ঢাকা ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, রোববার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪

বিলের ধারে প্যারিস শহর

প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০২:১০ পিএম
আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৫০ পিএম
বিলের ধারে প্যারিস শহর
ভাগ্যকূল জমিদার বাড়ি। ছবি: সংগৃহীত


শীতকাল এলেই মনে হয়, সরিষাখেতের পাশে সবুজ আলপথে বসে আয়েশ করে খিচুড়ি কিংবা পছন্দের কোনো ভারী খাবার খাব। সেই ভাবনা থেকেই শ্রীনগর যাওয়া। ঢাকার কাছাকাছি কোথায় সুন্দর সরিষাখেত পাব, সেই খোঁজ করতে গিয়ে সন্ধান পেলাম মুন্সীগঞ্জের। শীতের কুয়াশাঘেরা সকালে গুলিস্তান থেকে বাস এ চড়ে বসলাম। ঢাকা থেকেই খিচুড়ি আর ডিম ভাজি করে সঙ্গে নিয়ে গেলাম।

শ্রীনগর পৌঁছাতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগল। তখনো শীত জেঁকে বসে আছে। পরিচিত এক বড় ভাই আমাদের রিসিভ করলেন। তার বাইকে চড়ে চলে গেলাম গ্রামের দিকে। এক বাড়ি থেকে কলাপাতা জোগাড় করলাম। তার পর গ্রামের পুকুরঘাটে বসে সেই কলাপাতা ধুয়ে ফসলের মাঠের আলপথ ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুটা দূর যাওয়ার পর মনমতো জায়গায় বসে পড়লাম। আমরা মোট তিনজন ছিলাম। কলাপাতা বিছিয়ে সবার পাতে খিচুড়ি আর ডিম ভাজি বেড়ে দিলাম। শীতের মায়াময় প্রকৃতিতে আদিগন্ত বিস্তৃত সরিষাখেতের পাশে বসে কলাপাতায় খিচুড়ি খেতে এত ভালো লাগছিল, তা কোনো শব্দ দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়।

খিচুড়ি খাওয়া শেষ করে আমরা শতবর্ষী একটা বৃক্ষ দেখতে গেলাম। বৃক্ষটা খুব বেশি বড় নয়, তবে চারপাশজুড়ে ফসলের মাঠের মাঝখানে সে যেন তার অপূর্ব রূপ ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে বহুকাল ধরে। বৃক্ষটির নিচে বসে রইলাম কিছুক্ষণ।

আলপথ ধরে আবার মূল রাস্তায় চলে এলাম। বাইকে চড়ে সেখানকার একটা গ্রামের বাজারের দিকে যাচ্ছিলাম। যেতে যেতে শুনলাম, মুন্সীগঞ্জে নাকি একসময় প্রতিটি বাড়িতে একটা করে পুকুর থাকত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক পুকুরই এখন ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

বাজারে পৌঁছে একটা হোটেল থেকে গরম গরম শিঙাড়া আর চা খেলাম। গ্রামের খুব সাধারণ, ভাঙাচোরা ধরনের হোটেলগুলোয় যেন অন্যরকম মায়া থাকে। কোনো চাকচিক্য নেই, ভোজনরসিক বা শৌখিন মানুষদের আকর্ষণ করার কৃত্রিমতা নেই। নির্ভেজাল একটা শান্তি শান্তি ভাব শুধু। এরপর একটা হোটেল থেকে এক কাপ গরুর দুধ খেলাম। সেই হোটেলের গরুর দুধ নাকি ওখানকার মানুষের বেশ পছন্দের। অনেক জ্বাল দেওয়ার পর দুধ পরিবেশন করা হয়। আমিও খুব তৃপ্তি পেয়েছি খেয়ে।

শ্রীনগরের শ্যামসিদ্ধি গ্রামে রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় মঠ; যা শ্যামসিদ্ধির মঠ নামে পরিচিত। এর পরের গন্তব্য ছিল সেই মঠ দেখা। বিক্রমপুরের ধনাঢ্য ব্যক্তি শম্ভুনাথ মজুমদার এই মঠটি নির্মাণ করেন। কথিত আছে শম্ভুনাথ স্বপ্নে তার পিতার চিতার ওপরে মঠ নির্মাণের নির্দেশ পেলে তিনি এই মঠটি নির্মাণ করেন। মঠটির উচ্চতা ২৪১ ফুট এবং আনুমানিক ২৫০ বছরের পুরোনো। মঠটির এখন কেবল ধ্বংসাবশেষই অবশিষ্ট রয়েছে। মঠের গায়ের মূল্যবান পাথর এবং পিতলের কলসির কোনো অস্তিত্ব নেই। নকশা করা দরজা জানালাও অনেক আগেই চুরি হয়ে গেছে। মঠের ভেতরে ৩ ফুট উচ্চতার কষ্টি পাথরের একটি শিবলিঙ্গ স্থাপিত ছিল, যা ১৯৯৫ সালে চুরি হয়ে যায়। 

এর পরের গন্তব্য ছিল রাঢ়ীখাল গ্রামে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ইনস্টিটিউট ও কলেজ এবং জগদীশ চন্দ্র বসুর বাড়ি। জগদীশ চন্দ্র বসু ব্রিটিশ ভারতীয় উপমহাদেশের একজন অসম্ভব গুণী ব্যক্তিত্ব। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহারিক এবং গবেষণাধর্মী বিজ্ঞানের সূচনা তার হাত ধরেই হয় বলে মনে করা হয়। জগদীশ চন্দ্র বসু ইনস্টিটিউট ও কলেজ এবং জগদীশ চন্দ্র বসুর বাড়ি মোট ৩০ একর জায়গাজুড়ে। তার বাড়িতে রয়েছে স্মৃতি জাদুঘর, পশুপাখির ম্যুরাল, কৃত্রিম পাহাড়-ঝরনা, শান বাঁধানো পুকুর ঘাট, দিঘি প্রভৃতি। জাদুঘরে জগদীশ চন্দ্র বসুর ছবি, গবেষণাপত্র, হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল প্রাপ্তিতে তাকে লেখা চিঠি ও জগদীশ চন্দ্র বসুকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি, তেল রং দিয়ে আঁকা কিছু দুর্লভ ছবি, রয়্যাল সোসাইটিতে দেওয়া বক্তব্যের কপি এবং নানা দুর্লভ জিনিস রয়েছে। সবুজ প্রকৃতি ঘেরা এ বাড়িতে গেলে কিংবা পুকুরঘাটে কিছুটা সময় বসে থাকলে মন শান্ত হয়ে যাবে যে কারও।

শীতের রোদ কেবল ম্লান হতে শুরু করেছে। তখনই আমরা রওনা হলাম জমিদার যদুনাথ রায়ের বাড়ির উদ্দেশে। ভাগ্যকূল গ্রামে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক বাড়িটির অন্য নাম ভাগ্যকূল জমিদার বাড়ি। যেতে যেতে মনে হলো, এত ঘিঞ্জি পথ ধরে হয়তো বাইক না হলে আসাই যেত না। যদিও সেখানে যাওয়ার অন্য কোনো ভালো পথ রয়েছে কি না, আমার জানা নেই।

জমিদার যদুনাথ রায়ের বাড়ি। ছবি: সংগৃহীত

আনুমানিক ১৯ শতকে জমিদার যদুনাথ রায় এই জমিদার বাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। যদুনাথ রায় ছিলেন মূলত একজন ব্যবসায়ী। তিনি ছিলেন পাঁচ সন্তানের জনক। সবার জন্য আলাদা আলাদাভাবে আরও চারটি বাড়ি তৈরি করেন। আর মূল বাড়িটি ছোট ছেলে নবকুমারকে দিয়ে দেন। সবগুলো বাড়িই গ্রিক স্থাপত্যের আদলে তৈরি করা হয়। এ ছাড়া কয়েকটি মন্দির ও পুকুরসহ অনেক কিছু নির্মাণ করা হয় বাড়িটিকে ঘিরে। ড. হুমায়ুন আজাদ এই বাড়িটিকে বলেছিলেন, ‘বিলের ধারে প্যারিস শহর’। এই জমিদারের বংশধররা ব্রিটিশ আমলে কয়েকজন বাঙালি ধনীদের মধ্যে একটি ধনী পরিবার ছিল। তারা তাদের বিশাল কর্মযজ্ঞের কারণে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ‘রাজা’ উপাধি লাভ করেছিলেন। তখনকার সময় এই জমিদারের বংশধররা সবাই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। বংশধররা এখন ভারতে বসবাস করছেন।

এ বাড়িতে তিনতলা বিশিষ্ট একটি জাদুঘর রয়েছে, যা পুরো বিক্রমপুরের ঐতিহ্যকে তুলে ধরে। এতে মোট সাতটি গ্যালারি রয়েছে। গ্যালারিগুলোয় রয়েছে বিক্রমপুরের প্রাচীন মানচিত্র, বিক্রমপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাওয়া মাটিরপাত্র, পোড়া মাটির খেলনা, কাগজ আবিষ্কারের আগে প্রাচীন আমলে যে ভূর্জ গাছের বাকলে লেখা হতো সেই ভূর্জ গাছের বাকল, বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন দেশ ও সাম্রাজ্যের কয়েন, নোট, হুঁক্কা, হারিকেন, কুপি, কলের গান, টেলিফোন সেট, রেডিও, দোয়াত কলম, টাইপ রাইটার, ক্যামেরা, টেপ রেকর্ডার, ব্যাটারিচালিত টেলিভিশন, জাঁতা, খড়ম, পান বাটা, কাঁসার বাসনপত্র, মাটির জিনিসপত্র, কৃষি যন্ত্রপাতি, হাতে বুননের তাঁতশিল্পের যন্ত্রপাতি, মসলিন শাড়ি, তালপাতায় লেখা পুঁথি, পুরোনো খাট পালং, চেয়ার, টেবিল, আলমারি, কাঠের সিন্দুক, পোড়া মাটির মূর্তি, সিরামিকের থালা এবং আরও অনেক কিছু। জাদুঘরটি বৃহস্পতিবার বাদে অন্যান্য দিন সকাল ১০টা থেকে ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

