ঢাকা ১৬ বৈশাখ ১৪৩২, মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫
English
মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২

পাখির বিলে মেছো বিড়াল

প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৪৩ পিএম
পাখির বিলে মেছো বিড়াল

বাইক্কা বিল জলাভূমি অভয়াশ্রমে আসি বিকেলের দিকে। বিলের প্রবেশমুখে মনি লালের ঘরে ব্যাগ রাখি; তিনি বিলের পাশের মাছ চাষ প্রকল্পের কেয়ারটেকার। এরপর প্রবেশ করি বিলে। বিলের প্রবেশপথেই আছে এ অভয়াশ্রমের পরিচিতিমূলক বর্ণনা; যেন দর্শনার্থীরা বিলের উদ্ভিদ ও প্রাণিজগৎ সম্পর্কে একটা ধারণা পেতে পারেন। এ ছাড়া বিলে প্রবেশ করেই দেখা মেলে কিছু নির্দেশনার সাইনবোর্ড। যেমন- বিলের পর্যবেক্ষণ টাওয়ারগুলোর অবস্থান, হাঁটার পথ, নৌকা ভ্রমণ, শব্দ না করা, বর্জ্য না ফেলা ইত্যাদি।

আমরা বিলের কিনার দিয়ে মাটির পথ ধরে হাঁটি। মূলত বিলের কিনারে হিজল, করচ, বরুন, ঢোল কলমি, গুল্মসহ নানা উদ্ভিদ বা গাছগাছালি আছে। বর্ষা মৌসুমে এসব উদ্ভিদ বা গাছগাছালির অধিকাংশসহ পুরো বিল পানিতে ডুবে থাকে। এরপর শীত মৌসুমে বিলের মাঝে কিছু পানি থাকে এবং বিলের কিনার থাকে শুকনো। আর এ কিনারেই রয়েছে বিভিন্ন গাছগাছালি, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ও দর্শনার্থীদের জন্য হেঁটে ঘুরে দেখার প্রাকৃতিক পথ বা মাটির পথ। আমরা এ প্রাকৃতিক পথ ধরেই হাঁটি। কিছুক্ষণ হাঁটার পর আসি পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে। টাওয়ারে উঠে দূরবিন দিয়ে পাখি দেখি। বিলের মাঝে নানা প্রজাতির পাখির ওড়াওড়ি দেখে ভালো লাগছে।

পাখি পর্যবেক্ষণের জন্য বিলে দুটি টাওয়ার আছে। একটি বিলের প্রবেশমুখ থেকে এক কিলোমিটার দূরে, অন্যটি বিলের প্রবেশমুখ থেকে ১০০ মিটার দূরে। আমরা আছি প্রবেশ মুখ থেকে এক কিলোমিটার দূরেরটিতে। বিলের মাঝে একাধিক উঁচু খুঁটি বা চৌকি বসানো আছে। মূলত এসব খুঁটি ঈগলের বিশ্রাম ও বাসা তৈরির জন্য করা হয়েছে।

বিলের মাঝে চমৎকার সূর্যাস্ত দেখে টাওয়ার থেকে নামি। ফেরার পথে চমক হিসেবে দেখি একটি মেছো বিড়াল। অবশ্য বেশিক্ষণ দেখার সুযোগ হয়নি। আসলে এ বিলের ঝোপঝাড়ে মেছো বিড়ালের বসবাস আছে। বিপন্নের তালিকায় থাকা এ বুনো বিড়ালের ইংরেজি নাম- ফিশিং ক্যাট। নিশাচর এ প্রাণীর অন্যতম খাবার মাছ। সেজন্য হাওরের জলাশয় বেষ্টিত এলাকায় ঝোপঝাড়ে বা প্রাকৃতিক মৎস্যকেন্দ্রের কাছে এর বেশি বসবাস। তবে এখন খুবই কম দেখা যায়। এর অন্যতম কারণ, বিড়ালটিকে আমরা ভুল করে মেছো বাঘ ভেবে ‘বাঘ’ প্রজাতির হিংস্র প্রাণী মনে করে মেরে ফেলি। এ ছাড়া হাওরাঞ্চলের প্রাকৃতিক জলাভূমি ও ঝোপঝাড় পরিষ্কার বা বিল ভরাট করে কৃত্রিম মাছের খামার বা অন্য চাষাবাদ বা বসবাস করার ফলেও বিড়ালটি তার খাদ্য ও আবাসস্থল হারাচ্ছে। আবার এরা খাদ্যের খোঁজে লোকালয়ে চলে এলেও মানুষের হাতে মারা পড়ে। সব মিলিয়ে বিড়ালটি হারিয়ে যাচ্ছে।

মাছ এ বিড়ালের প্রধান খাবার হলেও শামুক, ঝিনুক বা ছোট স্তন্যপ্রাণীও খায়। একটু নীরব ও রাগী প্রকৃতির এ বিড়াল ভালো সাঁতার জানে। মোটাসোটা এ বিড়ালের পা খাটো। মাথা দীর্ঘ ও লেজ ছোট। শরীর গাঢ় ধূসর দাগ ও ডোরার সমন্বয়ে সজ্জিত। লোম মোটা এবং স্পষ্ট কালো দাগসহ হালকা বাদামি ধূসর। মার্চ থেকে জুন এদের প্রজননকাল। বিপন্ন এ বিড়ালকে বাঁচাতে এ বিলে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে গবেষণা চলছে। শুধু মেছো বিড়াল নয়, এ বিলের পাখি, মাছ বা অন্য জলজ উদ্ভিদ বা প্রাণী নিয়েও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে একাধিক গবেষণা কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

মূলত, হাইল হাওর বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি জলাভূমি। বর্ষার সময় এ হাওরের জলায়তন প্রায় ১৪ হাজার হেক্টরজুড়ে বিস্তৃত হয়। শুষ্ক মৌসুমে এসে দাঁড়ায় ৪ হাজার হেক্টরের কম। এ হাইল হাওরের মাছ, পাখি, জলজ উদ্ভিদ বা অন্যান্য প্রাণী সংরক্ষণ ও প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যেই ভূমি মন্ত্রণালয় ২০০৩ সালে বাইক্কা বিলকে স্থায়ী অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করে। এ অভয়াশ্রম চামরা, মাগুরা, জাদুরিয়া বিল ও এর আশপাশের জলাভূমির সমন্বয়ে গঠিত, যা একত্রে ‘বাইক্কা বিল’ নামে পরিচিত। বিলটির আয়তন প্রায় ১৭০ হেক্টর। এ বিল নানা প্রজাতির মাছ, পাখি, জলজ উদ্ভিদ, মেছো বিড়াল, বন বিড়াল, শেয়াল, বেজিসহ বিভিন্ন প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল।

বিলটির মাঝে সারা বছরই পানি থাকে। আর এ জলাবিল চিতল, রাম টেংরা, শোল বা চ্যানা, শাল বাইম, তেলচিটা পাথরচাটা, কাকিলা, বর্মী পুইয়া বা গুতুম, টাকি, করিকা পুইয়া, বটিয়া পুইয়া, আনন পুইয়া, চ্যাং, শিং, কৈ, পাঙাশ, গুচি বাইম, হলদে ডোরা তারা বাইম, বোয়াল, মহাশোল, রানীমাছ, টেরি পুঁটি, নারকেলি চেলা, জেব্রা, মোরারি, এলাং, ঘনিয়া, ঢেলা, দারকিনা, আইড়, মেনি, ফলি, পাবদাসহ ৯৮ প্রজাতির মাছের নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র বা ‘মাতৃ মৎস্যভাণ্ডার’। এসব মাছ এখানে বংশবৃদ্ধি করে, যা পুরো হাওরে ছড়িয়ে পড়ে।

