ঢাকা ৩ মাঘ ১৪৩১, শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি ২০২৫

পাহাড়ে সবুজের হাতছানি

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:০৯ পিএম
আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:১৭ পিএম
পাহাড়ে সবুজের হাতছানি
মেঘচূড়া হিল রিট্রিট

শুভ্র মেঘের ভেলা উড়ে যায় আপন গতিতে। কখনো আবার কালো মেঘরাশি জমাট বেঁধে রয় ওই দূর আকাশে। দৃষ্টিরসীমায় ধরা পাহাড়ের ঢেউ। ঝিরঝির বাতাসের আলিঙ্গন। অপার্থিব সৌন্দর্যের সূর্যোদয়ের নান্দনিক দৃশ্য দেখার ফাঁকে, আকস্মিক মেঘের আবরণে শরীর ঢেকে যাওয়া। এমনই সব প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম দৃশ্যগুলোর সাক্ষী হয়ে এলাম, ভূমি থেকে প্রায় ১০০০ থেকে ১২০০ ফিট উপরে সবুজ পাহাড়ের বুকে গড়া মেঘচূড়া হিল রিট্রিটের জুমঘরে বসে।

২৭ নভেম্বর রাতে দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের বন্ধুরা ছুটলাম বান্দরবানের আলীকদম। রাত পেরিয়ে ভোরের আলোয় আঁকাবাঁকা সড়ক ধরে গাড়ি চলছে। দূরের পাহাড়গুলো তখনো অস্পষ্ট। তবে গাছের ঝোপঝাড়ের ফাঁক গলে গভীর গিরিখাদ ঠিকই চোখে পড়ে। বান্দরবান হাজারবার গেলেও, পথের সৌন্দর্যে যে কাউকেই বারংবার মজতেই হবে। বাস যেতে যেতে পৌঁছায় আলীকদমের আবাসিক এলাকায়। নাশতা সেরে মোটরবাইকে চড়ি। মারায়নতং পাহাড়ের পথ ধরে বাইক ছুটে চলে। পাহাড়ি পথে মোটরবাইকের পিলিয়ন হতে পারাটা আরও বিশেষ আনন্দের। আর সেটা যদি হয় ভাড়ায় খাটা মোটরবাইক তাহলে তো ষোলোকলা পূর্ণ। এই পথটা সাজেক কিংবা সিন্দুকছড়ির মতো নয় যে তেলতেলে পিচ করা সড়ক। সরুপথে ইট সুরকির সলিং।

কোথাও-বা তা সরে যাচ্ছে, তাই ইটগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিংবা স্তূপ হয়ে রয়েছে। তার মধ্যে আবার ডানে-বামে খাদ। চালকের নেক্সট প্যাসেঞ্জার ধরার তাড়াহুড়া। এহেন পরিস্থিতিতে বাইকে উঠছে। ভালোয় ভালোয় নামিয়ে দিল প্রায় ১২০০ ফিট ওপরে। এরকম ১২০০ আর ২৪০০ ফিট তার চেয়েও বেশি, ট্র্যাকিং করাটা আমাদের জন্য মামুলি। ঘরের সামনে রিকশা পেলে দশ কদমও হাঁটতে ইচ্ছে করে না। ব্যাপারটা সেরকমই ঘটেছে। বাইক মিলে যাওয়ায় ট্র্যাকিং করতে ইচ্ছে করেনি। মোটরবাইকার নামিয়ে দিয়ে শাঁ করে চলে গেল। মনে হলো সে যেন মাওয়া রোডে টান মারল। আমরা এগোতে থাকি। জুমঘর পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রায় ২০০ ফিট নিচের দিকে নামতে হবে। শুরু হলো হাইকিং। চোখে ধরা পড়ল মাতামুহুরী নদী। ওপর থেকে নদীকে চিকন সুতার মতো লাগল। জুমঘরটা দৃষ্টির সীমায়। হুট করেই সাদা মেঘের দল ঘরটাকে ঘিরে ফেলল। দ্রুত কিছু ছবি তুলে নিই। প্রকৃতি যা কিছু করে, তা তার আপন খেয়ালেই করে থাকে। পরেরবার আবার নাও করতে পারে। তাই মিস করতে রাজি না।

ওদিকে আমাদের অপেক্ষায় থাকা ভ্রমণযোদ্ধা মাসুমের ফোন। তাকে আশ্বস্ত করি আমরা ঠিকানামতো প্রায় এসেই পড়ছি। সত্যি সত্যিই এসে পড়ছি। আমার প্রিয় পাঠক সজিব গাজী বাবু অভ্যর্থনা জানাল। চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছি যে, মুহূর্তেই সারা রাতের বাস জার্নির ক্লান্তি উবে গেছে। তাঁবুতে ব্যাগ রেখেই প্রকৃতির সৌন্দর্যের পিছু নিই। ভ্রমণবন্ধুরা উল্লাসে মাতে। বেলা গড়ায়। ইচ্ছে হলো মাতামুহুরী নদীতে জলকেলিতে মাতামাতি করব সবাই। যেমন কথা তেমন কাজ। প্রায় ১০০০ ফিট নেমে বাঘের ঝিরি হয়ে তবেই পৌঁছানো যাবে মাতামুহুরীতে। দে-ছুট প্রস্তুত। নামতে শুরু করলাম সবাই। নামতে নামতে মনে হলো এই পথে ট্র্যাকিং না করলে ভ্রমণের অনেক কিছুই অপূর্ণ থেকে যেত।

