্রেশন ৪২২৩৫০৯/ ৪২২৪৫৩, নাইট ট্যাক্সি ৪২২৪৩৭৪, অ্যাম্বুলেন্স (রেড ক্রস) ৪২২৮০৯৪, অ্যাম্বুলেন্স ১০২

 কলি

নাইজেরিয়া: বাস্তব জীবনের অ্যাডভেঞ্চার

প্রকাশ: ১০ মে ২০২৫, ০২:২৯ পিএম
আপডেট: ১০ মে ২০২৫, ০৪:২৮ পিএম
নাইজেরিয়া: বাস্তব জীবনের অ্যাডভেঞ্চার
কাজী আসমা আজমেরী

নাইজেরিয়ায় যেমন বড় বড় পাহাড় আছে তেমনি বাংলাদেশের মতো নদীও আছে। এখানকার খাবারগুলো ভাত-মাছ-মাংস সবকিছুই বাংলাদেশের মতোই। পৃথিবীর সবচেয়ে কম টাকায় মনে হয় আমি এই পাঁচ বছরে কোথাও গেলাম, তা হচ্ছে নাইজেরিয়া। মাত্র ১৩ ডলারে সুইমিং পুলওয়ালা হোটেলে থাকা চিন্তা করা যায় না, সঙ্গে ২৪ ঘণ্টা এসি। আবুজায় তো মাত্র ১৭ ডলারে ছিল তিন তারকা হোটেল সুইমিং পুল উইথ ব্রেকফাস্ট।

লেগোসে অনেক পার্টি করা হয়েছে। আর সবচেয়ে খারাপ লেগেছে এটিএম থেকে মাত্র ৪০ হাজার নাইরা উঠানো যায়, যার মূল্য মাত্র ২৩ ডলার। কিন্তু আমার অস্ট্রেলিয়ান ব্যাংক এই ২৩ ডলার উঠাতে খরচ নেয়  ১২ ডলার। তাই এখানে টাকা নিয়ে আমি বেশ ঝামেলায় পড়েছিলাম এবং নাইজেরিয়াতে পাঁচ তারকা হোটেল এবং বিদেশি রেস্টুরেন্টগুলো ছাড়া কোথাও বিদেশি কার্ড কাজ চলে না। যদিও নাইজেরিয়া টাকা-পয়সাবিহীন। সেখানে অনলাইন অ্যাপের মাধ্যমে সবকিছু হয়। বেশ ঝামেলা ক্যাশ টাকা নিয়ে, আবার খুচরা করার বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে সেখানে।

নাইজেরিয়ায় বড় বাস চলে না। এখানে ছোট ছোট মাইক্রোবাসকে স্থানীয়রা ভিআইপি বাস বলে‌। তবে সেখানকার প্রতিটি স্টেটে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা রয়েছে। খাবার এবং বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মাবলম্বীর মানুষজন বসবাস করে‌। যেমন কানু এবং ওই সাইট দিয়ে বাউছি এসব এলাকায় মুসলিম। আর অন্যান্য এরিয়ায় খ্রিষ্টান ও আফ্রিকান গোত্রীয় লোকজনের বাস। আফ্রিকার মধ্যে নাইজেরিয়ান ছেলেদের পোশাকে বেশ বৈচিত্র্য রয়েছে সঙ্গে ভিন্ন ধরনের পাগড়ি।

বাংলাদেশি ও পাকিস্তানিদের মতোই ওরা পাঞ্জাবি পরে, কিন্তু তার ওপর একটা কোট পরে। যেটা শুধু এই ওয়েস্ট আফ্রিকার সম্প্রদায়ের লোকজনই পরে থাকে। লেগোসে প্রায় আট দিন ছিলাম ফরাসি বন্ধুর বাসায়। ওর বাসা ভিআইপি এলাকাতে, ওই এরিয়ায় যেতে হলে প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন অ্যাক্সেস কোড নিয়ে যেতে হয়। একদিন রাতে প্রায় ৪৫ মিনিট রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, কোড ভুলে গিয়েছি তাই। তারপর ওর বাসার দারোয়ান আমাকে কোড টেক্সট করে পাঠালে যেতে পেরেছি।

