
কলকাতা সময় সকাল ৬টা হবে। সাত সকালে মামি ডাকা শুরু করলেন এই তাড়াতাড়ি ওঠ। আজ আমাদের অনেক জায়গায় যেতে হবে। মা প্রায় ১৮ বছর পর কলকাতায় এসেছেন। ব্যাংক থেকে পাঁচ দিনের ছুটি নিয়ে এসেছি এক ঢিলে দুই পাখি মারার জন্য। একদিকে ভ্রমণ অন্যদিকে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ। সময়ও হাতে কম, তাই আগে থেকেই আমরা কোন দিন কোথায় যাব ঠিক করে নিয়েছিলাম।
ভেবেছিলাম আরও কিছু সময় ঘুমাব কিন্তু মামি আর মায়ের ডাকাডাকির চোটে সুখের ঘুম থেকে উঠতেই হলো। ঘুম থেকে ওঠার পর আবার অত্যাচার শুরু করলেন মামি। এবার খাবারের টেবিলে নাশতা করতে যেতে হবে। এমনি আমি সকালবেলায় তেমন কিছু খাই না। অগত্যা খাবারের টেবিলে গিয়ে বসতে হলো। গরম গরম লুচি, আলুর দম, মিষ্টান্নের ঘ্রাণে মন ভরে গেল। এদিকে টুকুনদার ফোন জলদি নিচে নামার জন্য। টুকুন দা আমাদের কলকাতা ভ্রমণের প্রতিদিনের সঙ্গী। আমরা সিথির মোড়ের ডেরা থেকে বের হলাম। এই সাত সকালেই কলকাতা শহরের রাস্তায় যানজট। ঠিক আমাদের ঢাকা শহরের মতো, গাড়ি যেন এগোতেই চায় না। রাস্তার দুই ধারে পুরোনো আমলের বাড়ি। চুন সুরকি খসে বাড়িগুলো অপূর্ব রূপ ধারণ করেছে। আমার শিয়ালদহ রেলস্টেশন পেরিয়ে এগিয়ে চলছি। শিয়ালদহ রেলস্টেশনে চোখে পড়ল অনেক মানুষের ভিড়।

পথে ট্রামের দেখা মিলল। ছোটবেলায় মায়ের কাছে অনেক গল্প শুনেছি এই ট্রামের। প্রথমবারের মতো দর্শন মিলল ট্রামের। আমাদের আজকের গন্তব্যস্থল মিশনারিজ অব চ্যারিটি। যেখানে শায়িত আছেন মাদার তেরেসা। মাত্র পাঁচ টাকা এবং দশ জনকে নিয়ে শুরু এই মিশনারিজ অব চ্যারিটি। ধীরে ধীরে শহর থেকে রাজ্যে, দেশ ছাড়িয়ে বহির্দেশে। তার তৈরি মিশনারিজ অব চ্যারিটি ছড়িয়ে পড়েছে ১৩৯টি দেশে। সঙ্গে রয়েছেন সেই দুঃখী মানুষ যাদের জন্য এই ‘বিপুল’ কর্মকাণ্ড।
সেই ‘বিপুলে’র টানে এই শহরে ছুটে এসেছেন মোহম্মদ আলি, ডমিনিক ল্যাপিয়ের, ইয়াসির আরাফাত, যুবরাজ চার্লস, ডায়নাসহ তাবড় তাবড় খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। আমরা যাচ্ছি সেই মাদার হাউজে। আমাদের পথ নির্দেশক মামি নিজেও কখনো যাননি মাদার হাউজে। শুধু শুনেছেন বোস রোডে রয়েছে মাদার হাউজ। আমরা বোস রোডে এসে পৌঁছালাম। রাস্তা চিনতে না পারায় অগত্যা ট্রাফিক পুলিশের সাহায্য নিতে হলো। সামনে যেতেই দেখা পেলাম সেই কাঙ্ক্ষিত মাদার হাউজের। চারতলা ভবন, দেয়ালে মার্বেল পাথরে খোদাই করা লেখা MISSIONARIES OF CHARITY। বাঁ দিকে গলির ভেতর ঢুকতেই চোখে পড়ল মাদার তেরেসার মূর্তি। বড় সাইনবোর্ডে লেখা The Mother House। পুরোনো দিনের ভবন আর সেই আগের দিনের জানালা। প্রবেশপথে বাইরের দেশের অনেক লোকের দেখা পেলাম। আমরা নগ্ন পায়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম।
অসাধারণ পরিবেশ, নিঃশব্দ নীরবতা। একটি ঘরের দিকে সবাই যাচ্ছে, আমরাও তাদের পথ অনুসরণ করলাম। আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম। শান্তির দূত শায়িত আছেন। সবাই বসে নীরবে প্রার্থনা করছেন, কেউ কেউ অঝোরে চোখের জল ফেলছেন। ধূপকাঠির মোহিত গন্ধ আর পরিবেশ যে কারও খুব ভালো লাগবে। মাদারের সমাধির পাশে বসে প্রার্থনা করার অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না। আমরা বসে কিছু সময় প্রার্থনা করলাম। চোখে পড়ল একপাশে লেখা ‘These flower were placed on Mother tomb. You are most welcome to take them as a blessing।’