বেশ কিছুক্ষণ হাইকিং-ট্র্যাকিং করার পরে বিশাল সেগুন বাগানের দেখা পাই। পুরোনো সব সেগুন গাছ। সে এক অন্যরকম ভালো লাগা। সেগুনের ছায়া ঘেরা পথে হাঁটতে হাঁটতে বাঘের ঝিরি পার হয়ে নদীর দেখা পাই। আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ অগ্রহায়ণ মাসে তার কোমর পানি থাকে। বর্ষার প্রমত্তা পাহাড়ি মাতামুহুরী অগ্রহায়ণে নিষ্প্রাণ। এর বুকজুড়ে এখন ধুমছে চলছে চাষাবাদ। কোমর পানিতেই নেমে যাই। আহ কী শান্তি। জাতের মাইয়া কালা আর নদীর পানি ঘোলাও ভালা। বুড়া-বুড়িদের কথা একেবারে ফেলনা নয়। চলল অনেকটা সময় সুখ স্থান। যাই আবারও উঠতে হবে প্রায় হাজার ফিট। মাল্টা, কমলা ও আমবাগানের পাশ দিয়ে, নিচ দিয়ে হাইকিং করে যাচ্ছি। যেতে যেতে এবার ট্র্যাকিং করার পালা। ১১৮ কেজির দেহটা নিয়া পাহাড় চূড়ায় উঠা খানিকটা চ্যালেঞ্জিং। তবে মনের জোর থাকলে সেটা মামুলি ব্যাপার। বরাবরের মতো এবারো ভ্রমণসঙ্গীদের সহযোগিতা ও মনের জোরে উতরে গেলাম। ক্যাম্পিং সাইটে ফিরেই দেখি রতনের গুছিয়ে রাখা রান্নার আয়োজন দিয়ে, মান্নান ও আনিস দুপুরে খাবারে রাজহাঁস ভুনা ও আঠাল খিচুড়ি করে রেখেছে। খেয়েদেয়ে তাঁবুতে খানিকটা সময় বিশ্রাম নিয়েই চলে যাই সবচেয়ে উঁচুতে থাকা জুমঘরে। খুনসুটি হয় মেঘের সঙ্গে। আড্ডা জমে ঝিরঝিরে বাতাসের সঙ্গে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা।

আরাফাত, সৌরভ ও তুহিনের বারবিকিউ প্রস্তুতি। চার্জ ফুরিয়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের হতাশা। সব মিলিয়ে মজাদার বিফ বারবিকিউ। আকাশে ততক্ষণে তারার মেলা। জ্বল জ্বল করে আলো ছড়াচ্ছে নাম না জানা নানান তারা। একটা সময় সবাই ঘুমের বাড়ি পাড়ি জমাই। ঘুম ভাঙে সুবহে সাদিকের সময়। ফজর পড়েই পুব আকাশের পানে তাকিয়ে সূর্যোদয়ের অপেক্ষায়। একেবারে শুরু থেকেই সূর্যোদয় দেখার অনুভূতি ও এর সৌন্দর্য লিখে বর্ণনা করা অসম্ভব। শুধু এতটুকুই বলা যায়, যারা এই জনমে এখনো খালি চোখে সূর্যোদয় দেখেননি তারা এই ভুবনে জম্মানোটাই অনর্থক। কথাটা বেশ শক্ত হয়ে গেল তাই না। আদতে মোটেও তা শক্ত নয়। দেখেই আসুন না একবার দেশের যেকোনো পাহাড় চূড়ায় বসে। তখনই অনুভব করা যাবে, বেঁচে থাকার মানে কী। 

কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সরাসরি আলীকদম বাস সার্ভিস রয়েছে। 

কোথায় থাকবেন
লামাবাজার ও আলীকদমে হোটেল, কটেজসহ পাহাড় চূড়ায় বেশ কিছু রিসোর্ট, জুমঘর ও ক্যাম্পিং সাইট রয়েছে। যারা রোমাঞ্চকর পরিবেশ পছন্দ করেন তারা জুমঘর কিংবা তাঁবুতে থাকতে পারেন। নিরাপত্তাসহ খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে।

কলি

প্রকৃতির মায়ায় মারমেইড বিচ রিসোর্ট

প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫২ পিএম
প্রকৃতির মায়ায় মারমেইড বিচ রিসোর্ট
ছবি: মারমেইড বিচ রিসোর্ট

কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকত, যেখানে সোনালি বালু আর নীল আকাশ মেলে ধরেছে এক অপূর্ব দৃশ্য, সেখানে এমন এক রিসোর্ট রয়েছে, যা আপনাকে এনে দেবে সম্পূর্ণ অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা। শরতের সোনালি রোদের আলিঙ্গনে যখন আমি প্রথম রিসোর্টে প্রবেশ করি, মনে হচ্ছিল যেন একটি পুরনো বইয়ের পাতায় পা রেখেছি। মৃদু-মন্দ সাগরের হাওয়া, সোনালি আভায় ভেসে থাকা বালুকাবেলা, আর চারপাশে অগণিত গাছপালা- এই দৃশ্য যেন কিছুটা কবিতার মতো, যেখানে সময় থেমে গেছে।

মারমেইড বিচ রিসোর্ট, যা মেরিন ড্রাইভ রোডের পাশে পেঁচার দ্বীপের কোনে অবস্থিত, কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্যই নয়, এখানে আসলে এক অনন্য প্রশান্তির ছোঁয়া পাওয়া যায়। শরতের সোনালি রোদ আর মৃদু বাতাসের মাঝে সেখানে দুই রাত কাটিয়ে, মনে হয়েছে সময় যেন থমকে গেছে, আর প্রকৃতি আপনাকে তার আদর-মাখানো গান শুনিয়েছে।
রিসোর্টের কটেজগুলো যেন নিজেই একেকটি ছোট্ট পৃথিবী। বাঁশ আর পুনর্ব্যবহৃত কাঠ দিয়ে তৈরি, কটেজগুলো আধুনিক সুবিধার পাশাপাশি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক নিখুঁত মেলবন্ধন। গাছের ছায়ায় ঘেরা আমার কটেজটি যেন এক পুরনো গল্পের অংশ, যার প্রতিটি কোনে লুকিয়ে ছিল কিছু অজানা রহস্য। খোদাই করা কাঠের দরজা, স্থানীয়ভাবে তৈরি সজ্জা, আর সোনালি আলোয় স্নিগ্ধ লণ্ঠন- সবকিছু যেন আহ্বান জানাচ্ছিল- ‘আর একটু থাকুন, এখানে আরও কিছু মধুর স্মৃতি তৈরি করুন।’

প্রকৃতির সিম্ফনি, পাখির গান আর সমুদ্রের দূরবর্তী আওয়াজ- এখানে সকালের শুরুটা যেন একদম আলাদা। প্রথম সকালে, ঢেউয়ের ছন্দের মাঝে চোখ মেলে দেখলাম সমুদ্রের অপরূপ দৃশ্য। কফির কাপ হাতে, বারান্দায় বসে আমি শুধু তাকিয়ে ছিলাম। শান্ত, মৃদু বাতাস আর সমুদ্রের লবণাক্ত গন্ধে মন যেন আরও বেশি প্রকৃতির সান্নিধ্যে চলে যাচ্ছিল। এক মুহূর্তে, সময় যেন থেমে গিয়েছিল।

কিন্তু মারমেইড বিচ রিসোর্ট শুধুই নিঃসঙ্গতার স্থান নয়। এখানে সক্রিয়তার খোঁজে থাকা মানুষের জন্যও অনেক কিছু আছে। কায়াকিং, সাইকেল রাইডিং, অথবা সৈকতের ধারে পায়ের তলায় বালির অনুভূতি- সবকিছুই অপেক্ষা করছে আপনাকে অভ্যর্থনা জানাতে। এক বিকেলে, আমি সাইকেল নিয়ে রিসোর্টের চারপাশে ঘুরতে বের হই, আর হঠাৎ অনুভব করি, যেন দিগন্তের সীমাহীনতা আমাকে এক নতুন জীবন দেখাচ্ছে। বাতাসের টানে মাথার চুল উড়ছে, আর সমুদ্রের ধারে এই অসীম দৃশ্য মনে হয় যেন কোনো শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা ছবি।

 

রিসোর্টের রেস্তোরাঁর খাবার ছিল এক চমৎকার রন্ধনশিল্পের উদাহরণ। স্থানীয় উপাদান দিয়ে তৈরি প্রতিটি পদ যেন এক নান্দনিক রচনা। এক সন্ধ্যায়, আমি গ্রিলড পমফ্রেট খেয়েছিলাম- এটির ধোঁয়ামাখা গন্ধ, আর ট্যাঞ্জি আম সালসার সঙ্গে তার সমন্বয় ছিল এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। পরের রাতে নারকেল থেকে তৈরি একটি ডিজার্ট খেয়েছিলাম, যা মনে করিয়ে দিয়েছিল- যত সহজই হোক না কেন, আন্তরিকতা দিয়ে প্রস্তুত করা যেকোনো খাবার অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে।

মারমেইড বিচের সন্ধ্যাগুলো যেন এক বিশেষ মায়ায় রঙিন। প্রথম রাতে, সৈকতে লাইভ মিউজিক ছিল, আর আগুনের নরম আলো ছড়ানো ছিল সুরে সুরে। গিটারিস্টের বাজানো সুর যেন তরঙ্গের ধ্বনির সঙ্গে মিলে এক অভূতপূর্ব সংগীত রচনা করছিল। দ্বিতীয় রাতে, পূর্ণিমার আলোতে সৈকতের ধারে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়েছিল, এ যেন এক অপার্থিব অভিজ্ঞতা। আমার পায়ের তলায় শীতল বালি সমুদ্রের অপরূপ আলোয় চমকাচ্ছিল।