লেগোসের মধ্যে ভিক্টোরিয়া আইল্যান্ড সবচেয়ে ধনীদের বসবাস। তবে আফ্রিকার মধ্যে কেপটাউনের পরে লেগোসের অবস্থান যদিও। কেপটাউন অনেক সুন্দর। এখানে রয়েছে মিডিয়া হাউস, মিউজিয়াম, থিয়েটার, আর্ট গ্যালারি সবই। নাইজেরিয়াতে রাস্তায় গাড়ি খুব দ্রুত চলে এবং সবাই আগে যেতে চায়, সেজন্য এখানে অ্যাক্সিডেন্টের পরিমাণ অনেক বেশি।

নাইজেরিয়ার বেনিং সিটি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত। সেই সঙ্গে খাবারদাবার। বেনিং সিটিতে বেনিং রাজা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই দেখার আছে, ওখানে প্রায় চারটি মিউজিয়াম রয়েছে। বেনিং সিটি থেকে আমি চলে গিয়েছিলাম বাসে আবুজাতে‌। এখানে মানুষের সময়-জ্ঞান এত কম যে চিন্তা করা যায় না, তারা ফোন করে জিজ্ঞেস করে আসছি। তারপর দু-এক ঘণ্টা পরে তারা রওনা দেয়। বিউটি পিজেন্টে অনারেবল বিচারক হিসেবে গিয়েছিলাম ঈদের দিন। বিকেল ৩টায় প্রোগ্রাম শুরু করার কথা থাকলেও তারা রাত ৯টায় প্রোগ্রাম স্টার্ট করে। চমৎকার প্রোগ্রাম ছিল কালো সুন্দরীদের মেলা বসেছিল। সেখান থেকে মুশকিল ছিল বুদ্ধি আর সৌন্দর্য সবকিছু নিয়ে নির্বাচন করা বেস্ট সুন্দরীকে। আবুজাতে বন্ধু রোটারিয়ান আগে থেকেই সবকিছু আয়োজন করেছিল।

সেজন্য ওখানে বেশ কিছু রোটারি ক্লাব ভিজিট করার সৌভাগ্য হয়েছিল। স্পেশালি ইবি ও তার ক্লাব প্রেসিডেন্ট টন্ডি অনেক সাহায্য করেছে। বিভিন্ন ক্লাব ভিজিটে সহায়তা করেছে এবং আমার যাওয়া উপলক্ষে স্পেশাল মিটিংও তারা ডেকেছিল। আবুজাতে চাঁদের ভিসার জন্য অ্যাপ্লাই করেছিলাম। সেখান থেকে দুদিন পরেই চাঁদের ভিসা পেয়েছিলাম কিন্তু অনলাইনে ক্যামেরুন ভিসা করার পরে আবারও সেই ভিসার Stickers নিতে অ্যাপে Had to wait a long time. অপেক্ষা করতে হয়েছে বেশ কত দিন। তবে সময়টা খুব সুন্দর কেটেছে। কয়েকটা মিউজিয়াম আর মিলেনিয়াম পার্ক ঘুরেছি। আমি প্রতিদিন হিল্টান আর ইন্টার্ন কনটেইনারের লাঞ্চ ও ডিনার করেছি।

১১ এপ্রিল আবুজা থেকে সেই স্পেশাল শেয়ার ট্যাক্সিতে করে কানু শহরে পৌঁছায়। আগেই বলেছি যে, শহর মুসলিম ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত এবং এখানে আমির প্রথা রয়েছে। ওখানে লেবাননের একটি চমৎকার তাহির প্যালেস গেস্ট হোটেল। সেখানে দুদিন ছিলাম। এরপর প্রায় চার ঘণ্টা শেয়ারট্যাক্সি স্ট্যান্ডে বসে থেকে রাত ৩টায় পৌঁছালাম ইয়ালা শহরে। সেখান থেকে পরের দিন রওনা দিই ক্যামেরুনের উদ্দেশে। সত্যি কথা বলতে আমি জানি না বর্ডারের নাম কী এবং কোন শহরে যাচ্ছি। ট্যাক্সিতে করে নদীর তীরে পৌঁছাই। সেখানে এক নাইজেরিয়ান পাকিস্তানির সঙ্গে পরিচয় হয়। তার সঙ্গে চার ঘণ্টা নৌকায় করে পৌঁছালাম ক্যামেরুনের ডাঙ্গায়। কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় বর্ডার বন্ধ ছিল বলে ইমিগ্রেশনের সিল নিতে পারিনি।

