
অফিস থেকে বাসায় ফিরেছি সেই কখন। হাতে কোনো কাজ ছিল না তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরঘুর করছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল প্রায় ২৫০ বছরের পুরোনো ঢাকার ঐতিহাসিক নিমতলী প্রাসাদ দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হচ্ছে। দেখেই আমি চোখ নিবদ্ধ করলাম খবরের দিকে। ঢাকার মোগল নায়েব-নাজিমদের জন্য ২৫০ বছর আগে নির্মিত প্রাসাদ ভবনের মূল অংশ সংরক্ষণের অভাবে ইতোমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে। একটি অংশ বর্তমানে বিদ্যমান, যা সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজধানী ঢাকার ৪০০ বছর পূর্তি উদযাপন কর্মসূচির আওতায় ২০০৯ থেকে ২০১১ সালে সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু নিয়মিত ব্যবহার না করায় পুনরায় তা কার্যকারিতা হারাচ্ছিল এবং স্থায়ীভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছিল।
এই ভবন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এই ভবনে জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে। ১৭০০ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত ঢাকা এবং পূর্ব বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনভিত্তিক নিদর্শন দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। এসব নিদর্শন ঢাকার বহু বনেদী ও সংস্কৃতমনা পরিবার থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। আমি মনে মনে ছক করে ফেললাম সামনের সপ্তাহে যখন ঢাকায় যাব তখন ঘুরে আসব এই ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা থেকে। চলে এল কাঙ্ক্ষিত দিন, সকাল বেলা ঢাকায় এসে পৌঁছেছি। আমার অস্থায়ী ডেরায় কিছু সময় বিশ্রাম নেওয়ার জন্য নিদ্রা দেবীর আশ্রয়ে গেলাম।
যাওয়ার আগে মোবাইলকে নির্দেশ দিলাম আমায় ঠিক সকাল ৯টার মধ্যে ডেকে দেওয়ার জন্য। মোবাইল তো তার প্রতি দেওয়া নির্দেশ মতো ঠিক সময়েই বেজে উঠল কিন্তু আমার নিদ্রা দেবীর কোল থেকে উঠতে মন চাইছিল না। তাই আরও কিছু সময় নিদ্রা দেবীর আবেশে থাকতে লাগলাম। বেশ মনের আনন্দে ঘুমাচ্ছিলাম , কিন্তু সেই আনন্দে পানি ঢাললেন সহধর্মিণী সানন্দা। কী উঠবে না? ঘুম থেকে আর কত ঘুমাবে! বলতেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ঘড়ির কাঁটায় সকাল সাড়ে ১১টা বাজি বাজি। দেখে তো আমার চোখ মাথায় ওঠার জোগাড়, তাই দেরি না করে উঠে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠে ভাবলাম নতুন যে গন্তব্যে যাব তার ঠিকানাই তো বের করা হয়নি, তাই আবার যোগাযোগ মাধ্যমে ঢুঁ মারলাম। উবারে লোকেশন দিয়ে দেখলাম আমার অস্থায়ী ডেরা থেকে গন্তব্যে যেতে ৪৫ মিনিট লাগবে। তাই ভাবলাম দুপুরের পেটপূজা শেষ করেই বের হই। পেটপূজা শেষ করে তৈরি হয়ে নিলাম।

