ধলাপাখ-কালিদামা পাখিটি আমাদের দেশে খুব একটা দেখা যায় না। তবে সম্প্রতি এর উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। আর তাই একে দেখার জন্য গত ফেব্রুয়ারি মাসের এক সকালে হাজির হই রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পদ্মার তীরবর্তী প্রেমতলী বনে। সঙ্গী আছেন বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্য মানিক ভাই এবং এখানকার গাইড নূর ইসলাম। প্রচুর গাছপালায় ভরা বিশাল এ বনের কোথায় পাখিটি আছে, সেটি জানেন নূর ইসলাম। তিনি এ বনে তিনি নিয়মিত পাখি দেখতে বা দেখাতে আসেন। আমরা তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে হাঁটি।
হাঁটতে হাঁটতে বনের একটা জায়গায় এসে থামি। নূর জানান, সম্প্রতি এখানেই দেখা গেছে পাখিটিকে। আমরা তাই তাকে দেখার উদ্দেশে চোখ রাখি বনের গাছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও পাখিটির দেখা নেই। এরপর আসি আরেক স্থানে। এখানেও অনেকক্ষণ অপেক্ষা। অবশেষে পাখিটির দেখা পাই কিছু সময়ের জন্য। তবে মনমতো ছবি তুলতে পারিনি। তাই আরও অপেক্ষা করি। ইতোমধ্যে আরও কয়েকজন এসেছেন এ পাখির খোঁজে। কেউ এসেছেন ঢাকা থেকে, কেউ রাজশাহী থেকে। বেশ কিছুক্ষণ পর আবার পাখিটির দেখা পাই। ছবিও তুলি মনমতো। আমরা পুরুষ পাখিটি দেখি। মেয়ে পাখিটির খোঁজ পাইনি। অবশ্য রাজশাহীর পাশাপাশি পাখিটি সম্প্রতি হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান এবং কক্সবাজারের টেকনাফে দেখা গেছে বলে জেনেছি।
ইংরেজিতে পাখিটির নাম- গ্রে উইংড ব্ল্যাকবার্ড। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ‘উদ্ভিদ ও প্রাণিকোষ’ বইয়ে এর বাংলা নাম- ধলাপাখ-কালিদামা। কালো বর্ণের এ পাখি আকারে শালিকের চেয়ে একটু বড়। পাখিটির ডানা ফিকে ধুসর। এর ঠোঁট গাঢ় কমলা। চোখ বাদামি এবং চোখের বলয় হলুদ। সাধারণত পাখিটি বনে বা বনের ধারে বিচরণ করে। ভূমিতে হেঁটে হেঁটে খাবার খুঁজে খায়। খাবারের তালিকায় আছে পোকা, কেঁচো, অমেরুদণ্ডী ছোট প্রাণী ও রসালো ফল। মার্চ থেকে আগস্ট প্রজননকাল। জমির আইলে, পতিত গাছে বা গাছের উঁচু ডালে ঘাস, শেওলা বা পাতা দিয়ে বাটির মতো বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। ৩ থেকে ৪টি ডিম দেয়। মেয়েপাখি ডিমে একা তা দেয়।
ধলাপাখ-কালিদামা ছাড়াও বাাংলাদেশে দামা প্রজাতির আরও কয়েকটি পাখি আছে। নীল-শিলাদামা, নীল-শিসদামা, কমলা-দামা, আঁশটে-দামা, কালাপাশ-দামা, খয়রাপিঠ-দামা, লম্বাঠোঁট-দামা, ধলাঘাড়-দামা, কালাবুক-দামা, পাতি-কালিদামা, কালচে-দামা, ভ্রমণ লেখা-দামা, লালগলা-দামা এবং টিকেলের-দামা। এর মধ্যে দুর্লভ আবাসিক কমলা-দামা ও বিরল পরিযায়ী নীল-শিসদামা মাঝে মাঝে দেখা যায়। তবে দুর্লভ পরিযায়ী নীল-শিলাদামা বা বিরল পরিযায়ী কালাবুক-দামা, লালগলা-দামা ও টিকেলের-দামা খুব কম দেখা যায়। এ ছাড়া অন্য দামাগুলো অনিয়মিত হওয়াতে একেবারেই কম দেখা মেলে।
