
যখন আকাশজুড়ে থই থই জ্যোৎস্না থাকবে, তখন একবার লঞ্চের ছাদে চড়ে বরিশালে যাব- এমন ইচ্ছে ছিল অনেক দিনের। হঠাৎ একদম অপরিকল্পিতভাবে সেই সুযোগ এসে গেল।সেপ্টেম্বরের শেষ দিকের কথা। ১৭ জনের টিম যাবে কুয়াকাটায়। একদম রওনা দেওয়ার দিন আমাকে এক প্রকার কিডন্যাপ করে ধরেবেঁধে তাদের সঙ্গে নিয়ে গেল। দুই দিনের ভ্রমণ। ব্যাগ গোছানোর জন্য সময় পেলাম পাঁচ মিনিট। আমাকেসহ টিমের সদস্য সংখ্যা দাঁড়াল ১৮ জন এবং পুরো টিমের ভেতর আমিই সবচেয়ে সিনিয়র সদস্য। সবার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বয়সের কারণে পরে মনে হলো, আমিই যেন দায়িত্ব নিয়ে সবাইকে নিয়ে যাচ্ছি ঘুরতে।
সদরঘাট থেকে আমরা লঞ্চে উঠে বসলাম সন্ধ্যার আগে আগে। একাধিক কেবিন আর কিছু ডেকের সিট নেওয়া হয়েছে। যথাসময়ে লঞ্চ ছেড়ে দিল। আস্তে আস্তে শহর পেরিয়ে গেলাম। সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে রাত নামল। কেবিন ভাড়া করা হলেও সবাই মিলে ছাদে চলে গেলাম। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাঁদ আড়মোড়া ভেঙে জ্যোৎস্না ছড়াতে শুরু করল। শহর পেরিয়ে গ্রামের দিকে যেতে শীত অনুভূত হলো। এমনিতেই নদীর বাতাস, তার ওপর গ্রামের দিকে যেন শীতের অঙ্কুর গজাচ্ছে। সব মিলিয়ে মোহনীয় এক অনুভূতি।
ক্ষুধা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার পর আমরা সবাই রাতের খাবার খেলাম। টিমের একজন সদস্য সবার জন্য বিরিয়ানি রান্না করে এনেছিল। জ্যোৎস্নাপ্লাবিত আকাশের নিচে বসে আয়েশ করে খেলাম পছন্দের খাবার। গল্পে গল্পে রাত বাড়তে লাগল।
সকালের আলো যখন চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে তখন পটুয়াখালী পৌঁছালাম। তারপর অটোতে করে বাসস্ট্যান্ডে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে সেখানেই সকালের নাশতা সেরে বাসে চড়ে বসলাম। গন্তব্য সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটা। কুয়াকাটায় পৌঁছাতে আমাদের সময় লাগল প্রায় দুই ঘণ্টা। আগে হোটেল বুকিং দেওয়া ছিল না। তাই পৌঁছেই হোটেল খুঁজতে শুরু করলাম। সমুদ্রতীর থেকে পায়ে হাঁটা পথে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে পেয়ে গেলাম বাজেটের মধ্যে হোটেল। হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম।
দুপুরে গোসলের জন্য সবাই সমুদ্রে গেলাম। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছিল। সেই ঢেউয়ের সঙ্গে মিতালি করে দুপুরের রোদ গায়ে মেখে তুমুল আনন্দে গোসল করছিলাম আমরা। সমুদ্রতীরে ভেজা শরীর এলিয়ে দিয়ে সানগ্লাস চোখে বিশাল আকাশ আর সমুদ্র দেখতে দেখতে নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিল। সমুদ্রের কাছে এলে সবারই নিজেকে খুব ক্ষুদ্র লাগে বোধহয়।
গোসল শেষে হোটেলে ফিরে গিয়ে সবাই পোশাক বদলে নিলাম। সমুদ্রে দাপাদাপি করে গোসল করাতে সবাই খুব ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিল। আবাসিক হোটেলের কাছেই একাধিক খাবারের হোটেল রয়েছে। সেখান থেকে সবাই পেটপুরে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম।