আমার সঙ্গে সহধর্মিণী সানন্দা গুপ্ত আর অনিক গুপ্তও তৈরি হয়ে নিল নতুন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য। অস্থায়ী ডেরায় বসেই উবারে কল দিলাম। স্বল্প সময়ের মধ্যে গাড়ি এসে উপস্থিত। আমরা গাড়িতে উঠতেই পাইলট জানতে চাইলেন কোথায় যাব। বললাম, নিমতলীর ওই জায়গায় যেখানে নতুন একটি জাদুঘর হয়েছে। পাইলট বললেন, তাহলে লোকেশন ম্যাপে দেখানো পথেই এগিয়ে যাই। আমি বললাম ঠিক আছে, আমরা চলছি এগিয়ে ঘড়ির কাঁটায় তখন প্রায় বেলা ৩টা। শুক্রবার হলেও রাস্তায় যানজট লেগে আছে। দেখতে দেখতে ম্যাপ অনুযায়ী আমরা লোকেশনে পৌঁছালাম। কিন্তু এখন কোন দিকে যাব সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। কয়েকজনের কাছে জানতে চাইলাম নিমতলী দেউড়ি জাদুঘরটি কোথায়। কেউ সঠিক তথ্য দিতে পারছিল না।
হঠাৎ রিদওয়ান আক্রাম ভাইয়ের কথা মনে হলো, সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিলাম। ফোন দেওয়ার পর রিদওয়ান ভাই পাইলটকে গন্তব্যে যাওয়ার পথ বলে দিলেন। আমাদের গুগলে দেখানো পথ ভুল ছিল তাই উল্টো পথে যাওয়া শুরু করলাম আমরা। যানজট পেরিয়ে আমরা পৌঁছালাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে কিন্তু ঘড়ির কাঁটায় তখন ৪টা ৫ বাজে। প্রবেশদ্বারে লেখা দেখলাম এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘর। সামনে এগোতেই সেখানে উপস্থিত দ্বাররক্ষী না বলে দিলেন এখন আর ঢোকা যাবে না। অনুরোধ করার পর বলেন ঠিক আছে আমি ভেতরের কর্মকর্তাদের কাছে থেকে অনুমতি নিয়ে আসি, তারা ঢুকতে দিতে চাইলেই তবে ঢোকা যাবে। কিছুক্ষণের মধ্যে দ্বাররক্ষী এসে গেট খুলে দিলেন। বললেন, দ্রুত জাদুঘর দর্শন করে আসতে হবে।
আমরা এগিয়ে চললাম জাদুঘরের দিকে। জনপ্রতি ২০ টাকা করে টিকিট কিনে সামনে এগিয়ে চললাম। দেখা পেলাম সেই কাঙ্ক্ষিত জাদুঘরে নতুন রং লেগেছে। দেখলে মনে হবে মাঝারি আকৃতির কোনো সুরম্য ভবন। মনের ভেতর বিস্ময় নিয়ে প্রবেশ করলাম ভবনে । প্রবেশপথটি ঠিক মধ্যখানে। ভবনের নিচতলায় ডান দিকে পাশাপাশি দুটি ঘর। প্রতিটি ঘরে তিন দিকের দেয়ালে স্মারক রাখার জায়গা করা হয়েছে। আর বাঁয়ে আছে একটি ঘর। আমরা প্রবেশ করলাম ঘরের ভেতর, ঘরটি খুব সুন্দর করে সাজানো আছে নানা স্মারক দিয়ে। আর বাঁয়ে আছে একটি ঘর। দেউড়ি ভবনেই ছিল এশিয়াটিক সোসাইটির প্রথম কার্যালয়। নিচতলায় তাই রাখা হয়েছে ১৯৫২ সালের ৩ জানুয়ারি যাত্রা করা এশিয়াটিক সোসাইটির নানা স্মারক। আরেকটি ঘরে ডিজিটাল মনিটরে নায়েব নাজিমদের আমলে ঢাকার ইতিহাসভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র দেখানোর ব্যবস্থা রয়েছে। নিচতলায় তিনটি গ্যালারি দেখে সরু একটি সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলাম। পুরোনো সিঁড়িতে কাঠ বসিয়ে নতুনত্ব দেওয়া হয়েছে। দোতলায় একটি ঘর, দৈর্ঘ্য-প্রস্থে প্রায় সমান। আলোকচিত্র ও তৈলচিত্র আছে বেশ কিছু।

