
মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার একটি রেস্টুরেন্টে সকালের নাশতা সেরে যাত্রা করি হামহাম ঝরনার উদ্দেশে। ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল ছয়টা পেরিয়ে গেছে। সঙ্গী অনুজ বন্ধু সাজেদ, গুলজার, মাসুম, মাহবুব ও জামিল। এর মধ্যে সাজেদ আমার পরিচিত। বাকিরা সাজেদের বন্ধু। আমি এসেছি ঢাকা থেকে। বাকিরা যুক্ত হন বড়লেখা থেকে। আমরা একটা প্রাইভেট কারে রওনা হই। কারটি গুলজারের। চালকও সে।
প্রথমে আসি কমলগঞ্জ উপজেলা সদরে। এখান থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার দূরে হামহামের অবস্থান। কমলগঞ্জ থেকে আদমপুর বাজার হয়ে আমরা এগিয়ে চলি হামহামের দিকে। দুই পাশে সারি সারি চা-বাগান আর আঁকাবাঁকা মেঠো পথ পাড়ি দিয়ে আসি চাম্পারায় চা-বাগানে। এ পর্যন্ত পথটুকু ভালোই ছিল। গাড়িও চলছিল ঠিকঠাক। কিন্তু এরপর শুরু হয় মাটির পথ। গাড়ি চলার উপযুক্ত নয়। গুলজার ধীরে ধীরে গাড়ি চালায়। এভাবে কুরমা বন বিটের কুরমা চা-বাগান পাড়ি দিয়ে আসি কলাবন পাড়া। এ এলাকাটি রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অংশ। কলাবন পাড়ায় আদিবাসী ও চা শ্রমিকদের বসবাস রয়েছে।
কলাবন আসার সঙ্গে সঙ্গে আদিবাসী কয়েকজন তরুণ-যুবক আমাদের ঘিরে ধরেন। মূলত তারা হামহাম ঝরনা দেখানোর গাইড। আমরা বিকাশ নামের এক যুবককে গাইড হিসেবে সঙ্গে নিই। সঙ্গে আরও আছে টমি নামের একটি কুকুর। কুকুরটি বিকাশের পরিচিত। স্থানীয় কিশোরদের কাছ থেকে আমরা একটা করে বাঁশের চলা কিনে নিই হাতের লাঠি হিসেবে। এরপর সবাই হাফপ্যান্ট, টি-শার্ট পরে রওনা হই ঝরনার উদ্দেশে।
সঙ্গে পানির বোতল ও স্যালাইন নিই। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে হাঁটি নির্জন পাহাড়ি বনের ভেতর দিয়ে। পাহাড়ের চারপাশেই ঘন গাছগাছালি। এরই মাঝে হাঁটি। কখনো নিচু থেকে ওপরে উঠি, আবার কখনো ওপর থেকে নিচে নামি। আবার কখনোবা পাড়ি দিই ছোট্ট ছড়া। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হই, বিশ্রাম নিই, এরপর আবার হাঁটি। অবশ্য উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে দলের সবারই কষ্ট হচ্ছে। কেউ কেউ তো কষ্টের ভয়ে ফিরে যেতেও চাইছে। এভাবে দেড় ঘণ্টায় প্রায় ছয় থেকে সাত কিলোমিটার পথ হেঁটে অবশেষে পৌঁছি ঝরনার ছড়ায় বা ঝিরিতে। এ ছড়া দিয়ে হামহাম ঝরনারই পানি প্রবাহিত হয়ে চলছে। ছড়ায় এসে সাজেদ আর মাসুম শুয়ে পড়ল ক্লান্তিতে। আমরাও যোগ দিই তাদের সঙ্গে। আরামের জন্য শরীরটা একটু ভিজিয়ে নিই ছড়ার পানিতে। বেশ আরামই লাগছে। ছড়ার পানি আসলেই বেশ শীতল। এখানে একটু বিশ্রাম শেষে ছড়া ধরে আবার রওনা হই ঝরনার উদ্দেশে। কিছুক্ষণ হাঁটার পরই দেখি হামহাম। সত্যিই দারুণ বুনো পাহাড়ের এ ঝরনা বা জলপ্রপাত।