ধলাপাখ-কালিদামা দেখে বনে আরও কিছুক্ষণ ঘুরে আরও কিছু পাখি দেখি। বিকেলে ফিরি শহরে। রেলওয়ে স্টেশনের হোটেলে উঠি। ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খাই এখানকার একটা রেস্টুরেন্টে। এরপর আসি এখানকার সিঅ্যান্ডবি মোড়ে গরম গরম ছানার রসগোল্লা আর পুরি খেতে। রানার মিষ্টিখ্যাত এ স্পঞ্জ রসগোল্লা প্রতিটি ২০ টাকা। পুরি প্রতিটি ১০ টাকা। গরম গরম রসগোল্লার সঙ্গে গরম গরম পুরি, দারুণ স্বাদ। দোকানে বেশ ভিড়। বোঝা গেল রাজশাহী শহরে এ মিষ্টির বেশ সুনাম রয়েছে। একদিকে মিষ্টি বিক্রি হচ্ছে, অন্যদিকে মিষ্টি বানানো হচ্ছে। মিষ্টি খেয়ে আমরা রাতের শহর ঘুরি। ইতোমধ্যে এ শহর পরিচ্ছন্ন নগর হিসেবে দেশে খ্যাতি পেয়েছে। খ্যাতি পাওয়া শহরে কিছুক্ষণ ঘুরে হোটেলে ফিরি।
পরের দিন খুব সকালে আসি পবা উপজেলার দামকুড়ার ভিমের ডাইং এলাকায়। উদ্দেশ্য ক্রেস্টেড বান্টিং দেখার জন্য। বাংলায়-ঝুঁটিয়াল-চটক। বিরল প্রজাতির এ পাখি আমাদের দেশের নতুন পাখি বলা যায়। পরিযায়ী এ পাখি এর আগে বাংলাদেশের পাখির তালিকায় ছিল না। সম্প্রতি এ পাখিটি রাজশাহী অঞ্চলের খেতখামারে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
পাখিটিকে দেখার জন্য আমরা সরিষা খেতের আইলে বসি। আমাদের চারপাশেই খেত। সরিষা, ভুট্টা, গম, আখসহ বিভিন্ন ফসলে ভরা এসব খেত। শীতের সকাল হওয়াতে খেতের ফসলের বা জমিনের আইলের ঘাসের ওপর জমে থাকা শিশিরকণা তখনো শুকায়নি। সূর্যেরও তেজ বাড়েনি। অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যে আরও ১০-১২ জন এসে হাজির হয়েছেন এ পাখি দেখার জন্য।
আমরা সবাই যেখানে বসি, এর আশপাশেই পাখিটিকে সম্প্রতি বেশি দেখা গেছে। সেজন্যই আমরা এখানে বসি। পাখিটি সরিষা খেতের ভেতরে লুকিয়ে আছে। মাঝে মধ্যে উপরে উঠে একনজর দেখা দিয়ে আবার হারিয়ে যায়। এভাবেই চলে বেশ কিছুক্ষণ। এর মধ্যে যে যতটুকু পেরেছেন ছবি তুলেছেন। মানিক ভাইও ক্লিক করেছেন বেশ। আমরা দেখি স্ত্রী পাখিটি। যদিও স্ত্রী-পুরুষ দুটোই থাকার কথা। তবে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও পুরুষটিকে দেখিনি। এখানে ছাড়াও পাখিটি সম্প্রতি শেরপুর, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া, মৌলভীবাজারের কুড়মা চা বাগান ও জামালপুরে কেউ কেউ দেখেছেন বলে জেনেছি।
