
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার একটি শহর চন্দননগর, যা একসময় ফরাসি উপনিবেশ ছিল। চন্দননগরকে ভালো লাগার কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, রবি ঠাকুর আর কাদম্বরী দেবী তাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর কিছু দিন যাপন করেছিলেন চন্দননগরের মোড়ান সাহেবের বাগানবাড়িতে। এ ছাড়া রবি বাবু চন্দননগরের পাতাল বাড়িতেও এসেছিলেন। দ্বিতীয়ত, চন্দননগর নামটা খুব নান্দনিক। ফরাসিরা যে সেখানে বাস করতেন, আজও সেই ছোঁয়া লেগে আছে। তৃতীয়ত, ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল নবনীতা নামের এক দিদির সঙ্গে। থাকেন চন্দননগরের কাছাকাছিই। তার মেয়ে পড়ে চন্দননগরের একটা স্কুলে। তাই তার সেখানে নিয়মিত যাতায়াত। সব মিলিয়ে চন্দননগর যাওয়ার আগ্রহ ছিল ভীষণ। শেষ পর্যন্ত অনেক অপেক্ষার পর সেই দিনটা এসেই গেল।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া সুন্দর একটা নতুন হলুদ শাড়ি পরলাম। চন্দননগর ভ্রমণে আমার সঙ্গী হিসেবে ছিল পূজা এবং বৈশাখী নামে দুজন ভারতীয় বন্ধু। বৈশাখীও হলুদ রঙের একটা শাড়ি পরল। কলকাতায় আমরা উঠেছিলাম দমদমের একটি বাড়িতে। সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে দমদম স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম। পূজা উঠল কয়েকটা স্টেশন পরে, আলাদা বগিতে। আমরা নেমে গেলাম শ্যামনগরে। সেখানে আমাদের দেখা হলো। একটা টোটো নিলাম জগদ্দল ঘাট পর্যন্ত। ঘাটে নেমে রাণীঘাট অবধি ফেরির টিকিট সংগ্রহ করলাম। একটা ঘাট থেকে আরেকটা ঘাট দেখা যায়, এত কাছে। টিকিট মূল্য মাত্র ৯ রুপি। ফেরি থেকে নেমে পা রাখলাম বিখ্যাত চন্দননগরে!
চন্দননগরের রাণীঘাট সংলগ্ন যেই রাস্তাটা, প্রায় সব দর্শনীয় জায়গা সেই একই জায়গায় অবস্থিত। বাদবাকি দু-চারটা আলাদা জায়গায়। তাই অল্প সময়ে চন্দননগর আরাম করে ঘুরে ফেলা যায়। আমরা একে একে যা দেখলাম চন্দননগরে-
চন্দননগর স্ট্র্যান্ড
এটা চন্দননগরের গঙ্গাতীরের একটি ঘাট। ঘাটের প্রবেশদ্বার রাজকীয় স্টাইলে বানানো। এটাই সেই ঘাটের বিশেষত্ব। সন্ধ্যাবেলায় দেখতে আরও সুন্দর লাগে, যদিও আমরা দিনের বেলায় দেখেছিলাম।
চন্দননগর মিউজিয়াম
চন্দননগর মিউজিয়ামটা এখানেই। এটি মূলত ফরাসিদের একটি ঐতিহাসিক মিউজিয়াম। মিউজিয়ামে রয়েছে বই, ভাস্কর্য, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নানা ঐতিহাসিক জিনিসপত্র ইত্যাদি। এ ছাড়া রয়েছে ফরাসি ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা।
পাতাল বাড়ি
গঙ্গার ধারে সুন্দর একটি বাড়ি। রবি ঠাকুর ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্মৃতিবিজড়িত বলেই পাতাল বাড়িটা আরও বিখ্যাত। বহু প্রাচীন এই বাড়ির নিচের তলাটি বর্তমানে গঙ্গার নিচে। কিশোর রবি তার জ্যোতি দাদা ও বৌঠাকুরন কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে কিছুদিন এই বাড়ির পাশে তেলেনিপাড়ার বারুজ্যদের বাগান বাড়িতে ছিলেন। সেখান থেকে গিয়েছিলেন মোরান সাহেবের বাংলো বাড়িতে। পরবর্তী সময়ে রবি ঠাকুর এই পাতাল বাড়িতে এসেছিলেন। শোনা যায়, তিনি এখানে কয়েকবারই এসেছিলেন। অন্যদিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একবার বিধবা বিবাহ প্রচলন উপলক্ষে বেশ কিছুদিন এ বাড়িটিতে থেকে চন্দননগরের বাসিন্দাদের সাহায্য চেয়েছিলেন। ঐতিহাসিকভাবে হিন্দু সমাজে প্রথম বিধবা বিবাহ শুরু হয় এই চন্দননগরেই।
