ঢাকা ৪ ফাল্গুন ১৪৩১, সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
English
সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৪ ফাল্গুন ১৪৩১

সমুদ্র জল ছুঁয়ে গল্প বোনা দিন

প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:৫৯ পিএম
আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৩০ পিএম
সমুদ্র জল ছুঁয়ে গল্প বোনা দিন
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত , ছবি: সংগৃহীত

যখন আকাশজুড়ে থই থই জ্যোৎস্না থাকবে, তখন একবার লঞ্চের ছাদে চড়ে বরিশালে যাব- এমন ইচ্ছে ছিল অনেক দিনের। হঠাৎ একদম অপরিকল্পিতভাবে সেই সুযোগ এসে গেল।সেপ্টেম্বরের শেষ দিকের কথা। ১৭ জনের টিম যাবে কুয়াকাটায়। একদম রওনা দেওয়ার দিন আমাকে এক প্রকার কিডন্যাপ করে ধরেবেঁধে তাদের সঙ্গে নিয়ে গেল। দুই দিনের ভ্রমণ। ব্যাগ গোছানোর জন্য সময় পেলাম পাঁচ মিনিট। আমাকেসহ টিমের সদস্য সংখ্যা দাঁড়াল ১৮ জন এবং পুরো টিমের ভেতর আমিই সবচেয়ে সিনিয়র সদস্য। সবার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বয়সের কারণে পরে মনে হলো, আমিই যেন দায়িত্ব নিয়ে সবাইকে নিয়ে যাচ্ছি ঘুরতে।

সদরঘাট থেকে আমরা লঞ্চে উঠে বসলাম সন্ধ্যার আগে আগে। একাধিক কেবিন আর কিছু ডেকের সিট নেওয়া হয়েছে। যথাসময়ে লঞ্চ ছেড়ে দিল। আস্তে আস্তে শহর পেরিয়ে গেলাম। সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে রাত নামল। কেবিন ভাড়া করা হলেও সবাই মিলে ছাদে চলে গেলাম। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাঁদ আড়মোড়া ভেঙে জ্যোৎস্না ছড়াতে শুরু করল। শহর পেরিয়ে গ্রামের দিকে যেতে শীত অনুভূত হলো। এমনিতেই নদীর বাতাস, তার ওপর গ্রামের দিকে যেন শীতের অঙ্কুর গজাচ্ছে। সব মিলিয়ে মোহনীয় এক অনুভূতি।

ক্ষুধা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার পর আমরা সবাই রাতের খাবার খেলাম। টিমের একজন সদস্য সবার জন্য বিরিয়ানি রান্না করে এনেছিল। জ্যোৎস্নাপ্লাবিত আকাশের নিচে বসে আয়েশ করে খেলাম পছন্দের খাবার। গল্পে গল্পে রাত বাড়তে লাগল।

সকালের আলো যখন চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে তখন পটুয়াখালী পৌঁছালাম। তারপর অটোতে করে বাসস্ট্যান্ডে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে সেখানেই সকালের নাশতা সেরে বাসে চড়ে বসলাম। গন্তব্য সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটা। কুয়াকাটায় পৌঁছাতে আমাদের সময় লাগল প্রায় দুই ঘণ্টা। আগে হোটেল বুকিং দেওয়া ছিল না। তাই পৌঁছেই হোটেল খুঁজতে শুরু করলাম। সমুদ্রতীর থেকে পায়ে হাঁটা পথে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে পেয়ে গেলাম বাজেটের মধ্যে হোটেল। হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম।

দুপুরে গোসলের জন্য সবাই সমুদ্রে গেলাম। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছিল। সেই ঢেউয়ের সঙ্গে মিতালি করে দুপুরের রোদ গায়ে মেখে তুমুল আনন্দে গোসল করছিলাম আমরা। সমুদ্রতীরে ভেজা শরীর এলিয়ে দিয়ে সানগ্লাস চোখে বিশাল আকাশ আর সমুদ্র দেখতে দেখতে নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিল। সমুদ্রের কাছে এলে সবারই নিজেকে খুব ক্ষুদ্র লাগে বোধহয়।

গোসল শেষে হোটেলে ফিরে গিয়ে সবাই পোশাক বদলে নিলাম। সমুদ্রে দাপাদাপি করে গোসল করাতে সবাই খুব ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিল। আবাসিক হোটেলের কাছেই একাধিক খাবারের হোটেল রয়েছে। সেখান থেকে সবাই পেটপুরে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম।

রোদ একটু কমে এলে ঘোরার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। সেখানে পর্যটন স্পটগুলো ঘুরে দেখানোর জন্য পর্যাপ্ত মোটরসাইকেল আর ভ্যানগাড়ি আছে। আমরা কতগুলো বাইক ভাড়া করলাম সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত ঘোরার জন্য। তাদের কাছে কুয়াকাটার দর্শনীয় স্থানের একটি তালিকা থাকে। তারা সেসব তালিকা দেখিয়ে পর্যটকদের ইমপ্রেস করতে চায়। সেখানে বেশকিছু স্পটের কথা উল্লেখ থাকলেও কিছু কিছু স্পট শুধু নামে মাত্রই, দেখার তেমন কিছু নেই।

প্রথম দিনে আমরা লেবুর বন, ফিস মার্কেট, শুঁটকিপল্লী, ঝাউবন আর তিন নদীর মোহনা দেখলাম। সমুদ্রতীর থেকে ঝিনুক কুড়ালাম। যেসব জায়গা ভালো লাগছিল, বাইক থামিয়ে সেসব জায়গায় কিছুক্ষণ করে ঘুরে বেড়িয়েছি। শুঁটকিপল্লীতে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত শুঁটকি তৈরির কার্যক্রম চলে। তাই আমরা সেসব কার্যক্রম দেখতে পারিনি। তবু ঘুরে এসেছি। তিন নদীর মোহনায় দাঁড়িয়ে অন্য রকম ভালোলাগা কাজ করছিল। সূর্যাস্তের আগে আমরা সেখানটায় ফিরে এসেছিলাম, দুপুরে যেখানে গোসল করেছিলাম। সূর্যাস্তের সময়টায় বুকের ভেতর কেমন বিষাদ ভর করে। তাই সূর্যাস্ত দেখার জন্য কালো রঙের শাড়ি পরেছিলাম। সমুদ্র তখন বেশ শান্ত ছিল। সমুদ্রতীরে বসে ছিলাম গোধূলির অনেকটা সময়। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর সমুদ্রজলে পা ভিজিয়ে তাকিয়ে ছিলাম আকাশের দিকে। সে এক মন-কেমন করা অনুভূতি।

রাতে আমরা আবার সমুদ্রতীরে গেলাম। মাছের বারবিকিউ করার জন্য বড় দুটো সামুদ্রিক মাছ কিনলাম। বারবিকিউর প্রস্তুতি চলছিল, এমন সময় ভাটা পড়ে যাওয়া সমুদ্র যেন আমাকে দুই হাত বাড়িয়ে ডাকছিল। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছিল সমুদ্রাঞ্চল। চরাচরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সেই জ্যোৎস্না গায়ে মেখে হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলাম সমুদ্রের গহীন প্রকোষ্ঠে। তারপর আবার ফিরে এলাম বারবিকিউর উৎসবে। চারপাশে গোল হয়ে চৌকিতে বসলাম সবাই। মাঝখানে আগুন জ্বলছিল আর তার পাশে বারবিকিউ হচ্ছিল। সবাই গান-গল্পে মেতে রইলাম। বারবিকিউ হয়ে গেল। সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার অভ্যেস কম। তাই অন্য সবার মতো আয়েশ করে খেতে পারলাম না। অল্প করে খেলাম।