মারমেইড বিচ রিসোর্টের একটি অতিরিক্ত সৌন্দর্য রয়েছে, যা সাধারণত এমন রিসোর্টগুলোর মাঝে দেখা যায় না- এটি পরিবেশবান্ধব একটি রিসোর্ট, যা প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে। রিসোর্টের স্থাপত্য নকশা থেকে শুরু করে তার কার্যক্রম পর্যন্ত- সবকিছুতে পরিবেশের সঙ্গে খাপখাইয়ে চলার ছাপ। সৌরশক্তি ব্যবহার করে আলোকসজ্জা, বৃক্ষরোপণ প্রকল্প, আর ইকো-ফ্রেন্ডলি কাঠামো- সবকিছুই রিসোর্টটির পরিবেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে। বিশেষ করে, পেঁচার দ্বীপের সবুজে ঘেরা প্রকৃতি, যা রিসোর্টের একেবারে কাছেই অবস্থিত, তা যেন প্রাণী ও গাছপালার একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে।

আরেকটি দিক যা আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে, তা হলো রিসোর্টের স্থানীয় সম্প্রদায়ের প্রতি দায়বদ্ধতা। অনেক কর্মী এখানকার আশপাশের গ্রাম থেকে আসে এবং রিসোর্টটি স্থানীয় কৃষক ও কারিগরদের সহযোগিতা করে, যা এ ধরনের পর্যটন ব্যবসায় খুবই বিরল। রিসোর্টের সাবান, যা স্থানীয় সমবায় থেকে তৈরি, অথবা আমার সালাদের সবজি, যা মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি খামার থেকে সংগ্রহ করা- এসব প্রমাণ করে যে পর্যটন শুধু আনন্দের জন্য নয়, বরং দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করলে এর মাধ্যমে ব্যবসার পাশাপাশি স্থানীয় ভূমি ও সংস্কৃতিকেও সহযোগিতা করা সম্ভব।

রিসোর্টের শেষ সকালে, যখন আমি সৈকতে বসে সূর্যোদয় দেখছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল, যেন এই স্থানে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তই এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। এটি শুধু একটি থাকার স্থান নয়, বরং এ এক নতুন জীবন যাপনের পদ্ধতি- প্রকৃতির সঙ্গে, নিজের সঙ্গে, আর জীবনের সরল আনন্দের সঙ্গে মেলবন্ধনের জায়গা।

 কলি

বরেন্দ্রভূমিতে একদিন

প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৫৮ পিএম
আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৫৮ পিএম
বরেন্দ্রভূমিতে একদিন
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। ছবি: সংগৃহীত

বরেন্দ্রভূমি আমার কাছে বুকের ভেতর জেগে থাকা একটা জায়গার নাম। এ ভূমির পরতে পরতে মায়ার বিস্তার। এই মায়াপুরে কাটানো দুদিনের গল্প বলব আজ। প্রতিবারই কাকতালীয়ভাবে শীত মৌসুমে রাজশাহী যাওয়া হয় আমার। অন্য মৌসুমে এই জেলা দেখতে কেমন, তা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়নি। এবারেও রাতের ট্রেনে করে চলে গেলাম রাজশাহী; পৌঁছালাম শীতের নরম ভোরে। তখন সুয্যিমামা তার সোনালি আলো ছড়াতে শুরু করেছে। সেই আলো এসে পড়েছে রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের গায়ে। কী যে অপূর্ব সেই সোনামাখা দৃশ্য!

আত্মীয়ের বাসায় উঠে সকালের নাশতা সেরে বিশ্রাম নিলাম কিছুক্ষণ। তার পর রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঘুরতে। প্রথমে গেলাম সদরে অবস্থিত বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে।

প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহের জন্য এ জাদুঘরটি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম। শুধু তাই নয়, এটিই বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর। এ জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় নাটোরের দিঘাপাতিয়া রাজপরিবারের জমিদার শরৎ কুমার রায়, আইনজীবী অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এবং রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক রামপ্রসাদ চন্দ্রের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে তারা বাংলার ঐতিহ্য ও নিদর্শন সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি গঠন করেন। ওই বছরে তারা রাজশাহীর বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান চালিয়ে ৩২টি দুষ্প্রাপ্য নিদর্শন সংগ্রহ করেন।

