
উত্তরবঙ্গের একটি সমৃদ্ধ জেলা পাবনা। অনেক বরেণ্য ব্যক্তি এ জেলায় জন্মগ্রহণ করেছেন। এ ছাড়া ব্রিটিশ শাসকদের স্মৃতিবিজড়িত পাবনা জেলায় দেখার মতো আছে অনেক কিছু। হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিলাম পাবনা ঘুরতে যাব।
কল্যাণপুর থেকে রাত সাড়ে ১১টার বাসে রওনা দিয়ে ৬ ঘণ্টা পর প্রায় ভোরের দিকে পাবনা পৌঁছালাম। পাবনায় পরিচিত একজনের বাসায় উঠলাম। তিনতলা ছিমছাম সুন্দর বাংলো বাড়ি। সামনে ছোট্ট বাগান, শিউলি ফুল ছড়িয়ে আছে সেখানে।
ফ্রেশ হয়ে হাঁটতে বের হলাম। পাড়াটি বেশ, প্রতিটি বাড়িতে ফুলের গাছ। নাম না জানা ফুল ঝরে আছে গাছতলাগুলোতে, পথের মাঝে। এমন সুন্দর পরিবেশে হাঁটতে দারুণ লাগে!
.jpg)
হাঁটাহাঁটি শেষ করে সকালের নাশতা খেতে গেলাম পাবনার বিখ্যাত প্যারাডাইস সুইটসে। সেখানে সকালের নাশতা হিসেবে লুচি, সবজিটা বেশ জনপ্রিয়; যদিও আমার কাছে এভারেজ লেগেছে। প্যারাডাইস সুইটসের মিষ্টিও জনপ্রিয়। কয়েক ধরনের মিষ্টিও কিনে নিলাম।

সকালের নাশতা সেরে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম তাড়াশ ভবনে। পাবনা সদরে অবস্থিত অন্যতম একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা এটি। ১৮ শতকের দিকে তাড়াশের তৎকালীন জমিদার রায়বাহাদুর বনমালী রায় এটি নির্মাণ করেন।

যেতে যেতে বাইরে থেকেই দেখলাম পাবনার প্রসিদ্ধ পুরাতন একটি লাইব্রেরি। নাম ‘অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি’। ১৮৯০ সালে লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তৎকালীন পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার তাঁতিবন্দের জমিদার গঙ্গা গোবিন্দ চৌধুরীর দত্তক নেওয়া নাতি অন্নদা গোবিন্দ চৌধুরীর নামে পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখনো পাবনায় বিদ্যুৎ আসেনি। পাঠকদের সুবিধার জন্য ১৩ টাকা ৮ আনা মূল্যের পেট্রোম্যাক্স লাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৩৬ সালে ১০০ টাকা ব্যয়ে পাঠাগারটিতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়া হয়। বর্তমানে সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পাঠাগারটি উন্মুক্ত থাকে পাঠকদের পড়ার জন্য। জানতে পারলাম, প্রতিবছর একবার লাইব্রেরিটিতে প্রদর্শনী হয়। তখন বহু বছর আগে মানুষ যে তালপাতা আর নারিকেল পাতায় লিখত, সেসব সংরক্ষিত ঐতিহ্য দর্শনার্থীদের দেখানো হয় এবং সে সময় অনেক মানুষের ভিড় হয় পাবনার এই প্রসিদ্ধ লাইব্রেরিটিতে।

প্রথম দিন সঙ্গত কারণে পাবনার আর কোথাও ঘোরা হলো না। পরদিন সকালে আবার রেডি হয়ে বের হলাম। ইন্দুবালা ভাতের হোটেল- এ নামটির সঙ্গে অনেক মানুষ, বিশেষ করে সাহিত্যপ্রেমী মানুষ খুব পরিচিত। এই নামে কল্লোল লাহিড়ীর উপন্যাস বাংলাজুড়ে বেশ সাড়া পেয়েছে। ওয়েব সিরিজও তৈরি হয়েছে ভারতে। আর তা থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে পাবনায় গড়ে তোলা হয়েছে ইন্দুবালা ভাতের হোটেল। সকালের প্রথম গন্তব্য সেখানে।
আরও পড়ুন: পাবনার দর্শনীয় স্থানসমূহ
প্রথমে রিকশাযোগে চলে গেলাম পাবনার বাইপাস সড়কে। সেখান থেকে অটোতে চলে গেলাম ঢাকা-পাবনা মহাসড়কের পাশে (জালালপুর) অবস্থিত এই বিখ্যাত হোটেলে। রত্নদ্বীপ রিসোর্টের একদম বিপরীতেই এই হোটেলটির অবস্থান।