পরে ওখান থেকে মাটির রাস্তায় ট্যাক্সি ভাড়া করে ওই ভদ্রলোক ও আমরা চারজন মিলে একসঙ্গে গারোয়া নামে ক্যামেরুনের শহরে পৌঁছাই রাত সাড়ে ১০টায় দিকে। হোটেল তো খুবই খারাপ আর খুবই দামি। বেসিন ভালো থাকলে এসি চলে না, এ এক বিশাল সমস্যা। তারপর সেই গারুয়া থেকে পরের দিন অনেক কষ্টে কয়েকটা ব্যাংক চেষ্টা করার পরে সোসালিক নামের একটি ব্যাংক টাকা নিলাম। ওই দিন ৪টার দিকে মারুয়ার শহরে যাই। মারুয়া শহরে গিয়ে দেখি কুচারি বর্ডার শহরে কোনো বাস কিংবা ট্যাক্সি নেই। তারপরে ঐদিন রাত্রে বাস স্টেশনের পাশেই হোটেল শাহিদে ছিলাম প্রায় ৪০ ডলার দিয়ে।

হোটেলের দশা খুবই খারাপ যদিও সুইমিং পুল আছে, তবে কোনো কিছুর ঠিক নেই। পরের দিন সকালে উঠে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে শুনি টিকিট ফুল হয়ে গেছে। তারপরে বাস স্টেশনের চিল্লাপাল্লা করার পরে স্টেশন মাস্টার শেয়ার ট্যাক্সিওয়ালান কাছে নিয়ে যায়। সেই শেয়ার ট্যাক্সিতে করে কুচারিতে আসি। রাস্তা বলতে কোনো রাস্তায় নেই এখানে। মরুভূমির ওপরে দিয়ে কোথাও একসময় এখানে খাল বিল ছিল, তার ওপর দিয়ে গাড়ি চলেছে। আর আমার সেই গাড়ি তো সেই রকম দেখার মতো। মাত্র রাস্তায় তিনবার নষ্ট হয়। গাড়িতে পরিমাণে লাগেজ বহন করে যে চিন্তা করা যায় না। তারপর সন্ধ্যা ৬টায় পৌঁছাই অনেক কষ্টে কুচারি শহরে, সেখান থেকে মোটরসাইকেলে অনেক কষ্টে দুটি লাগে লাগেজ নিয়ে বর্ডারে পৌঁছাই।

দুজন কুলিকে ভাড়া করি। তারা সাহায্য করে। ইমিগ্রেশন পার করি অনেক কষ্টে ক্যামেরুনে। ক্যামেরুন আর চাঁদের মাঝখানে বাঙ্গি নদীর একটি ছোট ব্রিজ আছে যেটা হেঁটে পার হতে হয়। সেই ব্রিজ পার হয়ে অর্ধেক পথ আসার পরেই দেখি রাস্তায় শুধু গরু। গরুর জন্য রাস্তা পার হওয়া যাচ্ছিল না। সেই গরুগুলোর শিং দেখলে ভয়ংকর রকমের বড়। যদি একবার গুঁতা দেয় একেবারে পেটের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যাবে, I have moved here with great difficulty। অনেক কষ্ট করে বর্ডার পাড়ি দেওয়ার সময় দুজন লেবারসহ হঠাৎ দেখি আমার বন্ধু এসে ম্যারি বলে ডাকছে, In the kingdom of corruption মনে হলো দেবদূতের মতো এসে হাজির হয়েছে। আসবে জানতাম কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে আসবে জানতাম না। তারপর ও এসে ফ্রান্স ভাষাভাষীদের সঙ্গে কথা বলে ইমিগ্রেশনে প্রায় তিন ঘণ্টা কথা বলে আমাকে বের করেছে।