বিলটির অন্যতম আকর্ষণ নানা প্রজাতির পাখি। বিশেষ করে এ বিল ১৭০ প্রজাতির জলচর পাখির নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে বিবেচিত। ফলে বিলটি আন্তর্জাতিকভাবেও বিশেষ পরিচিত। এজন্য এ বিলের পাখি নিয়ে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান-সংগঠন নিয়মিত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব (বিবিসি) প্রতি শীতে পাখিশুমারি, পাখির পায়ে রিং পরানোসহ নানা কার্যক্রম করে থাকে। এ ছাড়া গবেষণার অংশ হিসেবে বিলের যাদুরিয়া প্রান্তে পাখির জন্য ৩০টি কৃত্রিম বাসা তৈরি করা হয়েছে। এসব বাসায় অনেক পাখি বাসা তৈরি করে বসবাস করছে।

দেশি-বিদেশি সংস্থার সহযোগিতায় বর্তমানে অভয়াশ্রমটি সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে বড়গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থপনা সংগঠন। আর সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের লক্ষ্যে বিলটিতে প্রবেশের জন্য প্রতিজন দর্শনার্থীর কাছ থেকে পাঁচ টাকা ফি নেওয়া হয়। পাশাপাশি দর্শনার্থীদের জন্য বিলটিতে দুটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণসহ বিভিন্ন সুবিধা প্রদানেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। মূলত শীতের সময় পাখি দেখার জন্যই দর্শনার্থীরা এখানে বেশি আসেন।

বিলের জলাভূমিতে দর্শনার্থীদের জন্য নৌকা ভ্রমণেরও ব্যবস্থা আছে। নৌকা ভাড়া নেওয়া যাবে ঘণ্টা হিসাবে। এ ছাড়া পদ্মফুলের জন্য এ জলাভূমি বেশ পরিচিত। নৌকায় ঘুরলে এসব ফুল দেখা যাবে খুব কাছ থেকে। কেবল পদ্মফুল নয়, শাপলা, হিজল-করচ, ফোকল, সিংড়া, পানিকলা, ওকল, ঢোল কলমী, কচুরিপানাসহ নানা জলজ উদ্ভিদে ভরপুর এ বিল।

সন্ধ্যার পর বিলের প্রবেশ মুখের মাছচাষ প্রকল্পের পাশে তাঁবু ফেলি। একটাতে সফিক ভাই, অন্যটিতে আমি আর ফেরদৌস ভাই। রাতের খাবার খাই মনি লালের ঘরে। শীতের রাতে বিলের মাঝে তাঁবুতে ঘুমানোর অভিজ্ঞতা দারুণ। অবশ্য এর আগেও উপকূলের চরে বা হাওরের বিলে তাঁবুতে ঘুমিয়েছি। এ ছাড়া দেশের বাইরে ভুটানেও পাখি দেখতে গিয়ে বনের মাঝে তাঁবুতে ঘুমানোর অভিজ্ঞতা আছে।

পরের দিন খুব সকালে আবার প্রবেশ করি বিলে। মাটির পথ ধরে ঝোপঝাড়-গাছগাছালি পেরিয়ে আসি এক কিলোমিটার দূরের পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে নানা প্রজাতির পাখি দেখে টাওয়ার থেকে নামি। এরপর বিলের একেবারে কিনার ধরে হাঁটি। সকাল হওয়াতে কোনো দর্শনার্থী নেই। বিলের কিনারে হেঁটে হেঁটে আরও কাছ থেকে আরও কিছু পাখি দেখি। সেই সঙ্গে দেখি শাপলা, পদ্ম, কচুরিপানাসহ বিভিন্ন বুনোফুল এবং প্রচুর ফড়িংয়ের ওড়াওড়ি। হেঁটে আসি বিলের অন্য টাওয়ারের কাছে। তবে টাওয়ারে উঠিনি। অবশ্য এর আগে এ বিলে যখন পাখি দেখতে আসি তখন এ টাওয়ারে উঠেছি। ২০০৬ সালে নির্মাণ করা এ টাওয়ারে ওঠার জন্য দর্শনার্থী ফি প্রতিজন ২০ টাকা। চারতলা সমান এ টাওয়ারের তৃতীয় ও চতুর্থ তলার গ্যালারিতে সাজানো আছে বাইক্কাবিলে বসবাস করা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, জলজ উদ্ভিদ ও পাখির ছবিসহ বর্ণনা। দর্শনার্থীদের বিল সম্পর্কে ধারণা দিতেই এ ব্যবস্থা।

দুদিনে এ বিলে যেসব পাখি দেখি, এর মধ্যে আছে বাচাল নলফুটকি, বেগুনি কালেম, নেউ পিপি, পাতি পানমুরগি, গয়ার, বড় পানকৌড়ি, ছোট পানকৌড়ি, খুদে বক, ধুপনি বক, লালচে বক, চিনা কানিবক, ছোট বগা, বড় বগা, গো বগা, ছোট ডুবুরি, এশীয় শামখোল, পাতি শরালি, উত্তরে খুন্তেহাঁস, পাতি তিলিহাঁস, পিয়াং হাঁস, গিরিয়া হাঁস, ধলা বালিহাঁস, মরচে রং ভুতিহাঁস, পাতি কুট, কালামাথা কাস্তেচরা, খয়রা কাস্তেচরা, মেটেমাথা টিটি, বন বাটান, বাংলা রাঙাচ্যাগা, শঙ্খ চিল, ভুবন চিল, পাকরা কাপাসি, ইউরেশীয় কণ্ঠীঘুঘু, তিলা ঘুঘু, পাতি চোখগ্যালো, করুণ পাপিয়া, বাংলা কুবো, পাতি-আবাবিল, পাতি হুদহুদ, পাতি মাছরাঙা, ধলাগলা মাছরাঙা, মাছমুরাল, বাতাবি কাঠকুড়ালি, বাংলা কাঠঠোকরা, কালামাথা বেনেবউ, কালা ফিঙে, ল্যাঞ্জা লাটোরা, খয়রা লাটোরা, পাকরা শালিক, খয়রালেজ কাঠশালিক, ভাত শালিক, ঝুঁটি শালিক, দাঁড় কাক, বাংলা বুলবুল, বন ছাতারে, উদয়ী দোয়েল, পাতি টুনটুনি, দাগি ঘাসপাখি, তাইগা চুটকি, ধানি ফুটকি, মোটাঠোঁট ফুটকি, ব্লাইদের নলফুটকি, কালচৈ ফুটকি, ধানি তুলিকা।

১০টায় বিল থেকে বের হই। নাশতা করি মনি লালের ঘরে। এরপর তাঁবু গুছিয়ে রওনা হই মাধবকুণ্ডের উদ্দেশে। পথে মাথিউরা চা বাগানের মাঝে খাই রং চা। চা বাগানের মাঝে চা খাওয়ার স্বাদ সত্যিই অন্যরকম।

নোট: ঢাকা থেকে বাসে অথবা ট্রেন পারাবত, জয়ন্তিকা বা উপবন এক্সপ্রেসে শ্রীমঙ্গল। এরপর সিএনজিতে বাইক্কা বিল আসা যাবে। এ বিলের অন্যতম আকর্ষণ নানা প্রজাতির জলচর পাখি, যা শীতের সময় বেশি দেখা যায়।

ছবি :লেখক

কলি 

বৃন্দাবন চা-বাগানে

প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ০২:০৮ পিএম
বৃন্দাবন চা-বাগানে
চা পাতা তুলছেন নাম না জানা এক কর্মী