উপন্যাসটিতে যেমন অনেক হারিয়ে যাওয়া খাবারের কথা তুলে ধরা হয়েছে, এই হোটেলটিও তেমনই সেসব হারিয়ে যাওয়া বা হারাতে বসা ঐতিহ্যবাহী খাবার ফিরিয়ে আনার প্রয়াসে কাজ করে যাচ্ছে। একই সঙ্গে কিছু নরমাল খাবারের আয়োজনও থাকে। উপন্যাসের সঙ্গে মিল রেখে কালো বোর্ডে চক দিয়ে প্রতি বেলার মেন্যুও লেখা হয়। খাবার পরিবেশন করা হয় স্টিলের পাত্রে। আমি গিয়েছিলাম সকালবেলা। কী খাব কনফিউজড হয়ে খিচুড়ি আর ডিম ভাজা নিয়েছিলাম। স্বাদ ভালো, তবে এভারেজই ছিল।

ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে নাশতা সেরে আবার অটোতে করে বাইপাস বাসটার্মিনালে চলে এলাম। তারপর রিকশা নিলাম হেমায়েতপুরে যাওয়ার জন্য। উদ্দেশ্য সেখানকার মানসিক হাসপাতালটি দেখব, যা ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তী সময়ে আরও বড় পরিসরে হাসপাতালটির কার্যক্রম শুরু হয় এবং সেই বিস্তৃত পরিসরের অধিকাংশ জমি আধ্যাত্মিক সাধক অনুকূল ঠাকুরের। হাসপাতালটিতে মানসিকভাবে অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। এখানে একটি জনকল্যাণ সংস্থা রয়েছে। সংস্থাটি সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষদের পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে থাকে। হাসপাতালে থাকাকালীন কেউ কর্মক্ষম অবস্থায় থাকলে তার কাজের ব্যবস্থা করে থাকে। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রও সরবরাহ করে থাকে।

পাবনা মানসিক হাসপাতালের পাশেই আধ্যাত্মিক সাধক অনুকূল চন্দ্রের আশ্রম। চলে গেলাম সেখানে। মা-বাবার স্মৃতি রক্ষার্থে তিনি এখানে মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। অনুকূলচন্দ্র ‘সৎসঙ্গ’ নামে একটি জনহিতকর সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। প্রকৃত অর্থে অনুকূল ঠাকুর মানবকল্যাণে তার জায়গা-জমি যথাসর্বস্ব উৎসর্গ করে গেছেন। এখানে শ্রীশ্রী অনুকূল চন্দ্রের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ওই সময় লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয় বলে জানা যায়। ভারত থেকেও লোকজন এখানে আসেন।
পাবনা শহরে আমার সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ছিল ভারতের প্রখ্যাত অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের সংগ্রহশালা দেখা। ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল জন্ম হয় এই কিংবদন্তি নায়িকার। ধারণা করা হয়, তার জন্ম হয়েছিল ভারতের বিহার রাজ্যের পাটনায় মামা বাড়িতে। ১৯২২ সালে তার বাবা পৌরসভার স্বাস্থ্য পরিদর্শকের চাকরি পেয়ে যশোরের আদি নিবাস ছেড়ে পাবনা চলে আসেন। পাবনা শহরের গোপালপুরের হেমসাগর লেনে একতলা বাড়ি তৈরি করেন। সেই বাড়িটির গা ঘেঁষেই ছিল হেমসাগর দীঘি। ইছামতি নদী আর সেই হেমসাগর দীঘির সঙ্গে বড় হয়ে উঠতে থাকেন সুচিত্রা।

এ বাড়িটি ঘিরে সুচিত্রাদের ভরপুর সোনালি জীবন ছিল। ১৯৪৭ সালে বিয়ের পর এ বাড়ি ছেড়ে কলকাতা চলে যান সুচিত্রা। ১৯৬০ সালে সুচিত্রার বাবাও বাড়িটি জেলা প্রশাসনের কাছে ভাড়া দিয়ে সপরিবারে কলকাতা চলে যান। আস্তে আস্তে বাড়িটি দখল হতে থাকে এবং ১৯৯০ সালে পুরোপুরি দখল হয়ে যায়। ২০০৯ সালে বাড়িটি দখলমুক্ত করতে পাবনা জেলার সাংস্কৃতিককর্মী এবং সুধীজনেরা একত্রিত হন। গড়ে তোলেন ‘সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ’। তাদের তুমুল প্রতিবাদের মুখে ২০১৪ সালের জুলাইতে বাড়িটি দখলমুক্ত হয় এবং সেখানে স্বল্প পরিসরে সংগ্রহশালাটি গড়ে তোলা হয়।

ছোটবেলা থেকেই সুচিত্রা পড়াশোনার পাশাপাশি নাচ, গান, পেইন্টিংয়ে খুব উৎসাহী ছিলেন। এই উৎসাহের পেছনে অন্যতম অবদান ছিল সংস্কৃতমনা একটি পরিবারের। সে পরিবারের বাসিন্দা ছিলেন মঞ্জুশ্রী চাকি; যিনি একজন বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী হয়ে উঠেছিলেন পরবর্তীকালে। তার বাড়িটি একদম সুচিত্রা সেনের বাড়ির পাশেই। প্রথমে সে বাড়িটি দেখে নিলাম। বেশ পুরোনো আর জমিদারবাড়ির মতো বিশাল বাড়ি। ওই বাড়ির বারান্দায় নাচ, গান, নাটকের মহড়া সব চলত। তখন থেকেই স্কুলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অভিনয় করতে থাকেন সুচিত্রা এবং অভাবনীয় সাড়াও পান।

