বাইক্কা বিল জলাভূমি অভয়াশ্রমে আসি বিকেলের দিকে। বিলের প্রবেশমুখে মনি লালের ঘরে ব্যাগ রাখি; তিনি বিলের পাশের মাছ চাষ প্রকল্পের কেয়ারটেকার। এরপর প্রবেশ করি বিলে। বিলের প্রবেশপথেই আছে এ অভয়াশ্রমের পরিচিতিমূলক বর্ণনা; যেন দর্শনার্থীরা বিলের উদ্ভিদ ও প্রাণিজগৎ সম্পর্কে একটা ধারণা পেতে পারেন। এ ছাড়া বিলে প্রবেশ করেই দেখা মেলে কিছু নির্দেশনার সাইনবোর্ড। যেমন- বিলের পর্যবেক্ষণ টাওয়ারগুলোর অবস্থান, হাঁটার পথ, নৌকা ভ্রমণ, শব্দ না করা, বর্জ্য না ফেলা ইত্যাদি।
আমরা বিলের কিনার দিয়ে মাটির পথ ধরে হাঁটি। মূলত বিলের কিনারে হিজল, করচ, বরুন, ঢোল কলমি, গুল্মসহ নানা উদ্ভিদ বা গাছগাছালি আছে। বর্ষা মৌসুমে এসব উদ্ভিদ বা গাছগাছালির অধিকাংশসহ পুরো বিল পানিতে ডুবে থাকে। এরপর শীত মৌসুমে বিলের মাঝে কিছু পানি থাকে এবং বিলের কিনার থাকে শুকনো। আর এ কিনারেই রয়েছে বিভিন্ন গাছগাছালি, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ও দর্শনার্থীদের জন্য হেঁটে ঘুরে দেখার প্রাকৃতিক পথ বা মাটির পথ। আমরা এ প্রাকৃতিক পথ ধরেই হাঁটি। কিছুক্ষণ হাঁটার পর আসি পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে। টাওয়ারে উঠে দূরবিন দিয়ে পাখি দেখি। বিলের মাঝে নানা প্রজাতির পাখির ওড়াওড়ি দেখে ভালো লাগছে।
পাখি পর্যবেক্ষণের জন্য বিলে দুটি টাওয়ার আছে। একটি বিলের প্রবেশমুখ থেকে এক কিলোমিটার দূরে, অন্যটি বিলের প্রবেশমুখ থেকে ১০০ মিটার দূরে। আমরা আছি প্রবেশ মুখ থেকে এক কিলোমিটার দূরেরটিতে। বিলের মাঝে একাধিক উঁচু খুঁটি বা চৌকি বসানো আছে। মূলত এসব খুঁটি ঈগলের বিশ্রাম ও বাসা তৈরির জন্য করা হয়েছে।
বিলের মাঝে চমৎকার সূর্যাস্ত দেখে টাওয়ার থেকে নামি। ফেরার পথে চমক হিসেবে দেখি একটি মেছো বিড়াল। অবশ্য বেশিক্ষণ দেখার সুযোগ হয়নি। আসলে এ বিলের ঝোপঝাড়ে মেছো বিড়ালের বসবাস আছে। বিপন্নের তালিকায় থাকা এ বুনো বিড়ালের ইংরেজি নাম- ফিশিং ক্যাট। নিশাচর এ প্রাণীর অন্যতম খাবার মাছ। সেজন্য হাওরের জলাশয় বেষ্টিত এলাকায় ঝোপঝাড়ে বা প্রাকৃতিক মৎস্যকেন্দ্রের কাছে এর বেশি বসবাস। তবে এখন খুবই কম দেখা যায়। এর অন্যতম কারণ, বিড়ালটিকে আমরা ভুল করে মেছো বাঘ ভেবে ‘বাঘ’ প্রজাতির হিংস্র প্রাণী মনে করে মেরে ফেলি। এ ছাড়া হাওরাঞ্চলের প্রাকৃতিক জলাভূমি ও ঝোপঝাড় পরিষ্কার বা বিল ভরাট করে কৃত্রিম মাছের খামার বা অন্য চাষাবাদ বা বসবাস করার ফলেও বিড়ালটি তার খাদ্য ও আবাসস্থল হারাচ্ছে। আবার এরা খাদ্যের খোঁজে লোকালয়ে চলে এলেও মানুষের হাতে মারা পড়ে। সব মিলিয়ে বিড়ালটি হারিয়ে যাচ্ছে।
মাছ এ বিড়ালের প্রধান খাবার হলেও শামুক, ঝিনুক বা ছোট স্তন্যপ্রাণীও খায়। একটু নীরব ও রাগী প্রকৃতির এ বিড়াল ভালো সাঁতার জানে। মোটাসোটা এ বিড়ালের পা খাটো। মাথা দীর্ঘ ও লেজ ছোট। শরীর গাঢ় ধূসর দাগ ও ডোরার সমন্বয়ে সজ্জিত। লোম মোটা এবং স্পষ্ট কালো দাগসহ হালকা বাদামি ধূসর। মার্চ থেকে জুন এদের প্রজননকাল। বিপন্ন এ বিড়ালকে বাঁচাতে এ বিলে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে গবেষণা চলছে। শুধু মেছো বিড়াল নয়, এ বিলের পাখি, মাছ বা অন্য জলজ উদ্ভিদ বা প্রাণী নিয়েও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে একাধিক গবেষণা কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