ইমিগ্রেশন অফিসার তো আমার পাসপোর্ট রেখে দিয়েছিল টাকা না দিলে দেবে না। খুবই চিল্লাচিল্লি শুরু করেছি যে ২৫০ ডলার দিয়ে ভিসা করেছি কি ওকে টাকা দেওয়ার জন্য। তারপর অনেক কষ্টে রাত সাড়ে ৯টায় এসে হোটেলে পৌঁছাই। হোটেল দেখে তো মন খুবই খারাপ, ৬০ ডলারে কী সুন্দর হোটেল দেখিয়েছে ছবিতে। আসার পরে দেখি পুরোনো যেখানেই দাঁড়াই সেখান থেকে মনে হয় ইট সুরকি ঝরে পড়ে। যাই হোক মন অনেক খারাপ হওয়ার পরও এখানেই থাকতে হবে কয়েকদিন।

অনেক কষ্টে ১৫ এপ্রিল বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে ১৫৪তম দেশ চাদে পৌঁছায়। চাঁদ বলে কথা, সহজেই হাতে পাওয়া যায় না। প্রায় চার দিন লেগেছে মাত্র ৬০০ কিলোমিটারের এই রাস্তাটি অতিক্রম করতে। খুবই ভালো লাগছে, চাদ ছিল স্বপ্নে পাওয়া একটি দেশ যেখানে আসতে পেরে অনেক ভালো লাগছে।

চাদের বুকে পা রাখলাম অনেক কষ্টের – নাইজেরিয়া থেকে চাদ পর্যন্ত এক দুর্ধর্ষ যাত্রা এই গল্পটা শুধু একটা ভ্রমণের না, এটা একটা বাস্তব জীবনের অ্যাডভেঞ্চার। নাইজেরিয়ার টানা রোড জার্নি থেকে শুরু করে ক্যামেরুন পার হয়ে অবশেষে চাদের বুকে পা রাখা– প্রতিটি মুহূর্ত ছিল নতুন, চ্যালেঞ্জিং আর শেখার মতো।

কলি

মাছিমপুর মণিপুরিপাড়া যেথায় কবিগুরুর পদধূলি পড়েছিল...

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৫, ০১:২৭ পিএম
মাছিমপুর মণিপুরিপাড়া যেথায় কবিগুরুর পদধূলি পড়েছিল...
রবীন্দ্র ভাস্কর্য আবক্ষ । ছবি: সুমন্ত গুপ্ত

১৯১৯ সালে অবকাশ যাপনের জন্য শিলংয়ে আসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯১৯ সালের ১১ অক্টোবর তিনি শিলং পৌঁছান। সেখানে ২০ থেকে ২২ দিন অবস্থান করার পর সিলেট ভ্রমণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। শিলং থেকে সিলেট মাত্র ১৪০ কিলোমিটারের পথ হলেও তখন সিলেট পর্যন্ত সরাসরি রাস্তা ছিল না। বিকল্প পথ গুয়াহাটি থেকে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের লামডিং-বদরপুর সেকশনের ভেতর দিয়ে করিমগঞ্জ-কুলাউড়া হয়ে সিলেট আসতে হয় তাকে। অনেকটা দীর্ঘ ছিল এই পথ।

১৯১৯ সালের ৫ নভেম্বর, দিনটি ছিল বুধবার। খুব ভোরে সিলেটে পৌঁছান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সঙ্গে ছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। সুরমা নদীর ঘাট থেকে কবিকে শঙ্খধ্বনি বাজিয়ে শোভাযাত্রাসহ সিলেট শহরে আনা হয়। তিনি উঠেছিলেন শহরের নয়াসড়ক টিলার ওপরে ফাদার টমাসের বাংলোয়। পরদিন বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় কবিকে টাউন হল প্রাঙ্গণে শ্রীহট্টবাসী জনসাধারণের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা জানানো হয়। সৈয়দ মুর্তজা আলীর একটি লেখায় (আমাদের কালের কথা, চট্টগ্রাম, ১৩৮২) উল্লেখ আছে, ওই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন প্রায় ৫ হাজার মানুষ। সেই অনুষ্ঠানে কবি দেড় ঘণ্টাব্যাপী বক্তৃতা করেন, যা পরে ১৩২৬ বঙ্গাব্দে প্রবাসী পত্রিকার পৌষ সংখ্যায় ‘বাঙালির সাধনা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। বেলা ২টার সময় ব্রাহ্মসমাজ গৃহে শ্রীহট্ট মহিলা সমিতি তাকে সম্মাননা জানায়। অনুষ্ঠানস্থলে কবির টেবিলে মোড়ানো ছিল মণিপুরি মেয়েদের তৈরি টেবিল ক্লথ।