রাতে হোটেলে ফিরে গিয়েও যেন আমাদের গল্প আর ফুরোয় না। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে কেবল একটু ঘুমিয়েছি, তখনই আবার উঠে পড়ার তাড়া। সূর্যোদয় দেখতে হবে। আগের দিনই বাইক ঠিক করা ছিল। বাইকওয়ালারা হোটেলের সামনে এসে তাড়া দিচ্ছে। সেদিন জীবনে প্রথম দুই মিনিটে শাড়ি পরলাম। সবুজ সতেজতার প্রতীক। তাই সূর্যোদয় দেখার জন্য সবুজ রঙের শাড়ি নিয়ে এসেছিলাম।

সূর্যোদয় দেখার জন্য বাইক ছুটতে শুরু করল দ্রুত গতিতে। ভোরের সমুদ্র যে কী অদ্ভুত সুন্দর, তা বলার মতো নয়। চলতে চলতে একবার ছোট একটা খালের মতোও পার হতে হলো নৌকায়। নৌকাতে বাইক তুলে দিয়ে আমরাও নৌকায় চড়ে বসলাম। নামার পর আবার বাইক চলতে শুরু করল। যেই স্পটে আমাদের সূর্যোদয় দেখার কথা ছিল, সেখানে পৌঁছানোর আগেই সূর্য উদয় হলো। তবু আমরা মুগ্ধ চোখে দেখলাম। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সূর্য তার সোনালি আলো ছড়িয়ে দিল খানিকটা। দ্বিতীয় দিনে আমরা দেখলাম গঙ্গামতির চর, লাল কাঁকড়ার চর, রাখাইন পল্লী, রাখাইন মার্কেট, বৌদ্ধমন্দির, ২০০ বছরের পুরোনো নৌকা, বিখ্যাত কুয়া ইত্যাদি। বাইকে চড়ে সমুদ্র আর গ্রামাঞ্চল ছুঁয়ে এসব জায়গা দেখতে বেশ ভালোই লাগছিল।

দুপুরে হোটেলে ফিরে এলাম। হোটেলে আসার আগে হোটেলের পাশেই আরেকটা বৌদ্ধমন্দির দেখে নিলাম। দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই বিশ্রাম নিলাম। এবার ফেরার পালা। ফেরার সময় আমরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেলাম। এক দল রাতের বাসে ঢাকা ফিরবে। আর আমরা কয়েকজন বরিশাল থেকে লঞ্চে উঠে ফিরব। দুপুরের পরই আমরা বরিশালে যাওয়ার জন্য বাসে করে রওনা হলাম। প্রায় ৪ ঘণ্টা লাগল পৌঁছাতে। বরিশাল পৌঁছে বাঁধল বিপত্তি। লঞ্চে একটা কেবিনও ফাঁকা নেই। সেই লঞ্চ মালিকরা আমাদের পরিচিত ছিল। অনেক চেষ্টার পরে কোনো একভাবে একটা কেবিনের ব্যবস্থা করে দিলেন তারা। ফেরার সময়ও সবাই ছাদে বসে জ্যোৎস্না দেখতে দেখতে ফিরেছি। কেউ কেউ কিছুটা সময়ের জন্য কেবিনে গিয়ে বিশ্রাম নিয়েছে।
ভোরবেলা সদরঘাটে এসে নামলাম। পেছনে ফেলে এলাম কিংবা হয়তো সঙ্গে করেই নিয়ে এলাম সমুদ্রজল ছুঁয়ে গল্প বোনা দিনের স্মৃতি।

কীভাবে যাবেন
বাসে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে কুয়াকাটা যেতে সময় লাগবে ৬-৭ ঘণ্টা। সায়েদাবাদ, আব্দুল্লাহপুর, আরামবাগ অথবা গাবতলী থেকে শ্যামলী, গ্রীন লাইফ, হানিফ এবং আরও কিছু বাস এই রুটে চলাচল করে। ভাড়া ৯০০-১৬০০ টাকা।

নদীপথে যেতে চাইলে সদরঘাট থেকে বরিশাল বা পটুয়াখালীগামী লঞ্চে উঠতে হবে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় লঞ্চ ছেড়ে যায়। ভোর বা সকালে পৌঁছায়। পটুয়াখালী বা বরিশাল নেমে বাসে করে যেতে হবে কুয়াকাটা। ডেকের ভাড়া ৪০০-৫০০ টাকা, কেবিন ভাড়া ১০০০-৭০০০ টাকা। তবে ভাড়া পরিবর্তনশীল।

কুয়াকাটা গিয়ে যে বাইকে করে দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখবেন, সেই বাইক সবগুলো স্থান ঘুরে দেখাতে ১০০০-১৫০০ টাকা পর্যন্ত নেবে।

কোথায় থাকবেন
কুয়াকাটায় প্রতি বছর অনেক পর্যটকই ঘুরতে যান। তাই সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে বাজেট হোটেল রয়েছে। সমুদ্র থেকে কাছেই হোটেল পেয়ে যাবেন।

সতর্কতা
সাঁতার না জানলে সমুদ্রে গোসল না করাই ভালো। বিশেষ করে জোয়ারের সময় সতর্ক থাকতে হবে। সমুদ্র কিংবা অন্য কোনো স্থানে আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন।

কলি

ভালোবাসা দিবসে যেখানে ঘুরতে যাবেন

প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:১১ পিএম
ভালোবাসা দিবসে যেখানে ঘুরতে যাবেন
ছবি: সংগৃহীত

ভালোবাসা দিবস উদযাপনের জন্য প্রিয় মানুষের সঙ্গে ঘুরতে যেতে পারেন। ঢাকার কাছেই কিছু দর্শনীয় জায়গা রয়েছে। যেখানে প্রিয়জনকে নিয়ে অল্প খরচের মধ্যে ঘুরতে গেলে সময় ভালো কাটবে। 

দোয়েল চত্বর ও কার্জন হল
কার্জন হল জায়গাটির একটি বিশেষ আকর্ষণ আছে। পুরো এলাকাটি পুরোনো স্থাপত্যের যে ছাপটি আছে, তা একটি প্রাচীন ভাব এনে দেয়। এখানকার বিভিন্ন ভবনের পুরোনো কাঠের সিঁড়িতে বসে খানিকটা সময় কাটিয়েই দেওয়া যায়। কার্জন হল থেকে বেরিয়েই দোয়েল চত্বর যেতে পারেন। সেখানে আপনি বিভিন্ন হস্তশিল্প কেনাকাটা করতে পারবেন। বেশ কিছু ছোট নার্সারি, যেখান থেকে বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় গাছ ও উপহার দিতে পারবেন।

আহসান মঞ্জিল ও লালবাগ কেল্লা
পুরান ঢাকায় বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত আহসান মঞ্জিল একসময় ঢাকার নবাবদের আবাসিক প্রাসাদ ও জমিদারির কাছারি হিসেবে ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। একই নদীর তীরে লালবাগ এলাকায় অবস্থিত মোগল স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন লালবাগ কেল্লা। মূল তিনটি ভবনের সমন্বয়ে (মসজিদ, পরী বিবির সমাধি এবং দেওয়ান-ই-আম বা দরবার হল) স্থাপনাটি গঠিত। আরও আছে কিছু ফোয়ারা এবং সর্বসাধারণের জন্য শায়েস্তা খাঁর বাসভবনে তৈরি করা জাদুঘর। চাইলে প্রিয়জনকে নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন এই ঐতিহাসিক জায়গাগুলোতে।