চা-বাগানে রয়েছে বিচিত্র সৌন্দর্য। শহুরে জীবনের অভ্যস্থতায় সে সৌন্দর্য অনেকেরই অদেখা। দিগন্ত প্রসারিত বিশাল একটি উপত্যকা ঘিরে ঘন সবুজ চা-গাছের কুয়াশায় মিলিয়ে যাওয়ার সারি, তা অপরূপ সৌন্দর্যেরই জানান দেয়। এই দৃশ্যটির জন্ম সকাল ঘিরেই। গত বছর শীতে আমরা গিয়েছিলাম  হবিগঞ্জ জেলার অন্যতম সুন্দর জায়গা বৃন্দাবন চা-বাগানে। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যদেবের কিরণ উঁকি দিচ্ছিল চা-বাগানের পথে পথে। আমি আর আমার ভ্রমণসঙ্গী এগিয়ে চলছি। গতকাল ভ্রমণের নিমিত্তে এসেছি হবিগঞ্জ শহরে।

ছোট ভাই এসি ল্যান্ড শিবরাজ চৌধুরীর আতিথেয়তায় খুব ভালো সময় অতিবাহিত করছিলাম আমরা। ঘুরে বেড়াচ্ছি হবিগঞ্জের আনাচে কানাচে। চা-বাগান মানেই অপার্থিব মুগ্ধতা ছড়ানো এক অস্তিত্ব। চা-বাগান মানেই সবুজের অবারিত সৌন্দর্য। যত দূর চোখ যায় কেবল সবুজের হাতছানি। সারি সারি চা-বাগান, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ আর ঘন সবুজ অরণ্যের অপরূপ সৌন্দর্য যে কাউকেই আকৃষ্ট করে। আমরা গাড়ি থেকে নেমে পদব্রজে এগিয়ে চলছি। কিছু দূরে দেখা পেলাম ধান কেটে ফেলা জমিতে এখন শুধুই শস্যহীন শূন্যতা। কুয়াশার চাদর তার ওপর গিয়ে পড়েছে। 

ফসলহীন জমিটুকুকে ঢেকে ফেলেছে ধোঁয়ার মতো করে। কিংবদন্তি অনুসারে চা প্রথম আবিষ্কার করেন চীনা সম্রাট শেন নাং, খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩৭ সালে। ওই সময় তার গরম পানির পাত্রে বুনো গাছের কিছু পাতা পড়ে, তিনি যেটি পান করলেন সেটাই চা। পৃথিবীতে কত জাতের চা আছে শুনলে চমকে উঠবেন। সংখ্যাটা আনুমানিক ৩ হাজার। পানি বাদ দিলে চা হলো পৃথিবীতে বেশি পান করা পানীয়।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি চা-বাগান আছে মৌলভীবাজারে। জেলার শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ, কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা ও রাজনগরে অনেক চা-বাগান দেখতে পাওয়া যায়। সিলেট ও হবিগঞ্জ জেলায়ও চমৎকার ও ঐতিহ্যবাহী কিছু চা-বাগান আছে। দেশের প্রথম চা-বাগান মালনীছড়ার অবস্থান সিলেট শহরেই। ব্ল্যাক টি, গ্রিন টি, হোয়াইট টি, ওলং টি- সব ধরনের চা আসে ক্যামেলিয়া সিনেসিস নামের উদ্ভিদ থেকে। তাদের স্বাদ, চেহারা আর গন্ধে ভিন্নতার কারণ প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রক্রিয়ায় ভিন্নতা। আমাদের দেশের অনেক চা-বাগানই তৈরি হয়েছে পাহাড়ের মাঝে, জঙ্গল সাফ করে।

চা-বাগানলাগোয়া জঙ্গলও আগে ছিল অনেক বেশি। কোনো কোনো চা-বাগানের নিজস্ব জঙ্গলের কথাও শুনেছি। একসময় চা-বাগানগুলো তাই ছিল চিতা, বাঘসহ নানা বুনো প্রাণীর আড্ডাখানা। আমাদের চা-বাগানে আর চিতা বাঘের খোঁজ না মিললেও পাশের দেশের চা-বাগানে এখনো অদ্ভুত সুন্দর এই প্রাণীর বেশ আনাগোনা আছে। চলতি পথে  হঠাৎ দেখতে পেলাম, সেই কুয়াশাঘেরা মাঠের পথটুকু পাড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন এক বৃদ্ধা গ্রামীণ নারী। এই সকালে ফাঁড়িপথের উল্লেখযোগ্য চরিত্র হয়ে তার এটাই প্রভাতী আগমন। উনি বললেন, বাবু এই পথ দিয়ে আরেকটু সামনে এগোলে আরও সুন্দর চা-বাগানের দৃশ্য দেখা পাবেন। প্রায় ৫০ মিনিটের ভ্রমণগতি ডিঙিয়ে অবশেষে চা-বাগানের একটি কোণে অবস্থান নেওয়া গেল। দুই দিকে দুরকম চায়ের অবস্থান। পুবদিকে চোখ ফেরাতেই দেখা গেল, ডানদিকে সবুজেঘেরা এবং কুয়াশা জড়ানো চা-গাছের সারি।

আর বামদিক প্রুনিং করা (মাথা ছাঁটাই) করা চা-গাছের দলগত অবস্থান। এরই ভেতর ঘন সবুজ চা-গাছের রাজ্যের মাঝে দারুণ মুগ্ধতাটুকু নিয়ে মাথা তুলেছে ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’। সব চা-গাছ থেকে আলাদা হয়ে সে একাই যেন ঘোষণা দিচ্ছে তার এই উন্নত উত্থিত শিরের কথা। আমরা এগিয়ে চলছি চা-বাগানের পথে-প্রান্তরে। দেখা পেলাম সমভূমিতে উৎপাদিত লাল শাক, শিম, টমেটো খেত থেকে তুলে নিয়ে আসছেন একজন প্রান্তিক চাষি। আমরা উনার কাছ থেকে কিনে নিলাম টাটকা সবজি। আমাদের ভ্রমণসঙ্গী শিবরাজ চৌধুরী বলছিল, সাধারণত ব্ল্যাক টি বাজারে বেশি পাওয়া যায়। কারণ এর দাম নাগালের মধ্যে। হালে কিছু কিছু চা-বাগানে গ্রিন টি বা সবুজ চা উৎপাদন হচ্ছে। সীমিত উৎপাদন ও ক্রেতা কম হওয়ায় বাজারে এর দাম বেশি।

এই বৃন্দাবন চা-বাগানে প্রথমবারের মতো উৎপাদিত হয়েছে হোয়াইট টি বা সাদা চা। নাম শুনলে মনে হতে পারে এটিও সাধারণ চায়ের মতো। রং হয়তো সাদা। আসলে তেমন নয়। এটা বরং দেখতে অনেকটা ছোট আকারের লইট্যা শুঁটকির মতো। আমরা যে মানের চা পান করে থাকি তার চেয়ে বহু গুণ উপকারী হোয়াইট টি। দামও বেশ চড়া। হোয়াইট টি বা সাদা চা-বাগানের সবচেয়ে কচি পাতা থেকে তৈরি হয়। মেশিনের পরিবর্তে হাতে কেটে এগুলো শুকাতে হয়, অত্যন্ত যত্নসহকারে। যার কারণে এটি সবচেয়ে ব্যয়বহুল চা হিসেবে পরিচিত।

সম্প্রতি শ্রীমঙ্গল চা নিলামকেন্দ্রে হবিগঞ্জের বৃন্দাবন চা-বাগানের ‘হোয়াইট টি’ বা সাদা চা কেজিপ্রতি ৫ হাজার ১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। হোয়াইট টি তৈরির প্রক্রিয়া বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ। সাধারণ চা (ব্ল্যাক টি) যেখানে ১২ ঘণ্টায় তৈরি সম্ভব সেখানে এর সময় লাগে কমপক্ষে ৭২ ঘণ্টা। ৫ কেজি কুঁড়ি চা পাতায় ১ কেজি হোয়াইট টি হয়ে থাকে। বহির্বিশ্বে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