রোদ একটু কমে এলে ঘোরার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। সেখানে পর্যটন স্পটগুলো ঘুরে দেখানোর জন্য পর্যাপ্ত মোটরসাইকেল আর ভ্যানগাড়ি আছে। আমরা কতগুলো বাইক ভাড়া করলাম সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত ঘোরার জন্য। তাদের কাছে কুয়াকাটার দর্শনীয় স্থানের একটি তালিকা থাকে। তারা সেসব তালিকা দেখিয়ে পর্যটকদের ইমপ্রেস করতে চায়। সেখানে বেশকিছু স্পটের কথা উল্লেখ থাকলেও কিছু কিছু স্পট শুধু নামে মাত্রই, দেখার তেমন কিছু নেই।
প্রথম দিনে আমরা লেবুর বন, ফিস মার্কেট, শুঁটকিপল্লী, ঝাউবন আর তিন নদীর মোহনা দেখলাম। সমুদ্রতীর থেকে ঝিনুক কুড়ালাম। যেসব জায়গা ভালো লাগছিল, বাইক থামিয়ে সেসব জায়গায় কিছুক্ষণ করে ঘুরে বেড়িয়েছি। শুঁটকিপল্লীতে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত শুঁটকি তৈরির কার্যক্রম চলে। তাই আমরা সেসব কার্যক্রম দেখতে পারিনি। তবু ঘুরে এসেছি। তিন নদীর মোহনায় দাঁড়িয়ে অন্য রকম ভালোলাগা কাজ করছিল। সূর্যাস্তের আগে আমরা সেখানটায় ফিরে এসেছিলাম, দুপুরে যেখানে গোসল করেছিলাম। সূর্যাস্তের সময়টায় বুকের ভেতর কেমন বিষাদ ভর করে। তাই সূর্যাস্ত দেখার জন্য কালো রঙের শাড়ি পরেছিলাম। সমুদ্র তখন বেশ শান্ত ছিল। সমুদ্রতীরে বসে ছিলাম গোধূলির অনেকটা সময়। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর সমুদ্রজলে পা ভিজিয়ে তাকিয়ে ছিলাম আকাশের দিকে। সে এক মন-কেমন করা অনুভূতি।
রাতে আমরা আবার সমুদ্রতীরে গেলাম। মাছের বারবিকিউ করার জন্য বড় দুটো সামুদ্রিক মাছ কিনলাম। বারবিকিউর প্রস্তুতি চলছিল, এমন সময় ভাটা পড়ে যাওয়া সমুদ্র যেন আমাকে দুই হাত বাড়িয়ে ডাকছিল। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছিল সমুদ্রাঞ্চল। চরাচরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সেই জ্যোৎস্না গায়ে মেখে হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলাম সমুদ্রের গহীন প্রকোষ্ঠে। তারপর আবার ফিরে এলাম বারবিকিউর উৎসবে। চারপাশে গোল হয়ে চৌকিতে বসলাম সবাই। মাঝখানে আগুন জ্বলছিল আর তার পাশে বারবিকিউ হচ্ছিল। সবাই গান-গল্পে মেতে রইলাম। বারবিকিউ হয়ে গেল। সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার অভ্যেস কম। তাই অন্য সবার মতো আয়েশ করে খেতে পারলাম না। অল্প করে খেলাম।
রাতে হোটেলে ফিরে গিয়েও যেন আমাদের গল্প আর ফুরোয় না। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে কেবল একটু ঘুমিয়েছি, তখনই আবার উঠে পড়ার তাড়া। সূর্যোদয় দেখতে হবে। আগের দিনই বাইক ঠিক করা ছিল। বাইকওয়ালারা হোটেলের সামনে এসে তাড়া দিচ্ছে। সেদিন জীবনে প্রথম দুই মিনিটে শাড়ি পরলাম। সবুজ সতেজতার প্রতীক। তাই সূর্যোদয় দেখার জন্য সবুজ রঙের শাড়ি নিয়ে এসেছিলাম।
