
ইউরোপের অন্যতম দরিদ্র দেশ নর্থ মেসিডোনিয়া। কোনো রকম রক্তক্ষরণ ছাড়াই শুধু এক গণভোটের মধ্য দিয়ে তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। দেশটির রাজধানীর নাম স্কোপিয়া, মাঝ দিয়ে চলে গেছে ভার্দার নদী। ভ্রমণের জন্য খুব ছোট একটি জায়গা, অথচ অনেক ইতিহাস, গল্প আর রহস্যে ভরা এই নগরী।
নগরীর মূল কেন্দ্র মেসিডোনিয়া স্কয়ারে ঢুকেই যা চোখে পড়বে তা হলো চারপাশটা মূর্তিতে ঘেরা। অগণিত মূর্তির মাঝে অ্যালেকজান্ডার দ্য গ্রেটের বিশাল মূর্তি যেন নীল আকাশ ছুঁয়ে যায়। অ্যালেকজান্ডার দ্য গ্রেট ছিলেন প্রাচীন মেসিডোনিয়া রাজ্যের রাজা, যার সাম্রাজ্য ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রিস, তুরস্ক, মিসর, ইরান ও ভারতের অংশে। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, ২০১৪ সালে ২০০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে বদলে দেওয়া হয়েছে শহরের নকশা। মূল কেন্দ্রে তৈরি করা হয়েছে প্রায় অগণিত মূর্তি, যা দেশটির ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। একদিকে মানুষের সীমাহীন অর্থনৈতিক কষ্ট, অন্যদিকে সরকারের এত বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় শুধু মূর্তির পেছনে, বিষয়টা সমালোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি করে। কিন্তু সেই সমালোচকদের মখে ছাই পড়েছে। মূর্তিগুলো শহরের আধুনিকীকরণের প্রচেষ্টার একটি অংশ ছিল। এখন এ শহর বদলে গেছে, আসছে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা, চাঙ্গা হচ্ছে অর্থনীতি।
শহরের ভার্দার নদীর দুপাশে দুই চিত্র। নদীটি খুবই ছোট। দুপাশে পারাপারের জন্য রয়েছে একটি সেতু। এ নদী যেন এক বিভাজনের ইতিহাস। নর্থ ম্যাসিডোনিয়ার প্রায় ৬০ ভাগ খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী, ৩০ ভাগ মুসলমান, বাকিরা অন্য ধর্মাবলম্বী। নদীর একপাশে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী, অন্যপাশে মুসলমান সম্প্রদায়ের বসবাস। শহরের জটিল কিন্তু সমৃদ্ধ ইতিহাসে আছে ওসমানীয়, স্লাভিক এবং বাইজেন্টাইনসহ আরও ভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রভাব। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বর্তমান রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটের সঙ্গে তুলনা করলে স্কোপিয়ার বাসিন্দারা এই বিভাজক নদীর দুপাশে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করছে। আজ এই নদীই যেন এক জাতীয় পরিচয়, ধর্মীয় সহাবস্থান এবং একটি বহু জাতিগত মানুষের এক মিলন মেলা।
স্কোপিয়া শহরের মূল অংশ হাঁটা পথ, একদিনের ভ্রমণই হয়তো যথেষ্ট অনেকের জন্য। শহরে থাকা খাওয়ার খরচ পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় বেশ কম। একদিকে মেসিডোনিয়া স্কয়ার, পশ্চিমা সংস্কৃতি, ক্লাব, রেস্টুরেন্ট, অ্যালকোহল। দুই মিনিটের হাঁটা সেতু পেরোলেই টার্কিশ কফি, পুরোনো বাজার, মুসলিম পোশাকের নারী-পুরুষ, চায়ের সঙ্গে লম্বা হুক্কায় সুখটান দেখতে পাওয়া যায়। নদীর দুপাশেই মানুষের আনাগোনা, চারপাশে প্রাণের ছোঁয়া স্পষ্ট, ধর্ম সংস্কৃতির বিভাজনে মানুষগুলো এখানে বিভক্ত নয়। জীবন এগোচ্ছে সামনের দিকে, পেছনে ফেরার সময় এখন নয়।
