
১৯৪০ সালে সিলেটের সুনামগঞ্জের ছাতকে নির্মাণ করা হয় আসাম বাংলা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে চুনাপাথর সংগ্রহ করে এর চাহিদা মেটানো হতো। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর বিভিন্ন সমস্যা ও ব্যয়বৃদ্ধির কারণে ভারত থেকে চুনাপাথর সংগ্রহ বন্ধ হয়ে গেলে সিমেন্ট ফ্যাক্টরিটি চালু রাখতে তাহিরপুর সীমান্তের টেকেরঘাট এলাকার ৩২৭ একর ভূমির ওপর জরিপ চালিয়ে ১৯৬০ সালে চুনাপাথরের সন্ধান পায় বিসিআইসি কর্তৃপক্ষ। সন্ধানের পর ১৯৬৬ সালে খনিজ প্রকল্প চালু করে মাইনিংয়ের মাধ্যমে দীর্ঘদিন পাথর উত্তোলন করা হয় এই লেক থেকে। পরে ১৯৯৬ সালে প্রকল্পটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। এর পর থেকে পড়ে থাকে টেকেরঘাট চুনাপাথরের পরিত্যক্ত খনির লাইমস্টোন লেক।
নীল রঙের পানি থাকায় এই লেককে নীলাদ্রি লেক বলে থাকে। এই লেকের প্রকৃত নাম শহীদ সিরাজ লেক। অবশ্য স্থানীয় লোকজন একে টেকেরঘাট পাথর কোয়ারি নামেই চেনে। এসব তথ্য জানিয়েছেন আমার অফিসের সহকর্মী মুসা ভাই। গত মঙ্গলবার অফিসে কিছুটা কাজের চাপ কম ছিল। তাই তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল আসছে সপ্তাহে নতুন কোথায় যাওয়া যায়। মুসা ভাইয়ের কথা শুনে মনে মনে ঠিক করে ফেললাম আসছে সপ্তাহে মিশন হবে নীলাদ্রি লেক।
সপ্তাহান্তে সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটি এল। দিনটি ছিল শুক্রবার। পূর্ব পরিকল্পনামতো সকাল হতেই তৈরি হয়ে নিলাম। ফোন দিলাম মুসা ভাইকে। আমি তৈরি হয়ে গেছি- কোথায় আসতে হবে? উনি বললেন, নীলাদ্রি লেকে যেতে হলে প্রথমে আমাদের যেতে হবে সুনামগঞ্জ শহরে। সেখান থেকে বাকি পথ মোটরসাইকেলে করে। আমাকে চৌহাট্টা যেতে বললেন। সেখান থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার পরিবহন পাওয়া যাবে। কথামতো আমি চৌহাট্টায় উপস্থিত হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম মুসা ভাইয়ের জন্য। অল্প সময়ের মধ্যে মুসা ভাই এসে উপস্থিত।

আমরা রওনা দিলাম সুনামগঞ্জপানে। আম্বরখানা, মদিনা মার্কেট পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। শীতের শেষ বর্ষার শুরু। তাই গাছে গাছে নতুন পাতা ডানা মেলেছে। দুই ঘণ্টার মধ্যে আমরা এসে পৌঁছলাম সুনামগঞ্জ শহরে। সেই কখন বের হয়েছি? তাই পেটে কোনো দানাপানি পড়ে নাই। সাইনবোর্ডবিহীন একটা হোটেলে সকালের নাশতা করে নিলাম। মন খুব ভালো লাগছিল আর কিছু সময়ের মধ্যে হয়তো আমরা পৌঁছে যাব আমাদের গন্তব্যে। গন্তব্যে পৌঁছানোর আনন্দে জল ঢেলে দিয়ে মুসা ভাই জানালেন, ধুলোমাখা পথে এক ঘণ্টার একটা মোটরসাইকেল জার্নি তখনো বাকি আছে। কী আর করা? গাড়ি থেকে নেমে রিকশায় উঠলাম। যাব এমএ খান সেতুতে। ওখানে ভাড়ায় মোটরসাইকেল পাওয়া যায়। সেতুর পথে যাওয়ার সময় দেখা মিলল সুনামগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়। এখানে মোটরবাইকের পাশাপাশি সিএনজিচালিত অটোরিকশাও পাওয়া যায়।