বইমেলা
বইমেলা জায়গাটা ঠিক ঘোরার জায়গা নয়, তবে ভালোবাসা দিবসে বইমেলায় থাকে তরুণ-তরুণীদের উপচে পড়া ভিড়। মেয়েরা লাল শাড়ি ও চুলের খোপায় ফুলের মালা পরে, তার সঙ্গে মিলিয়ে ছেলেরা পাঞ্জাবি পরে বইমেলায় ভিড় জমান। আপনার ভালো লাগার মানুষটিকে নিয়ে গিয়ে বই দেখতে বা কিনতে যেতেই পারেন।

মিরপুর বেড়িবাঁধ
মিরপুর বেড়িবাঁধে এলে হারিয়ে যেতে পারেন ট্রাফিক জ্যাম মুক্ত হাইওয়েতে। দেখতে পাবেন দুই পাশে গাছের সারি, দিগন্ত বিস্তৃত খোলা প্রান্তর, দূরে সবুজ গ্রাম আর রুপালি পানির নদী। এখানে রয়েছে বিভিন্ন ভাসমান রেস্তোরাঁ এবং বিনোদন পার্ক। সেখানেও সময় কাটাতে পারেন। রয়েছে অনেক পুরোনো কিছু বটগাছ। তবে আলো থাকতে থাকতে এখান থেকে চলে যাওয়াটা ভালো হবে।

মায়াদ্বীপ
নারায়ণঞ্জের বারদী ইউনিয়নের মায়াদ্বীপ হতে পারে সঙ্গীকে নিয়ে ঘুরে আসার ভালো জায়গা। দুজনে সুন্দর মুহূর্ত কাটাতে পারবেন। মেঘনা নদীর বুকে ভেসে ওঠা সুন্দর এক চরের নাম মায়াদ্বীপ। তবে মূল ভূখণ্ড থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন। রাজধানী ঢাকার গুলিস্তান থেকে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কয়েক মিনিট পরপর বিভিন্ন বাস ছেড়ে যায়। ভাড়া ৫০ থেকে ৬০ টাকা। বাসে গিয়ে সোজা নামতে হবে মোগরাপাড়ায়। তারপর সেখান থেকে ইজি বাইকে বৈদ্যের বাজার নেমে নৌকা ভাড়া করে যেতে হবে। সময় লাগবে ৪০ মিনিটের মতো।

নরসিংদী জমিদার বাড়ি
জমিদার বাড়ি ঘুরতে যাওয়া কিন্তু দারুণ অভিজ্ঞতা। নরসিংদীর জমিদার বাড়িটি বেশ সুন্দর। তাকালেই দৃষ্টি জুড়িয়ে যায়। শতবছরের ভবন ও ঐতিহ্যপ্রেমী এবং ভ্রমণপিপাসুদের মুগ্ধ করে বাড়িটি। উকিলবাড়ি বা লক্ষণ সাহার বাড়ি নামেই পরিচিত বাড়িটি। নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ডাংগা বাজার থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত লক্ষণ সাহার জমিদারবাড়ি। এর সামনে বিশাল পুকুর, শান বাঁধানো পুকুরঘাট, কারুকার্যখচিত মন্দির। ঢাকার গুলিস্তান সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের সামনে নরসিংদীগামী মেঘালয় বাস কাউন্টার আছে। মেঘালয় বাসে করে পাঁচদোনা মোড় নামবেন, ভাড়া নেবে ১২০ টাকা। পাঁচদোনা মোড় থেকে ডাংগা বাজারের অটোরিকশায় উঠবেন, ভাড়া ২০ টাকা। তারপর ডাংগা বাজার থেকে হেঁটে বা ৩০ টাকা রিকশা ভাড়ায় জমিদার লক্ষণ সাহার বাড়িতে যাওয়া যায়।

সোনার গাঁ
বাংলার এক প্রাচীন রাজধানী সোনার গাঁ, যেখানে প্রিয়জনকে নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন। সেখানে উপভোগ করার মতো আছে অনেক কিছুই। জাদুঘরের ভেতরে রয়েছে প্রধান ফটকে দুজন অশ্বারোহী, গরুর গাড়ির ভাস্কর্য, লাইব্রেরি ও ডকুমেন্টেশন সেন্টার, সদ্য নির্মিত জয়নুলের আবক্ষ ভাস্কর্য, ক্যান্টিন, লোকজ রেস্তোরাঁ, সেমিনার হল, ডাকবাংলো, কারুশিল্প গ্রাম, কারুপল্লি, জামদানি ঘর, কারু-মঞ্চ, কারু-ব্রিজ, মৃৎশিল্পের বিক্রয়কেন্দ্র। এ ছাড়া গ্রামীণ উদ্যান, আঁকাবাঁকা দৃষ্টিনন্দন লেক, বড়শিতে মাছ শিকার. নৌকায় ভ্রমণ ও বনজ, ফলদ, ঔষধিসহ শোভাবর্ধন প্রজাতির বাহারি বৃক্ষরাজি দিতে পারে অসাধারণ একটি সময়।

ছুটি রিসোর্ট
ঢাকা থেকে মাত্র ১৮ কিমি দূরে গাজীপুরে ছুটি রিসোর্ট অবস্থিত। ৫৪ বিঘা জমির ওপর তৈরি হয়েছে রিসোর্টটি। বিমানবন্দর থেকে এক ঘণ্টার কম সময়ে এখানে যেতে পারবেন। রিসোর্টে ঢুকেই নানা রকম গাছগাছালি ও বন্য প্রাণীর বিচরণ দেখা যায়। এখানে পরিবার বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে থাকার জন্য ৫০টির বেশি রুম আছে। বিশেষ করে উডেন কটেজ, ভাওয়াল কটেজ, ফ্যামিলি কটেজ নামের কটেজগুলো বেশ জনপ্রিয়।

পানাম নগর, নারায়ণগঞ্জ
যদি ঐতিহ্যের কাছাকাছি একটা দিন কাটাতে চান তবে নির্দ্বিধায় ঘুরে আসতে পারেন হারানো নগরীখ্যাত পানাম নগর বা পানাম সিটি থেকে। মূল সড়কের দুপাশ জুড়ে বেড়ে ওঠা প্রাচীন নগরীর মায়াজাল আপনাকে মুগ্ধ করে রাখবে। বার ভূঁইয়া প্রধান ঈসা খাঁ কর্তৃক নির্মিত এই পানাম নগরীতে হেঁটে বেড়ালে হয়তো আপনি নিজেকে ১৫ শতকে খুঁজে পেতে পারেন। ঢাকার গুলিস্তান থেকে দোয়েল, স্বদেশ কিংবা বোরাকের বাসে করে মোগড়াপাড়া চৌরাস্তায় নেমে ব্যাটারিচালিত রিকশায় কিংবা প্যাডেলচালিত রিকশায় করে পানাম নগরীতে যেতে পারবেন।