বর্তমানে মূল ভবন বাদে অন্যান্য সব ভবন ভগ্নপ্রায় অবস্থায় রয়েছে। তবু বাড়িটির পরতে পরতে যেন সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে ১০০ বছর পেছনে গিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করলাম এই সুবিশাল বাড়িটি তখন দেখতে কেমন ছিল। সে এক আশ্চর্য আবেশ জাগানো অনুভূতি।

প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। আমরা জমিদার বাড়ি থেকে বের হয়ে গুদারা ঘাটে গেলাম। একসময় ওই ঘাট থেকে স্টিমার চলাচল করত কলকাতার উদ্দেশে। এখন সেখানকার নদী আর ঘাট মৃতপ্রায়। একটা নৌকায় করে গোধূলীলগ্নে নদীর ওপারে গেলাম। সামান্য পথ। এপার ওপার দশ টাকা ভাড়া জনপ্রতি। ওপারে নাম না জানা ঝোপঝাড় আর কাশের বন, পায়ের নিচে সবুজ ঘাসের আস্তরণ। সেই ঘাসের চাদরে শুয়ে জীবনের অন্যতম সুন্দর সূর্যাস্ত দেখলাম।

নৌকা পার হয়ে ভাগ্যকূল বাজারে এলাম। তখন অন্ধকার নেমে গেছে পুরোপুরি। ছোট বাজারটির প্রতিটি দোকানে আলো জ্বলে উঠেছে। গোবিন্দ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে আমরা মিষ্টি আর ঘোল খেলাম। ভাগ্যকূলের মিষ্টির জনপ্রিয়তা সম্পর্কে আগেই অবগত ছিলাম। মিষ্টি খেয়ে আরও মোহিত হলাম। কিছু মিষ্টি ঢাকাতেও নিয়ে যাব বলে প্যাকেট করতে বললাম। ভাগ্যকূল বাজার থেকে বের হয়ে প্রধান সড়কে এলাম বাইকে করে। তার পর ঢাকাগামী বাসে চড়ে বসলাম। মন পড়ে রইল একটা আশ্চর্য সুন্দর দিনের কাছে।

কীভাবে যাবেন
গুলিস্তান গোলাপ শাহ মাজারের কাছ থেকে ঢাকা-দোহার রুটে চলাচলকারী বাসে উঠে শ্রীনগরে নেমে পড়ুন।

কী খাবেন
শ্রীনগর গেলে অবশ্যই ভাগ্যকূলের মিষ্টির স্বাদ নেওয়ার চেষ্টা করবেন।

কোথায় থাকবেন
শ্রীনগরে দর্শনার্থীরা সাধারণত এক দিনের ভ্রমণে গিয়ে থাকেন। তবু যদি থাকার প্রয়োজন হয়, তাহলে শ্রীনগর সদর, মুন্সীগঞ্জ সদর কিংবা মাওয়ায় আবাসিক হোটেল পেয়ে যাবেন।

সতর্কতা
শীতের দিনে ভ্রমণ করলে পর্যাপ্ত শীতের পোশাক সঙ্গে রাখুন। যেকোনো প্রয়োজনে স্থানীয়দের সহযোগিতা নিন।

 কলি

সুচিত্রা সেনের দেশে

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:০০ পিএম
আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৩৮ পিএম
সুচিত্রা সেনের দেশে
সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা। ছবি: খবরের কাগজ

উত্তরবঙ্গের একটি সমৃদ্ধ জেলা পাবনা। অনেক বরেণ্য ব্যক্তি এ জেলায় জন্মগ্রহণ করেছেন। এ ছাড়া ব্রিটিশ শাসকদের স্মৃতিবিজড়িত পাবনা জেলায় দেখার মতো আছে অনেক কিছু। হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিলাম পাবনা ঘুরতে যাব।

কল্যাণপুর থেকে রাত সাড়ে ১১টার বাসে রওনা দিয়ে ৬ ঘণ্টা পর প্রায় ভোরের দিকে পাবনা পৌঁছালাম। পাবনায় পরিচিত একজনের বাসায় উঠলাম। তিনতলা ছিমছাম সুন্দর বাংলো বাড়ি। সামনে ছোট্ট বাগান, শিউলি ফুল ছড়িয়ে আছে সেখানে।

ফ্রেশ হয়ে হাঁটতে বের হলাম। পাড়াটি বেশ, প্রতিটি বাড়িতে ফুলের গাছ। নাম না জানা ফুল ঝরে আছে গাছতলাগুলোতে, পথের মাঝে। এমন সুন্দর পরিবেশে হাঁটতে দারুণ লাগে!

প্যারাডাইস সুইটস

হাঁটাহাঁটি শেষ করে সকালের নাশতা খেতে গেলাম পাবনার বিখ্যাত প্যারাডাইস সুইটসে। সেখানে সকালের নাশতা হিসেবে লুচি, সবজিটা বেশ জনপ্রিয়; যদিও আমার কাছে এভারেজ লেগেছে। প্যারাডাইস সুইটসের মিষ্টিও জনপ্রিয়। কয়েক ধরনের মিষ্টিও কিনে নিলাম।

তাড়াশ জমিদার ভবন

সকালের নাশতা সেরে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম তাড়াশ ভবনে। পাবনা সদরে অবস্থিত অন্যতম একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা এটি। ১৮ শতকের দিকে তাড়াশের তৎকালীন জমিদার রায়বাহাদুর বনমালী রায় এটি নির্মাণ করেন।

অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি

যেতে যেতে বাইরে থেকেই দেখলাম পাবনার প্রসিদ্ধ পুরাতন একটি লাইব্রেরি। নাম ‘অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি’। ১৮৯০ সালে লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তৎকালীন পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার তাঁতিবন্দের জমিদার গঙ্গা গোবিন্দ চৌধুরীর দত্তক নেওয়া নাতি অন্নদা গোবিন্দ চৌধুরীর নামে পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখনো পাবনায় বিদ্যুৎ আসেনি। পাঠকদের সুবিধার জন্য ১৩ টাকা ৮ আনা মূল্যের পেট্রোম্যাক্স লাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৩৬ সালে ১০০ টাকা ব্যয়ে পাঠাগারটিতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়া হয়। বর্তমানে সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পাঠাগারটি উন্মুক্ত থাকে পাঠকদের পড়ার জন্য। জানতে পারলাম, প্রতিবছর একবার লাইব্রেরিটিতে প্রদর্শনী হয়। তখন বহু বছর আগে মানুষ যে তালপাতা আর নারিকেল পাতায় লিখত, সেসব সংরক্ষিত ঐতিহ্য দর্শনার্থীদের দেখানো হয় এবং সে সময় অনেক মানুষের ভিড় হয় পাবনার এই প্রসিদ্ধ লাইব্রেরিটিতে।

ইন্দুবালা ভাতের হোটেল

প্রথম দিন সঙ্গত কারণে পাবনার আর কোথাও ঘোরা হলো না। পরদিন সকালে আবার রেডি হয়ে বের হলাম। ইন্দুবালা ভাতের হোটেল- এ নামটির সঙ্গে অনেক মানুষ, বিশেষ করে সাহিত্যপ্রেমী মানুষ খুব পরিচিত। এই নামে কল্লোল লাহিড়ীর উপন্যাস বাংলাজুড়ে বেশ সাড়া পেয়েছে। ওয়েব সিরিজও তৈরি হয়েছে ভারতে। আর তা থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে পাবনায় গড়ে তোলা হয়েছে ইন্দুবালা ভাতের হোটেল। সকালের প্রথম গন্তব্য সেখানে।

আরও পড়ুন: পাবনার দর্শনীয় স্থানসমূহ

প্রথমে রিকশাযোগে চলে গেলাম পাবনার বাইপাস সড়কে। সেখান থেকে অটোতে চলে গেলাম ঢাকা-পাবনা মহাসড়কের পাশে (জালালপুর) অবস্থিত এই বিখ্যাত হোটেলে। রত্নদ্বীপ রিসোর্টের একদম বিপরীতেই এই হোটেলটির অবস্থান।

ইন্দুবালা ভাতের হোটেল এর মেন্যু

উপন্যাসটিতে যেমন অনেক হারিয়ে যাওয়া খাবারের কথা তুলে ধরা হয়েছে, এই হোটেলটিও তেমনই সেসব হারিয়ে যাওয়া বা হারাতে বসা ঐতিহ্যবাহী খাবার ফিরিয়ে আনার প্রয়াসে কাজ করে যাচ্ছে। একই সঙ্গে কিছু নরমাল খাবারের আয়োজনও থাকে। উপন্যাসের সঙ্গে মিল রেখে কালো বোর্ডে চক দিয়ে প্রতি বেলার মেন্যুও লেখা হয়। খাবার পরিবেশন করা হয় স্টিলের পাত্রে। আমি গিয়েছিলাম সকালবেলা। কী খাব কনফিউজড হয়ে খিচুড়ি আর ডিম ভাজা নিয়েছিলাম। স্বাদ ভালো, তবে এভারেজই ছিল।

