শীতকাল এলেই মনে হয়, সরিষাখেতের পাশে সবুজ আলপথে বসে আয়েশ করে খিচুড়ি কিংবা পছন্দের কোনো ভারী খাবার খাব। সেই ভাবনা থেকেই শ্রীনগর যাওয়া। ঢাকার কাছাকাছি কোথায় সুন্দর সরিষাখেত পাব, সেই খোঁজ করতে গিয়ে সন্ধান পেলাম মুন্সীগঞ্জের। শীতের কুয়াশাঘেরা সকালে গুলিস্তান থেকে বাস এ চড়ে বসলাম। ঢাকা থেকেই খিচুড়ি আর ডিম ভাজি করে সঙ্গে নিয়ে গেলাম।
শ্রীনগর পৌঁছাতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগল। তখনো শীত জেঁকে বসে আছে। পরিচিত এক বড় ভাই আমাদের রিসিভ করলেন। তার বাইকে চড়ে চলে গেলাম গ্রামের দিকে। এক বাড়ি থেকে কলাপাতা জোগাড় করলাম। তার পর গ্রামের পুকুরঘাটে বসে সেই কলাপাতা ধুয়ে ফসলের মাঠের আলপথ ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুটা দূর যাওয়ার পর মনমতো জায়গায় বসে পড়লাম। আমরা মোট তিনজন ছিলাম। কলাপাতা বিছিয়ে সবার পাতে খিচুড়ি আর ডিম ভাজি বেড়ে দিলাম। শীতের মায়াময় প্রকৃতিতে আদিগন্ত বিস্তৃত সরিষাখেতের পাশে বসে কলাপাতায় খিচুড়ি খেতে এত ভালো লাগছিল, তা কোনো শব্দ দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়।
খিচুড়ি খাওয়া শেষ করে আমরা শতবর্ষী একটা বৃক্ষ দেখতে গেলাম। বৃক্ষটা খুব বেশি বড় নয়, তবে চারপাশজুড়ে ফসলের মাঠের মাঝখানে সে যেন তার অপূর্ব রূপ ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে বহুকাল ধরে। বৃক্ষটির নিচে বসে রইলাম কিছুক্ষণ।
আলপথ ধরে আবার মূল রাস্তায় চলে এলাম। বাইকে চড়ে সেখানকার একটা গ্রামের বাজারের দিকে যাচ্ছিলাম। যেতে যেতে শুনলাম, মুন্সীগঞ্জে নাকি একসময় প্রতিটি বাড়িতে একটা করে পুকুর থাকত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক পুকুরই এখন ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
বাজারে পৌঁছে একটা হোটেল থেকে গরম গরম শিঙাড়া আর চা খেলাম। গ্রামের খুব সাধারণ, ভাঙাচোরা ধরনের হোটেলগুলোয় যেন অন্যরকম মায়া থাকে। কোনো চাকচিক্য নেই, ভোজনরসিক বা শৌখিন মানুষদের আকর্ষণ করার কৃত্রিমতা নেই। নির্ভেজাল একটা শান্তি শান্তি ভাব শুধু। এরপর একটা হোটেল থেকে এক কাপ গরুর দুধ খেলাম। সেই হোটেলের গরুর দুধ নাকি ওখানকার মানুষের বেশ পছন্দের। অনেক জ্বাল দেওয়ার পর দুধ পরিবেশন করা হয়। আমিও খুব তৃপ্তি পেয়েছি খেয়ে।
শ্রীনগরের শ্যামসিদ্ধি গ্রামে রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় মঠ; যা শ্যামসিদ্ধির মঠ নামে পরিচিত। এর পরের গন্তব্য ছিল সেই মঠ দেখা। বিক্রমপুরের ধনাঢ্য ব্যক্তি শম্ভুনাথ মজুমদার এই মঠটি নির্মাণ করেন। কথিত আছে শম্ভুনাথ স্বপ্নে তার পিতার চিতার ওপরে মঠ নির্মাণের নির্দেশ পেলে তিনি এই মঠটি নির্মাণ করেন। মঠটির উচ্চতা ২৪১ ফুট এবং আনুমানিক ২৫০ বছরের পুরোনো। মঠটির এখন কেবল ধ্বংসাবশেষই অবশিষ্ট রয়েছে। মঠের গায়ের মূল্যবান পাথর এবং পিতলের কলসির কোনো অস্তিত্ব নেই। নকশা করা দরজা জানালাও অনেক আগেই চুরি হয়ে গেছে। মঠের ভেতরে ৩ ফুট উচ্চতার কষ্টি পাথরের একটি শিবলিঙ্গ স্থাপিত ছিল, যা ১৯৯৫ সালে চুরি হয়ে যায়।