ঝরনাটির উচ্চতা প্রায় ১৪০ ফুট। কেউ কেউ আরও বেশিও বলেন। ২০১০ সালের দিকে এটি আবিষ্কার করেন বাংলাদেশের একদল অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পর্যটক। ঝরনাটি রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতরেই অবস্থিত। স্থানীয়দের কাছে এটি ‘চিতা ঝরনা’ নামেও পরিচিত। স্থানীয়দের দাবি, একসময় এ বনে চিতাবাঘ দেখা যেত। অবশ্য বন বিভাগের রেকর্ড আছে কি না সেটা জানা নেই। মূলত বর্ষা মৌসুমেই এ ঝরনার প্রকৃত সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। সেই তুলনায় শীতের সময় পানি কম থাকে।
গরমের মধ্যে দীর্ঘ পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে আমরা বেশ ক্লান্ত। তাই দেরি না করে সবাই ঝরনার পানিতে নেমে পড়ি। সত্যিই, দারুণ শীতল। ভুলে যাই কষ্ট করে আসা পথের সব ক্লান্তি। বেশ কিছুক্ষণ ঝরনার পানিতে শরীর ভেজাই।
ঝরনার পাদদেশে একটি চায়ের দোকান হয়েছে। আমরা সবাই এ দোকানে চা-বিস্কুট খাই। ঝরনার পাদদেশেরে আশপাশের পরিবেশটা দারুণ মায়াময়। এ মায়ায় পড়ে বেশ কিছুক্ষণ শুনি ঝরনার পানি পড়ার শব্দ। এরপর রওনা হই ফেরার উদ্দেশে। গাইড বললেন, এবার অন্য পথ দিয়ে ফিরব, তাহলে পাহাড় পাড়ি দিতে হবে কম। তার কথায় অন্যপথ ধরি। এ পথে পাহাড় পাড়ি দিই কিছুটা কম, তবে পথ কম নয়। অবশ্য এ পথে রোমাঞ্চটা একটু বেশি উপভোগ্য। কারণ পথটি ঝরনারই ছড়াপথ বা ঝিরিপথ। এ পথের দুই পাশে পাহাড়, আর মাঝখানে ছড়া। নির্জন-ছমছম ভাব। বেশ উপভোগ্য। তবে ছড়াগুলোয় জোঁকের উপদ্রব অনেক। দলের প্রায় সবাইকে জোঁকে ধরেছে, ভাগ্যক্রমে আমি ছাড়া। মূলত কলাবন পাড়া থেকে হামহাম যাওয়া-আসার দুটি ট্রেইল আছে। একটি পাহাড়ি পথ, অন্যটি ঝিরি পথ। ঝিরি পথে সময় একটু বেশি লাগে, তবে পথটি বেশ সুন্দর। অবশ্য ঝিরি পথে বর্ষাকালে জোঁকের উপদ্রবও বেশি থাকে।
কলাবন হয়ে আদমপুর আসতে আসতে বেলা প্রায় শেষ। এখানকার একটি রেস্টুরেন্টে খাই দুপুরের খাবার। এরপর ধরি কুলাউড়ার পথ। মাঝে শমসেরনগর বধ্যভূমি ও সম্মুখযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভে কিছুক্ষণ দাঁড়াই। শ্রদ্ধা জানাই মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের প্রতি। এরপর আবার রওনা হই। আসি বড়লেখায় সাজেদের গ্রামের আজিমগঞ্জ বাজারে।
নোট: ঢাকা থেকে বাসে শ্রীমঙ্গল। অথবা ট্রেন পারাবত, জয়ন্তিকা বা উপবন এক্সপ্রেসে শ্রীমঙ্গল। এরপর কমলগঞ্জ, চাম্পারার চা বাগান হয়ে কলাবন। এরপর হেঁটে হামহাম।
ছবি লেখক
কলি