
অনেক দিন হয় কোথাও বের হওয়া হয় না। তাই মন চাইছিল কোথাও ছুট লাগাই। শুক্রবার তাই সূয্যি মামা নয়ন মেলার পরই ফোন দিলাম আমাদের চার চাকার পাইলট পলাশ ভাইকে। বেশ কয়েকবার ফোন দিলাম কোনো সাড়া-শব্দ নেই। যার মানে দাঁড়ায় পলাশ ভাই এখনো নিদ্রায় আছেন। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সকাল নয়টার দিকে ফোন ব্যাক করলেন। ফোন ধরেই পলাশ ভাইকে বললাম আপনি ফ্রেশ হয়ে বাসায় চলে আসেন। বাইরে বের হব। স্বল্প সময় পরই পলাশ ভাই বাসায় এসে উপস্থিত। সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়লাম। গাড়িতে উঠতেই পলাশ ভাই বলে উঠলেন কোথায় যাব। আমি বললাম, কোথায় যাব তা তো জানি না। ঢাকামুখী চলেন- দেখি কোথায় গিয়ে থামা যায়। তপ্ত রোদে মহাসড়ক পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি।
চলতি পথে জাদুর বাক্স ঘাঁটছিলাম। আমি মোবাইল ফোনকে জাদুর বাক্স বলি। কেননা এই জাদুর বাক্সের নেশা থেকে বের হওয়া খুব কঠিন। যাই হোক, জাদুর বাক্সের কল্যাণে চোখে পড়ল ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মেড্ডায় অবস্থিত ৩০০ বছরের পুরনো শ্রীশ্রী কালভৈরব মন্দিরের কথা। পলাশ ভাইকে বললাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে যাওয়ার জন্য।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কালভৈরব মন্দিরে গিয়েছেন কি না জানতে চাইলে পলাশ ভাই বললেন, যাই নাই কখনো; তবে নেটে সার্চ দিয়ে বের করা যাবে। পলাশ ভাইয়ের কথা শুনে মনে হলো আসলেই আমরা ডিজিটাল যুগে আছি। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে আমরা মহাসড়কে আছি। নির্মীয়মাণ ছয় লেনের সড়ক ধরে এগিয়ে চলছি। ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চলায় গাড়ি একটু ধীরগতিতেই চলছিল। পলাশ ভাই বললেন, সড়কটি আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে আখাউড়া হয়ে আগরতলায় ঢুকেছে। আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে সরাইল বিশ্বরোড মোড়, সেখান থেকে আখাউড়ার ধরখার। পরে ঢুকেছে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায়। সড়কটির কাজ সম্পন্ন হলে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহনে উন্মুক্ত হবে নতুন দিগন্ত।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের মেড্ডা এলাকায় যখন আমাদের গাড়ি থামল তখন সূর্য হেলান দিয়েছে পশ্চিম কোণে। সড়ক থেকেই চোখে পড়ে মন্দিরটির বিশাল তিনটি মঠ। একটু সামনে এগোতেই গেট ঠেলে পা রাখতে রাখতেই দৃষ্টি পড়ল খোদাই করা লেখার দিকে। লেখা ‘শ্রীশ্রী কালভৈরব নাটমন্দির’। নেট ঘেঁটে পলাশ ভাই নিয়ে এলেন শত বছরের পুরনো কালভৈরব মন্দিরের প্রবেশদ্বারে। খালি পায়ে আমরা এগিয়ে চললাম মন্দির পানে। দর্শন পেলাম ২৮ ফুট উঁচু শ্রীশ্রী কালভৈরব মূর্তির। মাথা ঠেকে আছে মন্দিরের ছাদে। প্রশস্ত মধ্যপ্রদেশ উঁচিয়ে পায়ের ওপর হাত রেখে বসে আছেন শিব। জটা বিছিয়ে কাঁধজুড়ে। হাতের ডানপাশে বিশাল এক ত্রিশূল। সামনে থেকে না দেখলে মূর্তিটির বিশালতা আন্দাজ করা যায় না। আগরবাতির সুবাসিত গন্ধে মন নিয়ে গেল এক অপার্থিব জগতে।