স্কোপিয়া ঘুরে এসে একটা গল্প না বললেই নয়। এ দেশ একজন মানুষকে জন্ম দিয়েছে যার পরিচয় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। ছোটবেলা থেকে আমাদের সঙ্গে তাকে পরিচিত করা হয়েছে। অন্যের কাছ থেকে শুনে কিংবা ইতিহাসের পৃষ্ঠা উল্টে তাকে যেভাবে চিনেছি, সে কি আসলেই তাই? নাকি ছায়ার আড়ালে ভিন্ন এক মানুষ ছিলেন? মানবতায় অমর যিনি, আমি মাদার তেরেসার কথা বলছি। বিংশ শতাব্দীতে অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী হিসেবে তাকে বিবেচনা করা হয়। ভারতে কাটিয়েছেন দীর্ঘ ৬৯ বছর। এই রোমান ক্যাথলিক নান নিঃসন্দেহে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন গরিব-দুস্থদের সেবায়। মানুষের কল্যাণে তিনি যে জীবন ব্যয় করেছেন তার জন্য তাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। তার মানবিক কাজের পাশাপাশি কিছু বিতর্কিত বিষয় এড়িয়ে যায়নি।
মাদার তেরেসার মিশনারি ঘরগুলোয় অসুস্থ মানুষের সুচিকিৎসার চেয়ে তাদের মৃত্যুর প্রস্তুতির ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। যন্ত্রণাকাতর মানুষকে ব্যাথানাশক ওষুধ ব্যবহারে ছিল সীমাবদ্ধতা। খ্রিষ্টান ধর্মের প্রচারে তিনি মনে করতেন ব্যথা, ভোগান্তি আর কষ্ট মানুষকে ঈশ্বরের কাছে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। তার মিশনারী পরিচালনার দান করা অর্থের ব্যবহার নিয়ে ছিল উদ্বেগ। অর্থ এসেছে বিতর্কিত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছ থেকে, যা ছিল আড়ালে সুবিধা ভোগের এক নকশা।
কলকাতায় যাদের নিয়ে মাদার তেরেসা কাজ করতেন তারা সবাই দারিদ্র্য সীমানার অনেক নিচে পড়ে থাকা মানুষ, বিশেষত নারীরা। দারিদ্রতার নিচে নারীর ক্ষমতায়নের মূল চাবিকাঠি হচ্ছে তাদের সন্তান জন্ম দেওয়ার মেশিন হিসেবে ব্যবহার না করা। দারিদ্রতায় জর্জরিত একজন নারী বহু সন্তানের জন্ম দেওয়ার ফলাফল কখনো তাকে দারিদ্রতা থেকে বের হতে সাহায্য করেনি, বরং ঠেলে দিয়েছে দারিদ্রতার চরমে। মাদার তেরেসা মানবতার সেবায় করেছেন ধর্মের প্রচার। সে ধর্মে জন্মনিয়ন্ত্রণ ছিল মহাপাপ। তিনি সেই শিক্ষাই দিয়েছিলেন। বাকি অঙ্কটা খুব সাধারণ, ধর্মের মানবতার সেবার নামে বাকি জীবন কষ্টের ঘানি টেনেছেন দুস্থ দরিদ্র সমাজ, বিশেষত নারীরা।
ভ্রমণ মানেই জীবনকে আর একটু কাছ থেকে দেখার চেষ্টা। ভ্রমণে থাকে জীবনের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি বিষয়। ধর্ম বা রাজনীতি তার বাইরের কিছু নয়। সেটা থেকেই মাদার তেরেসার ভিন্ন এক রূপ ওপরে তুলে ধরা। আমরা ইতিহাস দেখিনি, জেনেছি অন্যের কাছ থেকে, অন্যরা আমাদের ঠিক যেভাবে জানাতে চেয়েছে সেটাকেই আমরা সত্য ধরে নিয়ে এগোচ্ছি।
আজ বাংলাদেশ এক রূপান্তরের সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। ভালো বা মন্দ সময় বলে দেবে, তবে ইতিহাস বলে- ধর্ম নিয়ে রাজনীতি, মানুষকে জোরপূর্বক ধর্মের বেড়াজালে সাহায্য বা শাসন কখনো মঙ্গল বয়ে আনেনি। আমরা সবাই পৃথিবীটাকে একটু ভিন্নভাবে দেখি বলেই তো আমরা মানুষ। পরিবর্তন, নতুনত্ব আর ভিন্নভাবে ভাবতে শেখা অগ্রগতির মূলমন্ত্র।
কলি