পাবনা মানসিক হাসপাতাল

ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে নাশতা সেরে আবার অটোতে করে বাইপাস বাসটার্মিনালে চলে এলাম। তারপর রিকশা নিলাম হেমায়েতপুরে যাওয়ার জন্য। উদ্দেশ্য সেখানকার মানসিক হাসপাতালটি দেখব, যা ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তী সময়ে আরও বড় পরিসরে হাসপাতালটির কার্যক্রম শুরু হয় এবং সেই বিস্তৃত পরিসরের অধিকাংশ জমি আধ্যাত্মিক সাধক অনুকূল ঠাকুরের। হাসপাতালটিতে মানসিকভাবে অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। এখানে একটি জনকল্যাণ সংস্থা রয়েছে। সংস্থাটি সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষদের পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে থাকে। হাসপাতালে থাকাকালীন কেউ কর্মক্ষম অবস্থায় থাকলে তার কাজের ব্যবস্থা করে থাকে। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রও সরবরাহ করে থাকে।

অনুকূল চন্দ্রের আশ্রম

পাবনা মানসিক হাসপাতালের পাশেই আধ্যাত্মিক সাধক অনুকূল চন্দ্রের আশ্রম। চলে গেলাম সেখানে। মা-বাবার স্মৃতি রক্ষার্থে তিনি এখানে মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। অনুকূলচন্দ্র ‘সৎসঙ্গ’ নামে একটি জনহিতকর সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। প্রকৃত অর্থে অনুকূল ঠাকুর মানবকল্যাণে তার জায়গা-জমি যথাসর্বস্ব উৎসর্গ করে গেছেন। এখানে শ্রীশ্রী অনুকূল চন্দ্রের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ওই সময় লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয় বলে জানা যায়। ভারত থেকেও লোকজন এখানে আসেন।

পাবনা শহরে আমার সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ছিল ভারতের প্রখ্যাত অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের সংগ্রহশালা দেখা। ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল জন্ম হয় এই কিংবদন্তি নায়িকার। ধারণা করা হয়, তার জন্ম হয়েছিল ভারতের বিহার রাজ্যের পাটনায় মামা বাড়িতে। ১৯২২ সালে তার বাবা পৌরসভার স্বাস্থ্য পরিদর্শকের চাকরি পেয়ে যশোরের আদি নিবাস ছেড়ে পাবনা চলে আসেন। পাবনা শহরের গোপালপুরের হেমসাগর লেনে একতলা বাড়ি তৈরি করেন। সেই বাড়িটির গা ঘেঁষেই ছিল হেমসাগর দীঘি। ইছামতি নদী আর সেই হেমসাগর দীঘির সঙ্গে বড় হয়ে উঠতে থাকেন সুচিত্রা।

সুচিত্রা সেন এর বাড়ির উঠোন ও ভেতরের দিক

এ বাড়িটি ঘিরে সুচিত্রাদের ভরপুর সোনালি জীবন ছিল। ১৯৪৭ সালে বিয়ের পর এ বাড়ি ছেড়ে কলকাতা চলে যান সুচিত্রা। ১৯৬০ সালে সুচিত্রার বাবাও বাড়িটি জেলা প্রশাসনের কাছে ভাড়া দিয়ে সপরিবারে কলকাতা চলে যান। আস্তে আস্তে বাড়িটি দখল হতে থাকে এবং ১৯৯০ সালে পুরোপুরি দখল হয়ে যায়। ২০০৯ সালে বাড়িটি দখলমুক্ত করতে পাবনা জেলার সাংস্কৃতিককর্মী এবং সুধীজনেরা একত্রিত হন। গড়ে তোলেন ‘সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ’। তাদের তুমুল প্রতিবাদের মুখে ২০১৪ সালের জুলাইতে বাড়িটি দখলমুক্ত হয় এবং সেখানে স্বল্প পরিসরে সংগ্রহশালাটি গড়ে তোলা হয়।

সুচিত্রা সেন সংগ্রহশালায় সুচিত্রা সেন এর স্মৃতিফলক(বাঁয়ে) এবং মঞ্জুশ্রী চাকির বাড়ি(ডানে)

ছোটবেলা থেকেই সুচিত্রা পড়াশোনার পাশাপাশি নাচ, গান, পেইন্টিংয়ে খুব উৎসাহী ছিলেন। এই উৎসাহের পেছনে অন্যতম অবদান ছিল সংস্কৃতমনা একটি পরিবারের। সে পরিবারের বাসিন্দা ছিলেন মঞ্জুশ্রী চাকি; যিনি একজন বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী হয়ে উঠেছিলেন পরবর্তীকালে। তার বাড়িটি একদম সুচিত্রা সেনের বাড়ির পাশেই। প্রথমে সে বাড়িটি দেখে নিলাম। বেশ পুরোনো আর জমিদারবাড়ির মতো বিশাল বাড়ি। ওই বাড়ির বারান্দায় নাচ, গান, নাটকের মহড়া সব চলত। তখন থেকেই স্কুলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অভিনয় করতে থাকেন সুচিত্রা এবং অভাবনীয় সাড়াও পান।

সুচিত্রা সেন কর্ণার(বাঁয়ে) এবং সুচিত্রা সেনের বিভিন্ন ছবির অনস্ক্রিন প্রদর্শনী(ডানে)

সুচিত্রার নাম ছিল রমা দাশগুপ্ত, ডাকনাম রমা, পাবনার মেয়ে। আজ সুচিত্রা নেই। কিন্তু পাবনা তার স্মৃতি ধরে রেখেছে যতটা সম্ভব। সুচিত্রা সেনের সংগ্রহশালায় তার বিভিন্ন বয়সের ছবি, তার অভিনীত সিনেমার তালিকা, সিনেমার পোস্টার, তার ব্যবহৃত কিছু জিনিস ইত্যাদি রয়েছে। সেখানে প্রবেশ করলে শোনা যায়, তার অভিনীত সিনেমার গান বাজছে। সেই গানের সুর অন্যরকম আবেশ তৈরি করে। জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক জানালেন, ‘কলকাতায় যোগাযোগ করা হয়েছে তার আরও কিছু নিদর্শন পাঠানোর জন্য। সেসব নিদর্শন দিয়ে সংগ্রহশালাটি সাজালে তা আরও সমৃদ্ধ হবে।’ পাবনার রূপকথা রোডে ‘রূপকথার কাব্য’ নামে একটি রেস্টুরেন্ট আছে। সেখানে রয়েছে সুচিত্রার পোর্ট্রেইট, তাকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন বই। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে রয়েছে ‘সুচিত্রা সেন ছাত্রী নিবাস’। অন্নদা গোবিন্দ লাইব্রেরিতে তাকে নিয়ে লেখা বই ও আর্টিকেল সংরক্ষণ করা আছে। রূপকথা রিসোর্টের রুমগুলো তার সিনেমা এবং গানের নাম দিয়ে নামকরণ করা, রুমে রুমে তার ছবি রাখা। একজন মানুষ চলে গিয়েও কী দারুণভাবে থেকে যায়, তাই নাহ্!

সুচিত্রা সেন অভিনীত চলচ্চিত্রের তালিকা

ওহ হ্যাঁ, জাদুঘরটির প্রবেশমূল্য মাত্র ২০ টাকা। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সাপ্তাহিক বন্ধ সোমবার।

সেদিনের মতো পাবনা ভ্রমণ সেখানেই সমাপ্ত করে ফেরার পথ ধরলাম। মনের ভেতর জেগে রইল বাংলার মেয়ে সুচিত্রা সেনের ঐশ্বর্যভরা মুখ।

পাবনায় আরও যা দেখার আছে

সদর উপজেলায় কাচারিপাড়া জামে মসজিদ, কবি বন্দে আলী মিয়ার বাড়ি, জোড় বাংলা মন্দির বা গোপীনাথ মন্দির, রত্নদ্বীপ রিসোর্ট, রূপকথা ইকো রিসোর্ট, এডরুক লিমিটেড এসব দেখতে পারেন। আটঘরিয়া উপজেলায় আছে চন্দ্রাবতীর ঘাট ও বংশীপাড়া স্মৃতিসৌধ, বেরুয়ান জামে মসজিদ, চাচকিয়ার তাঁতশিল্প, চন্দ্রনাথ সেনের জমিদারবাড়ি। ঈশ্বরদী উপজেলায় আছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রাশিয়ান সিটি, ঈশ্বরদী রেল জংশন, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, লালন শাহ সেতু, ঈশ্বরদী বিমানবন্দর, ঈশ্বরদী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, ফুরফুরা শরিফ, বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্র, চিনিকল। চাটমোহর উপজেলায় আছে প্রমথ চৌধুরীর পৈতৃক নিবাস, শাহী মসজিদ, মথুরাপুর মিশন। ফরিদপুর উপজেলায় আছে রাজা রায় বাহাদুরের বাড়ি বা বনওয়ারী নগর রাজবাড়ি। বেড়া উপজেলায় আছে হাটুরিয়া জমিদারবাড়ি বা ১৩ জমিদারবাড়ি। সাঁথিয়া উপজেলায় আছে ক্ষেতুপাড়া জমিদারবাড়ি। সুজানগর উপজেলায় আছে গাজনার বিল, তাঁতীবন্দ জমিদারবাড়ি, পাবনার ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প, আজিম চৌধুরী জমিদারবাড়ি।