সুচিত্রার নাম ছিল রমা দাশগুপ্ত, ডাকনাম রমা, পাবনার মেয়ে। আজ সুচিত্রা নেই। কিন্তু পাবনা তার স্মৃতি ধরে রেখেছে যতটা সম্ভব। সুচিত্রা সেনের সংগ্রহশালায় তার বিভিন্ন বয়সের ছবি, তার অভিনীত সিনেমার তালিকা, সিনেমার পোস্টার, তার ব্যবহৃত কিছু জিনিস ইত্যাদি রয়েছে। সেখানে প্রবেশ করলে শোনা যায়, তার অভিনীত সিনেমার গান বাজছে। সেই গানের সুর অন্যরকম আবেশ তৈরি করে। জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক জানালেন, ‘কলকাতায় যোগাযোগ করা হয়েছে তার আরও কিছু নিদর্শন পাঠানোর জন্য। সেসব নিদর্শন দিয়ে সংগ্রহশালাটি সাজালে তা আরও সমৃদ্ধ হবে।’ পাবনার রূপকথা রোডে ‘রূপকথার কাব্য’ নামে একটি রেস্টুরেন্ট আছে। সেখানে রয়েছে সুচিত্রার পোর্ট্রেইট, তাকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন বই। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে রয়েছে ‘সুচিত্রা সেন ছাত্রী নিবাস’। অন্নদা গোবিন্দ লাইব্রেরিতে তাকে নিয়ে লেখা বই ও আর্টিকেল সংরক্ষণ করা আছে। রূপকথা রিসোর্টের রুমগুলো তার সিনেমা এবং গানের নাম দিয়ে নামকরণ করা, রুমে রুমে তার ছবি রাখা। একজন মানুষ চলে গিয়েও কী দারুণভাবে থেকে যায়, তাই নাহ্!

ওহ হ্যাঁ, জাদুঘরটির প্রবেশমূল্য মাত্র ২০ টাকা। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সাপ্তাহিক বন্ধ সোমবার।
সেদিনের মতো পাবনা ভ্রমণ সেখানেই সমাপ্ত করে ফেরার পথ ধরলাম। মনের ভেতর জেগে রইল বাংলার মেয়ে সুচিত্রা সেনের ঐশ্বর্যভরা মুখ।
পাবনায় আরও যা দেখার আছে
সদর উপজেলায় কাচারিপাড়া জামে মসজিদ, কবি বন্দে আলী মিয়ার বাড়ি, জোড় বাংলা মন্দির বা গোপীনাথ মন্দির, রত্নদ্বীপ রিসোর্ট, রূপকথা ইকো রিসোর্ট, এডরুক লিমিটেড এসব দেখতে পারেন। আটঘরিয়া উপজেলায় আছে চন্দ্রাবতীর ঘাট ও বংশীপাড়া স্মৃতিসৌধ, বেরুয়ান জামে মসজিদ, চাচকিয়ার তাঁতশিল্প, চন্দ্রনাথ সেনের জমিদারবাড়ি। ঈশ্বরদী উপজেলায় আছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রাশিয়ান সিটি, ঈশ্বরদী রেল জংশন, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, লালন শাহ সেতু, ঈশ্বরদী বিমানবন্দর, ঈশ্বরদী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, ফুরফুরা শরিফ, বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্র, চিনিকল। চাটমোহর উপজেলায় আছে প্রমথ চৌধুরীর পৈতৃক নিবাস, শাহী মসজিদ, মথুরাপুর মিশন। ফরিদপুর উপজেলায় আছে রাজা রায় বাহাদুরের বাড়ি বা বনওয়ারী নগর রাজবাড়ি। বেড়া উপজেলায় আছে হাটুরিয়া জমিদারবাড়ি বা ১৩ জমিদারবাড়ি। সাঁথিয়া উপজেলায় আছে ক্ষেতুপাড়া জমিদারবাড়ি। সুজানগর উপজেলায় আছে গাজনার বিল, তাঁতীবন্দ জমিদারবাড়ি, পাবনার ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প, আজিম চৌধুরী জমিদারবাড়ি।
কীভাবে যাবেন
সড়কপথে- কল্যাণপুর, গাবতলী বা টেকনিক্যাল মোড় থেকে ঢাকা-পাবনা রুটে বাস চলাচল করে। ভাড়া ৫০০-৯০০ টাকা।
রেলপথে- কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠতে পারেন। ভাড়া ১১৫-৫২৭ টাকা।
কোথায় থাকবেন
পাবনা সদরে হোটেল নিতে পারেন। তা হলে দর্শনীয় জায়গাগুলো সহজে ঘুরে দেখতে পারবেন।
কী খাবেন
ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে খেতে পারেন। প্যারাডাইস সুইটসের মিষ্টি, জলযোগ হোটেলের খাবার, সেতু হোটেলের গরুর বট ও কালাভুনা এবং রাশিয়ান সিটির খাবার খেতে পারেন। পাবনার ঘি খুব ভালো। ঘি নিয়ে আসতে পারেন।
জাহ্নবী