আমি একটি কাগজে আমার প্রার্থনা মাদারের কাছে লিখে নির্ধারিত স্থানে দিলাম। এক পাশে একটি কাপড়ের মধ্যে দেখতে পেলাম বিভিন্ন দেশের মানুষের অনুভূতিগুলো নানান ভাষায় লিপিবদ্ধ করা। আমি বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম। পাশের কক্ষে প্রবেশ করলাম। এখানে বেশ বড় লাইব্রেরি কক্ষ। এখানে ছবি তোলা নিষেধ। এই কক্ষে মাদার তেরেসার ব্যবহৃত সামগ্রীগুলো সুন্দর করে সাজানো আছে। সেখান থেকে মাদার তেরেসার জীবনী নিয়ে একটি বই উপহার পেলাম। বইটি তিনটি ভাষায় রচিত। এরপর আমরা গেলাম শান্তির দূত যেখানে তার জীবনের বেশির ভাগ সময় পার করেছেন। দোতালার ছোট্ট একটি কক্ষ। তার মাঝে একটি খাঁটিয়া পাশে একটি টেবিল আর চেয়ার। বাইরে থেকে ভেতরে প্রবেশ নিষেধ তাই আমরা বাইরে দাঁড়িয়েই দেখলাম। আমি মনে মনে ভাবলাম এই দালানের প্রতিটি স্থানে মাদার তেরেসার পদধূলি পড়েছে। এ রকম একটি স্থানে আসতে পারা ভাগ্যের ব্যাপার। নিচে আমরা মাদার তেরেসার জীবনী নিয়ে রচিত বিভিন্ন কথামালার দিকে মনোনিবেশ করলাম। দেখা মিলল সিস্টার সিজের।
তিনি আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে খুব খুশি হলেন। তিনি বললেন, তিনিও বাংলাদেশ এসে ঘুরে গেছেন। তিনি আরও বললেন, বিশ্বে মানবসেবায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করা মানবাধিকার কর্মী মাদার তেরেসাকে সন্ত ঘোষণা করেছেন পোপ ফ্রান্সিস। গত ৪ সেপ্টেম্বর ভ্যাটিকান সিটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে মাদার তেরেসাকে সন্ত ঘোষণা করেন পোপ। সন্ত হওয়ার প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করেছেন মাদার তেরেসা। দুটি ঘটনাকে অলৌকিক বলে স্বীকৃতি দেয় ভ্যাটিকান এবং সর্বশেষে পোপ। সন্ত হওয়ার শর্ত হিসেবে প্রথম ঘটনা ঘটে ১৯৯৮ সালে। পশ্চিমবঙ্গের এক আদিবাসী নারী মণিকা বেসরার পেটের টিউমার সেরেছিল মাদার তেরেসার নামে প্রার্থনা করে। অন্যটি ঘটে ২০০৮ সালে ভ্যাটিকানের দাবি, ওই বছর ব্রাজিলে মাদার টেরেসার নামে প্রার্থনা করে সুস্থ হন এক যুবক যার মস্তিষ্কে একাধিক টিউমার ছিল।
আরও পড়ুন: ফরাসিদের স্মৃতিবিজড়িত শহর চন্দননগর
৫ সেপ্টেম্বর মাদারের ১৯তম মৃত্যুদিন। তার ঠিক আগের দিন রোমে ‘বিয়েটিফিকেশন’ অনুষ্ঠানে মাদারকে ‘সন্ত’ ভূষিত করবেন পোপ ফ্রান্সিস। তার কথার সঙ্গে চোখে জল চলে এল। এ অশ্রু আনন্দের, তার সঙ্গে আমরা ছবি তুললাম। দেখতে দেখতে আমাদের বিদায় নেওয়ার পালা চলে এল আমরা চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের দিকে। বলে রাখা ভালো মাদার হাউজের দর্শন পেতে হলে আপনাকে যেতে হবে সকাল ৮টা থেকে ১২টার ভেতর আর বিকেল বিকেল ৩টা থেকে ৬টার মধ্যে। বৃহস্পতিবার মাদার হাউজ বন্ধ থাকে।
যাবেন কীভাবে
কলকাতা বিমানবন্দর, রেলস্টেশন, সড়কপথে মাদার হাউজের যেতে আপনাকে ট্যাক্সি অথবা অটো ভাড়া করে এজিসি বোস রোডে পৌঁছাতে হবে। সেখনে যে কাউকে বললে দেখিয়ে দিবে মিশনারিজ অব চ্যারিটি অথবা মাদার হাউজ।
কলি