কীভাবে যাবেন

সড়কপথে- কল্যাণপুর, গাবতলী বা টেকনিক্যাল মোড় থেকে ঢাকা-পাবনা রুটে বাস চলাচল করে। ভাড়া ৫০০-৯০০ টাকা।
রেলপথে- কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠতে পারেন। ভাড়া ১১৫-৫২৭ টাকা।

কোথায় থাকবেন

পাবনা সদরে হোটেল নিতে পারেন। তা হলে দর্শনীয় জায়গাগুলো সহজে ঘুরে দেখতে পারবেন।

কী খাবেন

ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে খেতে পারেন। প্যারাডাইস সুইটসের মিষ্টি, জলযোগ হোটেলের খাবার, সেতু হোটেলের গরুর বট ও কালাভুনা এবং রাশিয়ান সিটির খাবার খেতে পারেন। পাবনার ঘি খুব ভালো। ঘি নিয়ে আসতে পারেন।

জাহ্নবী

মাদার হাউজে একদিন

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩২ পিএম
আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫৬ এএম
মাদার হাউজে একদিন
ছবি: সংগৃহীত

কলকাতা সময় সকাল ৬টা হবে। সাত সকালে মামি ডাকা শুরু করলেন এই তাড়াতাড়ি ওঠ। আজ আমাদের অনেক জায়গায় যেতে হবে। মা প্রায় ১৮ বছর পর কলকাতায় এসেছেন। ব্যাংক থেকে পাঁচ দিনের ছুটি নিয়ে এসেছি এক ঢিলে দুই পাখি মারার জন্য। একদিকে ভ্রমণ অন্যদিকে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ। সময়ও হাতে কম, তাই আগে থেকেই আমরা কোন দিন কোথায় যাব ঠিক করে নিয়েছিলাম।

ভেবেছিলাম আরও কিছু সময় ঘুমাব কিন্তু মামি আর মায়ের ডাকাডাকির চোটে সুখের ঘুম থেকে উঠতেই হলো। ঘুম থেকে ওঠার পর আবার অত্যাচার শুরু করলেন মামি। এবার খাবারের টেবিলে নাশতা করতে যেতে হবে। এমনি আমি সকালবেলায় তেমন কিছু খাই না। অগত্যা খাবারের টেবিলে গিয়ে বসতে হলো। গরম গরম লুচি, আলুর দম, মিষ্টান্নের ঘ্রাণে মন ভরে গেল। এদিকে টুকুনদার ফোন জলদি নিচে নামার জন্য। টুকুন দা আমাদের কলকাতা ভ্রমণের প্রতিদিনের সঙ্গী। আমরা সিথির মোড়ের ডেরা থেকে বের হলাম। এই সাত সকালেই কলকাতা শহরের রাস্তায় যানজট। ঠিক আমাদের ঢাকা শহরের মতো, গাড়ি যেন এগোতেই চায় না। রাস্তার দুই ধারে পুরোনো আমলের বাড়ি। চুন সুরকি খসে বাড়িগুলো অপূর্ব রূপ ধারণ করেছে। আমার শিয়ালদহ রেলস্টেশন পেরিয়ে এগিয়ে চলছি। শিয়ালদহ রেলস্টেশনে চোখে পড়ল অনেক মানুষের ভিড়।

এই কক্ষে থেকেছেন মাদার তেরেসা  

পথে ট্রামের দেখা মিলল। ছোটবেলায় মায়ের কাছে অনেক গল্প শুনেছি এই ট্রামের। প্রথমবারের মতো দর্শন মিলল ট্রামের। আমাদের আজকের গন্তব্যস্থল মিশনারিজ অব চ্যারিটি। যেখানে শায়িত আছেন মাদার তেরেসা। মাত্র পাঁচ টাকা এবং দশ জনকে নিয়ে শুরু এই মিশনারিজ অব চ্যারিটি। ধীরে ধীরে শহর থেকে রাজ্যে, দেশ ছাড়িয়ে বহির্দেশে। তার তৈরি মিশনারিজ অব চ্যারিটি ছড়িয়ে পড়েছে ১৩৯টি দেশে। সঙ্গে রয়েছেন সেই দুঃখী মানুষ যাদের জন্য এই ‘বিপুল’ কর্মকাণ্ড। 

সেই ‘বিপুলে’র টানে এই শহরে ছুটে এসেছেন মোহম্মদ আলি, ডমিনিক ল্যাপিয়ের, ইয়াসির আরাফাত, যুবরাজ চার্লস, ডায়নাসহ তাবড় তাবড় খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। আমরা যাচ্ছি সেই মাদার হাউজে। আমাদের পথ নির্দেশক মামি নিজেও কখনো যাননি মাদার হাউজে। শুধু শুনেছেন বোস রোডে রয়েছে মাদার হাউজ। আমরা বোস রোডে এসে পৌঁছালাম। রাস্তা চিনতে না পারায় অগত্যা ট্রাফিক পুলিশের সাহায্য নিতে হলো। সামনে যেতেই দেখা পেলাম সেই কাঙ্ক্ষিত মাদার হাউজের। চারতলা ভবন, দেয়ালে মার্বেল পাথরে খোদাই করা লেখা MISSIONARIES OF CHARITY। বাঁ দিকে গলির ভেতর ঢুকতেই চোখে পড়ল মাদার তেরেসার মূর্তি। বড় সাইনবোর্ডে লেখা The Mother House। পুরোনো দিনের ভবন আর সেই আগের দিনের জানালা। প্রবেশপথে বাইরের দেশের অনেক লোকের দেখা পেলাম। আমরা নগ্ন পায়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম।

অসাধারণ পরিবেশ, নিঃশব্দ নীরবতা। একটি ঘরের দিকে সবাই যাচ্ছে, আমরাও তাদের পথ অনুসরণ করলাম। আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম। শান্তির দূত শায়িত আছেন। সবাই বসে নীরবে প্রার্থনা করছেন, কেউ কেউ অঝোরে চোখের জল ফেলছেন। ধূপকাঠির মোহিত গন্ধ আর পরিবেশ যে কারও খুব ভালো লাগবে। মাদারের সমাধির পাশে বসে প্রার্থনা করার অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না। আমরা বসে কিছু সময় প্রার্থনা করলাম। চোখে পড়ল একপাশে লেখা ‘These flower were placed on Mother tomb. You are most welcome to take them as a blessing।’

আমি একটি কাগজে আমার প্রার্থনা মাদারের কাছে লিখে নির্ধারিত স্থানে দিলাম। এক পাশে একটি কাপড়ের মধ্যে দেখতে পেলাম বিভিন্ন দেশের মানুষের অনুভূতিগুলো নানান ভাষায় লিপিবদ্ধ করা। আমি বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম। পাশের কক্ষে প্রবেশ করলাম। এখানে বেশ বড় লাইব্রেরি কক্ষ। এখানে ছবি তোলা নিষেধ। এই কক্ষে মাদার তেরেসার ব্যবহৃত সামগ্রীগুলো সুন্দর করে সাজানো আছে। সেখান থেকে মাদার তেরেসার জীবনী নিয়ে একটি বই উপহার পেলাম। বইটি তিনটি ভাষায় রচিত। এরপর আমরা গেলাম শান্তির দূত যেখানে তার জীবনের বেশির ভাগ সময় পার করেছেন। দোতালার ছোট্ট একটি কক্ষ। তার মাঝে একটি খাঁটিয়া পাশে একটি টেবিল আর চেয়ার। বাইরে থেকে ভেতরে প্রবেশ নিষেধ তাই আমরা বাইরে দাঁড়িয়েই দেখলাম। আমি মনে মনে ভাবলাম এই দালানের প্রতিটি স্থানে মাদার তেরেসার পদধূলি পড়েছে। এ রকম একটি স্থানে আসতে পারা ভাগ্যের ব্যাপার। নিচে আমরা মাদার তেরেসার জীবনী নিয়ে রচিত বিভিন্ন কথামালার দিকে মনোনিবেশ করলাম। দেখা মিলল সিস্টার সিজের।

তিনি আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে খুব খুশি হলেন। তিনি বললেন, তিনিও বাংলাদেশ এসে ঘুরে গেছেন। তিনি আরও বললেন, বিশ্বে মানবসেবায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করা মানবাধিকার কর্মী মাদার তেরেসাকে সন্ত ঘোষণা করেছেন পোপ ফ্রান্সিস। গত ৪ সেপ্টেম্বর ভ্যাটিকান সিটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে মাদার তেরেসাকে সন্ত ঘোষণা করেন পোপ। সন্ত হওয়ার প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করেছেন মাদার তেরেসা। দুটি ঘটনাকে অলৌকিক বলে স্বীকৃতি দেয় ভ্যাটিকান এবং সর্বশেষে পোপ। সন্ত হওয়ার শর্ত হিসেবে প্রথম ঘটনা ঘটে ১৯৯৮ সালে। পশ্চিমবঙ্গের এক আদিবাসী নারী মণিকা বেসরার পেটের টিউমার সেরেছিল মাদার তেরেসার নামে প্রার্থনা করে। অন্যটি ঘটে ২০০৮ সালে ভ্যাটিকানের দাবি, ওই বছর ব্রাজিলে মাদার টেরেসার নামে প্রার্থনা করে সুস্থ হন এক যুবক যার মস্তিষ্কে একাধিক টিউমার ছিল।