প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য ভালোভাবে দেখার সুযোগ নষ্ট করতে চাইলাম না। আমাদের পাইলট, থুক্কু মোটরসাইকেলচালকের নাম দেলোয়ার। বেশ স্মার্ট ছেলে, চোখে সানগ্লাস। প্রথম দিকে কিছুক্ষণ পরপর ছবি তোলার জন্য তাকে থামাতে হচ্ছিল। ভাবলাম বিরক্ত হচ্ছেন। ছবি তোলার চিন্তা বাদ দিলাম। খানিক পর দেলোয়ার নিজে থেকেই বলে বসল, ‘ভাইজান, এইটা তোলেন, ভাইজান ওইটা তোলেন।’ আবার শুরু হলো ছবি তোলা। আর তা চলেছিল পুরো যাত্রাপথেই। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমরা এসে পৌঁছালাম জাদুকাটা নদীর তীরে। অসাধারণ রূপ জাদুকাটা নদীর। জাদুকাটা পাড়ি দিয়ে স্বল্প সময়ের মাঝে আমরা চলে এলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য নীলাদ্রি লেকের কাছে। লেকের কাছে গিয়ে নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না।
নীল রঙে রূপায়িত ‘নীলাদ্রি’। এ যেন নীলের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া! আমরা পদব্রজে এগিয়ে যেতে লাগলাম। মাঝের টিলাগুলো আর ওপাড়ে পাহাড়ের নিচের অংশটুকু বাংলাদেশের শেষ সীমানা। বড় উঁচু পাহাড়টিই সীমানা। কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া আছে। এই লেকটি এক সময় চুনাপাথরের কারখানার কাঁচামাল সাপ্লাইয়ের ভাণ্ডার ছিল, যা এখন বিলীন।
আরো পড়ুন: তিন শ বছরের পুরনো কালভৈরব মন্দির
ও আরেকটা কথা বলাই হলো না; এই লেকের মূল নাম শহীদ সিরাজ লেক। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার ৫ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর সাব সেক্টর ছিল টেকেরঘাট। মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম ছিলেন এই সাবসেক্টর টেকেরঘাটের কমান্ডার। সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হলে তাকে কবর দেওয়া হয় এই টেকেরঘাটে। তাই এককালের চুনাপাথরের খনি যখন লেকে পরিণত হয়, তখন এর নামকরণ করা হয় শহীদ সিরাজ লেক। মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য এই কমান্ডারকে বীরবিক্রম উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। এই লেকের পাড়েই আছে শহীদ সিরাজের সমাধি।
আমরা চলছি এগিয়ে। পাশেই আমাদের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারতের সীমানা। তাই বন্ধুরা যারা যাবেন তাদের কাছে অনুরোধ থাকবে- সীমান্ত এলাকা; তাই সাবধানে থাকুন এবং সীমানার খুব কাছাকাছি না যাওয়ার চেষ্টা করুন। আর লেকের পানিতে সাঁতার না জানলে না নামাই ভালো। নামলেও বেশি দূরে যাবেন না। কারণ এখান থেকে প্রচুর পরিমাণে চুনাপাথর উঠানো হতো। ফলে লেক অনেক গভীর।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে শ্যামলী/মামুন/এনা বাস যায় সুনামগঞ্জে। ভাড়া ৫৫০ টাকা। সুনামগঞ্জ থেকে নতুন ব্রিজ পার হয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে যেতে হবে। চাইলে টেকেরঘাট পর্যন্ত সরাসরি মোটরসাইকেল রিজার্ভ নিতে পারেন। এক্ষেত্রে ভাড়া ৩০০-৫০০ টাকা নিতে পারে। আর মাঝপথে যাদুকাটা নদী পার হতে জনপ্রতি ভাড়া ৫ টাকা আর মোটরসাইকেলের ভাড়া ২০ টাকা।
এ ছাড়া আপনি সুনামগঞ্জ থেকে লাউড়েরগড় পর্যন্ত মোটরসাইকেলে করে যেতে পারেন। ভাড়া ২০০ টাকা। তারপর যাদুকাটা নদী পার হয়ে বারেকটিলা থেকে ১২০ টাকা ভাড়ায় টেকেরঘাট যেতে পারবেন। এখানে উল্লিখিত মোটরসাইকেলের ভাড়া যেটা উল্লেখ আছে সেটা পুরো বাইকের ভাড়া; মানে একটা বাইকে দুইজন যেতে পারবেন। তবে মোটরসাইকেলের ভাড়া আগে দামাদামি করে নেবেন। যতটা সম্ভব কমিয়ে নেওয়াই ভালো।
কলি