মূলত, হাইল হাওর বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি জলাভূমি। বর্ষার সময় এ হাওরের জলায়তন প্রায় ১৪ হাজার হেক্টরজুড়ে বিস্তৃত হয়। শুষ্ক মৌসুমে এসে দাঁড়ায় ৪ হাজার হেক্টরের কম। এ হাইল হাওরের মাছ, পাখি, জলজ উদ্ভিদ বা অন্যান্য প্রাণী সংরক্ষণ ও প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যেই ভূমি মন্ত্রণালয় ২০০৩ সালে বাইক্কা বিলকে স্থায়ী অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করে। এ অভয়াশ্রম চামরা, মাগুরা, জাদুরিয়া বিল ও এর আশপাশের জলাভূমির সমন্বয়ে গঠিত, যা একত্রে ‘বাইক্কা বিল’ নামে পরিচিত। বিলটির আয়তন প্রায় ১৭০ হেক্টর। এ বিল নানা প্রজাতির মাছ, পাখি, জলজ উদ্ভিদ, মেছো বিড়াল, বন বিড়াল, শেয়াল, বেজিসহ বিভিন্ন প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল।
বিলটির মাঝে সারা বছরই পানি থাকে। আর এ জলাবিল চিতল, রাম টেংরা, শোল বা চ্যানা, শাল বাইম, তেলচিটা পাথরচাটা, কাকিলা, বর্মী পুইয়া বা গুতুম, টাকি, করিকা পুইয়া, বটিয়া পুইয়া, আনন পুইয়া, চ্যাং, শিং, কৈ, পাঙাশ, গুচি বাইম, হলদে ডোরা তারা বাইম, বোয়াল, মহাশোল, রানীমাছ, টেরি পুঁটি, নারকেলি চেলা, জেব্রা, মোরারি, এলাং, ঘনিয়া, ঢেলা, দারকিনা, আইড়, মেনি, ফলি, পাবদাসহ ৯৮ প্রজাতির মাছের নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র বা ‘মাতৃ মৎস্যভাণ্ডার’। এসব মাছ এখানে বংশবৃদ্ধি করে, যা পুরো হাওরে ছড়িয়ে পড়ে।
বিলটির অন্যতম আকর্ষণ নানা প্রজাতির পাখি। বিশেষ করে এ বিল ১৭০ প্রজাতির জলচর পাখির নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে বিবেচিত। ফলে বিলটি আন্তর্জাতিকভাবেও বিশেষ পরিচিত। এজন্য এ বিলের পাখি নিয়ে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান-সংগঠন নিয়মিত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব (বিবিসি) প্রতি শীতে পাখিশুমারি, পাখির পায়ে রিং পরানোসহ নানা কার্যক্রম করে থাকে। এ ছাড়া গবেষণার অংশ হিসেবে বিলের যাদুরিয়া প্রান্তে পাখির জন্য ৩০টি কৃত্রিম বাসা তৈরি করা হয়েছে। এসব বাসায় অনেক পাখি বাসা তৈরি করে বসবাস করছে।
দেশি-বিদেশি সংস্থার সহযোগিতায় বর্তমানে অভয়াশ্রমটি সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে বড়গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থপনা সংগঠন। আর সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের লক্ষ্যে বিলটিতে প্রবেশের জন্য প্রতিজন দর্শনার্থীর কাছ থেকে পাঁচ টাকা ফি নেওয়া হয়। পাশাপাশি দর্শনার্থীদের জন্য বিলটিতে দুটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণসহ বিভিন্ন সুবিধা প্রদানেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। মূলত শীতের সময় পাখি দেখার জন্যই দর্শনার্থীরা এখানে বেশি আসেন।