হোয়াইট টি গরম পানিতে ছাড়ার কিছুক্ষণ পর পানি ও শুকনো পাতার রং সবুজ হয়ে যায়। এই চা ক্যানসার প্রতিরোধক ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। সময়ের ধারাপাতে চলে আসার সময় হয়ে এল। পেছনে চোখ মেলে তাকাতেই দেখা যায়, দূরে হারিয়ে যাওয়া চা-গাছের দুই রকম সৌন্দর্য। একদিকে সবুজে সবুজময়। অন্যদিকে মাথা কাটা চা-গাছের সম্মিলিত অবস্থান। 

কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ মাধ্যম হলো সিলেটগামী যেকোনো বাসে মাধবপুর মুক্তিযোদ্ধা চত্বরে নেমে সেখান থেকে বাস কিংবা ম্যাক্সিতে বৃন্দাবন চা-বাগান। এ ছাড়া ঢাকা থেকে রেল ও সড়কপথে হবিগঞ্জ গিয়ে সেখান থেকেও বৃন্দাবন চা-বাগানে যাওয়া যায়। এ ছাড়া ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে অগ্রদূত পরিবহন, দিগন্ত পরিবহন ও বিসমিল্লাহ পরিবহন সরাসরি হবিগঞ্জ যায়। 

কলি

 

নেপালে একদিন

প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ০২:৫৫ পিএম
নেপালে একদিন
ছবি: সুমন্ত গুপ্ত

অন্য সবার মতো আমিও নতুন বছরের শুরুতেই ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে যে কাজটা সবার আগে করি, তা হলো কোন মাসে কত দিন ছুটি- খুঁজে দেখা। ভ্রমণ নেশা হলেও পেশা হচ্ছে ব্যাংকে চাকরি। তাই চাইলেই ছুটি পাওয়া যায় না। অনেক কষ্ট করে যোগ-বিয়োগের পর হিসাব মেলাতে হয় ছুটির। নেপাল দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সুন্দর ও ঐতিহ্যবাহী দেশ।

এটি পর্বতশ্রেণি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশি পর্যটকদের মধ্যে নেপাল ভ্রমণের জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সহজ ভিসাব্যবস্থা, কম খরচে ভ্রমণের সুযোগ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মিল এবং অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ- এসব কারণ নেপালকে বাংলাদেশের ভ্রমণপিপাসুদের কাছে আকর্ষণীয় গন্তব্য করে তুলেছে। অনেক দিন ধরে পরিকল্পনা করছিলাম হিমালয়কন্যা নেপালে ঘুরে আসার।

কিন্তু ব্যাটে-বলে মিলছিল না। গত বছরের শেষে হঠাৎ করে আমন্ত্রণ পেলাম নেপালে-বাংলাদেশ ইয়ুথ কনক্লেভের অনুষ্ঠানের। কষ্ট করে অফিস থেকে নিয়ে নিলাম ছুটি। ঘড়ির কাঁটায় ভোর ৫টা, মোবাইলে বেজে উঠল অ্যালার্ম। সাড়ে ৬টার ভেতরে পৌঁছাতে হবে বিমানবন্দরে। বিমানবন্দরে এসে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। প্রতিটি গেটে মানুষের দীর্ঘ লাইন। কোন দিক দিয়ে ঢুকব তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এর মাঝে একজন এসে বলল, তিনি ভেতরে প্রবেশ করিয়ে দেবেন। তাকে দিতে হবে ৫০০ টাকা। আমি বললাম ৩০০ টাকা। নাম না জানা লোকটি রাজি হয়ে গেলেন আমাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দিতে। আমি মনে মনে ভাবলাম দীর্ঘ সময় লাইনে না দাঁড়িয়ে দিলাম ৩০০ টাকা। আর সময়ও কমে এসেছিল, ইমিগ্রেশনের কাজও শেষ করতে হবে। আমরা প্রবেশ করলাম বিমানবন্দরে বোর্ডিং পাস নিয়ে চলে গেলাম ইমিগ্রেশনে।

এবার অপেক্ষার পালা বিমানে ওঠার। নির্ধারিত সময়ে আমাদের বিমান উড়াল দিল হিমালয়কন্যার পানে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিমানের জানালা দিয়ে হিমালয়ের অপূর্ব দৃশ্য নয়নভরে দেখছি। চেষ্টা করছি মোবাইলের ফ্রেমে বন্দি করে রাখতে। আগে নানাভাবে হিমালয় দেখেছি। প্রতিটি পাহাড়চূড়ার দৃশ্যই হৃদয়ে লেগে থাকার মতো। পাখির চোখে হিমালয়ের দৃশ্য দেখে আমি অভিভূত। এত সুন্দর হিমালয়ের রূপ, চোখের পাতা পড়ছিল না। নভেম্বরের শুরুর দিকে বরফ জমাট বাঁধতে শুরু করে।

তাই এ সময়টা কোথাও সাদা বরফে ঢাকা, কোথাও আবার বরফের চাদরে ঢেকে দেওয়ার প্রস্তুতি দেখতে পেলাম। ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা ২টা, উড়োজাহাজে চেপে আমরা এসে পৌঁছালাম হিমালয়কন্যার দেশ নেপালে, বাংলাদেশ ইয়ুথ কনক্লেভের অনুষ্ঠানে। কাঠমান্ডুতে বিমানবন্দরে  আমাদের বরণ করে নিলেন নেপাল-বাংলাদেশ ইয়ুথ কনক্লেভ অনুষ্ঠানের প্রধান সমন্বয়ক অভিনব দাদা। বিমানবন্দরে মোবাইলের সিম কিনে আর ডলার ভাঙিয়ে আমরা সোজা চলে গেলাম স্বয়ম্ভুনাথ মন্দির পানে। ঢাকা শহরের মতো যানজট পেরিয়ে আমরা চলছি এগিয়ে। কাঠমান্ডুর শীতল হাওয়া বেশ উপভোগ্য। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরা এসে উপস্থিত হলাম স্বয়ম্ভুনাথ মন্দিরের প্রবেশদ্বারে, যা বানরমন্দির নামেও পরিচিত। এই মন্দিরটি নেপালের প্রাচীনতম মন্দিরগুলোর একটি। নেপালের কাঠমান্ডুকে বলা হয় মন্দিরের শহর। এখানকার মন্দিরের স্থাপত্যের খ্যাতি জগৎজোড়া। মধ্যযুগীয় সময়ে শহরটিকে কখনো কখনো ‘কান্তিপুর’ নামেও ডাকা হয়েছে।

কাঠমান্ডু উপত্যকার শম্ভুনাথ পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত স্বয়ম্ভুনাথ মন্দির। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের কাছেও এটি অত্যন্ত পবিত্র স্থান। পঞ্চম শতকের শুরুর দিকে এর অস্তিত্ব আবিষ্কার হয়। আশার কথা হচ্ছে, ২০১৫ সালের ভূমিকম্প উল্লেখ করার মতো কোনো ক্ষতিই করতে পারেনি এ স্থানটির। ধারণা করা হয়, এগুলো লিচাভি যুগে তৈরি হয়েছিল। সম্প্রতি এখানে একটি তিব্বতি বিহার, জাদুঘর ও গ্রন্থাগার সংযোজন হয়েছে। বলছিলেন অভিনব দাদা। টিকিট কেটে সিঁড়ি বেঁয়ে প্রবেশ করলাম মন্দিরে। পদব্রজে আমরা এগিয়ে চলছি  দর্শনের নিমিত্তে। হাতের বাঁ পাশে দেখতে পেলাম একটি গোল জলাধারে দাঁড়িয়ে আছেন বুদ্ধ। অনেকেই দেখলাম যার যার মনস্কামনা করে ওই জলাধারে কয়েন ছড়িয়ে দিতে।পাশেই আছে ঝরনাধারা। এখানে বসে আছেন গৌতম বুদ্ধ।