সাদুল্লাহপুর গোলাপ বাগান, ঢাকা
সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের সাদুল্লাপুর গ্রামটি বর্তমানে গোলাপ গ্রাম নামে পরিচিত। এখানে বছরজুড়েই গোলাপের ঘ্রাণে ভরে থাকে সারা গ্রাম। বিস্তীর্ণ গোলাপের বাগান ছাড়াও এখানে রজনীগন্ধা, জারভারা ও গ্লাডিওলাসের বাগান রয়েছে। ঢাকার সিংহভাগ গোলাপের চাহিদা এই গ্রামের উৎপাদন থেকেই মেটানো হয়। প্রিয়জনকে নিয়ে বেড়িয়ে আসতে পারেন গোলাপের এই রাজ্য থেকে। বিভিন্ন রুট দিয়ে গোলাপ গ্রাম যাওয়া যায়। এর মধ্যে ঢাকার মিরপুর বা উত্তরা দিয়ে যাওয়াটা সুবিধাজনক। উত্তরার হাউজ বিল্ডিং এলাকায় নর্থ টাওয়ারের কাছ থেকে লেগুনায় করে দিয়াবাড়ি আসতে হবে। সেখান থেকে মেইন রোডে  এগিয়ে লোকাল গাড়িতে বিরুলিয়া ব্রিজ পর্যন্ত গিয়ে আরেকটি অটো ভাড়া করে চলে আসুন সাদুল্লাহপুর গোলাপ গ্রামে।

বাহ্রা ঘাট
মিনি কক্সবাজারের মতো ঢাকার আশপাশেই আছে মিনি পতেঙ্গা। ঢাকার কাছে তেমনই একটি মনোমুগ্ধকর স্থান হলো বাহ্রা ঘাট। দোহার উপজেলায় অবস্থিত এই ঘাট বর্তমানে মিনি পতেঙ্গা নামে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ঢাকার কাছাকাছি হওয়ায় রাজধানীবাসী ডে লং ট্রিপের জন্য বেছে নেন দৃষ্টিনন্দন এই স্থান। নদীভাঙন ঠেকাতে পদ্মা নদীর পাড়ের দীর্ঘ এলাকাজুড়ে বসানো হয়েছে ব্লক। এই ব্লকের ওপর দিয়েই ঘুরে বেড়ান দর্শনার্থীরা। মৈনট ঘাটের মতোই মিনি পতেঙ্গার পাড় থেকে পদ্মা নদীতে নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়ানো যায় পাড় ধরে। ঢাকার গুলিস্তান থেকে প্রায় ৩৮ কিলোমিটার দূরে এটি অবস্থিত। ঢাকার গুলিস্তান থেকে বাসে সেখানে যেতে সময় লাগে মাত্র দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। গোলাপশাহ মাজার থেকে দোহারের মৈনট ঘাটে সরাসরি বাসে যেতে জনপ্রতি ভাড়া ১১০ টাকা।

 কলি

যেতে যেতে বানিয়াচং

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬:২৫ পিএম
আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬:২৮ পিএম
যেতে যেতে বানিয়াচং
ছবি: লেখক

প্রথমে জানতাম বাংলাদেশ। পরে শুনলাম দক্ষিণ এশিয়া। এর পর মাত্র কিছুদিন আগেই জানা যায়, সারা পৃথিবীর মধ্যে বানিয়াচং হলো সবচেয়ে বড় গ্রাম। বলছি সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার অন্তর্গত বানিয়াচং গ্রামের কথা। এত বড় গ্রাম বাংলাদেশে, আর সেখানে যাব না ঘুরতে, তা কী করে হয়! অধিক সদস্য সংখ্যার ভয়ে চুপেচাপে দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের সাত ভ্রমণবন্ধু এক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মাইক্রো করে ছুটলাম। যেতে যেতে শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভা কার্যালয়ে ব্রেক।

রাত তখন প্রায় দেড়টা। আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন পৌর নির্বাহী অফিসার কাজী কামাল মনির ভাই। উনি আরেক পাগলু ট্রাভেলার। আমাদেরকে পেয়ে পাগলামির পারদ তার তুঙ্গে। এ যেন  হরেকরকম পাগল দিয়া মিলাইছিল মেলা! গভীর রাতেই আমাদেরকে নিয়ে বের হয়ে গেলেন। মনে মনে ভাবি, আমি আর কি পাগল! তার চেয়ে বড় পাগলের পাল্লায় পইড়া রাতের ঘুম হারাম। হা হা হা। প্রথমে নিয়ে গেলেন বিরামচরের সাহেববাড়ির পুকুরে। সারি সারি সুপারি গাছের ফাঁক গলে অর্ধচন্দ্রের আলোতেও পুকুরের চারপাশটা বেশ আলোকিত ছিল। চাঁদ-তারা- এসব নক্ষত্রের আসল সৌন্দর্য অন্ধকারেই বেশ বোঝা যায়।

এর পর নিয়ে গেলেন জমিদার গিরিশ চন্দ্র বিশ্বাসের বাড়িতে। চমৎকার স্থাপত্য। দারুণ সব নকশা। তবে দীর্ঘদিন অযত্ন-অবহেলায় পরিত্যক্ত হয়ে উঠেছিল। এর পর ইউএনও মিনহাজুল সাহেবের তৎপরতায় জমিদারবাড়িটি সংস্কার করা হয়। যা বর্তমানে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাড়ির সামনে শান বাঁধানো পুকুরটাও বেশ দৃষ্টিনন্দন। পুকুরঘাটেও চলল একচোট আড্ডা। ওদিকে বানিয়াচংয়ের তরুণরা আমাদের অপেক্ষায় প্রায় নির্ঘুম। তাই আড্ডার ছেদ টেনে পৌর কার্যালয়ের ফ্লোরে বেডিং বিছিয়ে কিছুটা সময়ের জন্য সবাই চিতপটাং।

মরিচপোড়া ঘুম দিয়েই সাতসকালে সবাই রেডি। নাশতা সারতেই মাইক্রো চলল। যেতে যেতে বানিয়াচং সড়কে উঠতেই মায়াবী প্রকৃতির  দুই চোখে ধরা দিল। বড় বাজার পৌঁছার আগ পর্যন্ত বারংবার থামতে হলো। আসলে প্রকৃতি আমাদেরকে থামতে বাধ্য করেছে। চোখের সামনে ফুটন্ত লাল শাপলার বিল, দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠসহ আরও কত কী! এ রকম সব মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে দেখতেই বড় বাজার পৌঁছে যাই। সেখানে অপেক্ষমাণ স্থানীয় যুবক দিহানের সঙ্গে যৎসামান্য হাই-হ্যালো করেই ছুটলাম হান্নির হাওরে। যেতে যেতে পথে দেখা মিলল শুকিয়ে যাওয়া বিল ঝিল ডোবা নালা থেকে মাছ মারার দৃশ্য। হায়রে মাছ! মাছ আর মাছ। কত পদের যে মাছ! শহুরে বাজারগুলোতে এখন না আসা বিলুপ্তপ্রায় বিভিন্ন জাতের মাছেরও দেখা পেলাম। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গাড়ি হান্নির হাওরে পৌঁছে যায়। দৃষ্টির সীমা ছাড়িয়ে যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি। মাঝে মধ্যে দু-একটা গ্রাম মাথা উঁচু করে একপায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রাতটা এখানেই কাটাব। তাই যার যার দায়িত্ব অনুযায়ী কেউ তাঁবু গাড়তে লাগল, কেউবা বাজার-সদাই লেখার লিস্ট করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল।