কাপড়খানি তার ভালো লাগে। মেয়েদের বয়ন-নৈপুণ্য দেখে কবি মণিপুরিদের তাঁত ও জীবনযাত্রা দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। পড়ছিলাম বইয়ের পাতা থেকে। এর পর থেকে শুধু পরিকল্পনাই করছিলাম গুরুদেবের স্মৃতিবিজড়িত মাছিমপুরে মণিপুরিপাড়ায় ঘুরে আসব। কিন্তু বিধিবাম হলে যা হয়, যাব যাব বলে যাওয়া হচ্ছিল না। এদিকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত মাছিমপুর মণিপুরিপাড়ায় কবিগুরুর আবক্ষ মূর্তি স্থাপিত হয়েছে শুনে ওই স্থানে যাওয়ার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। যাই হোক সূর্যদেবের অশেষ কৃপায় আমি আর আমার এক সঙ্গী বের হয়েছি। গন্তব্য মাছিমপুরের দিকে।

আমরা আমাদের কুটির থেকে ত্রিচক্র যান করে এগিয়ে যাচ্ছি। জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার পেরিয়ে আমরা ধাবিত হচ্ছি মাছিমপুরের দিকে। মাছিমপুরে সেই ছোটবেলায় গিয়েছিলাম বাবার সঙ্গে করে। সময়ের ধারাপাতে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে, তাই পথগুলো নতুন মনে হচ্ছিল। ভ্রমণস্থানে নিয়ে যাওয়ার ত্রিচক্র যানের কাণ্ডারি মহোদয়ের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরা এসে পৌঁছলাম মাছিমপুরে। এখন কোন দিকে যাব সে পথটাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। নিরুপায় হয়ে এক প্রবীণের শরণাপন্ন হতে হলো। তার কথা মতো আমরা পৌঁছে গেলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত মাছিমপুরের মণিপুরিপাড়ায়।

পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সুরমা নদী। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবক্ষ ভাস্কর্য। দেখে মন ভরে গেল। মনে মনে ভাবছিলাম এ স্থানেই একদিন পা দিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র সবার প্রিয় কবি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমি কিছু সময় দাঁড়িয়ে রইলাম। পাশেই দেখতে পেলাম মন্দির। মনে মনে ভাবছিলাম এই মন্দিরেও নিশ্চয়ই গুরুদেবের পদধূলি পড়েছিল। আমি মনে মনে খুঁজছিলাম কারও কাছ থেকে যদি পুরো ইতিহাস জানা যেত।

দেখা হলো কবি ও গবেষক এ কে শেরাম দাদার সঙ্গে। তার কাছে ইতিহাস জানতে চাইলে তিনি বলেন ৬ নভেম্বর বিকেল ৩টার দিকে মাছিমপুর বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি বস্তিতে আসেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মণিপুরি বস্তিতে কবির আগমন ঘটবে, এ জন্য বস্তিবাসী তাৎক্ষণিকভাবে রাস্তায় সারি সারি কলাগাছ পুঁতে তোরণ নির্মাণ করেন। প্রতি গাছের গোড়ায় মঙ্গলঘট ও আমপাতার শোভন সজ্জা করেন। সে তোরণদ্বার দিয়ে কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় মাছিমপুর পূর্বমণ্ডপের গোপীনাথ জিউ মন্দিরে। কবির উদ্দেশে মণিপুরি ছেলেমেয়েরা রাখালনৃত্য পরিবেশন করে।