এখানে বানরের বেশ আধিক্য দেখলাম। বলা চলে বানরের সাম্রাজ্য। তবে কোনো বিরক্ত করছে না দর্শনার্থীদের। মূল প্রাঙ্গণে যাওয়ার জন্য দুটি পথ আছে। আমরা বাঁ দিকের সিঁড়ি পথ ধরে এগোতে লাগলাম। হিমেল হাওয়ার ছোঁয়া যাত্রার ক্লান্তি দূর করে দিচ্ছিল। আশপাশের দোকানগুলোতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মতো নানা সামগ্রী। ছোট ছোট দোকানঘর। হরেক রকম পসরা সাজানো। বেশির ভাগ হস্তশিল্পের জিনিস। পিতলের, তামার। পাথর, মাটি, শোলা, কাঠ বিভিন্ন সহজলভ্য উপাদানেই তৈরি এসব। হাতের নিখুঁত কারুকাজ, রঙের ছটা, তুলির আঁচড়, ঢালাইয়ের পেটা কাজ প্রভৃতির মিশ্রণে বিভিন্নভাবে শিল্প সৃষ্টি হয়েছে। একটি দোকানের পসরায় আমার চোখ আটকালো। ছোট ছোট নীলাভ পাথরকুচি বসিয়ে মেটালে তৈরি পদ্মাসন বুদ্ধদেবের অবয়বকে আরও মোহনীয় করে উপস্থাপন করা হয়েছে। দোকানটির বেশির ভাগ ঘরের সৌন্দর্যবর্ধনসামগ্রী এ রকম পাথর বসিয়ে তৈরি করা।

অনেকটা ম্যুরালের শিল্পমাধ্যমের মতো। আমরা এগিয়ে চলছি। গুনে গুনে ৩৬৫টি পাথরের তৈরি সিঁড়ি পাড়ি দিয়ে পৌঁছালাম মূল প্রাঙ্গণে। নেপালের গোপাল রাজার বংশাবলি অনুযায়ী লিচ্চবি রাজা মানদেব (৪৬৪-৫০৫ খ্রি.)-এর দাদা রাজা ভ্রসাদেব পঞ্চম শতাব্দীতে এই স্তূপা নির্মাণ করেন। বলা হয় সম্রাট অশোক তৃতীয় শতাব্দীতে এখানে সফর করে একটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন, যা পরবর্তীতে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। নির্মাণের ১৫০০ বছর পর এটি পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল, ১৯২১ সালে এই প্যাগোডার ব্যাপক সংস্কার করা হয়েছিল, আর ২০১০ সালেও এই স্তূপা সংস্কার হয়েছিল। ২০০৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার তিব্বতি নিংগমা মেডিটেশন সেন্টারের প্রদত্ত আর্থিক অনুদানে তখন স্বয়ম্ভুনাথ স্তূপায় ২০ কেজি স্বর্ণ দিয়ে গম্বুজের সোনালি দ্যুতি প্রদান করা হয়েছিল। ১৯৭৯ সালে এটি ইউনেসকোর বিশ্বঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

আমরা চলে এলাম মূলমন্দির প্রাঙ্গণে। চারপাশের আগরবাতির মোহনীয় গন্ধ আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য ভুবনে। মন্দিরপ্রাঙ্গণ থেকে পুরো কাঠমান্ডু শহর দেখা যায়। প্রাঙ্গণের কোথাও কোথাও সন্ন্যাসীরা আছেন ধ্যানে মগ্ন। আমরা চারপাশে ঘুরে দেখতে লাগলাম। সেই সকালবেলা বের হয়েছি বাসা থেকে। তার পর থেকে একটু সময়ের জন্য বিশ্রাম নিতে পারিনি। তার পরও আমাদের কারোর মধ্যে নেই কোনো ক্লান্তির ছাপ। স্তূপার চতুর্পাশ পৃথিবীর পাঁচটি মৌলিক উপাদানে পৃথিবী, বায়ু, জল, অগ্নি ও আকাশের রূপকে গড়ে তোলা হয়েছে। প্রচলিত আছে যে, এই মন্দিরের স্থানে একটি হ্রদ ছিল, যার মাঝখানে দ্বীপের মতো প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা স্ফটিকের স্তূপ ছিল। গৌতম বুদ্ধ আসার পর এ স্তূপ দেখে ভাবেন, এই দ্বীপ মানুষকে আলোকিত করতে পারে। অবতার মঞ্জুশ্রী এই হ্রদের পানি সরিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে মানুষ এই ‘স্তূপা’য় আসতে পারে। সেই হ্রদই হচ্ছে কাঠমান্ডু উপত্যকা। সেখানে ভেসে থাকা পদ্ম পাহাড়ে পরিণত হয় আর ফুল হয়ে যায় স্তূপা।

দেখার সময়
মন্দির সপ্তাহে সাত দিন ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে বহু পুণ্যার্থী দর্শনার্থী আসেন। শুধু ঝড় বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে মন্দির খুলবে না। তদুপরি, স্বয়ম্ভুনাথ সারা বছর খোলা থাকে। আপনি যে কোনো সময় আসতে পারেন। চমৎকার পরিবেশ দেখতে খুব ভোরে যাওয়া ভালো। এ ছাড়া আপনি বৌদ্ধ মন্ত্র শোনার সময় একটি দুর্দান্ত সন্ধ্যার পরিবেশ উপভোগ করতে পারেন।
 
প্রবেশ ফি
এই মন্দিরটি সব জাতি এবং ধর্মের দর্শনার্থীদের স্বাগত জানায়। এই মন্দির দর্শনের জন্য কোনো বাধা বা সীমাবদ্ধতা নেই। উপরন্তু, মন্দিরে প্রবেশ করার আগে আপনাকে অবশ্যই একটি ছোট প্রবেশ ফি দিতে হবে। তাছাড়া শিশু এবং গৃহস্থ ও স্থানীয় লোকজনকে প্রবেশ ফি দিতে হবে না। একইভাবে বিদেশি দর্শনার্থীরাও সামান্য পারিশ্রমিক দেন। এই অভয়ারণ্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সুবিধা হলো এখানে কোনো প্রবেশদ্বার বা অনুসন্ধানের সীমাবদ্ধতা নেই।
 
কীভাবে যাবেন
বাংলাদেশ থেকে নেপালে বিমানযোগে যাওয়া যায়। খরচ যাওয়া-আসার টিকিট নিয়ে ১৮ হাজার টাকা থেকে ২২ হাজার টাকার মতো পড়বে। আগেভাগে টিকিট কাটতে পারলে ১৭ হাজার টাকার মতো পড়ার কথা। বাই রোডে নেপাল যেতে হলে খরচ কমে যাবে অনেকটা। সে ক্ষেত্রে ভারতের ট্রানজিট ভিসা নিতে হবে। যেখানে পোর্টের নাম দিতে হবে চ্যাংড়াবান্ধা বা রানীগঞ্জ। এখানে বা বিমানে কোনোটাতেই নেপালের ইমিগ্রেশনে কোনো ভিসা ফি-র দরকার নেই, যদি-না আপনি একই বছরে দুবার ভ্রমণ করতে চান। এসআর পরিবহন সরাসরি বাই রোডে নেপালের সেবা দিচ্ছে। চাইলে ভেঙে ভেঙে ভারতের বর্ডার পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে নেপালের কাঁকড়ভিটা পর্যন্ত যেতে পারেন। এতে খরচ পড়বে প্রায় ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকার মতো।