এরই মধ্যেই রাতভর মাছ মারতে যাওয়া জেলেরা, নৌকাভর্তি মাছ নিয়ে ফিরতে শুরু করেছে। মাছের প্রাচুর্য দেখে চোখ আমাদের কপালে। নামমাত্র মূল্যে হরেক পদের মাছ কিনি। বোয়াল মাছের কেজি মাত্র ৩৫০ টাকা। সঙ্গে কাইক্কা, পুঁটি ফ্রি। মজার মজার মাছ খেতে চাইলে আর কেন দেরি! মাছ, কাঁচাবাজার ও রাত্রি নিবাসের তাঁবু টানানো শেষ।

যাই এবার লক্ষ্মী বাঁওড়। মাদ্দের বিলের গাঙ পাড়ি দিয়ে হাঁটা শুরু করি  হাওড়ের বুক চিরে। দেশি গরুর পিছু পিছু, কখনো-বা আবার মাছ ধরার ফাঁদে চোখ বুলাতে বুলাতে কোমরসমান পানি কেটে গিয়ে পৌঁছাই লক্ষ্মী বাঁওড়ের প্রান্তরে। যতই ভিতরে যেতে থাকি, ততই মুগ্ধতা ভর করতে থাকে। হিজল-কড়ই গাছের ছড়াছড়ি। গাছগুলোর আকার-আকৃতি অনেকটাই রাতারগুলের পরিবেশ লক্ষ্মী বাঁওড়ে ভর করেছে। হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে মেছো বিড়ালের পায়ের ছাপ। বর্ষায় পানি থাকে টইটুম্বর।

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ মিঠাপানির জলাবন। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে প্রায় সমান। এই বনের আয়তন সাড়ে তিন কিলোমিটার। আকার ও আয়তনে লক্ষ্মী বাঁওড় রাতারগুলের চেয়েও অনেক বড়। পর্যটকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে পারলে দেশ-বিদেশের প্রচুর ভ্রমণপিপাসুর সমাগম হবে নিশ্চিত। পেটে টান পড়তেই চলে যাই অস্থায়ী নিবাস নূরপুর। মৎস্যজীবীদের বাবুর্চি আমাদের করা বাজার দিয়ে আগেভাগেই রান্নাটা সেরে রেখেছিলেন। এসেই শুধু গপাগপ ভাতের লোকমা। কাইক্কা মাছের ভুনা এতটাই জোশ ছিল যে, অন্যান্য মাছের তরকারির স্বাদ পুরাই ম্লান।

সময় কম। খেয়েদেয়েই ছুটলাম কমলা রানীর দীঘি। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে যাই দীঘির প্রান্তরে। প্রথম দেখায় ভালো না লাগলেও কাছাকাছি যাওয়ার পর বিস্মিত হই এর সৌন্দর্যে। নীলাভ পানি। আসমানের রঙ আর পানির রঙ মিলেমিশে একাকার। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দীঘি। সাগরদীঘি নামেও এর পরিচিতি রয়েছে।

 
দ্বাদশ শতাব্দীতে রাজা পদ্মনাভ প্রজাদের পানির কষ্ট লাঘবের জন্য গ্রামের মধ্যভাগ দিয়ে দীঘিটি খনন করান। কিন্তু খননের পর পানি না ওঠায় রাজা চিন্তিত হয়ে পড়েন। একদা রাতে রাজার স্ত্রী রানী কমলাবতী স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে আত্মবিসর্জন দেন বলে এই অঞ্চলে জনশ্রুতি রয়েছে। এই দীঘির পাড়ে বসে পল্লীকবি জসীম উদদীন রানী কমলাবতীর দীঘি নামক একটি কবিতা লিখেছিলেন।

সূর্য হেলে পড়েছে। যাই এবার বানিয়াচং রাজবাড়ি। বর্তমানে রাজবাড়ির উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো ইমারত অবশিষ্ট নেই। যাও একটি ঘর রয়েছে, সেটাও থাকে তালাবদ্ধ। তবে বাড়ির উঠোনটা বেশ চমৎকার। রাজা গোবিন্দ সিংহ বানিয়াচং রাজ্যের অধিপতি হওয়ার পর এই বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছিল। চারপাশ ভর করে সন্ধ্যা এলো নেমে। মাগরিব আদায় করেই ফিরলাম তাঁবুতে।

ভাটিয়ালি গানের আসর বসল নাজমুলের তত্ত্বাবধানে। কিন্তু আকাশে জ্বলজ্বল করা তারার মেলা আমাদেরকে সেদিকেই বেশি আকৃষ্ট করে।  হাওড়ের প্রান্তরে নিঝুম এক পরিবেশে গাড়া তাঁবুতে বেশ একটা ফুরফুরে ঘুম দিয়ে, সুবহে সাদিকের অপার্থিব ও নজরকাড়া সৌন্দর্যের স্মৃতি নিয়ে ঢাকার পথ ধরি। 

কীভাবে যাবেন
ঢাকার সায়েদাবাদ হতে সরাসরি হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং বাস সার্ভিস রয়েছে।

থাকা-খাওয়া
সুবিধামতো স্থানে তাঁবু টানিয়ে অথবা বানিয়াচং বাজারে থাকা-খাওয়ার হোটেল রয়েছে।

কলি

কার্তাহেনাতে ফুর্তি

প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭:০৮ পিএম
কার্তাহেনাতে ফুর্তি
ছবি: লেখক

কলম্বিয়াতে এবার দ্বিতীয়বারের মতো আসা। দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর উপকূলে, ক্যারিবিয়ান সাগরের তীরে জ্বলজ্বলে রত্নের মতো ছোট শহর কার্তাহেনা। এয়ারপোর্টে সময় লেগে গেল বেশ খানিক, ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়েই দেশের কথা ভাবছি। দেশে এয়ারপোর্টে নামলেই ইমিগ্রেশনটাকে একটা যন্ত্রণা বলে মনে হয়।

এখন কার্তাহেনার লম্বা ধীরগতি সম্পন্ন ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়িয়ে ঢাকার যন্ত্রণাকে আর যন্ত্রণা মনে হচ্ছে না। এয়ারপোর্টে নেমে এ ধরনের যন্ত্রণা আর অভিজ্ঞতা ভ্রমণেরই অংশ। কাজেই হা হুতাশ না করে সেটাকেও কোনো একভাবে উপভোগ করছি। ইমিগ্রেশনে যারা কাজ করেছে তাদের জেনেটিক পরীক্ষা করা হলে আমি নিশ্চিত কচ্ছপের জিন পাওয়া যাবে। পৃথিবীটাকে দেখা, অন্য প্রান্তে মানুষের জীবনটাকে একটু কাছ থেকে দেখা। 

জীবনে কখনো জন্মবার্ষিকী পালন করা হয়নি, এই প্রথম ফুর্তি করতে ইচ্ছা হচ্ছে। শারমিন, আমার এয়ার ফোর্স ওয়ান (ফার্স্ট প্রায়োরিটি), সেও চাচ্ছে ইচ্ছামতো ফুর্তি করি। আর ফুর্তি হবে বলেই কার্তাহেনাতে আসা। বলতে গেলে কার্তাহেনা দক্ষিণ আমেরিকার ব্যাংকক।

