
অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার ‘ঈশ্বরের নিজের বাগান’ বলে খ্যাত মওলিননং গ্রামটি দেখার জন্য আমি আর আমার মা রওনা দিয়েছি। আজ আমাদের মেঘালয় (শিলং) ভ্রমণের তৃতীয় দিন। আমাদের সঙ্গী আমাদের চার চাকার মহাজন বাপ্পিদা। উত্তর-পূর্ব ভারতে ‘সেভেন সিস্টারস স্টেটস’ বলে খ্যাত সাতটি রাজ্যের মধ্যে একটি মেঘালয় রাজ্য। এই রাজ্যের পূর্ব খাসি পাহাড়ের কোলে অবস্থিত ছোট্ট একটি গ্রাম মওলিননং। চলতি পথে বাপ্পিদা জানালেন, এই উপজাতি অধ্যুষিত ছোট্ট গ্রামটিই ‘এশিয়ার পরিচ্ছন্নতম গ্রাম’-এর মর্যাদা পেয়েছে ২০০৩ সালে। ‘ডিসকভার ইন্ডিয়া ম্যাগাজিন’-এর সদস্যদের বিশেষ পর্যবেক্ষণের পর এই সম্মান পেয়েছিল গ্রামটি। তারপর ‘ভারতের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম’-এর মর্যাদা পেয়েছে ২০০৫ সালে।
প্রকৃত অর্থেই নির্মল গ্রাম। নিঃশ্বাসে বিষ ঢোকে না। নেই কোনো কোলাহল। প্রকাশ্যে মানুষ বা জন্তুর বর্জ্য পড়ে থাকে না। মানুষ স্বাস্থ্যসচেতন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় সরকারি কর্মচারীরা চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখেন গ্রামটির ওপর। ইউরোপীয় অ্যাংলিকান চার্চের মিশনারিরাই ‘মওলিননং’ গ্রামে প্রথম শ্বেতাঙ্গ আগন্তুক। তারা যিশুর বাণী প্রচারের জন্য ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো উত্তর-পূর্ব ভারতের নানা রাজ্যেও ঘুরছিলেন। মেঘালয়ের নানা জায়গা ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসেছিলেন ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে।
একদিকে ধূসর পাহাড়শ্রেণির গা থেকে শুরু করে চারদিকে সবুজের সমারোহের মাঝখানে অবস্থিত গ্রামটি। পরিচ্ছন্নতা এখানকার গ্রামবাসীর ঐতিহ্য। ভারত-বাংলাদেশ সীমানার ধারঘেঁষে পাহাড়ের কোলে অবস্থিত গ্রামটি শিলং থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে। আমরা চলছি এক স্নিগ্ধ সকালে প্রকৃতির হাওয়ার তালে। পথিমধ্যে বৃষ্টি আমাদের বরণ করে নিল। পথেই দেখা মিলল গোছা গোছা ফুলঝাড়ু পিঠে নিয়ে হেঁটে চলেছেন খাসিয়া রমণীরা৷ কোথাও এক টুকরো কাগজও পড়ে থাকতে দেখা যাবে না ৷ আর রাস্তায় এক টুকরো কাগজ পড়ে থাকতে দেখলেই তা শঙ্কু আকৃতির ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছেন৷ গ্রামকে কোনোভাবেই অপরিচ্ছন্ন হতে দেন না এই খাসিয়া উপজাতিরা৷ গ্রামের চারদিকে সবুজের সমারোহ। কালচে সবুজ, টিয়া সবুজ, পান্না সবুজ, নানারকম সবুজ গাছপালায় সাজানো ছবির মতো একটি গ্রাম। কালো পিচঢালা রাস্তার একপাশে গাড়ি পার্কিং করার জায়গা।
রাস্তাঘাট ঝকঝকে। কোথাও পানের পিক, থুতু, ছেঁড়া কাগজের টুকরো বা পলিথিনের আবর্জনার কোনো অস্তিত্ব নেই রাস্তায় বা গ্রামের ত্রিসীমায়। রাস্তায় কোনো আবর্জনা পড়লে, গাছের পাতা ঝরে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তুলে ফেলে দেয় গ্রামের বাচ্চা-বুড়ো যেকোনো মানুষ। রাস্তার মাঝে মাঝেই রয়েছে ময়লা ফেলার পাত্র। সবই জৈব পদার্থে তৈরি। কাঠ বা বাঁশের তিনটি খুঁটির ওপর রাখা আছে বাঁশের চাঁচাড়ি থেকে তৈরি ত্রিকোণা ডাস্টবিন। সেখানেই ফেলে দেয় রাস্তার আবর্জনা। এসব ডাস্টবিন থেকে জৈব আবর্জনাগুলো সংগ্রহ করে সেগুলো দিয়ে গ্রামবাসী জৈবসার তৈরি করে ব্যবহার করেন চাষের খেতে।