রাধা-কৃষ্ণের প্রেম নিয়ে রাখাল নৃত্যের কাহিনি। এটি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের পার্বণিক আচারেরই অংশ। ওই মণ্ডপটি এখনো বর্তমান আছে। কবির ইচ্ছা ছিল রাসনৃত্য দেখার, কিন্তু ক্লান্ত বোধ করায় মণিপুরি ছেলেমেয়েদের সন্ধ্যায় তার বাংলোয় আসতে বলেন। তিনি আসার সময় মণিপুরি মেয়েদের তৈরি তাঁতের কাপড় কিনে নিয়ে আসেন। সেই রাতে মাছিমপুর বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি বস্তি থেকে একদল শিল্পী ফাদার টমাসের বাংলোয় পৌঁছান। শিল্পীরা মণিপুরি রাসলীলার কিছু গীতি ও নৃত্য কবির সামনে উপস্থাপন করেন। 

সেদিন কবিগুরু মণিপুরি নৃত্যের সজ্জা, সাবলীল ছন্দ ও সৌন্দর্যে বিমোহিত হন এবং শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েদের এই নৃত্য শেখানোর ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এ কে শেরাম দাদার কথা চলছে আর আমরা পদব্রজে ঘুরে বেড়াচ্ছি। দাদার কথা শুনে সেই সময়কার কথা চোখে ভেসে উঠল। ইস! আবার যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ফিরে আসতেন আমাদের মাঝে। আমরা মাছিমপুর এলাকাটা ঘুরে দেখতে লাগলাম। নগর জীবনের ছোঁয়ায় নেই সেই মণিপুরিদের আগের কোমড় তাঁত। তবে কবিগুরুর পদধুলিপ্রাপ্ত সেই মন্দির আজ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আমরা মন্দিরে গিয়ে কিছু সময় বসলাম। মণিপুরি সম্প্রদায়ের দেবালয়ের গঠন প্রায় সব জায়গায় একই। প্রতিটি মন্দিরের পাশে শিবমন্দির থাকে, এখানেও তার ব্যতিক্রম দেখলাম না।

তাছাড়া মণিপুরি সম্প্রদায়ের প্রতিটি বাসার সামনে তুলসী মন্দির দেখতে পেলাম, যা নগরজীবনে খুব একটা দেখতে পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কল্যাণে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা মণিপুরি নৃত্যের বিশ্বময় প্রচার হতে থাকে। গত শতকের তৃতীয় দশক থেকে মণিপুরি সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ ঘটতে থাকে। মণিপুরি নৃত্যগুরু ও শিল্পীরা সমাদৃত হতে থাকেন এবং বিভিন্ন জায়গায় সাংস্কৃতিক উৎসবগুলোয় তারা আমন্ত্রিত হতে থাকেন।

কেবল ধর্মীয় আচারের জন্য পালিত সংস্কৃতি অর্থকরী হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে মণিপুরি সমাজে। মণিপুরি সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ অসামান্য ভূমিকা রাখার জন্য মণিপুরি সম্প্রদায় আজও কবিগুরুকে ‘মণিপুরি নৃত্যের পথিকৃৎ’ হিসেবে বিবেচনা করেন। মণিপুরি নৃত্যগুরুরা আজও গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করেন কবিগুরুর নাম। উল্লেখ্য, আসছে নভেম্বরের ৫ তারিখে সিলেটে কবিগুরুর আগমনের শত বছর পূর্তি হচ্ছে।

কিভাবে যাবেন
ঢাকার সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল, রাজারবাগ ও মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে গ্রিনলাইন, শ্যামলী, এনা, হানিফ বা বিআরটিসি বাসে অথবা ট্রেনে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে সকালে আন্তনগর পারাবাত, দুপুরে জয়ন্তিকা ও কালনী এবং রাতে উপবন সিলেটের পথে ছোটে। ভাড়া ৩৬০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকার মধ্যে। সেখান থেকে মাছিমপুর মণিপুরিপাড়ায় যেতে ভাড়া নেবে ৪০ টাকা, সিএনজি অটোরিকশা  ভাড়া ১০০ থেকে ১৫০ টাকা।

 কলি