কোথায় থাকবেন
থাকতে হলে থামেলের চেয়ে উপযুক্ত স্থান আর দ্বিতীয়টি নেই। কারণ পুরো থামেলের গলি ঘুপচিতে অসংখ্য হোটেল/ ব্যাকপ্যাকার হোস্টেল রয়েছে। ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৮০০ রুপির মধ্যে ভালো ডাবল রুমের বাজেট হোটেল এখানে পাওয়া সম্ভব। ৪০০ রুপিতে সিঙ্গেল রুমের হোটেলও এখানে আছে। বাজেট আরেকটু বেশি, যেমন- ৩ হাজার রুপি বা তার বেশি হলে ডিলাক্স রুমের খাবারসহ অনেক ভালো হোটেল পাওয়া যায়। তবে থামেলের হোটেল এবং তাদের দরদাম ও চেহারা এত বেশি বৈচিত্র্যময় যে, আগে থেকে বুকিং না দিয়ে বরং হেঁটে হেঁটে কয়েকটি হোটেল ঘুরে যাচাই-বাছাই করলে সস্তায় ভালো হোটেল পাওয়া সম্ভব।

 কলি

 

নববর্ষের ঘোরাফেরা

প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:৩৬ পিএম
নববর্ষের ঘোরাফেরা
ছবি: সংগৃহীত

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাচীন লোক উৎসব। এই দিনকে ঘিরে বিভিন্ন সময় গ্রামে-শহরে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের উৎসব। বাংলা বছরের প্রথম দিন এবং সরকারি ছুটির এই দিনটি কাটাতে পারেন সেসব উৎসবে যোগ দিয়ে। এদিন বাঙালির পরিচয় ও ইতিহাস সংবলিত বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনাও মন্দ নয়। 

রমনার বটমূল
রমনা পার্কের বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ বাঙালি নববর্ষের প্রাণের অনুষ্ঠান। ১৯৬৭ সালে শুরু হওয়া এই সাংস্কৃতিক আয়োজনই ছিল বড় পরিসরে জনসমাগম করে নববর্ষ পালনের প্রথম অনুষ্ঠান। এরপর থেকে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে জড়ো হয় শিশু-বুড়ো, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ। চেনা-অচেনা বাঙালি একে অপরকে জানায় নতুন বছরের শুভেচ্ছা। রবীন্দ্র, নজরুল, লোকগান আর নৃত্যে মেতে ওঠে সবাই। মুক্তিযুদ্ধের আগে বটমূলের এই বর্ষবরণই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি রক্ষণশীল শাসকের বিরুদ্ধে বাঙালির আত্মপরিচয়, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির ভাষা। তাই বছরের প্রথম দিনের সকালে পরিবারের ছোট সদস্যদের নিয়ে চলে যেতে পারেন বটমূলের উৎসবে।

চারুকলা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রতি বছর নববর্ষকে ঘিরে আয়োজন করে মঙ্গল শোভাযাত্রা। পুরোনো বছরের গ্লানি ভুলে সুন্দরের প্রত্যাশায় এই শৈল্পিক শোভাযাত্রায় অংশ নেয় নারী-পুরুষ, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ। মঙ্গল শোভাযাত্রার এই আয়োজনকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেসকো। নববর্ষের সকালে বৈশাখী সাজপোশাকে চলে যেতে পারেন চারুকলা প্রাঙ্গণে। ফেস্টুন, মুখোশ হাতে অংশ নিতে পারেন শোভাযাত্রায়। এ ছাড়া এদিন চারুকলা প্রাঙ্গণ থাকে উৎসবমুখর। তার আগের দিন চৈত্র সংক্রান্তি ও বৈশাখের প্রথম দিন যাত্রার আয়োজন হয়ে থাকে চারুকলায়।

টিএসসি চত্বর
যেকোনো সাধারণ সময়েই জমজমাট থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বর। পহেলা বৈশাখে বাঙালিয়ানা সাজে মানুষের সমাগমে টিএসসি হয়ে উঠে উৎসবের প্রাণকেন্দ্র। নববর্ষকে ঘিরে কনসার্ট, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলপনা আঁকা, বাহারি নানা জিনিস ও খাবারের পসরা বসে এই এলাকায়।

শিল্পকলা একাডেমি
শিল্পকলা একাডেমিতে দিনব্যাপী সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি, নাটক, প্রদর্শনী ও বাউলগানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। চাইলে সেখান থেকে ঘুরে আসতে পারেন। 

খনার মেলা
খনার জন্ম বাংলায় ৮০০ থেকে ১২০০ শতাব্দীর সময়। জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী খনা ছিলেন এক বিদুষী নারী। বাংলার কৃষি, ফসল, প্রকৃতি ও জীবনযাপন নিয়ে খনার রয়েছে অসংখ্য প্রবাদ প্রবচন। যা পরিচিত খনার বচন হিসেবে। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার আঙ্গারোয়ায় বাংলা বছরের শেষ দিন থেকে নববর্ষের সূর্যোদয় পর্যন্ত আয়োজন হয় ‘খনার মেলা।’ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিল্পীদের আগমনে সেখানে চলে পালাগান, বাউল গান, পুঁথি পাঠ ও নানা ধরনের গীত-বাদ্যবাজনা। সেই সঙ্গে প্রদর্শিত হয় বাংলার কৃষি উপকরণ, প্রকৃতি ও পরিবেশের কথা। এদিন শহর থেকে দূরে গ্রামীণ প্রকৃতি ও বাঙালি জীবনযাত্রার সঙ্গে মিশে যেতে চাইলে নববর্ষের আগের দিনই চলে যেতে পারেন কেন্দুয়ার আঙ্গুরোয়ায় খনার মেলায়।

সোনারগাঁও
প্রাচীন বাংলার রাজধানী ও বাণিজ্যের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র সোনারগাঁওয়ে নববর্ষের তোড়জোড় চলত পুরোনো আমল থেকেই। নববর্ষ উদযাপনের বিশেষ আমেজ এখনো খুঁজে পাবেন সেখানে। সোনারগাঁওয়ের জয়রামপুর গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় পাঁচ দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা। স্থানীয়ভাবে ১০০ বছরে পুরোনো এই মেলা বউমেলা বা বটতলার মেলা নামেও পরিচিত। এ ছাড়া সোনারগাঁও লোক ও কারুশিল্প ভবনে চলে লোকজ মেলা। সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যবাহী এসব মেলা পরিদর্শন শেষে এদিন ঘুরে আসতে পারেন প্রাচীন নগরী পানাম নগরেও।

পাহাড়ি উৎসবে
পহেলা বৈশাখ বাঙালিদের প্রাণের উৎসব। তবে মানুষে মানুষে যেমন রয়েছে বৈচিত্র্য তেমনি নববর্ষের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি এই উৎসবকে করে তুলেছে আরও রঙিন। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের কাছে নববর্ষ উদযাপন বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় বিজু, সাংগ্রাই ও বৈসাবী উৎসবের মধ্য দিয়ে পাহাড়ের পরিবেশ হয়ে ওঠে আরও জমকালো ও আনন্দমুখর। যারা পাহাড় ভালোবাসেন এবং নববর্ষের ছুটিতে দূরে কোথাও ভ্রমণ করতে চান তারা এদিনটা কাটাতে চলে যেতে পারেন বান্দরবান, রাঙামাটি এলাকায় আদিবাসী পাড়ার উৎসবে।

 কলি

নববর্ষের ঘোরাফেরা

প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:২৯ পিএম
নববর্ষের ঘোরাফেরা
ছবি: সংগৃহীত