পরের বিস্ময় তৃতীয় তলার দিকে আমরা এগিয়ে গেলাম। দেখে মনে হলো জাদুঘরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় গ্যালারি এটি। ৪৫ ফুট দৈর্ঘ্যের এই কামরায় রাখা হয়েছে মসলিন শাড়ি, ধাতব মুদ্রা ও তৈজসপত্র। সুপরিসর ঘরে নবাব নুসরাত জংয়ের দরবারের ত্রিমাত্রিক উপস্থাপনাও তুলে ধরা হয়েছে। যেন জীবন্ত! হঠাৎ করে দেখে মনে হবে দরবারে বসে আছেন নুসরাত জং। নবাবের হাতে হুঁকার নল। পেছনে একজন কাপড়ের পাখা নাড়িয়ে বাতাস দিচ্ছেন নবাবকে। পুরো ভবনটা এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যেন দর্শনার্থীরা নবাবি আমলে ফিরে যেতে পারেন। আমি, সানন্দা আর অনিক মিলে স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ছবি তুলতে লাগলাম। ১৭ থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের স্মারক দেখা গেল জাদুঘরে। সময়কাল ধরে ধরে সাজানো হয়েছে। ঢাকায় সুবেদারি আমলের পর আসে নবাবি আমল। নায়েব নাজিমদের নবাব নামেই ডাকা হতো। ঢাকা নিয়াবত বলা হতো এই অঞ্চলকে। তখনকার ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য আছে।
নবাবদের তালিকা আছে। তাদের কাজকর্মের বর্ণনা আছে। নবাবদের আওতায় ত্রিপুরা আর চট্টগ্রামও ছিল। তার বর্ণনাও দেখা গেল জাদুঘরে। আছে তখনকার দালানকোঠা, মসজিদ, ভবন সম্পর্কেও তথ্য। ঢাকার গান-বাজনা, পোশাক, খাবার নিয়েও থাকছে অনেক তথ্য। সব মিলে পাঁচটি কক্ষে পাঁচ গ্যালারি। দেখা পেলাম জাদুঘরের কিউরেটর জাহাঙ্গীর হোসেনের তিনি জানালেন, ১৭ জনের কাছ থেকে ইতোমধ্যে ৮৩টি স্মারক পাওয়া গেছে। সবই প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে মসলিন শাড়ি, ধাতব মুদ্রা, আসবাব, তৈজসপত্র, দরবারে ব্যবহার হতো এমন হুঁকা, কাঁটা চামচ, চাকু, রাইস ডিশ, প্লেট, বাটি, স্যুপের পাত্র, শাড়ি, শাল, হরিণের শিং, ক্যাশবাক্স, বাতি, কলস, ঝাড়বাতি, পানদান, কোরআন শরিফ, গহনার বাক্স, সাবানদানি, দোয়াত ইত্যাদি। এগুলো দিয়েছেন জেবউননেছা, মুহাম্মদ জালালউদ্দিন, আনজালুর রহমান, শায়লা পারভীন, সৈয়দ আবেদ হাসান, জিন্নাতুল বাকিয়া, এ ই আর খান, সাদউর রহমান, হাশমতি আরা বেগম, হোমায়রা খাতুন, মো. রফিকুল ইসলাম, নাজমুল হক, মালিয়া আলম, জিনাত পারভীন, সুলতান মাহমুদ রহমান, লুৎফুল করিম ও আবদুস সালাম। তারা সবাই পুরান ঢাকার বাসিন্দা। এদিকে জাদুঘরের সবার বাসায় ফিরার তারা তাই আমরা আর দেরি না করে বেড়িয়ে পরলাম।
বলে রাখা ভালো দর্শকদের জন্য প্রতি শুক্রবার ও শনিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। শুক্রবার দুপুর ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত নামাজের বিরতি থাকবে। জাদুঘর পরিদর্শনের জন্য দর্শকদের প্রবেশমূল্য ২০ টাকা এবং ছাত্রছাত্রীদের পরিচয়পত্র প্রদর্শন সাপেক্ষে ১০ টাকা। বিদেশি দর্শকদের জন্য ২০০ টাকা।
যাবেন কীভাবে: ঢাকার যেকোনো প্রান্ত থেকে আপনাকে যেতে হবে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রধান কার্যালয়ে, যা নিমতলীতে অবস্থিত। মতিঝিল থেকে রিকশায় খরচ পড়বে ৬০ থেকে ৮০ টাকা।
কলি