এখন বছরের প্রায় শেষ সময়, বড়দিন সামনে, শহর আলোকিত, আনন্দের শ্রেষ্ঠ সময় এখনই। প্রায় সপ্তাহখানেকের জন্য এসেছি আমরা, খাবদাব, হাঁটব, মানুষ দেখব, শহরের আলো এসে পড়বে গায়ে– এই তো ভ্রমণ। আমার পঞ্চাশে যুক্ত হলো কার্তাহেনার নাম, অস্বীকার করা ঠিক হবে না, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একগাদা ফুর্তি। এখন থেকেই ঠিক করে ফেললাম, বাকিটা জীবন ফুর্তি করেই কাটিয়ে দেব। কী আছে দুনিয়ায়! এখানে ‘ফুর্তি’ শব্দটার অর্থ একটু পরিষ্কার করে বলি, নয়তো অনেকেই ভাববে ফুর্তি মানেই লাফালাফি, ফালাফালি, পার্টি, হিহি-হাহা টাইপ কাজকর্ম। আমি এখানে ফুর্তি বলতে যা বলি তা হলো অনেকটা এরকম, ভালো থাকা, দুশ্চিন্তার বাইরে চলে যাওয়া, সবকিছুতেই অংশ নেওয়া, কিন্তু গা না মাখানো। কোনো কষ্ট যাতে ছুঁয়ে যেতে না পারে। চারপাশে হচ্ছে, যা হওয়ার, হোক, আমার ভেতর থাকবে ফুর্তিতে।

কলম্বিয়ার কার্তাহেনা প্রাণবন্ত শহর ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য এক স্বপ্নের গন্তব্য। এসে দেখে যাও ঔপনিবেশিক ইতিহাসের গল্প, প্রাণচঞ্চল জীবন, এবং নীল সমুদ্রের নিরন্তর ডাক।

কার্তাহেনা পুরোনো শহর, সে যেন সময়কে ধরে রেখেছে। শহরের রঙিন বাড়ি, সংকীর্ণ পথ এবং প্রাচীন প্রাসাদগুলো স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক শাসনের এক নিখুঁত চিত্র। পুরোনো শহরের চত্বরে বসে গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে দেখা যায় ব্যস্ত জীবন পাশ কেটে যায় পলকে।

রাতের কার্তাহেনা আলোতে ছোঁয়া, অলিগলি, হাঁটা পথ, মানুষের সমাগম। রাস্তাগুলোতে ফুটে ওঠে জীবনের উচ্ছ্বাস। গেটসেমানি এলাকায় দেয়ালচিত্রের (স্ট্রিট আর্ট) মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বোঝা যায়, শিল্প এখানে জীবনেরই আরেকটি ভাষা।

শহরের আধুনিক দিক দেখতে চাইলে যেতে হবে বোকা গ্রান্ডে। এখানে ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের ধারে সারি সারি আধুনিক হোটেল আর রেস্টুরেন্ট। দিনভর সৈকতে রোদ পোহানোর পর সন্ধ্যায় অভিজাত রেস্টুরেন্টগুলোতে সি-ফুডের সঙ্গে স্থানীয় মিউজিকের তালে তালে নাচের আমেজে মেতে উঠে শহর।

পৃথিবীর যেকোনো ভূখণ্ডেই তার বড় সম্পদ সেখানকার মানুষগুলো। কার্তাহেনাতেও তাই, এখানেও মানুষ দরিদ্র অনেক, আছে অভাব-অনটন, তবু মুখে হাসি। আর প্রাণখোলা হাসি বারবার মনে করিয়ে দেয়, ভ্রমণ শুধু স্থান নয়, এ এক মানুষকে জানার গল্প।

কার্তাহেনা শুধু একটি শহর নয়, এটি ইতিহাস, প্রকৃতি, সংস্কৃতি এবং জীবনের এক মেলবন্ধন। কার্তাহেনার ইতিহাস আছে, মানুষ, শিল্প, সংস্কৃতি আছে, আছে আরও বহু কিছু। আমার ক্ষুদ্র সময় এখানে মনে করিয়ে দেয় আমি অর্ধশত বছরে পা ফেলেছি কার্তাহেনাতে। হাতে সময় নেই আর, আরও অনেকটা পথ যেতে হবে, হয়তো যাব, হয়তো থেমে যাবে সব। ঘটুক যা ঘটার। আমার আছে শুধু ‘আজ’, এই নিয়েই থাকব আমি। অতীত ছুঁয়ে দেখার নয়, ভবিষ্যৎ কারও কখনো আসেনি। আমরা যা কিছু, সব এখনই। কাজেই ঘরে বসে থেকে কী লাভ? চল ফুর্তি করি, এর চেয়ে ভালো কিছু নিজেকে উপহার দেওয়া প্রায় অসম্ভব।

 কলি 

প্রকৃতির মায়ায় মারমেইড বিচ রিসোর্ট

প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫২ পিএম
প্রকৃতির মায়ায় মারমেইড বিচ রিসোর্ট
ছবি: মারমেইড বিচ রিসোর্ট

কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকত, যেখানে সোনালি বালু আর নীল আকাশ মেলে ধরেছে এক অপূর্ব দৃশ্য, সেখানে এমন এক রিসোর্ট রয়েছে, যা আপনাকে এনে দেবে সম্পূর্ণ অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা। শরতের সোনালি রোদের আলিঙ্গনে যখন আমি প্রথম রিসোর্টে প্রবেশ করি, মনে হচ্ছিল যেন একটি পুরনো বইয়ের পাতায় পা রেখেছি। মৃদু-মন্দ সাগরের হাওয়া, সোনালি আভায় ভেসে থাকা বালুকাবেলা, আর চারপাশে অগণিত গাছপালা- এই দৃশ্য যেন কিছুটা কবিতার মতো, যেখানে সময় থেমে গেছে।

মারমেইড বিচ রিসোর্ট, যা মেরিন ড্রাইভ রোডের পাশে পেঁচার দ্বীপের কোনে অবস্থিত, কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্যই নয়, এখানে আসলে এক অনন্য প্রশান্তির ছোঁয়া পাওয়া যায়। শরতের সোনালি রোদ আর মৃদু বাতাসের মাঝে সেখানে দুই রাত কাটিয়ে, মনে হয়েছে সময় যেন থমকে গেছে, আর প্রকৃতি আপনাকে তার আদর-মাখানো গান শুনিয়েছে।
রিসোর্টের কটেজগুলো যেন নিজেই একেকটি ছোট্ট পৃথিবী। বাঁশ আর পুনর্ব্যবহৃত কাঠ দিয়ে তৈরি, কটেজগুলো আধুনিক সুবিধার পাশাপাশি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক নিখুঁত মেলবন্ধন। গাছের ছায়ায় ঘেরা আমার কটেজটি যেন এক পুরনো গল্পের অংশ, যার প্রতিটি কোনে লুকিয়ে ছিল কিছু অজানা রহস্য। খোদাই করা কাঠের দরজা, স্থানীয়ভাবে তৈরি সজ্জা, আর সোনালি আলোয় স্নিগ্ধ লণ্ঠন- সবকিছু যেন আহ্বান জানাচ্ছিল- ‘আর একটু থাকুন, এখানে আরও কিছু মধুর স্মৃতি তৈরি করুন।’