আরও পড়ুন: ফরাসিদের স্মৃতিবিজড়িত শহর চন্দননগর

৫ সেপ্টেম্বর মাদারের ১৯তম মৃত্যুদিন। তার ঠিক আগের দিন রোমে ‘বিয়েটিফিকেশন’ অনুষ্ঠানে মাদারকে ‘সন্ত’ ভূষিত করবেন পোপ ফ্রান্সিস। তার কথার সঙ্গে চোখে জল চলে এল। এ অশ্রু আনন্দের, তার সঙ্গে আমরা ছবি তুললাম। দেখতে দেখতে আমাদের বিদায় নেওয়ার পালা চলে এল আমরা চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের দিকে। বলে রাখা ভালো মাদার হাউজের দর্শন পেতে হলে আপনাকে যেতে হবে সকাল ৮টা থেকে ১২টার ভেতর আর বিকেল বিকেল ৩টা থেকে ৬টার মধ্যে। বৃহস্পতিবার মাদার হাউজ বন্ধ থাকে।

যাবেন কীভাবে
কলকাতা বিমানবন্দর, রেলস্টেশন, সড়কপথে মাদার হাউজের যেতে আপনাকে ট্যাক্সি অথবা অটো ভাড়া করে এজিসি বোস রোডে পৌঁছাতে হবে। সেখনে যে কাউকে বললে দেখিয়ে দিবে মিশনারিজ অব চ্যারিটি অথবা মাদার হাউজ।

 কলি 

 

নীল সমুদ্রের হাতছানির দেশ গাম্বিয়া

প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:০৪ পিএম
আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:০৪ পিএম
নীল সমুদ্রের হাতছানির দেশ গাম্বিয়া
ছবি: সংগৃহীত

কাজী আসমা আজমেরী। বাংলাদেশি পাসপোর্ট হাতে ঘুরেছেন বিশ্বের ১৫০টি দেশ। স্বপ্ন দেখেন পুরো বিশ্ব ছোঁবেন তিনি। ২০০৯ সাল থেকে বিশ্বভ্রমণ শুরু কাজী আসমার। সেই যে উড়ে চলেছেন, আর থামেননি। একজন নারী হিসেবে সেই পথ পাড়ি দিতে পেরোতে হয়েছে অনেক বাধা। দৈনিক খবরের কাগজের লাইফস্টাইল পেজ ‘ফ্যাশন প্লাস’-এর পাঠকের জন্য তিনি নিয়মিত ভ্রমণকাহিনি লিখবেন। আজ থাকছে একটি পর্ব-

চলতি বছরের জুনে আমি আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া ভ্রমণে যাই। এটা ছিল আমার ১৪৫ তম দেশ ভ্রমণ। দেশটির সেরাকুন্ডু এলাকায় পৌঁছানোর অভিজ্ঞতা বেশ মিশ্র ছিল। শহরের কেন্দ্রীয় ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে সাড়ে ৫ হাজার সেনেগালি টাকায় গাম্বিয়ার সেরাকুন্ডু শহরে পৌঁছাই। ইমিগ্রেশন পার হওয়া বেশ সহজ ছিল, কিন্তু লাগেজ চেকিং প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ এবং কিছুটা বিরক্তিকর। সময় বাঁচাতে সামান্য অতিরিক্ত টাকা দিলে দ্রুত কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হলেও আমি সেটি এড়িয়ে যাই।

সন্ধ্যায় শহরে পৌঁছানোর পর, আমার হোস্ট মোহাম্মদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম। তবে সেনেগাল সিম কাজ না করায় স্থানীয় সিম কিনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। অবশেষে, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সেরাকুন্ডু বাজারে তার সঙ্গে দেখা হয়। বাজারটি বাংলাদেশের বাজারের মতোই। রাস্তায় ছোট ছোট দোকানে চা, কফি, এমনকি ভ্যানগাড়িতে বিভিন্ন খাবার পাওয়া যায়। সেই রাস্তায় একটু আড্ডা দেওয়ার পর মোহাম্মদের বাসায় আসি। তার ড্রয়িং রুমটি সুন্দরভাবে পরিষ্কার হলেও বেডরুমটি বেশ পুরোনো এবং কিছুটা অস্বাস্থ্যকর ছিল, ফলে রাতে কষ্ট করে ঘুমাতে হয়।

পরের দিন সকালে সিদ্ধান্ত নিই যে, ভালো মানের হোটেলেই থাকব। তাই অনলাইনে সেনেগামিয়া রিসোর্টে বুকিং দিই, যেখানে বেশ কয়েকটি সুইমিং পুল এবং সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা রয়েছে। মাত্র ৫৫ ডলারে এমন সুন্দর রিসোর্ট পেয়ে আমি আনন্দিত এবং Agoda পয়েন্ট ব্যবহার করায় রেটটি আরও কমে আসে। মূলত তিন দিনের জন্য বুক করলেও পরিবেশ এতটাই মনোমুগ্ধকর ছিল যে, শেষমেশ সাত দিন থেকে যাই।

এখানে থাকার সময় পরিচয় হয় ইমানুল নামের এক বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে, যিনি গাম্বিয়ার মানবাধিকার সংগঠনের চেয়ারম্যান এবং অং সান সু চির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মামলা করেছেন। তার সঙ্গে আলাপের মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানবাধিকার বিষয়ে গভীর কিছু জানার সুযোগ হয়।

গাম্বিয়ায় আমার ১৪৫তম দেশ উদযাপন সত্যিই একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা ছিল। রোটারি ক্লাব বাঞ্জুলে সামাদি নামের এক রোটারিয়ান বন্ধু এই আয়োজন করে, যেখানে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জন রোটারিয়ানের সঙ্গে কেক কেটে এবং ডিনার করে এই বিজয়কে উদযাপন করি। নতুন দেশের মাটিতে, এমনভাবে নতুন বন্ধুদের সঙ্গে মিলে নিজের বিজয় উদযাপন করার সুযোগ পাওয়া ছিল এক অত্যন্ত আনন্দের ব্যাপার।

বাঞ্জুল এবং এর আশপাশের হেরিটেজ সাইটগুলো ঘুরতে গিয়ে এখানকার নদী পার হয়ে বাড়া নামের ছোট একটি শহরে যাই, যেখানে গাধার গাড়িতে চড়ে গ্রামের পরিবেশ উপভোগ করি। সেখানে স্থানীয় গরুর কলিজা ভুনা স্যান্ডউইচ খাওয়ার অভিজ্ঞতাও বেশ আনন্দদায়ক ছিল। সাত দিন ধরে এ শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে অনেক কিছু দেখেছি। এখানকার জাতীয় জাদুঘরটি বেশ আকর্ষণীয়, আর স্থানীয় স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটি মোটিভেশনাল প্রোগ্রাম করতে পেরে সত্যিই অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। গাম্বিয়ায় ইংরেজি ভাষা প্রচলিত হওয়ায় এখানে ঘোরাফেরা করা সহজ ছিল।

মোহাম্মদ ও আসান নামের দুই বন্ধুর সহযোগিতায় গাম্বিয়ার বিভিন্ন স্থান এবং তাদের গ্রামীণ জীবনযাত্রা সম্পর্কে আরও গভীর ধারণা লাভ করি। স্থানীয় মুসলিম আচার-আচরণের মধ্যে বাংলাদেশি প্রভাব দেখা গেলেও কিছু সাংস্কৃতিক পার্থক্য লক্ষ করেছি। এখানে কেউ হজ থেকে ফিরে এলে বড় গরু জবাই করে এলাকাবাসীকে আপ্যায়ন করাটা তাদের জন্য খুবই সম্মানজনক কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়।

গাম্বিয়ায় সরকার ট্যুরিজমকে গুরুত্ব দিয়েছে, যা ব্রিটিশ পর্যটকদের কাছে দেশটিকে জনপ্রিয় হলিডে ডেস্টিনেশন হিসেবে পরিচিত করেছে। সমুদ্রের নীল জলরাশি, আকর্ষণীয় রিসোর্ট এবং বিভিন্ন বিনোদনের ব্যবস্থা এখানে ট্যুরিস্টদের জন্য একটি মজাদার অভিজ্ঞতা। যদিও এই সমাজের কিছু বিতর্কিত দিকও রয়েছে যেখানে অনেক স্থানীয় তরুণ পর্যটকদের সঙ্গে সামাজিকীকরণের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে।