এই নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করার জন্য শরৎ কুমার রায়ের দান করা জমিতে জাদুঘরটির নিজস্ব ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। নির্মাণ শেষ হয় ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে। একই বছরের ১৩ নভেম্বর বাংলার তৎকালীন গভর্নর কারমাইকেল জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন। মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ছাড়াও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি এই জাদুঘরটি পরিদর্শন করেছেন। জাদুঘরটিতে অনেক পুরোনো দিনের নিদর্শন রয়েছে। মহেঞ্জোদারো সভ্যতা থেকে সংগৃহীত প্রত্নতত্ত, পাথরের মূর্তি, খ্রিষ্টীয় একাদশ শতকে নির্মিত বুদ্ধমূর্তি, গঙ্গামূর্তিসহ অসংখ্য মূর্তি এই জাদুঘরের অমূল্য সংগ্রহের অন্তর্ভুক্ত। মোগল আমলের রৌপ্য মুদ্রা, গুপ্তসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের গোলাকার স্বর্ণমুদ্রা, সম্রাট শাহজাহানের গোলাকার রৌপ্য মুদ্রাও রয়েছে সংগ্রহে। এখানে প্রায় ৫,০০০ পুঁথি রয়েছে, যার মধ্যে ৩,৬৪৬টি সংস্কৃত আর বাকিগুলো বাংলায় রচিত।

কালো পাথরের মূর্তি

জাদুঘর দেখা শেষ করে গেলাম টি-বাঁধে। পেয়ারা মাখা খেয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর চলে গেলাম রুয়েটে। রুয়েট আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পাশাপাশি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাজ্জাদের লেবুচুরের বেশ সুনাম রয়েছে। তাই রুয়েট থেকে গেলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেবুচুর খেতে এবং তা খেয়ে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি। তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা আর বধ্যভূমি দেখে মন খুব ভার হয়ে গেল। সংগ্রহশালা দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে উঠেছিল জলে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল প্রায়। প্রথম দিনের ঘোরাঘুরি এভাবেই শেষ হলো।

দ্বিতীয় দিনের ভ্রমণটা ছিল সবচেয়ে স্মরণীয়। আমার ইচ্ছে ছিল, রাজশাহীর কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে গরুর গাড়িতে চড়ব। হারিকেন জ্বালিয়ে ঝুলিয়ে দিব সেই গাড়িতে। আর সরিষাখেতের পাশে বসে মাটির সানকিতে করে খিচুড়ি খাব। আমার ইচ্ছে পূরণ করতে কিছু মাটির সানকি কেনা হলো। খুঁজে খুঁজে গরুর গাড়ি না পেয়ে মহিষের গাড়ি জোগাড় করা হলো। একটা হারিকেনের বন্দোবস্তও করা হলো। শুধু তাই নয়, আমার জন্য ভাপা পিঠাও বানানো হলো। আর খিচুড়ির সঙ্গে মুরগির মাংস, বেগুন ভাজা, ডিম ভাজা এসবের আয়োজন করা হলো। আমি ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম আমার ইচ্ছে পূরণে কাছের মানুষগুলোর এই কর্মযজ্ঞ দেখে।

প্রাইভেট কারে প্রথমে রাজশাহীর পবা উপজেলার এক গ্রামে গেলাম। খুব প্রত্যন্ত না হলেও খাঁটি গ্রাম বলা যায় অবশ্যই। গ্রামের নাম ভুগরইল। প্রথমে সরিষাখেতের পাশে বসে খিচুড়ি খেলাম আয়েশ করে। তখন বিকেল বেলা। এরপর ঠিক করে রাখা মহিষের গাড়িতে উঠে বসলাম। ফসলের মাঠের আলপথ ধরে যাচ্ছিলাম আর মুগ্ধচিত্তে অনুভব ঘনিয়ে এলে হারিকেন জ্বালানো হলো। সূর্য ডুবে গেল, অন্ধকার গাঢ় হতে লাগল। সবুজ ফসলের মাঠে ছন্নছাড়া অন্ধকার খেলা করতে শুরু করল রাত নামাবে বলে। জীবনে এত অভূতপূর্ব মুহূর্ত বারবার আসে না।

এক আকাশ স্বপ্ন পূরণের উচ্ছ্বলতা নিয়ে ফিরে এলাম রাজশাহী শহরে। সিঅ্যান্ডবি মোড়ে এক লেখকের সঙ্গে দেখা করে শিক কাবাবের বার্গার খেলাম আর কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে এবারের রাজশাহী ভ্রমণের সমাপ্তি টানলাম।

রাজশাহীতে আরও যা যা দেখার আছে
রাজশাহী সদরে আছে জিয়া শিশুপার্ক, পদ্মা গার্ডেন, মুক্তমঞ্চ, শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী পার্ক বা সেন্ট্রাল পার্ক। পবা উপজেলায় আছে শাহ্ মখদুম বিমানবন্দর, গরু-মহিষের বাজার, হস্তশিল্পপল্লী। পুঠিয়া উপজেলায় আছে পুঠিয়া রাজবাড়ি, রাজবাড়িসংলগ্ন একাধিক মন্দির, দোল মন্দির, হাওয়াখানা। মোহনপুর উপজেলায় আছে পানের বরজ। তানোর উপজেলায় আছে চোলকুরের জমিদারবাড়ি, কিশোর মোহন চৌধুরী জমিদারবাড়ির শত বছরের শিবমন্দির, সাঁওতালপল্লী, গরু-মহিষের গাড়ি, কামার-কুমারপল্লী, বাঁশের হস্তশিল্পপল্লী, নাইস গার্ডেন পার্ক। চারঘাট উপজেলায় আছে সারদা ক্যাডেট কলেজ, সারদা পুলিশ একাডেমি, হাজার বছরের পুরোনো বৃক্ষ, সরদহ রেলওয়ে স্টেশন, তাঁতপল্লী, নীলকুঠি, খয়ের প্রস্তুতকরণ এলাকা। গোদাগাড়ি উপজেলায় আছে বরেন্দ্র পার্ক, সাফিনা পার্ক, সরমংলা ইকোপার্ক, মৃৎপল্লী, সাঁওতালপল্লী, গরু-মহিষের গাড়ি, ধানসিঁড়ি খেত। বাগমারা উপজেলায় আছে হাজার দুয়ারী জমিদারবাড়ি (বীরকুৎসা নামেও পরিচিত), তাহেরপুর রাজবাড়ি, গোয়ালকান্দি জমিদারবাড়ি। বাঘা উপজেলায় আছে বাঘা শাহী মসজিদ ও তৎসংলগ্ন বাঘা দীঘি, উৎসব পার্ক, বাঘা জাদুঘর, বাঘা দরগাহ শরিফ ইত্যাদি।