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাচীন লোক উৎসব। এই দিনকে ঘিরে বিভিন্ন সময় গ্রামে-শহরে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের উৎসব। বাংলা বছরের প্রথম দিন এবং সরকারি ছুটির এই দিনটি কাটাতে পারেন সেসব উৎসবে যোগ দিয়ে। এদিন বাঙালির পরিচয় ও ইতিহাস সংবলিত বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনাও মন্দ নয়। 

রমনার বটমূল
রমনা পার্কের বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ বাঙালি নববর্ষের প্রাণের অনুষ্ঠান। ১৯৬৭ সালে শুরু হওয়া এই সাংস্কৃতিক আয়োজনই ছিল বড় পরিসরে জনসমাগম করে নববর্ষ পালনের প্রথম অনুষ্ঠান। এরপর থেকে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে জড়ো হয় শিশু-বুড়ো, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ। চেনা-অচেনা বাঙালি একে অপরকে জানায় নতুন বছরের শুভেচ্ছা। রবীন্দ্র, নজরুল, লোকগান আর নৃত্যে মেতে ওঠে সবাই। মুক্তিযুদ্ধের আগে বটমূলের এই বর্ষবরণই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি রক্ষণশীল শাসকের বিরুদ্ধে বাঙালির আত্মপরিচয়, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির ভাষা। তাই বছরের প্রথম দিনের সকালে পরিবারের ছোট সদস্যদের নিয়ে চলে যেতে পারেন বটমূলের উৎসবে।

চারুকলা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রতি বছর নববর্ষকে ঘিরে আয়োজন করে মঙ্গল শোভাযাত্রা। পুরোনো বছরের গ্লানি ভুলে সুন্দরের প্রত্যাশায় এই শৈল্পিক শোভাযাত্রায় অংশ নেয় নারী-পুরুষ, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ। মঙ্গল শোভাযাত্রার এই আয়োজনকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেসকো। নববর্ষের সকালে বৈশাখী সাজপোশাকে চলে যেতে পারেন চারুকলা প্রাঙ্গণে। ফেস্টুন, মুখোশ হাতে অংশ নিতে পারেন শোভাযাত্রায়। এ ছাড়া এদিন চারুকলা প্রাঙ্গণ থাকে উৎসবমুখর। তার আগের দিন চৈত্র সংক্রান্তি ও বৈশাখের প্রথম দিন যাত্রার আয়োজন হয়ে থাকে চারুকলায়।

টিএসসি চত্বর
যেকোনো সাধারণ সময়েই জমজমাট থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বর। পহেলা বৈশাখে বাঙালিয়ানা সাজে মানুষের সমাগমে টিএসসি হয়ে উঠে উৎসবের প্রাণকেন্দ্র। নববর্ষকে ঘিরে কনসার্ট, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলপনা আঁকা, বাহারি নানা জিনিস ও খাবারের পসরা বসে এই এলাকায়।

শিল্পকলা একাডেমি
শিল্পকলা একাডেমিতে দিনব্যাপী সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি, নাটক, প্রদর্শনী ও বাউলগানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। চাইলে সেখান থেকে ঘুরে আসতে পারেন। 

খনার মেলা
খনার জন্ম বাংলায় ৮০০ থেকে ১২০০ শতাব্দীর সময়। জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী খনা ছিলেন এক বিদুষী নারী। বাংলার কৃষি, ফসল, প্রকৃতি ও জীবনযাপন নিয়ে খনার রয়েছে অসংখ্য প্রবাদ প্রবচন। যা পরিচিত খনার বচন হিসেবে। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার আঙ্গারোয়ায় বাংলা বছরের শেষ দিন থেকে নববর্ষের সূর্যোদয় পর্যন্ত আয়োজন হয় ‘খনার মেলা।’ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিল্পীদের আগমনে সেখানে চলে পালাগান, বাউল গান, পুঁথি পাঠ ও নানা ধরনের গীত-বাদ্যবাজনা। সেই সঙ্গে প্রদর্শিত হয় বাংলার কৃষি উপকরণ, প্রকৃতি ও পরিবেশের কথা। এদিন শহর থেকে দূরে গ্রামীণ প্রকৃতি ও বাঙালি জীবনযাত্রার সঙ্গে মিশে যেতে চাইলে নববর্ষের আগের দিনই চলে যেতে পারেন কেন্দুয়ার আঙ্গুরোয়ায় খনার মেলায়।

সোনারগাঁও
প্রাচীন বাংলার রাজধানী ও বাণিজ্যের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র সোনারগাঁওয়ে নববর্ষের তোড়জোড় চলত পুরোনো আমল থেকেই। নববর্ষ উদযাপনের বিশেষ আমেজ এখনো খুঁজে পাবেন সেখানে। সোনারগাঁওয়ের জয়রামপুর গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় পাঁচ দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা। স্থানীয়ভাবে ১০০ বছরে পুরোনো এই মেলা বউমেলা বা বটতলার মেলা নামেও পরিচিত। এ ছাড়া সোনারগাঁও লোক ও কারুশিল্প ভবনে চলে লোকজ মেলা। সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যবাহী এসব মেলা পরিদর্শন শেষে এদিন ঘুরে আসতে পারেন প্রাচীন নগরী পানাম নগরেও।

পাহাড়ি উৎসবে
পহেলা বৈশাখ বাঙালিদের প্রাণের উৎসব। তবে মানুষে মানুষে যেমন রয়েছে বৈচিত্র্য তেমনি নববর্ষের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি এই উৎসবকে করে তুলেছে আরও রঙিন। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের কাছে নববর্ষ উদযাপন বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় বিজু, সাংগ্রাই ও বৈসাবী উৎসবের মধ্য দিয়ে পাহাড়ের পরিবেশ হয়ে ওঠে আরও জমকালো ও আনন্দমুখর। যারা পাহাড় ভালোবাসেন এবং নববর্ষের ছুটিতে দূরে কোথাও ভ্রমণ করতে চান তারা এদিনটা কাটাতে চলে যেতে পারেন বান্দরবান, রাঙামাটি এলাকায় আদিবাসী পাড়ার উৎসবে।

 কলি

চড়ক পূজার মেলায়

প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২৫, ০১:৪২ পিএম
চড়ক পূজার মেলায়
ছবি: সুমন্ত গুপ্ত

গত বছরের ১৪ এপ্রিল। ঘড়ির কাঁটায় ঠিক বিকেল ৩টা। আমরা ছুটে চলছি ঐতিহ্যবাহী চড়ক পূজা দেখতে। গন্তব্য সিলেটের লাক্কাতুরা চা-বাগান। অনেক বছর ধরে প্ল্যান করেও যাওয়া হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত ভাগ্যদেবী প্রসন্ন হলেন। আমি, সুমিত কর্মকার, মাহফুজ শহরে বৈশাখী ভিড় ঠেলে আমরা তিন চাকার পরিবহনে এগিয়ে চলছি। পথে দেখলাম প্রায় সব নারীর পরনে নতুন কাপড়, হাতে রঙিন কাচের চুড়ি। বৈশাখী সাজের মানুষগুলো জানান দিচ্ছে, দিনটা আজ বাঙালি পঞ্জিকার প্রথম দিন।