প্রকৃতির সিম্ফনি, পাখির গান আর সমুদ্রের দূরবর্তী আওয়াজ- এখানে সকালের শুরুটা যেন একদম আলাদা। প্রথম সকালে, ঢেউয়ের ছন্দের মাঝে চোখ মেলে দেখলাম সমুদ্রের অপরূপ দৃশ্য। কফির কাপ হাতে, বারান্দায় বসে আমি শুধু তাকিয়ে ছিলাম। শান্ত, মৃদু বাতাস আর সমুদ্রের লবণাক্ত গন্ধে মন যেন আরও বেশি প্রকৃতির সান্নিধ্যে চলে যাচ্ছিল। এক মুহূর্তে, সময় যেন থেমে গিয়েছিল।

কিন্তু মারমেইড বিচ রিসোর্ট শুধুই নিঃসঙ্গতার স্থান নয়। এখানে সক্রিয়তার খোঁজে থাকা মানুষের জন্যও অনেক কিছু আছে। কায়াকিং, সাইকেল রাইডিং, অথবা সৈকতের ধারে পায়ের তলায় বালির অনুভূতি- সবকিছুই অপেক্ষা করছে আপনাকে অভ্যর্থনা জানাতে। এক বিকেলে, আমি সাইকেল নিয়ে রিসোর্টের চারপাশে ঘুরতে বের হই, আর হঠাৎ অনুভব করি, যেন দিগন্তের সীমাহীনতা আমাকে এক নতুন জীবন দেখাচ্ছে। বাতাসের টানে মাথার চুল উড়ছে, আর সমুদ্রের ধারে এই অসীম দৃশ্য মনে হয় যেন কোনো শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা ছবি।

 

রিসোর্টের রেস্তোরাঁর খাবার ছিল এক চমৎকার রন্ধনশিল্পের উদাহরণ। স্থানীয় উপাদান দিয়ে তৈরি প্রতিটি পদ যেন এক নান্দনিক রচনা। এক সন্ধ্যায়, আমি গ্রিলড পমফ্রেট খেয়েছিলাম- এটির ধোঁয়ামাখা গন্ধ, আর ট্যাঞ্জি আম সালসার সঙ্গে তার সমন্বয় ছিল এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। পরের রাতে নারকেল থেকে তৈরি একটি ডিজার্ট খেয়েছিলাম, যা মনে করিয়ে দিয়েছিল- যত সহজই হোক না কেন, আন্তরিকতা দিয়ে প্রস্তুত করা যেকোনো খাবার অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে।

মারমেইড বিচের সন্ধ্যাগুলো যেন এক বিশেষ মায়ায় রঙিন। প্রথম রাতে, সৈকতে লাইভ মিউজিক ছিল, আর আগুনের নরম আলো ছড়ানো ছিল সুরে সুরে। গিটারিস্টের বাজানো সুর যেন তরঙ্গের ধ্বনির সঙ্গে মিলে এক অভূতপূর্ব সংগীত রচনা করছিল। দ্বিতীয় রাতে, পূর্ণিমার আলোতে সৈকতের ধারে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়েছিল, এ যেন এক অপার্থিব অভিজ্ঞতা। আমার পায়ের তলায় শীতল বালি সমুদ্রের অপরূপ আলোয় চমকাচ্ছিল।

মারমেইড বিচ রিসোর্টের একটি অতিরিক্ত সৌন্দর্য রয়েছে, যা সাধারণত এমন রিসোর্টগুলোর মাঝে দেখা যায় না- এটি পরিবেশবান্ধব একটি রিসোর্ট, যা প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে। রিসোর্টের স্থাপত্য নকশা থেকে শুরু করে তার কার্যক্রম পর্যন্ত- সবকিছুতে পরিবেশের সঙ্গে খাপখাইয়ে চলার ছাপ। সৌরশক্তি ব্যবহার করে আলোকসজ্জা, বৃক্ষরোপণ প্রকল্প, আর ইকো-ফ্রেন্ডলি কাঠামো- সবকিছুই রিসোর্টটির পরিবেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে। বিশেষ করে, পেঁচার দ্বীপের সবুজে ঘেরা প্রকৃতি, যা রিসোর্টের একেবারে কাছেই অবস্থিত, তা যেন প্রাণী ও গাছপালার একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে।

আরেকটি দিক যা আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে, তা হলো রিসোর্টের স্থানীয় সম্প্রদায়ের প্রতি দায়বদ্ধতা। অনেক কর্মী এখানকার আশপাশের গ্রাম থেকে আসে এবং রিসোর্টটি স্থানীয় কৃষক ও কারিগরদের সহযোগিতা করে, যা এ ধরনের পর্যটন ব্যবসায় খুবই বিরল। রিসোর্টের সাবান, যা স্থানীয় সমবায় থেকে তৈরি, অথবা আমার সালাদের সবজি, যা মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি খামার থেকে সংগ্রহ করা- এসব প্রমাণ করে যে পর্যটন শুধু আনন্দের জন্য নয়, বরং দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করলে এর মাধ্যমে ব্যবসার পাশাপাশি স্থানীয় ভূমি ও সংস্কৃতিকেও সহযোগিতা করা সম্ভব।

রিসোর্টের শেষ সকালে, যখন আমি সৈকতে বসে সূর্যোদয় দেখছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল, যেন এই স্থানে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তই এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। এটি শুধু একটি থাকার স্থান নয়, বরং এ এক নতুন জীবন যাপনের পদ্ধতি- প্রকৃতির সঙ্গে, নিজের সঙ্গে, আর জীবনের সরল আনন্দের সঙ্গে মেলবন্ধনের জায়গা।

 কলি

বরেন্দ্রভূমিতে একদিন

প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৫৮ পিএম
আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৫৮ পিএম
বরেন্দ্রভূমিতে একদিন
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। ছবি: সংগৃহীত

বরেন্দ্রভূমি আমার কাছে বুকের ভেতর জেগে থাকা একটা জায়গার নাম। এ ভূমির পরতে পরতে মায়ার বিস্তার। এই মায়াপুরে কাটানো দুদিনের গল্প বলব আজ। প্রতিবারই কাকতালীয়ভাবে শীত মৌসুমে রাজশাহী যাওয়া হয় আমার। অন্য মৌসুমে এই জেলা দেখতে কেমন, তা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়নি। এবারেও রাতের ট্রেনে করে চলে গেলাম রাজশাহী; পৌঁছালাম শীতের নরম ভোরে। তখন সুয্যিমামা তার সোনালি আলো ছড়াতে শুরু করেছে। সেই আলো এসে পড়েছে রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের গায়ে। কী যে অপূর্ব সেই সোনামাখা দৃশ্য!