কীভাবে যাবেন
ঢাকার কল্যাণপুর থেকে বাসে যেতে পারেন। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে যেতে পারেন। বিমানেও যেতে পারবেন রয়েছে এই সুন্দর শহরে।

কী খাবেন
কালাভুনা, সিঅ্যান্ডবি মোড়ের গরম মিষ্টি, বট পরোটা, বীরেন রেস্তোরাঁর কলিজা সিঙ্গারা, খাসির মাংসের চপ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাজ্জাদের লেবুচুর, টি-বাঁধের পেয়ারা ও আচার মাখা, শিক কাবাবের বার্গার, নবরূপা আর মৌচাকের মিষ্টি এবং আম।

কোথায় থাকবেন
রাজশাহী শহরেই থাকার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট হোটেল রয়েছে।

 কলি 

থামেলের দিনরাত্রি

প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৪১ পিএম
আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৪২ পিএম
থামেলের দিনরাত্রি
থামেল বাজার কাঠমান্ডু। ছবি: সংগৃহীত

ঘড়ির কাঁটায় বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টা বেজে ১৫ মিনিট আর নেপাল সময় দুপুর ১টা, আমরা আছি নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সকালবেলা বাংলাদেশ বিমানের বিজি ৭০৭ চেপে হিমালয়কন্যার কাছে এসেছি। আসার অবশ্য কারণও আছে। আমারা এসেছি নেপাল-বাংলাদেশ ইয়ুথ কনক্লেভের অনুষ্ঠানে।

নেপাল এয়ারপোর্টে আমাদের নেপালের ঐতিহ্যবাহী টুপি আর উত্তরীয় দিয়ে বরণ করেন অনুষ্ঠানের প্রধান সমন্বয়ক অভিনব দাদা। আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে আরও অনেকেই উড়াল দিয়ে এসেছেন এই আয়োজনে অংশ নিতে। আমরা একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হলাম। মোবাইলের সিম কিনলাম এয়ারপোর্ট থেকেই। আনুষঙ্গিক সব কাজ শেষ করে এবার আমরা চেপে বসলাম চার চাকার বাহনে। সূর্যদেবের উষ্ণ অভ্যর্থনা আমাদের বেশ ভালোই লাগছিল। আমরা আসার আগে ভেবেছিলাম খুব ঠাণ্ডা পরে হয়তো নেপালে তবে এতটা ঠাণ্ডা অনুভূত হলো না। আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের হোটেল পানে। চলতি পথে আমাদের দেশের মতো রাস্তায় যানজটের দেখা পেলাম।

ধীরগতিতে চলছিল আমাদের চার চাকার বাহন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা চলে এলাম থামেলের প্রান্তে। থামেল জায়গাটি আমাদের শাঁখারীবাজার বা লক্ষ্মীবাজারের মতোই। বলা যায় যেকোনো পুরোনো জেলা শহরের বড় বাজার এলাকাটি যেমন, তেমনই। কিন্তু অনেক কালারফুল। পথে পর্যটকে ঠাসা। দেখে মনে হলো অধিকাংশই পশ্চিমা। ছোট ছোট দোকানঘর। হরেক রকম পসরা সাজানো। আমি এক দৃষ্টিতে গাড়ির বাইরে তাকিয়েছিলাম। অনুভব করছিলাম থামেল শহরের স্পন্দন। বেশির ভাগ হস্তশিল্পের জিনিস।

পিতলের, তামা, পাথর, মাটি, শোলা, কাঠ বিভিন্ন সহজলভ্য উপাদানে তৈরি এসব। হাতের নিখুঁত কারুকাজ, রঙের ছটা, তুলির আঁচড়, ঢালাইয়ের পেটা কাজ প্রভৃতি বিভিন্নভাবে শিল্প সৃষ্টি হয়েছে। অভিনব দা ঘোষণা দিলেন আমরা হোটেলের কাছে চলে এসেছি। এখন গাড়ি থেকে নেমে পদব্রজে যেতে হবে সামান্য একটু পথ। আমরা গাড়ি থেকে নেমে গলির পথে এগিয়ে চললাম। গলির ভেতরে ছোট ছোট দোকান যার বেশির ভাগই নারীরা পরিচালনা করছেন। আমরা প্রবেশ করলাম সাতকার হোটেল অ্যান্ড স্পা’তে। প্রবেশের পর আমাদের ওয়েলকাম ড্রিংকস পরিবেশন করা হলো। মনে হলো আসল তরমুজের স্বাদ। এরপর আমাদের প্রত্যেকের রুমের চাবি বুঝিয়ে দেওয়া হলো।

পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবকিছুই পাবেন থামেলে।

আমরা অস্থায়ী ডেরায় প্রবেশ করলাম। বেশ ছিমছাম গোছানো। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে বের হলাম দুপুরের পেটপূজার জন্য, যদিও নেপাল সময় তখন বিকেল ৫টা। আমরা চলে এলাম নেপালি এক খাবার হোটেলে। যার যেমন পছন্দ তেমনি এক:এক মেন্যু অর্ডার করলেন। আমরা নিলাম নেপালি ভেজ থালি। অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের খাবার পরিবেশন করা হলো। এক থালাতেই সব অল্প অল্প করে সাজানো। শাঁক, আলু ভর্তা, ডাল, বরবটি আলু দিয়ে তরকারি, বাদামের তরকারি, আচার, দই। তার ওপর খাঁটি ঘি দিয়ে গেলেন খাবার পরিবেশনকারী। পেটে চলছিল রাম-রাবণের যুদ্ধ, সেই সকাল বেলায় দানাপানি পড়েছিল। তাই আর ভদ্রতা না করে খাওয়া শুরু করলাম। 

খাবার নয়, যেন অমৃত খাচ্ছি। নেপালিদের অথেনটিক খাবারের রেস্টুরেন্ট এটি। নেপালিরা ফ্রেশ রান্না করে, বাসি খাবার রাখে না, উচ্ছিষ্ট খায় না একদমই। বেঁচে যাওয়া খাবার ডিশে থেকে গেলে বা হাতের স্পর্শ ছাড়া বেড়ে নেওয়া হলে তা-ও উচ্ছিষ্ট বলে ধরে নেন। এজন্য খাবার আসতে সবখানেই সময় লাগে একটু বেশি। একদল পরিকল্পনা করল নাগরকোট যাবে, কেউ যাবে আবার চন্দ্রা গিরি হিল। পেটপূজা শেষ করে আমরা বের হয়ে পড়লাম থামেলের পথে প্রান্তরে। সূর্যদেব তখন অস্তাচলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সন্ধ্যা ক্রম আসন্ন। পাহাড়ের উপত্যকার শহর। রাত নামে দ্রুত, শহর ঘুমিয়ে পড়ে আগে আগে। যখন জেগে ওঠে অন্যরকম আরেকটি শহর। আমরা পদব্রজে এগিয়ে চলছি। থামেলের পথে প্রান্তরে বিভিন্ন ধরনের দোকানের দেখা পাওয়া যায়।

কেউ ঠাণ্ডার কাপড় বিক্রি করছেন, কেউবা পিতলের সামগ্রী, কেউ আবার হিমালয় ট্র্যাকিং করার সামগ্রী আবার কেউ কেউ বিভিন্ন ধরনের চা। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবকিছুই পাবেন এই থামেলে। আমরা একটি দোকানে প্রবেশ করলাম। দোকানে গৃহসজ্জার সামগ্রী বিক্রি হয়, সবই পিতলের। কিছু নিকেল করা। আমাদের দেশের এলিফ্যান্ট রোডের পিতলের দোকানগুলোর মতোই। অসাধারণ কারুকাজ দেখলেই কিনতে মনে চাইছিল। পরে ভাবলাম আরেকটু দেখি অন্য দোকান আরও ভালো কিছু পাব হয়তো। আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম পরের দোকানের দিকে।

এবার একটি মেডিটেশন বোল দেখে চোখ আটকে গেল। মেডিটেশন বোলের শব্দ আপনাকে নিয়ে যাবে এক অন্য ভুবনে। দামাদামি করে কিনে নিলাম। রাতের গভীরতা বাড়ছে পাহাড়ের উপত্যকার শহরে। রাতের গভীরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে থামেলের চিত্র পরিবর্তিত হতে লাগল। তখন সে এক অন্য থামেল। বিদেশিদের আনাগোনা বাড়ছে।

পাব ও নাইট ক্লাব খুলে গেছে। ক্লাবগুলোর বাইরে মানুষের ভিড়। মিউজিকের উত্তাল তরঙ্গে যে কাউকেই ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। থামেল শহরের পুরোনো অংশ। ঘরবাড়ি অধিকাংশই পুরোনো। আমাদের জমিদার বাড়িগুলোর মতো। ভবনগুলোর প্রধান দরজা কাঠের, নকশা করা। মনে হয় একেকটি রাজবাড়ির প্রবেশদ্বার। এরই রেপ্লিকা স্বর্গের দরজা নামে এখানকার দোকানে বিক্রি হয়। স্থানে স্থানে সমদ্বিবাহু ত্রিভুজের রঙিন কাগজ বা পলিমার দড়িতে টাঙানো।