সবার মুখে নতুন প্রত্যয়ে এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা। ভোরে খুব ঝড়-বৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু এখন কড়া রোদ। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে নিরুপায় হয়ে কোমল পানীয়র ওপর নির্ভর করতে হলো আমাদের। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা চৈত্র সংক্রান্তি পালন করে পুরোনো বছরকে বিদায় দেয়। বাংলা বছরের হিসাব চলে সূর্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। এ দিন সূর্য মীন প্রতীকের মধ্যে প্রবেশ করে, দিনগুলো বড় হতে থাকে। ক্রান্তি শব্দের অর্থ কিনারা, সংক্রান্তি বলতে বোঝায় সঞ্চার বা গমন করা অর্থাৎ এক কিনারা থেকে অন্য কিনারায় গমন করা। চৈত্র সংক্রান্তি বলতে বোঝায় পুরোনো বছরের কিনারা থেকে নতুন বছরে আরোহণ। কালের ফেরে সূর্য তার সঞ্চারপথে বারবার ঘুরে আসে এবং সেই সঙ্গে পুনরায় ফিরে আসে ঋতু ও মাস। তাই পুরোনো বছরের কিনারা থেকে নতুন বছরের সূচনালগ্নে উপনীত হওয়াকেই চৈত্র সংক্রান্তি হিসেবে পালন করা হয়। চৈত্র সংক্রান্তিতেই মূলত চড়ক পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

শহরের যান্ত্রিক কোলাহল পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। চৌহাট্টা, আম্বরখানা পেরিয়ে খাসদবির পৌঁছানোর পর রোদের তেজ কিছুটা কমে এল। লাক্কাতুরা চা বাগানের কাছে আসতেই নতুন চা পাতার মায়াবী রূপ মন ভরিয়ে দিল। কিছুদূর এগোনোর পর দেখি, শত শত মানুষ সামনের দিকে ছুটে যাচ্ছে। হেঁটে, সাইকেলে, মোটরসাইকেলে, ভ্যানে—যে যার মতো ছুটছে।

মানুষের পদচারণে পুরো পথে মানবজট সৃষ্টি হয়েছে। আমরা তিন চাকার যান্ত্রিক পরিবহন ছেড়ে দিয়ে পদব্রজে রওনা হলাম। চারদিকে মানুষ আর মানুষ। রাস্তার দুই পাশে মেলা বসেছে। চটপটি, পাপড়, চানাচুর, লেইস ফিতা, রাজভোগ, চায়না পুতুল, রাইফেল, পিস্তল, বন্দুকসহ নানা ধরনের খেলনার কত রকমের দ্রব্যাদি নাম বলে শেষ করা যাবে না। আমরা ভিড় ঠেলে শেষ পর্যন্ত পৌঁছালাম চড়ক পূজার মূল কেন্দ্রে।

শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে শঙ্খ, ঢাকের বাজনা অন্য দিকে ধূপের গন্ধ এক অন্য রকম পরিবেশ তৈরি করেছে। মাঠের মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে লাল কাপড়ে মোড়া চড়ক নামের গাছটি। এর মাথায় লম্বালম্বি করে বাঁশ বাঁধা আছে। সেই বাঁশের দুই পাশে ঝোলানো আছে দড়ি। দেখা হলো লাক্কাতুরা চা বাগানের চা ঘর বাবু সঞ্জীব গুপ্তের সঙ্গে। তিনি বললেন, চড়ক পূজার ১০-১২ দিন আগে থেকে বিভিন্ন এলাকার বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিব-গৌরী নৃত্যগীত সহকারে অর্থ ও খাদ্য শস্য সংগ্রহে অংশ নেন। এরা পূজার দিন পর্যন্ত সন্ন্যাসব্রত পালন করে নিরামিষ ভোজন এবং সারা দিন উপবাস পালন করেন। চড়ক পূজার দুদিন আগে পূজারিরা পূজা-অর্চনা শুরু করেন। পূজার প্রথম দিন রাতে তান্ত্রিক মন্ত্র পড়ে জ্বলন্ত কয়লার ওপর মানুষরূপী কালী সেজে নৃত্য করেন। অন্য ভক্তরা নৃত্যের তালে তালে, ছন্দে ছন্দে ঢোলক, কাশি, করতাল বাজিয়ে থাকেন।

মূল অনুষ্ঠানের দিন অনেক আচার-নিষ্ঠার মাধ্যমে সন্ন্যাসীরা পূজায় অংশগ্রহণ করে থাকেন। যারা চড়কে ওঠেন তারা তিন দিন উপোস থাকেন, নানা রীতিনীতি পালন করেন। শিবের আশীর্বাদ লাভের আশায় প্রাচীনকাল থেকে কষ্টসহিষ্ণু এই কৃত্যানুষ্ঠানটি বাংলায় পালিত হয়ে আসছে। শিব ভক্তরা শারীরিক কষ্টকে তুচ্ছ জ্ঞান করে থাকেন। তাদের প্রধান লক্ষ্য থাকে শিবের অপার কৃপা লাভ। চড়কের মাঠে প্রথমেই দেখা মিলল শিব সজ্জিত রঞ্জিত বাবুর সঙ্গে। মাথায় পাটের আঁশ দিয়ে তৈরি জটা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, সারা মুখে নীল রং মাখা, হাতে ত্রিশূল। ভক্তরা তাকে ঘিরে ধরে আছে।

কেউ কেউ লম্বা হয়ে প্রণাম করছে আবার কেউবা নানা দ্রব্য দান করছে। চড়ক পূজার শেষ পর্যায়ে পিঠে বড়শি বাঁধা সন্ন্যাসীকে উপুড় করে ঝুলে থাকা দড়ির একপ্রান্তে বেঁধে দেওয়া হলো। অপর প্রান্তের দড়ি একজন টান দিয়ে ধরে থাকলেন। মূল সন্ন্যাসীর নির্দেশ পাওয়ার পর তিনি ঘোরাতে লাগলেন আর অপর দড়িতে পিঠে বড়শি বাঁধা সন্ন্যাসী উপুড় হয়ে ভাসতে লাগলেন সমান বেগে। এদিকে আমার সঙ্গীরা একের পর এক ছবি তুলতে লাগল। আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম সন্ন্যাসী বাবার কার্যক্রম দেখতে। ঘুরন্ত অবস্থায় তিনি বাজাতে লাগলেন ঢাক।

এই দৃশ্য ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। চারদিকে ঢাকঢোলের বাজনা এক অন্য রকম পরিবেশ তৈরি করেছে। ধূপের ধোঁয়া, ঢাকের বাদন, মানুষের কোলাহল-উপস্থিত সবাইকে মুহূর্তেই নিয়ে গেল এক অপার্থিব জগতে। একপর্যায়ে ঢাক বাজানো বন্ধ করে সন্ন্যাসী তার ঝোলায় থাকা আম-বাতাসা-শসা ভক্তদের মধ্যে ছুড়ে দিতে লাগলেন।

সন্ন্যাসীর ছোড়া এসব জিনিস হাতে পাওয়ার জন্য ভক্তদের মধ্যে পড়ে গেল হুড়োহুড়ি। অনেকেরই বিশ্বাস, এসবে থাকে দৈবশক্তি। পাক থেকে নামানোর পর সুযোগ বুঝে কথা বলি নাম না জানা সন্ন্যাসী বাবার সঙ্গে। তিনি জানালেন, ১২ বছর ধরে তিনি পাক ঘুরছেন। কোনো কষ্ট হয় না। ভগবান সঙ্গে থাকে বলে ব্যথাও লাগে না। আমরা সূর্য দেবের নৈকট্য পাওয়ার আশায় তাকে প্রণাম করে ফিরে চলি শহর পানে। 

কিভাবে যাবেন
ঢাকার সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল, রাজারবাগ ও মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে গ্রিনলাইন, শ্যামলী, এনা, হানিফ বা বিআরটিসি বাসে অথবা ট্রেনে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে সকালে আন্তনগর পারাবাত, দুপুরে জয়ন্তিকা ও কালনী এবং রাতে উপবন সিলেটের পথে ছোটে। ভাড়া ৪০০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে। শহর থেকে লাক্কাতুরা চা বাগান  পর্যন্ত ভাড়া রিকশায় ৪০ টাকা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া ১০০ থেকে ১৫০ টাকা।