গাম্বিয়ার গ্রামগুলোয় যাওয়ার অভিজ্ঞতা সত্যিই অনন্য ছিল। বাংলাদেশের গ্রামের মতোই, তবে এখানকার মানুষের আন্তরিকতা যেন আরও বেশি উষ্ণ আর খোলামেলা। গ্রামগুলোয় সহজে পৌঁছানোর জন্য শেয়ার ট্যাক্সির ব্যবস্থা রয়েছে, যা যেকোনো স্থানে ঘোরার কাজকে খুবই সুলভ করে তোলে।
এখানে আমার নতুন বন্ধুত্বের জোয়ার বইয়ে দিয়েছে, বিশেষ করে নারী সাংবাদিকদের বিশাল একটি গ্রুপের সঙ্গে। ইজি এবং তার স্বামী, ওমরসহ অনেকেই আমাকে চমৎকার সময় উপহার দিয়েছে এবং গাম্বিয়ার নানা স্থানে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। এই বন্ধুত্বের মাধ্যমেই আমি গাম্বিয়ার মিডিয়া ও সংবাদ জগতে কিছুটা প্রভাব ফেলতে পেরেছিলাম। আমার ১৪৫তম দেশের ভ্রমণের কাহিনি গাম্বিয়ার সবচেয়ে বড় সংবাদপত্র ‘স্ট্যান্ডার্ড’ এ প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া ‘পয়েন্ট’ নিউজ পেপারেও আমার ভ্রমণ ও মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবে কাজের উল্লেখযোগ্য বিবরণ ছাপা হয়, যা এই দেশকে ভিন্ন এক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ করে দেয়।

গাম্বিয়ায় মানুষের জীবনধারা আর সামাজিক সম্প্রীতির বিষয়টি সত্যিই মনোমুগ্ধকর। মুসলিম ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষ একসঙ্গে বড় পাত্রে বসে খাবার খায়, যা এখানকার ঐতিহ্যের একটি অংশ। এদের বিশেষ খাবারটা অনেকটা আমাদের বিরিয়ানির মতো, সঙ্গে গরুর ভুনা ও রসুন থাকে যা আমাদের বাংলাদেশি স্বাদকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে দিনের বেলায় স্থানীয় খাবার পাওয়া গেলেও রাতের বেলায় তা কমে যায়। রাস্তার পাশের ছোট ছোট রেস্তোরাঁয় স্যামন মাছ, গরুর বিরিয়ানি জাতীয় খাবার পাওয়া যায়, যা বেশ সস্তায় মেলে—আমাদের প্রায় ২০০ টাকার মতো খরচ হয়। এই খাবারগুলোয় থাকে বড় মাছের টুকরা, সেদ্ধ আলু ও গাজর ও ক্যাপসিকামের মতো দেখতে কিছুটা তেতো একটি সবজি, যা পোলাওয়ের সঙ্গে খেতে বেশ ভালো লাগে। এভাবেই আফ্রিকার সবচেয়ে ছোট দেশ গাম্বিয়ায় ভ্রমণ শেষ করলাম।

কলি 

ফরাসিদের স্মৃতিবিজড়িত শহর চন্দননগর

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২১ পিএম
আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:১১ পিএম
ফরাসিদের স্মৃতিবিজড়িত শহর চন্দননগর
চন্দননগর স্ট্র্যান্ড। ছবি: সংগৃহীত

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার একটি শহর চন্দননগর, যা একসময় ফরাসি উপনিবেশ ছিল। চন্দননগরকে ভালো লাগার কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, রবি ঠাকুর আর কাদম্বরী দেবী তাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর কিছু দিন যাপন করেছিলেন চন্দননগরের মোড়ান সাহেবের বাগানবাড়িতে। এ ছাড়া রবি বাবু চন্দননগরের পাতাল বাড়িতেও এসেছিলেন। দ্বিতীয়ত, চন্দননগর নামটা খুব নান্দনিক। ফরাসিরা যে সেখানে বাস করতেন, আজও সেই ছোঁয়া লেগে আছে। তৃতীয়ত, ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল নবনীতা নামের এক দিদির সঙ্গে। থাকেন চন্দননগরের কাছাকাছিই। তার মেয়ে পড়ে চন্দননগরের একটা স্কুলে। তাই তার সেখানে নিয়মিত যাতায়াত। সব মিলিয়ে চন্দননগর যাওয়ার আগ্রহ ছিল ভীষণ। শেষ পর্যন্ত অনেক অপেক্ষার পর সেই দিনটা এসেই গেল।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া সুন্দর একটা নতুন হলুদ শাড়ি পরলাম। চন্দননগর ভ্রমণে আমার সঙ্গী হিসেবে ছিল পূজা এবং বৈশাখী নামে দুজন ভারতীয় বন্ধু। বৈশাখীও হলুদ রঙের একটা শাড়ি পরল। কলকাতায় আমরা উঠেছিলাম দমদমের একটি বাড়িতে। সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে দমদম স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম। পূজা উঠল কয়েকটা স্টেশন পরে, আলাদা বগিতে। আমরা নেমে গেলাম শ্যামনগরে। সেখানে আমাদের দেখা হলো। একটা টোটো নিলাম জগদ্দল ঘাট পর্যন্ত। ঘাটে নেমে রাণীঘাট অবধি ফেরির টিকিট সংগ্রহ করলাম। একটা ঘাট থেকে আরেকটা ঘাট দেখা যায়, এত কাছে। টিকিট মূল্য মাত্র ৯ রুপি। ফেরি থেকে নেমে পা রাখলাম বিখ্যাত চন্দননগরে!

চন্দননগরের রাণীঘাট সংলগ্ন যেই রাস্তাটা, প্রায় সব দর্শনীয় জায়গা সেই একই জায়গায় অবস্থিত। বাদবাকি দু-চারটা আলাদা জায়গায়। তাই অল্প সময়ে চন্দননগর আরাম করে ঘুরে ফেলা যায়। আমরা একে একে যা দেখলাম চন্দননগরে-

চন্দননগর স্ট্র্যান্ড
এটা চন্দননগরের গঙ্গাতীরের একটি ঘাট। ঘাটের প্রবেশদ্বার রাজকীয় স্টাইলে বানানো। এটাই সেই ঘাটের বিশেষত্ব। সন্ধ্যাবেলায় দেখতে আরও সুন্দর লাগে, যদিও আমরা দিনের বেলায় দেখেছিলাম।

চন্দননগর মিউজিয়াম


চন্দননগর মিউজিয়ামটা এখানেই। এটি মূলত ফরাসিদের একটি ঐতিহাসিক মিউজিয়াম। মিউজিয়ামে রয়েছে বই, ভাস্কর্য, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নানা ঐতিহাসিক জিনিসপত্র ইত্যাদি। এ ছাড়া রয়েছে ফরাসি ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা। 

পাতাল বাড়ি


গঙ্গার ধারে সুন্দর একটি বাড়ি। রবি ঠাকুর ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্মৃতিবিজড়িত বলেই পাতাল বাড়িটা আরও বিখ্যাত। বহু প্রাচীন এই বাড়ির নিচের তলাটি বর্তমানে গঙ্গার নিচে। কিশোর রবি তার জ্যোতি দাদা ও বৌঠাকুরন কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে কিছুদিন এই বাড়ির পাশে তেলেনিপাড়ার বারুজ্যদের বাগান বাড়িতে ছিলেন। সেখান থেকে গিয়েছিলেন মোরান সাহেবের বাংলো বাড়িতে। পরবর্তী সময়ে রবি ঠাকুর এই পাতাল বাড়িতে এসেছিলেন। শোনা যায়, তিনি এখানে কয়েকবারই এসেছিলেন। অন্যদিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একবার বিধবা বিবাহ প্রচলন উপলক্ষে বেশ কিছুদিন এ বাড়িটিতে থেকে চন্দননগরের বাসিন্দাদের সাহায্য চেয়েছিলেন। ঐতিহাসিকভাবে হিন্দু সমাজে প্রথম বিধবা বিবাহ শুরু হয় এই চন্দননগরেই।

পাতাল বাড়িটি আজও অনেকটা টিকে থাকলেও বারুজ্যদের বাগান বাড়ি এবং মোরান সাহেবের বাংলো বাড়ির আর কোনো অস্তিত্ব নেই। বর্তমানে এখানে দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ। ভেতরে যেতে পারলে আরও ভালো লাগত। তবু বাইরে থেকেও যে এমন একটি মূল্যবান বাড়ি দেখার সুযোগ হলো, তাতেই নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি।

স্যাক্রেড হার্ট চার্চ


এটি একটি রোমান ক্যাথলিক ঐতিহ্যবাহী চার্চ। বলাবাহুল্য যে, এই চার্চ ফরাসিদেরই বানানো। ফরাসি স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত চার্চটি মোটামুটি বড় আর দেখতে সুন্দর। চার্চটির স্থপতি ছিলেন জ্যাক ডুচাটজ। ১৮৭৫ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৮৮৪ সালে। আমি যখন যাই, তখন দুপুরের বিরতিতে চার্চটি বন্ধ ছিল। কিন্তু যখন চার্চটির একজন তত্ত্বাবধায়ক জানতে পারলেন বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি চন্দননগর ভ্রমণে, তখন তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে চার্চটি খুলে দিয়ে আমাদের দেখার সুযোগ করে দিলেন।

চন্দননগর কলেজ


হুগলি জেলার একটি প্রাচীনতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চন্দননগর কলেজ, যা ১৮৬২ সালে নির্মিত। কলেজটি এজন্য বেশি ভালো লেগেছে যে, তাতে ফরাসি স্থাপত্যের ছোঁয়া আছে। সেই আগেরকার হলুদ বিল্ডিং, সবুজ জানালা সমৃদ্ধ কী সুন্দর ভবন। আসলে প্রাচীন যেকোনো স্থাপনার ভেতরই অন্যরকম একটা ব্যাপার আছে!