আত্মীয়ের বাসায় উঠে সকালের নাশতা সেরে বিশ্রাম নিলাম কিছুক্ষণ। তার পর রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঘুরতে। প্রথমে গেলাম সদরে অবস্থিত বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে।

প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহের জন্য এ জাদুঘরটি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম। শুধু তাই নয়, এটিই বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর। এ জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় নাটোরের দিঘাপাতিয়া রাজপরিবারের জমিদার শরৎ কুমার রায়, আইনজীবী অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এবং রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক রামপ্রসাদ চন্দ্রের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে তারা বাংলার ঐতিহ্য ও নিদর্শন সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি গঠন করেন। ওই বছরে তারা রাজশাহীর বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান চালিয়ে ৩২টি দুষ্প্রাপ্য নিদর্শন সংগ্রহ করেন।

এই নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করার জন্য শরৎ কুমার রায়ের দান করা জমিতে জাদুঘরটির নিজস্ব ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। নির্মাণ শেষ হয় ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে। একই বছরের ১৩ নভেম্বর বাংলার তৎকালীন গভর্নর কারমাইকেল জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন। মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ছাড়াও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি এই জাদুঘরটি পরিদর্শন করেছেন। জাদুঘরটিতে অনেক পুরোনো দিনের নিদর্শন রয়েছে। মহেঞ্জোদারো সভ্যতা থেকে সংগৃহীত প্রত্নতত্ত, পাথরের মূর্তি, খ্রিষ্টীয় একাদশ শতকে নির্মিত বুদ্ধমূর্তি, গঙ্গামূর্তিসহ অসংখ্য মূর্তি এই জাদুঘরের অমূল্য সংগ্রহের অন্তর্ভুক্ত। মোগল আমলের রৌপ্য মুদ্রা, গুপ্তসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের গোলাকার স্বর্ণমুদ্রা, সম্রাট শাহজাহানের গোলাকার রৌপ্য মুদ্রাও রয়েছে সংগ্রহে। এখানে প্রায় ৫,০০০ পুঁথি রয়েছে, যার মধ্যে ৩,৬৪৬টি সংস্কৃত আর বাকিগুলো বাংলায় রচিত।

কালো পাথরের মূর্তি

জাদুঘর দেখা শেষ করে গেলাম টি-বাঁধে। পেয়ারা মাখা খেয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর চলে গেলাম রুয়েটে। রুয়েট আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পাশাপাশি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাজ্জাদের লেবুচুরের বেশ সুনাম রয়েছে। তাই রুয়েট থেকে গেলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেবুচুর খেতে এবং তা খেয়ে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি। তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা আর বধ্যভূমি দেখে মন খুব ভার হয়ে গেল। সংগ্রহশালা দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে উঠেছিল জলে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল প্রায়। প্রথম দিনের ঘোরাঘুরি এভাবেই শেষ হলো।

দ্বিতীয় দিনের ভ্রমণটা ছিল সবচেয়ে স্মরণীয়। আমার ইচ্ছে ছিল, রাজশাহীর কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে গরুর গাড়িতে চড়ব। হারিকেন জ্বালিয়ে ঝুলিয়ে দিব সেই গাড়িতে। আর সরিষাখেতের পাশে বসে মাটির সানকিতে করে খিচুড়ি খাব। আমার ইচ্ছে পূরণ করতে কিছু মাটির সানকি কেনা হলো। খুঁজে খুঁজে গরুর গাড়ি না পেয়ে মহিষের গাড়ি জোগাড় করা হলো। একটা হারিকেনের বন্দোবস্তও করা হলো। শুধু তাই নয়, আমার জন্য ভাপা পিঠাও বানানো হলো। আর খিচুড়ির সঙ্গে মুরগির মাংস, বেগুন ভাজা, ডিম ভাজা এসবের আয়োজন করা হলো। আমি ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম আমার ইচ্ছে পূরণে কাছের মানুষগুলোর এই কর্মযজ্ঞ দেখে।

প্রাইভেট কারে প্রথমে রাজশাহীর পবা উপজেলার এক গ্রামে গেলাম। খুব প্রত্যন্ত না হলেও খাঁটি গ্রাম বলা যায় অবশ্যই। গ্রামের নাম ভুগরইল। প্রথমে সরিষাখেতের পাশে বসে খিচুড়ি খেলাম আয়েশ করে। তখন বিকেল বেলা। এরপর ঠিক করে রাখা মহিষের গাড়িতে উঠে বসলাম। ফসলের মাঠের আলপথ ধরে যাচ্ছিলাম আর মুগ্ধচিত্তে অনুভব ঘনিয়ে এলে হারিকেন জ্বালানো হলো। সূর্য ডুবে গেল, অন্ধকার গাঢ় হতে লাগল। সবুজ ফসলের মাঠে ছন্নছাড়া অন্ধকার খেলা করতে শুরু করল রাত নামাবে বলে। জীবনে এত অভূতপূর্ব মুহূর্ত বারবার আসে না।

এক আকাশ স্বপ্ন পূরণের উচ্ছ্বলতা নিয়ে ফিরে এলাম রাজশাহী শহরে। সিঅ্যান্ডবি মোড়ে এক লেখকের সঙ্গে দেখা করে শিক কাবাবের বার্গার খেলাম আর কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে এবারের রাজশাহী ভ্রমণের সমাপ্তি টানলাম।

রাজশাহীতে আরও যা যা দেখার আছে
রাজশাহী সদরে আছে জিয়া শিশুপার্ক, পদ্মা গার্ডেন, মুক্তমঞ্চ, শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী পার্ক বা সেন্ট্রাল পার্ক। পবা উপজেলায় আছে শাহ্ মখদুম বিমানবন্দর, গরু-মহিষের বাজার, হস্তশিল্পপল্লী। পুঠিয়া উপজেলায় আছে পুঠিয়া রাজবাড়ি, রাজবাড়িসংলগ্ন একাধিক মন্দির, দোল মন্দির, হাওয়াখানা। মোহনপুর উপজেলায় আছে পানের বরজ। তানোর উপজেলায় আছে চোলকুরের জমিদারবাড়ি, কিশোর মোহন চৌধুরী জমিদারবাড়ির শত বছরের শিবমন্দির, সাঁওতালপল্লী, গরু-মহিষের গাড়ি, কামার-কুমারপল্লী, বাঁশের হস্তশিল্পপল্লী, নাইস গার্ডেন পার্ক। চারঘাট উপজেলায় আছে সারদা ক্যাডেট কলেজ, সারদা পুলিশ একাডেমি, হাজার বছরের পুরোনো বৃক্ষ, সরদহ রেলওয়ে স্টেশন, তাঁতপল্লী, নীলকুঠি, খয়ের প্রস্তুতকরণ এলাকা। গোদাগাড়ি উপজেলায় আছে বরেন্দ্র পার্ক, সাফিনা পার্ক, সরমংলা ইকোপার্ক, মৃৎপল্লী, সাঁওতালপল্লী, গরু-মহিষের গাড়ি, ধানসিঁড়ি খেত। বাগমারা উপজেলায় আছে হাজার দুয়ারী জমিদারবাড়ি (বীরকুৎসা নামেও পরিচিত), তাহেরপুর রাজবাড়ি, গোয়ালকান্দি জমিদারবাড়ি। বাঘা উপজেলায় আছে বাঘা শাহী মসজিদ ও তৎসংলগ্ন বাঘা দীঘি, উৎসব পার্ক, বাঘা জাদুঘর, বাঘা দরগাহ শরিফ ইত্যাদি।

কীভাবে যাবেন
ঢাকার কল্যাণপুর থেকে বাসে যেতে পারেন। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে যেতে পারেন। বিমানেও যেতে পারবেন রয়েছে এই সুন্দর শহরে।

কী খাবেন
কালাভুনা, সিঅ্যান্ডবি মোড়ের গরম মিষ্টি, বট পরোটা, বীরেন রেস্তোরাঁর কলিজা সিঙ্গারা, খাসির মাংসের চপ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাজ্জাদের লেবুচুর, টি-বাঁধের পেয়ারা ও আচার মাখা, শিক কাবাবের বার্গার, নবরূপা আর মৌচাকের মিষ্টি এবং আম।

কোথায় থাকবেন
রাজশাহী শহরেই থাকার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট হোটেল রয়েছে।

 কলি