বিলের জলাভূমিতে দর্শনার্থীদের জন্য নৌকা ভ্রমণেরও ব্যবস্থা আছে। নৌকা ভাড়া নেওয়া যাবে ঘণ্টা হিসাবে। এ ছাড়া পদ্মফুলের জন্য এ জলাভূমি বেশ পরিচিত। নৌকায় ঘুরলে এসব ফুল দেখা যাবে খুব কাছ থেকে। কেবল পদ্মফুল নয়, শাপলা, হিজল-করচ, ফোকল, সিংড়া, পানিকলা, ওকল, ঢোল কলমী, কচুরিপানাসহ নানা জলজ উদ্ভিদে ভরপুর এ বিল।
সন্ধ্যার পর বিলের প্রবেশ মুখের মাছচাষ প্রকল্পের পাশে তাঁবু ফেলি। একটাতে সফিক ভাই, অন্যটিতে আমি আর ফেরদৌস ভাই। রাতের খাবার খাই মনি লালের ঘরে। শীতের রাতে বিলের মাঝে তাঁবুতে ঘুমানোর অভিজ্ঞতা দারুণ। অবশ্য এর আগেও উপকূলের চরে বা হাওরের বিলে তাঁবুতে ঘুমিয়েছি। এ ছাড়া দেশের বাইরে ভুটানেও পাখি দেখতে গিয়ে বনের মাঝে তাঁবুতে ঘুমানোর অভিজ্ঞতা আছে।
পরের দিন খুব সকালে আবার প্রবেশ করি বিলে। মাটির পথ ধরে ঝোপঝাড়-গাছগাছালি পেরিয়ে আসি এক কিলোমিটার দূরের পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে নানা প্রজাতির পাখি দেখে টাওয়ার থেকে নামি। এরপর বিলের একেবারে কিনার ধরে হাঁটি। সকাল হওয়াতে কোনো দর্শনার্থী নেই। বিলের কিনারে হেঁটে হেঁটে আরও কাছ থেকে আরও কিছু পাখি দেখি। সেই সঙ্গে দেখি শাপলা, পদ্ম, কচুরিপানাসহ বিভিন্ন বুনোফুল এবং প্রচুর ফড়িংয়ের ওড়াওড়ি। হেঁটে আসি বিলের অন্য টাওয়ারের কাছে। তবে টাওয়ারে উঠিনি। অবশ্য এর আগে এ বিলে যখন পাখি দেখতে আসি তখন এ টাওয়ারে উঠেছি। ২০০৬ সালে নির্মাণ করা এ টাওয়ারে ওঠার জন্য দর্শনার্থী ফি প্রতিজন ২০ টাকা। চারতলা সমান এ টাওয়ারের তৃতীয় ও চতুর্থ তলার গ্যালারিতে সাজানো আছে বাইক্কাবিলে বসবাস করা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, জলজ উদ্ভিদ ও পাখির ছবিসহ বর্ণনা। দর্শনার্থীদের বিল সম্পর্কে ধারণা দিতেই এ ব্যবস্থা।
দুদিনে এ বিলে যেসব পাখি দেখি, এর মধ্যে আছে বাচাল নলফুটকি, বেগুনি কালেম, নেউ পিপি, পাতি পানমুরগি, গয়ার, বড় পানকৌড়ি, ছোট পানকৌড়ি, খুদে বক, ধুপনি বক, লালচে বক, চিনা কানিবক, ছোট বগা, বড় বগা, গো বগা, ছোট ডুবুরি, এশীয় শামখোল, পাতি শরালি, উত্তরে খুন্তেহাঁস, পাতি তিলিহাঁস, পিয়াং হাঁস, গিরিয়া হাঁস, ধলা বালিহাঁস, মরচে রং ভুতিহাঁস, পাতি কুট, কালামাথা কাস্তেচরা, খয়রা কাস্তেচরা, মেটেমাথা টিটি, বন বাটান, বাংলা রাঙাচ্যাগা, শঙ্খ চিল, ভুবন চিল, পাকরা কাপাসি, ইউরেশীয় কণ্ঠীঘুঘু, তিলা ঘুঘু, পাতি চোখগ্যালো, করুণ পাপিয়া, বাংলা কুবো, পাতি-আবাবিল, পাতি হুদহুদ, পাতি মাছরাঙা, ধলাগলা মাছরাঙা, মাছমুরাল, বাতাবি কাঠকুড়ালি, বাংলা কাঠঠোকরা, কালামাথা বেনেবউ, কালা ফিঙে, ল্যাঞ্জা লাটোরা, খয়রা লাটোরা, পাকরা শালিক, খয়রালেজ কাঠশালিক, ভাত শালিক, ঝুঁটি শালিক, দাঁড় কাক, বাংলা বুলবুল, বন ছাতারে, উদয়ী দোয়েল, পাতি টুনটুনি, দাগি ঘাসপাখি, তাইগা চুটকি, ধানি ফুটকি, মোটাঠোঁট ফুটকি, ব্লাইদের নলফুটকি, কালচৈ ফুটকি, ধানি তুলিকা।
১০টায় বিল থেকে বের হই। নাশতা করি মনি লালের ঘরে। এরপর তাঁবু গুছিয়ে রওনা হই মাধবকুণ্ডের উদ্দেশে। পথে মাথিউরা চা বাগানের মাঝে খাই রং চা। চা বাগানের মাঝে চা খাওয়ার স্বাদ সত্যিই অন্যরকম।
নোট: ঢাকা থেকে বাসে অথবা ট্রেন পারাবত, জয়ন্তিকা বা উপবন এক্সপ্রেসে শ্রীমঙ্গল। এরপর সিএনজিতে বাইক্কা বিল আসা যাবে। এ বিলের অন্যতম আকর্ষণ নানা প্রজাতির জলচর পাখি, যা শীতের সময় বেশি দেখা যায়।
ছবি :লেখক
কলি