চড়ুই আকারের সুদর্শন পাখিটির মাথায় ঝুঁটি রয়েছে। সেজন্য নামের আগে ঝুঁটিয়াল বসানো হয়েছে। গায়ের রং অনেকটা হালকা বাদামি। আমাদের দেশে আরও চার প্রজাতির চটক দেখা যায়। লালকান-চটক, খুদে-চটক, হলদেবুক-চটক এবং কালামুখ-চটক। এর মধ্যে কালামুখ-চটক মাঝে মধ্যে দেখা যায়। আর বাকিগুলো কমই দেখা যায়। অনেকক্ষণ ধরে পাখিটিকে পর্যবেক্ষণ করার পর আমরা আবার রওনা হই ধলাপাখ-কালিদামার উদ্দেশে।
প্রেমতলী বাজার হয়ে আমরা নদীর দিকে আগাই। এরপর খেয়াপার হই। আগের দিনও এ খেয়াপার হই। নদীর নাম পদ্মা। নদীতে পানি কম। পলি জমে ভরাট হয়েছে। তেমন কোনো খেয়াঘাট নেই। দু-একটি নৌকা পাড়ে আছে। কেউ পার হতে চাইলে মাঝি পার করে দেন। আবার যখন মাঝি থাকেন না, তখন কেউ কেউ নিজেরাই বইঠা বেয়ে পার হন। খেয়াপার হয়ে একটু হাঁটলেই বন।
আমরা বনের একটা জায়গায় এসে দাঁড়াই। কিছুক্ষণ পরই পাখিটির দেখা পাই। মানিক ভাই আয়েশ করে ছবি তোলেন। এরপর বনের আরও কিছু জায়গা ঘুরি। বের হওয়ার সময় বনের পাশের একটা খেতে দেখি দেশি-মোটাহাঁটু। ইংরেজিতে- ইন্ডিয়ান থিকনি। পাখিটি আকারে মুরগির ছানার মতো। শরীর বাদামি রঙের। ডানার প্রান্ত কালো এবং সাদাটে পেট। হলুদ চোখের চারপাশে কালচে রিং এবং রিংয়ের ওপরে ও নিচে রেখা। পা হলদে। কালচে ঠোঁটের গোড়া হলদে। বিরল প্রজাতির এ পাখি মাঝে মধ্যে দেখা যায়। এটা ছাড়াও বাংলাদেশে আরও দুটি প্রজাতির মোটাহাঁটু রয়েছে। এর মধ্যে ইউরেশীয়-মোটাহাঁটু আমাদের অনিয়মিত পাখি। আর বড়-মোটাহাঁটু বিরল আবাসিক পাখি। ফলে এগুলোও খুব কম দেখা যায়।
পাখি দেখে নদীর তীরে এসে দেখি নৌকা আছে কিন্তু মাঝি নেই। তাই নূর মাঝি হন। শহরে যাওয়ার আগে এখানকার বাজারে খাই দুপুরের খাবার। যদিও বিকেল হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় আসি শহরে। শহরে নদীর পাড়ে কিছুক্ষণ বসি। রাতে রেলওয়ে স্টেশনের পাশে ফুটপাতের দোকানে খাই কালাইরুটি। সঙ্গে পেঁয়াজ দিয়ে বেগুনভর্তা। এটা রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবার।
একসময় ফুটপাতে শীত মৌসুমে বেশি বিক্রি হলেও এখন রেস্টুরেন্টেও মেলে। এ ছাড়া শীত ছাড়া অন্য সময়ও পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, এখন এ রুটির নামে অনেক রেস্টুরেন্টও আছে এ শহরে। সাধারণত এ রুটি গরুর মাংস, হাঁসের মাংস, বেগুনভর্তা, শুঁটকিভর্তা বা ধনিয়াভর্তা দিয়ে খায়।
প্রথমে তিনভাগ মাষকলাইয়ের গুঁড়ার সঙ্গে একভাগ চালের আটা মেশাতে হয়। এরপর পানি দিয়ে খামির বানিয়ে গোল বল তৈরি করতে হয়। এরপর পানি দিয়ে খামির বানিয়ে গোল বল তৈরি করতে হয়। এরপর বল দুই হাতের তালুর চাপে চাপে তৈরি হতে থাকে রুাট। এরপর মাটির খোলায় বা তাওয়াতে এপিট ওপিঠ সেঁকে তৈরি হয় রুটি।
প্রতি রুটি ৩০ টাকা। তবে স্পেশাল ৫০ টাকা। সঙ্গে ভর্তা ফ্রি। রুটির পর রেলওয়ে স্টেশনের সামনে খাই গরুর দুধের চা। ১২ টাকা কাপ। পরপর কয়েকটি চায়ের দোকান। সবগুলোতেই ভিড়।
ছবি: লেখক
কলি