পাতাল বাড়িটি আজও অনেকটা টিকে থাকলেও বারুজ্যদের বাগান বাড়ি এবং মোরান সাহেবের বাংলো বাড়ির আর কোনো অস্তিত্ব নেই। বর্তমানে এখানে দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ। ভেতরে যেতে পারলে আরও ভালো লাগত। তবু বাইরে থেকেও যে এমন একটি মূল্যবান বাড়ি দেখার সুযোগ হলো, তাতেই নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি।
স্যাক্রেড হার্ট চার্চ
এটি একটি রোমান ক্যাথলিক ঐতিহ্যবাহী চার্চ। বলাবাহুল্য যে, এই চার্চ ফরাসিদেরই বানানো। ফরাসি স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত চার্চটি মোটামুটি বড় আর দেখতে সুন্দর। চার্চটির স্থপতি ছিলেন জ্যাক ডুচাটজ। ১৮৭৫ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৮৮৪ সালে। আমি যখন যাই, তখন দুপুরের বিরতিতে চার্চটি বন্ধ ছিল। কিন্তু যখন চার্চটির একজন তত্ত্বাবধায়ক জানতে পারলেন বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি চন্দননগর ভ্রমণে, তখন তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে চার্চটি খুলে দিয়ে আমাদের দেখার সুযোগ করে দিলেন।
চন্দননগর কলেজ
হুগলি জেলার একটি প্রাচীনতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চন্দননগর কলেজ, যা ১৮৬২ সালে নির্মিত। কলেজটি এজন্য বেশি ভালো লেগেছে যে, তাতে ফরাসি স্থাপত্যের ছোঁয়া আছে। সেই আগেরকার হলুদ বিল্ডিং, সবুজ জানালা সমৃদ্ধ কী সুন্দর ভবন। আসলে প্রাচীন যেকোনো স্থাপনার ভেতরই অন্যরকম একটা ব্যাপার আছে!
রবীন্দ্র ভবন
রবীন্দ্র ভবন শিল্প সাধনার একটি জায়গা; যাকে চন্দননগরের সাংস্কৃতিক চর্চার প্রাণকেন্দ্রও বলা যায়। শিল্প সাহিত্যের বিভিন্ন প্রোগ্রাম সেখানে হয়ে থাকে।
নন্দদুলাল মন্দির
এই মন্দিরটা রাণীঘাট থেকে সামান্য দূরে লালবাগান এলাকায়। টোটোতে করে চলে গেলাম সেখানে। মন্দিরটি ১৭৩৯ সালে চন্দননগরের তৎকালীন ফরাসি সরকারের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরটি দৈর্ঘ্যে ৫১ ফুট ৯ ইঞ্চি এবং প্রস্থে ১১ ফুট। মন্দিরের সামনে ও পশ্চিম দিকের দেয়ালে ছোট ছোট কিছু পোড়ামাটির ফুলের নকশা আছে। মাঝ বরাবর আছে মন্দিরে প্রবেশের সিঁড়ি। মন্দিরটির ভেতরে একটি গুপ্তঘরও আছে।
দ্য স্লিপি হোলো
এটি একটি পুরোনো বাড়ি এবং চন্দননগরের ঐতিহাসিক ল্যান্ডমার্ক। নন্দদুলাল মন্দিরের বিপরীতেই এই বাড়িটা। পুরোনো বাড়ির প্রতি আমার আলাদা মায়া কাজ করে, তাই দেখে নিলাম। এ কথা অনস্বীকার্য যে, বাড়িটি সুন্দর ছিল। আরভিং ওয়াশিংটনের উনিশ শতকের বিখ্যাত আমেরিকান উপন্যাস ‘দ্য লিজেন্ড অব দ্য স্লিপি হোলো’ এর নামানুসারে বাড়িটির নামকরণ করা হয়েছিল ‘স্লিপি হোলো’। এই বাড়ির বাসিন্দা ছিলেন চন্দননগরের প্রধান প্রকৌশলী মহাশয় ভবানীচরণ চ্যাটার্জি।
আরও পড়ুন: বিলের ধারে প্যারিস শহর
জলশ্রী