এর পরের গন্তব্য ছিল রাঢ়ীখাল গ্রামে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ইনস্টিটিউট ও কলেজ এবং জগদীশ চন্দ্র বসুর বাড়ি। জগদীশ চন্দ্র বসু ব্রিটিশ ভারতীয় উপমহাদেশের একজন অসম্ভব গুণী ব্যক্তিত্ব। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহারিক এবং গবেষণাধর্মী বিজ্ঞানের সূচনা তার হাত ধরেই হয় বলে মনে করা হয়। জগদীশ চন্দ্র বসু ইনস্টিটিউট ও কলেজ এবং জগদীশ চন্দ্র বসুর বাড়ি মোট ৩০ একর জায়গাজুড়ে। তার বাড়িতে রয়েছে স্মৃতি জাদুঘর, পশুপাখির ম্যুরাল, কৃত্রিম পাহাড়-ঝরনা, শান বাঁধানো পুকুর ঘাট, দিঘি প্রভৃতি। জাদুঘরে জগদীশ চন্দ্র বসুর ছবি, গবেষণাপত্র, হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল প্রাপ্তিতে তাকে লেখা চিঠি ও জগদীশ চন্দ্র বসুকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি, তেল রং দিয়ে আঁকা কিছু দুর্লভ ছবি, রয়্যাল সোসাইটিতে দেওয়া বক্তব্যের কপি এবং নানা দুর্লভ জিনিস রয়েছে। সবুজ প্রকৃতি ঘেরা এ বাড়িতে গেলে কিংবা পুকুরঘাটে কিছুটা সময় বসে থাকলে মন শান্ত হয়ে যাবে যে কারও।
শীতের রোদ কেবল ম্লান হতে শুরু করেছে। তখনই আমরা রওনা হলাম জমিদার যদুনাথ রায়ের বাড়ির উদ্দেশে। ভাগ্যকূল গ্রামে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক বাড়িটির অন্য নাম ভাগ্যকূল জমিদার বাড়ি। যেতে যেতে মনে হলো, এত ঘিঞ্জি পথ ধরে হয়তো বাইক না হলে আসাই যেত না। যদিও সেখানে যাওয়ার অন্য কোনো ভালো পথ রয়েছে কি না, আমার জানা নেই।
আনুমানিক ১৯ শতকে জমিদার যদুনাথ রায় এই জমিদার বাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। যদুনাথ রায় ছিলেন মূলত একজন ব্যবসায়ী। তিনি ছিলেন পাঁচ সন্তানের জনক। সবার জন্য আলাদা আলাদাভাবে আরও চারটি বাড়ি তৈরি করেন। আর মূল বাড়িটি ছোট ছেলে নবকুমারকে দিয়ে দেন। সবগুলো বাড়িই গ্রিক স্থাপত্যের আদলে তৈরি করা হয়। এ ছাড়া কয়েকটি মন্দির ও পুকুরসহ অনেক কিছু নির্মাণ করা হয় বাড়িটিকে ঘিরে। ড. হুমায়ুন আজাদ এই বাড়িটিকে বলেছিলেন, ‘বিলের ধারে প্যারিস শহর’। এই জমিদারের বংশধররা ব্রিটিশ আমলে কয়েকজন বাঙালি ধনীদের মধ্যে একটি ধনী পরিবার ছিল। তারা তাদের বিশাল কর্মযজ্ঞের কারণে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ‘রাজা’ উপাধি লাভ করেছিলেন। তখনকার সময় এই জমিদারের বংশধররা সবাই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। বংশধররা এখন ভারতে বসবাস করছেন।