রবীন্দ্র ভবন


রবীন্দ্র ভবন শিল্প সাধনার একটি জায়গা; যাকে চন্দননগরের সাংস্কৃতিক চর্চার প্রাণকেন্দ্রও বলা যায়। শিল্প সাহিত্যের বিভিন্ন প্রোগ্রাম সেখানে হয়ে থাকে।

নন্দদুলাল মন্দির


এই মন্দিরটা রাণীঘাট থেকে সামান্য দূরে লালবাগান এলাকায়। টোটোতে করে চলে গেলাম সেখানে। মন্দিরটি ১৭৩৯ সালে চন্দননগরের তৎকালীন ফরাসি সরকারের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরটি দৈর্ঘ্যে ৫১ ফুট ৯ ইঞ্চি এবং প্রস্থে ১১ ফুট। মন্দিরের সামনে ও পশ্চিম দিকের দেয়ালে ছোট ছোট কিছু পোড়ামাটির ফুলের নকশা আছে। মাঝ বরাবর আছে মন্দিরে প্রবেশের সিঁড়ি। মন্দিরটির ভেতরে একটি গুপ্তঘরও আছে। 

দ্য স্লিপি হোলো 


এটি একটি পুরোনো বাড়ি এবং চন্দননগরের ঐতিহাসিক ল্যান্ডমার্ক। নন্দদুলাল মন্দিরের বিপরীতেই এই বাড়িটা। পুরোনো বাড়ির প্রতি আমার আলাদা মায়া কাজ করে, তাই দেখে নিলাম। এ কথা অনস্বীকার্য যে, বাড়িটি সুন্দর ছিল। আরভিং ওয়াশিংটনের উনিশ শতকের বিখ্যাত আমেরিকান উপন্যাস ‘দ্য লিজেন্ড অব দ্য স্লিপি হোলো’ এর নামানুসারে বাড়িটির নামকরণ করা হয়েছিল ‘স্লিপি হোলো’। এই বাড়ির বাসিন্দা ছিলেন চন্দননগরের প্রধান প্রকৌশলী মহাশয় ভবানীচরণ চ্যাটার্জি।

আরও পড়ুন: বিলের ধারে প্যারিস শহর

জলশ্রী 


জলশ্রী হচ্ছে রাণীঘাটের একটি ভাসমান রেস্তোরাঁ। ইউটিউবে অনেক ভিডিও দেখে এখানে এক বেলা খাওয়ার ইচ্ছে ছিল। জলশ্রীর পরিবেশ সুন্দর, গঙ্গার বুকে ভেসে খাবার খাওয়ার অভিজ্ঞতাও দারুণ। ৫০ টাকা দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করে রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করতে হয়। টাকাটা পরে খাবারের মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়। প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এই রেস্তোরাঁটি খোলা থাকে। ভেতরে প্রায় ৫০ জন লোক একসঙ্গে খেতে পারে। যখন লোক প্রায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়, তখন নৌযান অর্থাৎ রেস্তোরাঁটি গঙ্গার বুকে চলতে শুরু করে। এই অনুভূতি অন্যরকম সুন্দর।

নবনীতা দিদি আমাদের সবাইকে চিকেন চাওমিন, চা আর চন্দননগরের বিখ্যাত জলভরা সন্দেশ খাওয়ালেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও খুব প্রিয় ছিল এখানকার জলভরা সন্দেশ। বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি বলে আমাকে উপহার দিতেও ভুললেন না তিনি। ‘চন্দননগরের ইতিহাস’ এবং ‘কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড নোট’ নামে দুটি বই উপহার দিলেন। স্কুল ছুটির পর দিদির একমাত্র ছোট্ট মেয়ে চলে এল। কী মিষ্টি আর আদুরে। তবে ততক্ষণে আমাদের ফেরার সময়ও হয়ে গেল। আর কখনো চন্দননগরে যাওয়া হবে কি না জানি না, তবে চন্দননগরের এই স্মৃতি দীর্ঘজীবন মনে রাখব। গঙ্গার ধারের ওই হাঁটা শান্ত স্নিগ্ধ পথটা মনে আঁকা থেকে যাবে বহুকাল!

দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে গেল। ফেরার সময় আবার একইভাবে আমরা শ্যামনগর এলাম। তারপর ট্রেনে করে গেলাম উত্তর চব্বিশ পরগণার নৈহাটীতে। সেখানে বিখ্যাত বড় মায়ের মন্দিরে গেলাম। বৈশাখী গঙ্গাজল নিল। তখন সূর্য ডুবে যাচ্ছিল গঙ্গার বুকে। কী যে অসাধারণ সেই দৃশ্য!

ফুচকা খেয়ে উত্তর চব্বিশ পরগনা থেকে আবার আমরা ট্রেনে উঠলাম দমদমের উদ্দেশে। তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। আসতে আসতে অনেক গল্প হচ্ছিল আমাদের। পূজা নেমে গেল কয়েক স্টেশন আগে। ওকে ছেড়ে চলে যেতে কষ্ট হচ্ছিল। আমি ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ট্রেন আবার চলতে শুরু করল।

দমদম পৌঁছে আমরা গেলাম মিত্র ক্যাফেতে। মেদিনীপুর থেকে ভিক্টর আর দমদম থেকে দীপক নামের দুই ভারতীয় বন্ধু যোগ দিল আমাদের সঙ্গে। মিত্র ক্যাফের ফিশ কবিরাজি খুব বিখ্যাত, মিত্র ক্যাফেও শতবছরের পুরোনো বিখ্যাত ক্যাফে। ফিশ কবিরাজি ছাড়াও বেশ কিছু আইটেম অর্ডার করা হলো। মিত্র ক্যাফের পরিবেশটা সুন্দর। গল্প করতে করতে আয়েশ করে খেলাম। তারপর ফিরে এলাম দমদমের সেই বাড়িতে।

কীভাবে যাবেন
যেকোনো জায়গা থেকে চন্দনগর স্টেশনে চলে আসবেন প্রথমে। তারপর টোটোতে করে চলে যাবেন রাণীঘাট। আর দমদম থেকে সহজে যেতে চাইলে আমার পথ অনুসরণ করতে পারেন।

কী খাবেন
বিখ্যাত জলভরা সন্দেশ অবশ্যই খাবেন। রাণীঘাটের স্ট্রিট ফুডও ট্রাই করতে পারেন। আর লাঞ্চ করার জন্য জলশ্রীতে খেতে পারেন।

কোথায় থাকবেন
চন্দননগর শহরের কোনো হোটেলে থাকতে পারেন। তবে শহরটির সব দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখার জন্য একটি দিনই যথেষ্ট, থাকার প্রয়োজন নেই।

 কলি 

নিমতলী প্রাসাদ

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২৬ পিএম
নিমতলী প্রাসাদ
নিমতলী প্রসাদ।

অফিস থেকে বাসায় ফিরেছি সেই কখন। হাতে কোনো কাজ ছিল না তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরঘুর করছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল প্রায় ২৫০ বছরের পুরোনো ঢাকার ঐতিহাসিক নিমতলী প্রাসাদ দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হচ্ছে। দেখেই আমি চোখ নিবদ্ধ করলাম খবরের দিকে। ঢাকার মোগল নায়েব-নাজিমদের জন্য ২৫০ বছর আগে নির্মিত প্রাসাদ ভবনের মূল অংশ সংরক্ষণের অভাবে ইতোমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে। একটি অংশ বর্তমানে বিদ্যমান, যা সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজধানী ঢাকার ৪০০ বছর পূর্তি উদযাপন কর্মসূচির আওতায় ২০০৯ থেকে ২০১১ সালে সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু নিয়মিত ব্যবহার না করায় পুনরায় তা কার্যকারিতা হারাচ্ছিল এবং স্থায়ীভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছিল।

এই ভবন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এই ভবনে জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে। ১৭০০ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত ঢাকা এবং পূর্ব বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনভিত্তিক নিদর্শন দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। এসব নিদর্শন ঢাকার বহু বনেদী ও সংস্কৃতমনা পরিবার থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। আমি মনে মনে ছক করে ফেললাম সামনের সপ্তাহে যখন ঢাকায় যাব তখন ঘুরে আসব এই ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা থেকে। চলে এল কাঙ্ক্ষিত দিন, সকাল বেলা ঢাকায় এসে পৌঁছেছি। আমার অস্থায়ী ডেরায় কিছু সময় বিশ্রাম নেওয়ার জন্য নিদ্রা দেবীর আশ্রয়ে গেলাম।

যাওয়ার আগে মোবাইলকে নির্দেশ দিলাম আমায় ঠিক সকাল ৯টার মধ্যে ডেকে দেওয়ার জন্য। মোবাইল তো তার প্রতি দেওয়া নির্দেশ মতো ঠিক সময়েই বেজে উঠল কিন্তু আমার নিদ্রা দেবীর কোল থেকে উঠতে মন চাইছিল না। তাই আরও কিছু সময় নিদ্রা দেবীর আবেশে থাকতে লাগলাম। বেশ মনের আনন্দে ঘুমাচ্ছিলাম , কিন্তু সেই আনন্দে পানি ঢাললেন সহধর্মিণী সানন্দা। কী উঠবে না? ঘুম থেকে আর কত ঘুমাবে! বলতেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ঘড়ির কাঁটায় সকাল সাড়ে ১১টা বাজি বাজি। দেখে তো আমার চোখ মাথায় ওঠার জোগাড়, তাই দেরি না করে উঠে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠে ভাবলাম নতুন যে গন্তব্যে যাব তার ঠিকানাই তো বের করা হয়নি, তাই আবার যোগাযোগ মাধ্যমে ঢুঁ মারলাম। উবারে লোকেশন দিয়ে দেখলাম আমার অস্থায়ী ডেরা থেকে গন্তব্যে যেতে ৪৫ মিনিট লাগবে। তাই ভাবলাম দুপুরের পেটপূজা শেষ করেই বের হই। পেটপূজা শেষ করে তৈরি হয়ে নিলাম।

