
কাজী আসমা আজমেরী। বাংলাদেশি পাসপোর্ট হাতে ঘুরেছেন বিশ্বের ১৫০টি দেশ। স্বপ্ন দেখেন পুরো বিশ্ব ছোঁবেন তিনি। ২০০৯ সাল থেকে বিশ্বভ্রমণ শুরু কাজী আসমার। সেই যে উড়ে চলেছেন, আর থামেননি। একজন নারী হিসেবে সেই পথ পাড়ি দিতে পেরোতে হয়েছে অনেক বাধা। দৈনিক খবরের কাগজের লাইফস্টাইল পেজ ‘ফ্যাশন প্লাস’-এর পাঠকের জন্য তিনি নিয়মিত ভ্রমণকাহিনি লিখবেন। আজ থাকছে একটি পর্ব-
চলতি বছরের জুনে আমি আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া ভ্রমণে যাই। এটা ছিল আমার ১৪৫ তম দেশ ভ্রমণ। দেশটির সেরাকুন্ডু এলাকায় পৌঁছানোর অভিজ্ঞতা বেশ মিশ্র ছিল। শহরের কেন্দ্রীয় ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে সাড়ে ৫ হাজার সেনেগালি টাকায় গাম্বিয়ার সেরাকুন্ডু শহরে পৌঁছাই। ইমিগ্রেশন পার হওয়া বেশ সহজ ছিল, কিন্তু লাগেজ চেকিং প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ এবং কিছুটা বিরক্তিকর। সময় বাঁচাতে সামান্য অতিরিক্ত টাকা দিলে দ্রুত কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হলেও আমি সেটি এড়িয়ে যাই।
সন্ধ্যায় শহরে পৌঁছানোর পর, আমার হোস্ট মোহাম্মদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম। তবে সেনেগাল সিম কাজ না করায় স্থানীয় সিম কিনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। অবশেষে, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সেরাকুন্ডু বাজারে তার সঙ্গে দেখা হয়। বাজারটি বাংলাদেশের বাজারের মতোই। রাস্তায় ছোট ছোট দোকানে চা, কফি, এমনকি ভ্যানগাড়িতে বিভিন্ন খাবার পাওয়া যায়। সেই রাস্তায় একটু আড্ডা দেওয়ার পর মোহাম্মদের বাসায় আসি। তার ড্রয়িং রুমটি সুন্দরভাবে পরিষ্কার হলেও বেডরুমটি বেশ পুরোনো এবং কিছুটা অস্বাস্থ্যকর ছিল, ফলে রাতে কষ্ট করে ঘুমাতে হয়।
পরের দিন সকালে সিদ্ধান্ত নিই যে, ভালো মানের হোটেলেই থাকব। তাই অনলাইনে সেনেগামিয়া রিসোর্টে বুকিং দিই, যেখানে বেশ কয়েকটি সুইমিং পুল এবং সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা রয়েছে। মাত্র ৫৫ ডলারে এমন সুন্দর রিসোর্ট পেয়ে আমি আনন্দিত এবং Agoda পয়েন্ট ব্যবহার করায় রেটটি আরও কমে আসে। মূলত তিন দিনের জন্য বুক করলেও পরিবেশ এতটাই মনোমুগ্ধকর ছিল যে, শেষমেশ সাত দিন থেকে যাই।
এখানে থাকার সময় পরিচয় হয় ইমানুল নামের এক বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে, যিনি গাম্বিয়ার মানবাধিকার সংগঠনের চেয়ারম্যান এবং অং সান সু চির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মামলা করেছেন। তার সঙ্গে আলাপের মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানবাধিকার বিষয়ে গভীর কিছু জানার সুযোগ হয়।
গাম্বিয়ায় আমার ১৪৫তম দেশ উদযাপন সত্যিই একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা ছিল। রোটারি ক্লাব বাঞ্জুলে সামাদি নামের এক রোটারিয়ান বন্ধু এই আয়োজন করে, যেখানে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জন রোটারিয়ানের সঙ্গে কেক কেটে এবং ডিনার করে এই বিজয়কে উদযাপন করি। নতুন দেশের মাটিতে, এমনভাবে নতুন বন্ধুদের সঙ্গে মিলে নিজের বিজয় উদযাপন করার সুযোগ পাওয়া ছিল এক অত্যন্ত আনন্দের ব্যাপার।