কথা হচ্ছিল ওই এলাকার প্রবীণ শিবু বাবুর সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ১৯০৫ সালে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন ২৮ ফুট উচ্চতার কালভৈরব বা শিবমূর্তি ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বাধিক উচ্চতার মূর্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশালাকার মূর্তির ডান দিকে কালী এবং বাম দিকে দেবী পার্বতীর প্রতিমা রয়েছে। সরাইলের বিখ্যাত জমিদার নূর মোহাম্মদ কালভৈরব মন্দিরের জমি দান করেন। প্রচলিত আছে, কাশীশ্বর দেবাদিদেব মহাদেব নিজ শরীরের অংশ থেকে কালভৈরবের সৃষ্টি করে তাকে কাশীধাম রক্ষার ভার দেন। শ্রীশ্রী কালভৈরবের আবির্ভাবের পর স্থানীয় দুর্গাচরণ আচার্য স্বপ্নে প্রাপ্ত নির্দেশ অনুসারে মাটি দিয়ে বিশালাকার কালভৈরবের বিগ্রহ (মূর্তি) তৈরি করেন।
নির্মাণের পর থেকে স্থানীয় ভক্তবৃন্দের সহায়তায় ১৯৭১ সাল পর্যন্ত নিয়মিতভাবে পূজা-অর্চনা হয়ে আসছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কালভৈরবের বিগ্রহটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ক্ষতিগ্রস্ত করে। পরবর্তী সময়ে ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী মহারাজ ও স্থানীয় মানুষের সহযোগিতায় আবারও ২৮ ফুট উঁচু শ্রীশ্রী কালভৈরব মূর্তি ও মন্দির পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
শ্রীশ্রী কালভৈরব মন্দিরের বাম পাশে আলাদা ভবনে ১০৫ বছরের পুরনো ১১ কেজি ওজনের কষ্টিপাথরের শ্রীশ্রী কৈলাসেশ্বর শিবলিঙ্গ রয়েছে। শ্রীশ্রী কালভৈরব বিগ্রহ ছাড়াও প্রাচীনতম এই মন্দিরে আরও আছে দেবী পার্বতী, শ্রীশ্রী কৈলাসেশ্বর শিবলিঙ্গ, কালীমূর্তি, দুর্গামন্দির, সরস্বতী দেবী, শ্রীশ্রী কালভৈরব নাটমন্দির এবং দুইটি মঠ। প্রতিবছর বাংলা সালের ফাল্গুনী শুক্লা সপ্তমী তিথিতে এখানে ৪ দিনব্যাপী পূজা, হোমযজ্ঞ, মেলাসহ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। তখন শ্রীলঙ্কা, ভারত, মালদ্বীপ, চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পূজারি, ভক্ত এবং দর্শনার্থীদের ভিড়ে মুখর হয়ে ওঠে কালভৈরব মন্দির প্রাঙ্গণ।
মন্দিরটি পরিদর্শনের সময় দেখতে পেলাম দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন এসেছেন কালভৈরব মন্দির দর্শনে। কেউ-বা এসেছেন মনোবাঞ্ছা পূরণের নিমিত্তে, আবার কেউ-বা এসেছেন মনোবাঞ্ছা পূরণের পর পূজা দিতে।
আরো পড়ুন: কবিগুরুর ছোঁয়া পেতে শিলাইদহের কুঠিবাড়ি
সনাতন ধর্মে বিশ্বাসীদের মতে, কালভৈরব হচ্ছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দেবতা বিশেষ। সংস্কৃত শব্দ 'ভৈরব'-এর অর্থ ভয়ংকর বা ভয়াবহ। যা শিবের একটি হিংস্র প্রকাশ। এর সঙ্গে মৃত্যু ও বিনাশ সম্পর্কিত। তাই কালভৈরবকে মনে করা হয় মহাদেব শিবের রুদ্ররূপ। দুষ্ট শক্তির বিনাশ করতে মহাদেব এই রুদ্ররূপ ধারণ করেন। হিন্দু পুরাণ, বজ্রযানী বৌদ্ধ শাস্ত্র এবং জৈন ধর্মগ্রন্থগুলোর বক্তব্য অনুযায়ী, 'মহাজগতের বিশেষ স্থানগুলো ভৈরব রক্ষা করেন। ভৈরবের মোট সংখ্য ৬৪। তাদের আটটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। প্রতিটি শ্রেণির আবার একজন করে প্রধান ভৈরব রয়েছেন। প্রধান আট ভৈরবকে 'অষ্টাঙ্গ ভৈরব' বলা হয়। এই আটজন মহাবিশ্বের আটটি দিকের অধিপতি। এই আটজন আবার নিয়ন্ত্রিত হন মহাস্বর্ণ কালভৈরবের দ্বারা। তিনি সাধারণভাবে কালভৈরব নামেই পরিচিত।
কিভাবে যাবেন
ঢাকার সায়েদাবাদ কিংবা যাত্রাবাড়ী থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রুটে চলাচলকারী বাসে চড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলাস্থ বিশ্বরোড আসবেন। সেখান থেকে রিকশা বা সিএনজির মতো স্থানীয় পরিবহনে মেড্ডা এলাকায় অবস্থিত কালভৈরব মন্দির যেতে পারবেন।
কলি