ঢালু জমির পূর্বদিকে ক্রমশ উঁচু হয়ে চলা পাথুরে এলাকাজুড়ে গ্রামের বাড়িঘর। গ্রামে ঢোকার মুখেই একটি বাগান, বেড়া দিয়ে ঘেরা। তাতে আছে নানা জাতের গাছ। গোলকধাঁধার মতো রাস্তা চলে গেছে নানা দিকে। একটি রাস্তা ধরে চলতে থাকলে দুপাশেই দেখা যাবে বাড়িঘর। ঢালু রাস্তা ক্রমশ উঁচু হতে হতে ঢুকে গেছে গ্রামের ভেতরে। নানা দিকে রাস্তা গেছে। আর দুই ধারে বাড়িঘর। বাগান আছে প্রতি বাড়িতে। গ্রামের বাড়িঘর বাঁশ ও টিনের তৈরি। চেরা বাঁশের পাটাতনে ঘরের মেঝে। সেও বাসিন্দারা মুছে পরিষ্কার করে রাখেন। প্রতিটি বাড়িতেই আছে বিরাট বিরাট পাথরের চ্যাপ্টা চাঁই। প্রায় প্রতিটি চাঁইতেই আছে তিনটি করে ছোট্ট গর্ত, কোনোটিতে আবার দুটো গর্ত। যে গর্তগুলো একটু বড়ো, সেগুলোতে জল ধরা আছে। এখনো হয়তো এগুলো হাত ধোয়ার জলের জন্য এরা ব্যবহার করে।
গর্তগুলো দেখে প্রথমে মনে হয়েছিল- আদিমকালে যে মানুষেরা এখানে বসবাস করত, হয়তো ঘসে ঘসে এই গর্তগুলো তৈরি করেছিল নিজেদের প্রয়োজনে। পরে শুনেছি এগুলো আগ্নেয়গিরি থেকে উৎক্ষিপ্ত বিশাল বিশাল পাথরের গর্ত। হয়তো একের পর এক বিস্ফোরিত আগ্নেয় পদার্থের আঘাতেই এই গর্তগুলো তৈরি। কিন্তু প্রতি গর্তে দুটি বা তিনটি প্রায় সমান আকারের গর্ত মনে প্রশ্ন রেখেই যায়, এগুলো মানুষের তৈরি বলে মনে হয়। গ্রামের ভেতরের দিকে জমি ক্রমশ উঁচু হয়ে গেছে। বিরাট বিরাট পাথরের নানা আকারের চাঁইয়ের সঙ্গে আছে এক বিরাট ‘ব্যালান্সিং রক’। একটি বিরাট পাথরের ওপর আর একটি বিরাট পাথর আশ্চর্যভাবে ভারসাম্য বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে, কোন অজানা কাল থেকে কেউ জানে না। তবে এখন সেটির নিচে ঠেকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
গ্রামের মধ্যে কোনো গাড়ি চলে না। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা নির্বিঘ্নে রাস্তায় খেলা করছে। আমরা গ্রামের ভেতর দিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ করে চোখে পড়ল গ্রামের মাঝে এক জায়গায় আর একটি নতুন স্কুলবাড়ি তৈরি হচ্ছে, জানালা-দরজা এখনো তৈরি হয়নি। সেখানেই ক্লাস চলছে। বাপ্পিদা বললেন, এখানে শিক্ষিতের হার বুঝি ১০০ শতাংশ। আমিও কথা বলে দেখলাম, সবাই ইংরেজিতে কথা বলছে পর্যটকদের সঙ্গে। বর্তমানে এই গ্রামে ৯৫টি পরিবার মিলিয়ে প্রায় ৫০০ জন মানুষের বসবাস। চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে উপলব্ধি করলাম, এখানে শব্দদূষণও নেই। সবাই মৃদুভাষী। শুধু আছে পাখির কাকলি, বাতাসে গাছের পাতার দোলন আর শুকনো পাতা ঝরার শব্দ। আমরা বাংলাদেশের ল্যান্ডস্কেপ দেখার জন্য স্কাই ভিউ পয়েন্টের বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে গাছের ডাল আর গাছের গুঁড়ির তৈরি দোতলা বা তিনতলার মাচানে গেলাম৷ মওলিননং-এ গেলে তার ঠিক পাশের গ্রাম নাহোয়েট-এর প্রধান আকর্ষণ লিভিং রুট ব্রিজ না দেখে ফেরা মানে নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছু না৷ বলা ভালো, এর জন্যই আমাদের সবাই মওলিননং-এ পাড়ি দেয় ৷
আমি আর মা লিভিং রুট ব্রিজ দেখার জন্য নিচে নামা শুরু করলাম। একদিকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে; সেই সঙ্গে পাহাড়ি নদীর স্রোতের আওয়াজ কানে ভেসে আসছে। বৃষ্টির ফলে রাস্তা একটু পিচ্ছিল। অনেকে আবার হাতে লাঠি নিয়েছে হাঁটার সুবিধার জন্য। আমরা এসে পৌঁছালাম লিভিং রুট ব্রিজে। বিশাল আকারের কয়েকটা গাছের শিকড় আর ডালপালা মিলেমিশে এক অদ্ভুত বুনট তৈরি হয়েছে, যার নাম জীবন্ত সেতু৷ প্রকৃতির লীলাখেলা একেই বলে! সেতুর ওপরে-নিচে ছড়িয়ে আছে ছোট-বড় মাপের পাথর৷ চারদিকে সবুজ ঘন জঙ্গল৷ নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে পাহাড়ি খরস্রোতা থাইলং নদী।