আমার সঙ্গে সহধর্মিণী সানন্দা গুপ্ত আর অনিক গুপ্তও তৈরি হয়ে নিল নতুন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য। অস্থায়ী ডেরায় বসেই উবারে কল দিলাম। স্বল্প সময়ের মধ্যে গাড়ি এসে উপস্থিত। আমরা গাড়িতে উঠতেই পাইলট জানতে চাইলেন কোথায় যাব। বললাম, নিমতলীর ওই জায়গায় যেখানে নতুন একটি জাদুঘর হয়েছে। পাইলট বললেন, তাহলে লোকেশন ম্যাপে দেখানো পথেই এগিয়ে যাই। আমি বললাম ঠিক আছে, আমরা চলছি এগিয়ে ঘড়ির কাঁটায় তখন প্রায় বেলা ৩টা। শুক্রবার হলেও রাস্তায় যানজট লেগে আছে। দেখতে দেখতে ম্যাপ অনুযায়ী আমরা লোকেশনে পৌঁছালাম। কিন্তু এখন কোন দিকে যাব সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। কয়েকজনের কাছে জানতে চাইলাম নিমতলী দেউড়ি জাদুঘরটি কোথায়। কেউ সঠিক তথ্য দিতে পারছিল না। 

হঠাৎ রিদওয়ান আক্রাম ভাইয়ের কথা মনে হলো, সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিলাম। ফোন দেওয়ার পর রিদওয়ান ভাই পাইলটকে গন্তব্যে যাওয়ার পথ বলে দিলেন। আমাদের গুগলে দেখানো পথ ভুল ছিল তাই উল্টো পথে যাওয়া শুরু করলাম আমরা। যানজট পেরিয়ে আমরা পৌঁছালাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে কিন্তু ঘড়ির কাঁটায় তখন ৪টা ৫ বাজে। প্রবেশদ্বারে লেখা দেখলাম এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘর। সামনে এগোতেই সেখানে উপস্থিত দ্বাররক্ষী না বলে দিলেন এখন আর ঢোকা যাবে না। অনুরোধ করার পর বলেন ঠিক আছে আমি ভেতরের কর্মকর্তাদের কাছে থেকে অনুমতি নিয়ে আসি, তারা ঢুকতে দিতে চাইলেই তবে ঢোকা যাবে। কিছুক্ষণের মধ্যে দ্বাররক্ষী এসে গেট খুলে দিলেন। বললেন, দ্রুত জাদুঘর দর্শন করে আসতে হবে।

আমরা এগিয়ে চললাম জাদুঘরের দিকে। জনপ্রতি ২০ টাকা করে টিকিট কিনে সামনে এগিয়ে চললাম। দেখা পেলাম সেই কাঙ্ক্ষিত জাদুঘরে নতুন রং লেগেছে। দেখলে মনে হবে মাঝারি আকৃতির কোনো সুরম্য ভবন। মনের ভেতর বিস্ময় নিয়ে প্রবেশ করলাম ভবনে । প্রবেশপথটি ঠিক মধ্যখানে। ভবনের নিচতলায় ডান দিকে পাশাপাশি দুটি ঘর। প্রতিটি ঘরে তিন দিকের দেয়ালে স্মারক রাখার জায়গা করা হয়েছে। আর বাঁয়ে আছে একটি ঘর। আমরা প্রবেশ করলাম ঘরের ভেতর, ঘরটি খুব সুন্দর করে সাজানো আছে নানা স্মারক দিয়ে। আর বাঁয়ে আছে একটি ঘর। দেউড়ি ভবনেই ছিল এশিয়াটিক সোসাইটির প্রথম কার্যালয়। নিচতলায় তাই রাখা হয়েছে ১৯৫২ সালের ৩ জানুয়ারি যাত্রা করা এশিয়াটিক সোসাইটির নানা স্মারক। আরেকটি ঘরে ডিজিটাল মনিটরে নায়েব নাজিমদের আমলে ঢাকার ইতিহাসভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র দেখানোর ব্যবস্থা রয়েছে। নিচতলায় তিনটি গ্যালারি দেখে সরু একটি সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলাম। পুরোনো সিঁড়িতে কাঠ বসিয়ে নতুনত্ব দেওয়া হয়েছে। দোতলায় একটি ঘর, দৈর্ঘ্য-প্রস্থে প্রায় সমান। আলোকচিত্র ও তৈলচিত্র আছে বেশ কিছু।

পরের বিস্ময় তৃতীয় তলার দিকে আমরা এগিয়ে গেলাম। দেখে মনে হলো জাদুঘরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় গ্যালারি এটি। ৪৫ ফুট দৈর্ঘ্যের এই কামরায় রাখা হয়েছে মসলিন শাড়ি, ধাতব মুদ্রা ও তৈজসপত্র। সুপরিসর ঘরে নবাব নুসরাত জংয়ের দরবারের ত্রিমাত্রিক উপস্থাপনাও তুলে ধরা হয়েছে। যেন জীবন্ত! হঠাৎ করে দেখে মনে হবে দরবারে বসে আছেন নুসরাত জং। নবাবের হাতে হুঁকার নল। পেছনে একজন কাপড়ের পাখা নাড়িয়ে বাতাস দিচ্ছেন নবাবকে। পুরো ভবনটা এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যেন দর্শনার্থীরা নবাবি আমলে ফিরে যেতে পারেন। আমি, সানন্দা আর অনিক মিলে স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ছবি তুলতে লাগলাম। ১৭ থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের স্মারক দেখা গেল জাদুঘরে। সময়কাল ধরে ধরে সাজানো হয়েছে। ঢাকায় সুবেদারি আমলের পর আসে নবাবি আমল। নায়েব নাজিমদের নবাব নামেই ডাকা হতো। ঢাকা নিয়াবত বলা হতো এই অঞ্চলকে। তখনকার ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য আছে।

নবাবদের তালিকা আছে। তাদের কাজকর্মের বর্ণনা আছে। নবাবদের আওতায় ত্রিপুরা আর চট্টগ্রামও ছিল। তার বর্ণনাও দেখা গেল জাদুঘরে। আছে তখনকার দালানকোঠা, মসজিদ, ভবন সম্পর্কেও তথ্য। ঢাকার গান-বাজনা, পোশাক, খাবার নিয়েও থাকছে অনেক তথ্য। সব মিলে পাঁচটি কক্ষে পাঁচ গ্যালারি। দেখা পেলাম জাদুঘরের কিউরেটর জাহাঙ্গীর হোসেনের তিনি জানালেন, ১৭ জনের কাছ থেকে ইতোমধ্যে ৮৩টি স্মারক পাওয়া গেছে। সবই প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে মসলিন শাড়ি, ধাতব মুদ্রা, আসবাব, তৈজসপত্র, দরবারে ব্যবহার হতো এমন হুঁকা, কাঁটা চামচ, চাকু, রাইস ডিশ, প্লেট, বাটি, স্যুপের পাত্র, শাড়ি, শাল, হরিণের শিং, ক্যাশবাক্স, বাতি, কলস, ঝাড়বাতি, পানদান, কোরআন শরিফ, গহনার বাক্স, সাবানদানি, দোয়াত ইত্যাদি। এগুলো দিয়েছেন জেবউননেছা, মুহাম্মদ জালালউদ্দিন, আনজালুর রহমান, শায়লা পারভীন, সৈয়দ আবেদ হাসান, জিন্নাতুল বাকিয়া, এ ই আর খান, সাদউর রহমান, হাশমতি আরা বেগম, হোমায়রা খাতুন, মো. রফিকুল ইসলাম, নাজমুল হক, মালিয়া আলম, জিনাত পারভীন, সুলতান মাহমুদ রহমান, লুৎফুল করিম ও আবদুস সালাম। তারা সবাই পুরান ঢাকার বাসিন্দা। এদিকে জাদুঘরের সবার বাসায় ফিরার তারা তাই আমরা আর দেরি না করে বেড়িয়ে পরলাম।

বলে রাখা ভালো দর্শকদের জন্য প্রতি শুক্রবার ও শনিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। শুক্রবার দুপুর ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত নামাজের বিরতি থাকবে। জাদুঘর পরিদর্শনের জন্য দর্শকদের প্রবেশমূল্য ২০ টাকা এবং ছাত্রছাত্রীদের পরিচয়পত্র প্রদর্শন সাপেক্ষে ১০ টাকা। বিদেশি দর্শকদের জন্য ২০০ টাকা।
যাবেন কীভাবে: ঢাকার যেকোনো প্রান্ত থেকে আপনাকে যেতে হবে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রধান কার্যালয়ে, যা নিমতলীতে অবস্থিত। মতিঝিল থেকে রিকশায় খরচ পড়বে ৬০ থেকে ৮০ টাকা।

 কলি