এ বাড়িতে তিনতলা বিশিষ্ট একটি জাদুঘর রয়েছে, যা পুরো বিক্রমপুরের ঐতিহ্যকে তুলে ধরে। এতে মোট সাতটি গ্যালারি রয়েছে। গ্যালারিগুলোয় রয়েছে বিক্রমপুরের প্রাচীন মানচিত্র, বিক্রমপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাওয়া মাটিরপাত্র, পোড়া মাটির খেলনা, কাগজ আবিষ্কারের আগে প্রাচীন আমলে যে ভূর্জ গাছের বাকলে লেখা হতো সেই ভূর্জ গাছের বাকল, বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন দেশ ও সাম্রাজ্যের কয়েন, নোট, হুঁক্কা, হারিকেন, কুপি, কলের গান, টেলিফোন সেট, রেডিও, দোয়াত কলম, টাইপ রাইটার, ক্যামেরা, টেপ রেকর্ডার, ব্যাটারিচালিত টেলিভিশন, জাঁতা, খড়ম, পান বাটা, কাঁসার বাসনপত্র, মাটির জিনিসপত্র, কৃষি যন্ত্রপাতি, হাতে বুননের তাঁতশিল্পের যন্ত্রপাতি, মসলিন শাড়ি, তালপাতায় লেখা পুঁথি, পুরোনো খাট পালং, চেয়ার, টেবিল, আলমারি, কাঠের সিন্দুক, পোড়া মাটির মূর্তি, সিরামিকের থালা এবং আরও অনেক কিছু। জাদুঘরটি বৃহস্পতিবার বাদে অন্যান্য দিন সকাল ১০টা থেকে ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
বর্তমানে মূল ভবন বাদে অন্যান্য সব ভবন ভগ্নপ্রায় অবস্থায় রয়েছে। তবু বাড়িটির পরতে পরতে যেন সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে ১০০ বছর পেছনে গিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করলাম এই সুবিশাল বাড়িটি তখন দেখতে কেমন ছিল। সে এক আশ্চর্য আবেশ জাগানো অনুভূতি।
প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। আমরা জমিদার বাড়ি থেকে বের হয়ে গুদারা ঘাটে গেলাম। একসময় ওই ঘাট থেকে স্টিমার চলাচল করত কলকাতার উদ্দেশে। এখন সেখানকার নদী আর ঘাট মৃতপ্রায়। একটা নৌকায় করে গোধূলীলগ্নে নদীর ওপারে গেলাম। সামান্য পথ। এপার ওপার দশ টাকা ভাড়া জনপ্রতি। ওপারে নাম না জানা ঝোপঝাড় আর কাশের বন, পায়ের নিচে সবুজ ঘাসের আস্তরণ। সেই ঘাসের চাদরে শুয়ে জীবনের অন্যতম সুন্দর সূর্যাস্ত দেখলাম।
নৌকা পার হয়ে ভাগ্যকূল বাজারে এলাম। তখন অন্ধকার নেমে গেছে পুরোপুরি। ছোট বাজারটির প্রতিটি দোকানে আলো জ্বলে উঠেছে। গোবিন্দ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে আমরা মিষ্টি আর ঘোল খেলাম। ভাগ্যকূলের মিষ্টির জনপ্রিয়তা সম্পর্কে আগেই অবগত ছিলাম। মিষ্টি খেয়ে আরও মোহিত হলাম। কিছু মিষ্টি ঢাকাতেও নিয়ে যাব বলে প্যাকেট করতে বললাম। ভাগ্যকূল বাজার থেকে বের হয়ে প্রধান সড়কে এলাম বাইকে করে। তার পর ঢাকাগামী বাসে চড়ে বসলাম। মন পড়ে রইল একটা আশ্চর্য সুন্দর দিনের কাছে।
কীভাবে যাবেন
গুলিস্তান গোলাপ শাহ মাজারের কাছ থেকে ঢাকা-দোহার রুটে চলাচলকারী বাসে উঠে শ্রীনগরে নেমে পড়ুন।
কী খাবেন
শ্রীনগর গেলে অবশ্যই ভাগ্যকূলের মিষ্টির স্বাদ নেওয়ার চেষ্টা করবেন।
কোথায় থাকবেন
শ্রীনগরে দর্শনার্থীরা সাধারণত এক দিনের ভ্রমণে গিয়ে থাকেন। তবু যদি থাকার প্রয়োজন হয়, তাহলে শ্রীনগর সদর, মুন্সীগঞ্জ সদর কিংবা মাওয়ায় আবাসিক হোটেল পেয়ে যাবেন।
সতর্কতা
শীতের দিনে ভ্রমণ করলে পর্যাপ্ত শীতের পোশাক সঙ্গে রাখুন। যেকোনো প্রয়োজনে স্থানীয়দের সহযোগিতা নিন।
কলি