প্রসঙ্গত, মেঘালয়ের প্রাচীন খাসি উপজাতির মানুষদের চোখে প্রথম পড়ে ফাইকাস ইলেকটাস নামে এক প্রজাতির রবার গাছ ৷ খাসি এবং জয়ন্তিয়া পাহাড়ের দক্ষিণের বনজঙ্গলে জন্মানো এই গাছের মূল শিকড় মাটির নিচে থাকলেও পরে শিকড়গুলো আড়াআড়িভাবে মাটির ওপর বেড়ে ওঠে৷ আর এই শিকড়েই রয়েছে জীবন্ত সেতুর প্রযুক্তির ইতিহাস৷ এখানকার মানুষ সুপারি গাছের কাণ্ড ফাঁপা করে কেটে দেন৷ তার ভেতর জীবন্ত রবার কাছের শিকড় ঢোকানো হয়৷ এরপর তারা নিজের ছন্দে বেড়ে চলে৷ শিকড় নদী পেরিয়ে গেলে ফাঁপা সুপারি গাছ কেটে ফেলা হয়৷ রবারের শিকড় সহজেই মাটিতে ঢুকে যায়৷ সেতুর ভিতও শক্ত হয়৷ এমন একখানা প্রাকৃতিক ঝুলন্ত সেতু তৈরি হতে সময় নেয় প্রায় ১৫ বছর৷ দৈর্ঘ্য ৫০ মিটারের বেশিও হয় অনেক সময়৷ একসঙ্গে ৫০-৬০ জন চলতে পারে এই সেতুপথে৷ প্রকৃতি আর স্থানীয় মানুষের কারিকুরিতে জীবন্ত সেতু অন্যতম দর্শনীয় স্থান মওলিননংয়ের।
আমরা ফিরে চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যে। ফিরতি পথে চোখে পড়ল প্রতি বাড়িতেই বৃষ্টির জল ধরে রাখার (রেন হার্ভেস্টিং) ব্যবস্থা আছে। পরিচ্ছন্নতা রক্ষার আদর্শের সঙ্গে এরা জল সংরক্ষণ বিষয়েও সচেতন। বাপ্পিদা বললেন, এখানকার ‘খুরি’ নদীর জলসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের ক্রমোন্নতি হলে গ্রামে জল সরবরাহের সুবিধা হবে। বিদ্যুতের ব্যাপারেও গ্রামের মানুষ স্বনির্ভর থাকার চেষ্টা করছেন। এরা প্রধানত সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। প্রতিটি বাড়িতেই আলাদা আলাদা সোলার প্যানেল বসানো আছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। সরকারি সংস্থা আরডি এনার্জি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহায়তা নিয়েই এই ব্যবস্থা হয়েছে।
জেনে রাখা ভালো
মওলিননং বেড়ানোর সময় মে থেকে নভেম্বর মাস। মেঘালয়ে সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষা খাসিয়া। পরদেশিদের সঙ্গে অবশ্য হিন্দি-ইংরেজি মেশানো এক মিশ্র ভাষায় কথা বলে স্থানীয়রা। তামাবিল সীমান্তে ভ্রমণ কর দেওয়ার মতো ব্যাংক নেই। এ জন্য বেশ খানিকটা দূরে যেতে হতে পারে। তাই ঢাকা থেকেই ভ্রমণ কর পরিশোধ করে যাওয়া ভালো। এ ছাড়া সীমান্ত পার হওয়ার পর মুদ্রা বিনিময়ের সুযোগও খুব সীমিত। তাই প্রাথমিক ঘোরাফেরার জন্য যতদূর সম্ভব সীমান্ত এলাকায়ই বেশকিছু ডলার ভাঙিয়ে নিন। তবে শিলং শহরে পুলিশ বাজারে গোল্ডের অ্যারো ট্রাভেলসে ডলার ভাঙাতে পারবেন।
কিভাবে যাবেন
প্রথমত আপনাকে ইন্ডিয়ার ভিসা করতে হবে। রুট দিতে হবে ডাউকি বর্ডার আর আপনি চাইলে একদিনেই গিয়ে ঘুরে আসতে পাড়বেন। সময় কম থাকলে সেক্ষেত্রে আপনাকে সিলেটে এসে পৌঁছাতে হবে সকালে। এর পর সরাসরি সিএনজি অথবা মাইক্রোবাস করে তামাবিল বর্ডার। ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে সেখান থেকে জিপ অথবা ট্যাক্সি করে সোজা মওলিননং যাওয়া যাবে। ভাড়া দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার রুপি। তবে মওলিননং-এ থাকার কোনো হোটেল নাই। তাই থাকতে হলে শিলং শহরে গিয়ে থাকতে হবে।
ছবি :লেখক
কলি