বাঞ্জুল এবং এর আশপাশের হেরিটেজ সাইটগুলো ঘুরতে গিয়ে এখানকার নদী পার হয়ে বাড়া নামের ছোট একটি শহরে যাই, যেখানে গাধার গাড়িতে চড়ে গ্রামের পরিবেশ উপভোগ করি। সেখানে স্থানীয় গরুর কলিজা ভুনা স্যান্ডউইচ খাওয়ার অভিজ্ঞতাও বেশ আনন্দদায়ক ছিল। সাত দিন ধরে এ শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে অনেক কিছু দেখেছি। এখানকার জাতীয় জাদুঘরটি বেশ আকর্ষণীয়, আর স্থানীয় স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটি মোটিভেশনাল প্রোগ্রাম করতে পেরে সত্যিই অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। গাম্বিয়ায় ইংরেজি ভাষা প্রচলিত হওয়ায় এখানে ঘোরাফেরা করা সহজ ছিল।
মোহাম্মদ ও আসান নামের দুই বন্ধুর সহযোগিতায় গাম্বিয়ার বিভিন্ন স্থান এবং তাদের গ্রামীণ জীবনযাত্রা সম্পর্কে আরও গভীর ধারণা লাভ করি। স্থানীয় মুসলিম আচার-আচরণের মধ্যে বাংলাদেশি প্রভাব দেখা গেলেও কিছু সাংস্কৃতিক পার্থক্য লক্ষ করেছি। এখানে কেউ হজ থেকে ফিরে এলে বড় গরু জবাই করে এলাকাবাসীকে আপ্যায়ন করাটা তাদের জন্য খুবই সম্মানজনক কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়।
গাম্বিয়ায় সরকার ট্যুরিজমকে গুরুত্ব দিয়েছে, যা ব্রিটিশ পর্যটকদের কাছে দেশটিকে জনপ্রিয় হলিডে ডেস্টিনেশন হিসেবে পরিচিত করেছে। সমুদ্রের নীল জলরাশি, আকর্ষণীয় রিসোর্ট এবং বিভিন্ন বিনোদনের ব্যবস্থা এখানে ট্যুরিস্টদের জন্য একটি মজাদার অভিজ্ঞতা। যদিও এই সমাজের কিছু বিতর্কিত দিকও রয়েছে যেখানে অনেক স্থানীয় তরুণ পর্যটকদের সঙ্গে সামাজিকীকরণের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে।
গাম্বিয়ার গ্রামগুলোয় যাওয়ার অভিজ্ঞতা সত্যিই অনন্য ছিল। বাংলাদেশের গ্রামের মতোই, তবে এখানকার মানুষের আন্তরিকতা যেন আরও বেশি উষ্ণ আর খোলামেলা। গ্রামগুলোয় সহজে পৌঁছানোর জন্য শেয়ার ট্যাক্সির ব্যবস্থা রয়েছে, যা যেকোনো স্থানে ঘোরার কাজকে খুবই সুলভ করে তোলে।
এখানে আমার নতুন বন্ধুত্বের জোয়ার বইয়ে দিয়েছে, বিশেষ করে নারী সাংবাদিকদের বিশাল একটি গ্রুপের সঙ্গে। ইজি এবং তার স্বামী, ওমরসহ অনেকেই আমাকে চমৎকার সময় উপহার দিয়েছে এবং গাম্বিয়ার নানা স্থানে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। এই বন্ধুত্বের মাধ্যমেই আমি গাম্বিয়ার মিডিয়া ও সংবাদ জগতে কিছুটা প্রভাব ফেলতে পেরেছিলাম। আমার ১৪৫তম দেশের ভ্রমণের কাহিনি গাম্বিয়ার সবচেয়ে বড় সংবাদপত্র ‘স্ট্যান্ডার্ড’ এ প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া ‘পয়েন্ট’ নিউজ পেপারেও আমার ভ্রমণ ও মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবে কাজের উল্লেখযোগ্য বিবরণ ছাপা হয়, যা এই দেশকে ভিন্ন এক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ করে দেয়।
গাম্বিয়ায় মানুষের জীবনধারা আর সামাজিক সম্প্রীতির বিষয়টি সত্যিই মনোমুগ্ধকর। মুসলিম ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষ একসঙ্গে বড় পাত্রে বসে খাবার খায়, যা এখানকার ঐতিহ্যের একটি অংশ। এদের বিশেষ খাবারটা অনেকটা আমাদের বিরিয়ানির মতো, সঙ্গে গরুর ভুনা ও রসুন থাকে যা আমাদের বাংলাদেশি স্বাদকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে দিনের বেলায় স্থানীয় খাবার পাওয়া গেলেও রাতের বেলায় তা কমে যায়। রাস্তার পাশের ছোট ছোট রেস্তোরাঁয় স্যামন মাছ, গরুর বিরিয়ানি জাতীয় খাবার পাওয়া যায়, যা বেশ সস্তায় মেলে—আমাদের প্রায় ২০০ টাকার মতো খরচ হয়। এই খাবারগুলোয় থাকে বড় মাছের টুকরা, সেদ্ধ আলু ও গাজর ও ক্যাপসিকামের মতো দেখতে কিছুটা তেতো একটি সবজি, যা পোলাওয়ের সঙ্গে খেতে বেশ ভালো লাগে। এভাবেই আফ্রিকার সবচেয়ে ছোট দেশ গাম্বিয়ায় ভ্রমণ শেষ করলাম।
কলি