সূর্যোদয় দেখার জন্য বাইক ছুটতে শুরু করল দ্রুত গতিতে। ভোরের সমুদ্র যে কী অদ্ভুত সুন্দর, তা বলার মতো নয়। চলতে চলতে একবার ছোট একটা খালের মতোও পার হতে হলো নৌকায়। নৌকাতে বাইক তুলে দিয়ে আমরাও নৌকায় চড়ে বসলাম। নামার পর আবার বাইক চলতে শুরু করল। যেই স্পটে আমাদের সূর্যোদয় দেখার কথা ছিল, সেখানে পৌঁছানোর আগেই সূর্য উদয় হলো। তবু আমরা মুগ্ধ চোখে দেখলাম। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সূর্য তার সোনালি আলো ছড়িয়ে দিল খানিকটা। দ্বিতীয় দিনে আমরা দেখলাম গঙ্গামতির চর, লাল কাঁকড়ার চর, রাখাইন পল্লী, রাখাইন মার্কেট, বৌদ্ধমন্দির, ২০০ বছরের পুরোনো নৌকা, বিখ্যাত কুয়া ইত্যাদি। বাইকে চড়ে সমুদ্র আর গ্রামাঞ্চল ছুঁয়ে এসব জায়গা দেখতে বেশ ভালোই লাগছিল।
দুপুরে হোটেলে ফিরে এলাম। হোটেলে আসার আগে হোটেলের পাশেই আরেকটা বৌদ্ধমন্দির দেখে নিলাম। দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই বিশ্রাম নিলাম। এবার ফেরার পালা। ফেরার সময় আমরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেলাম। এক দল রাতের বাসে ঢাকা ফিরবে। আর আমরা কয়েকজন বরিশাল থেকে লঞ্চে উঠে ফিরব। দুপুরের পরই আমরা বরিশালে যাওয়ার জন্য বাসে করে রওনা হলাম। প্রায় ৪ ঘণ্টা লাগল পৌঁছাতে। বরিশাল পৌঁছে বাঁধল বিপত্তি। লঞ্চে একটা কেবিনও ফাঁকা নেই। সেই লঞ্চ মালিকরা আমাদের পরিচিত ছিল। অনেক চেষ্টার পরে কোনো একভাবে একটা কেবিনের ব্যবস্থা করে দিলেন তারা। ফেরার সময়ও সবাই ছাদে বসে জ্যোৎস্না দেখতে দেখতে ফিরেছি। কেউ কেউ কিছুটা সময়ের জন্য কেবিনে গিয়ে বিশ্রাম নিয়েছে।
ভোরবেলা সদরঘাটে এসে নামলাম। পেছনে ফেলে এলাম কিংবা হয়তো সঙ্গে করেই নিয়ে এলাম সমুদ্রজল ছুঁয়ে গল্প বোনা দিনের স্মৃতি।
কীভাবে যাবেন
বাসে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে কুয়াকাটা যেতে সময় লাগবে ৬-৭ ঘণ্টা। সায়েদাবাদ, আব্দুল্লাহপুর, আরামবাগ অথবা গাবতলী থেকে শ্যামলী, গ্রীন লাইফ, হানিফ এবং আরও কিছু বাস এই রুটে চলাচল করে। ভাড়া ৯০০-১৬০০ টাকা।
নদীপথে যেতে চাইলে সদরঘাট থেকে বরিশাল বা পটুয়াখালীগামী লঞ্চে উঠতে হবে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় লঞ্চ ছেড়ে যায়। ভোর বা সকালে পৌঁছায়। পটুয়াখালী বা বরিশাল নেমে বাসে করে যেতে হবে কুয়াকাটা। ডেকের ভাড়া ৪০০-৫০০ টাকা, কেবিন ভাড়া ১০০০-৭০০০ টাকা। তবে ভাড়া পরিবর্তনশীল।
কুয়াকাটা গিয়ে যে বাইকে করে দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখবেন, সেই বাইক সবগুলো স্থান ঘুরে দেখাতে ১০০০-১৫০০ টাকা পর্যন্ত নেবে।
কোথায় থাকবেন
কুয়াকাটায় প্রতি বছর অনেক পর্যটকই ঘুরতে যান। তাই সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে বাজেট হোটেল রয়েছে। সমুদ্র থেকে কাছেই হোটেল পেয়ে যাবেন।
সতর্কতা
সাঁতার না জানলে সমুদ্রে গোসল না করাই ভালো। বিশেষ করে জোয়ারের সময় সতর্ক থাকতে হবে। সমুদ্র কিংবা অন্য কোনো স্থানে আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন।
কলি