জলশ্রী হচ্ছে রাণীঘাটের একটি ভাসমান রেস্তোরাঁ। ইউটিউবে অনেক ভিডিও দেখে এখানে এক বেলা খাওয়ার ইচ্ছে ছিল। জলশ্রীর পরিবেশ সুন্দর, গঙ্গার বুকে ভেসে খাবার খাওয়ার অভিজ্ঞতাও দারুণ। ৫০ টাকা দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করে রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করতে হয়। টাকাটা পরে খাবারের মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়। প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এই রেস্তোরাঁটি খোলা থাকে। ভেতরে প্রায় ৫০ জন লোক একসঙ্গে খেতে পারে। যখন লোক প্রায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়, তখন নৌযান অর্থাৎ রেস্তোরাঁটি গঙ্গার বুকে চলতে শুরু করে। এই অনুভূতি অন্যরকম সুন্দর।
নবনীতা দিদি আমাদের সবাইকে চিকেন চাওমিন, চা আর চন্দননগরের বিখ্যাত জলভরা সন্দেশ খাওয়ালেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও খুব প্রিয় ছিল এখানকার জলভরা সন্দেশ। বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি বলে আমাকে উপহার দিতেও ভুললেন না তিনি। ‘চন্দননগরের ইতিহাস’ এবং ‘কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড নোট’ নামে দুটি বই উপহার দিলেন। স্কুল ছুটির পর দিদির একমাত্র ছোট্ট মেয়ে চলে এল। কী মিষ্টি আর আদুরে। তবে ততক্ষণে আমাদের ফেরার সময়ও হয়ে গেল। আর কখনো চন্দননগরে যাওয়া হবে কি না জানি না, তবে চন্দননগরের এই স্মৃতি দীর্ঘজীবন মনে রাখব। গঙ্গার ধারের ওই হাঁটা শান্ত স্নিগ্ধ পথটা মনে আঁকা থেকে যাবে বহুকাল!
দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে গেল। ফেরার সময় আবার একইভাবে আমরা শ্যামনগর এলাম। তারপর ট্রেনে করে গেলাম উত্তর চব্বিশ পরগণার নৈহাটীতে। সেখানে বিখ্যাত বড় মায়ের মন্দিরে গেলাম। বৈশাখী গঙ্গাজল নিল। তখন সূর্য ডুবে যাচ্ছিল গঙ্গার বুকে। কী যে অসাধারণ সেই দৃশ্য!
ফুচকা খেয়ে উত্তর চব্বিশ পরগনা থেকে আবার আমরা ট্রেনে উঠলাম দমদমের উদ্দেশে। তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। আসতে আসতে অনেক গল্প হচ্ছিল আমাদের। পূজা নেমে গেল কয়েক স্টেশন আগে। ওকে ছেড়ে চলে যেতে কষ্ট হচ্ছিল। আমি ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ট্রেন আবার চলতে শুরু করল।
দমদম পৌঁছে আমরা গেলাম মিত্র ক্যাফেতে। মেদিনীপুর থেকে ভিক্টর আর দমদম থেকে দীপক নামের দুই ভারতীয় বন্ধু যোগ দিল আমাদের সঙ্গে। মিত্র ক্যাফের ফিশ কবিরাজি খুব বিখ্যাত, মিত্র ক্যাফেও শতবছরের পুরোনো বিখ্যাত ক্যাফে। ফিশ কবিরাজি ছাড়াও বেশ কিছু আইটেম অর্ডার করা হলো। মিত্র ক্যাফের পরিবেশটা সুন্দর। গল্প করতে করতে আয়েশ করে খেলাম। তারপর ফিরে এলাম দমদমের সেই বাড়িতে।
কীভাবে যাবেন
যেকোনো জায়গা থেকে চন্দনগর স্টেশনে চলে আসবেন প্রথমে। তারপর টোটোতে করে চলে যাবেন রাণীঘাট। আর দমদম থেকে সহজে যেতে চাইলে আমার পথ অনুসরণ করতে পারেন।
কী খাবেন
বিখ্যাত জলভরা সন্দেশ অবশ্যই খাবেন। রাণীঘাটের স্ট্রিট ফুডও ট্রাই করতে পারেন। আর লাঞ্চ করার জন্য জলশ্রীতে খেতে পারেন।
কোথায় থাকবেন
চন্দননগর শহরের কোনো হোটেলে থাকতে পারেন। তবে শহরটির সব দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখার জন্য একটি দিনই যথেষ্ট, থাকার প্রয়োজন নেই।
কলি