কোনো কোনোখানে এর সঙ্গে মরিচবাতি দেওয়া। ছবি বিক্রির দোকানের সামনে গিয়ে আমরা দাঁড়ালাম। বেশির ভাগ ছবিই হিমালয়, হিমালয়ের পাদদেশে জনজীবন, বুদ্ধদেব ও বুদ্ধচক্রের। হিমালয়ে সূর্যোদয়, পাহাড়ে চমরি গাইয়ের দল, পাহাড়ি পরিশ্রমী মানুষের ঋজু চেহারা, তাদের জীবিকার সুকঠিন সংগ্রামের ছবি…। এই শহরে পর্যটকের অভাব নেই। বিশেষ করে থামেলে তো বিদেশিই বেশি। সেই বিদেশি পর্যটকের মধ্যে তরুণী, বৃদ্ধা, সুন্দরী, অসুন্দরী সব রকম নারীই আছেন। পোশাকও তাদের বিচিত্র রকম। 

কীভাবে যাবেন
বাংলাদেশ থেকে নেপালে বিমানযোগে যাওয়া যায়। যাওয়া-আসার টিকিট নিয়ে ১৮ থেকে ২২ হাজার টাকার মতো খরচ পড়বে। আগে টিকিট কাটতে পারলে ১৭ হাজার টাকার মতো হতে পারে। বাই রোডে নেপাল যেতে হলে খরচ কমে যাবে অনেকটা। সেক্ষেত্রে ভারতের ট্রানজিট ভিসা নিতে হবে যেখানে পোর্টের নাম দিতে হবে চ্যাংরাবান্ধা বা রানীগঞ্জ। এখানে বা বিমানে কোনোটাতেই নেপালের ইমিগ্রেশনে কোনো ভিসা ফি’র দরকার নেই যদিনা আপনি একই বছরে দুবার ভ্রমণ করতে চান। এসআর পরিবহন সরাসরি বাই রোডে নেপালের বাসের সেবা দিচ্ছে। চাইলে ভেঙে ভেঙে ভারতের বর্ডার পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে নেপালের কাঁকড়ভিটা পর্যন্ত যেতে পারেন। এতে খরচ পড়বে প্রায় ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকার মতো।

কোথায় থাকবেন
থাকতে হলে থামেলের চেয়ে উপযুক্ত স্থান আর দ্বিতীয়টি নেই। কারণ, পুরো থামেলের গলি-ঘুপচিতে অসংখ্য হোটেল/ব্যাকপ্যাকার হোস্টেল রয়েছে। ১০০০ থেকে ১৮০০ রুপির মধ্যে ভালো ডাবল রুমের বাজেট হোটেল এখানে পাওয়া সম্ভব। ৪০০ রুপিতে সিঙ্গেল রুমের হোটেলও এখানে আছে। বাজেট আরেকটু বেশি যেমন ৩০০০ রুপি বা তার বেশি হলে ডিলাক্স রুমের খাবারসহ অনেক ভালো হোটেল পাওয়া যায়। তবে থামেলের হোটেল এবং তাদের দরদাম ও চেহারা এত বেশি বৈচিত্র্যময় যে, আগে থেকে বুকিং না দিয়ে বরং হেঁটে ঘুরে কয়েকটি হোটেল ঘুরে যাচাই-বাছাই করলে সস্তায় ভালো হোটেল পাওয়া সম্ভব।

 কলি

সুচিত্রা সেনের দেশে

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:০০ পিএম
আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩৪ এএম
সুচিত্রা সেনের দেশে
সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা। ছবি: খবরের কাগজ

উত্তরবঙ্গের একটি সমৃদ্ধ জেলা পাবনা। অনেক বরেণ্য ব্যক্তি এ জেলায় জন্মগ্রহণ করেছেন। এ ছাড়া ব্রিটিশ শাসকদের স্মৃতিবিজড়িত পাবনা জেলায় দেখার মতো আছে অনেক কিছু। হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিলাম পাবনা ঘুরতে যাব।

কল্যাণপুর থেকে রাত সাড়ে ১১টার বাসে রওনা দিয়ে ৬ ঘণ্টা পর প্রায় ভোরের দিকে পাবনা পৌঁছালাম। পাবনায় পরিচিত একজনের বাসায় উঠলাম। তিনতলা ছিমছাম সুন্দর বাংলো বাড়ি। সামনে ছোট্ট বাগান, শিউলি ফুল ছড়িয়ে আছে সেখানে।

ফ্রেশ হয়ে হাঁটতে বের হলাম। পাড়াটি বেশ, প্রতিটি বাড়িতে ফুলের গাছ। নাম না জানা ফুল ঝরে আছে গাছতলাগুলোতে, পথের মাঝে। এমন সুন্দর পরিবেশে হাঁটতে দারুণ লাগে!

প্যারাডাইস সুইটস

হাঁটাহাঁটি শেষ করে সকালের নাশতা খেতে গেলাম পাবনার বিখ্যাত প্যারাডাইস সুইটসে। সেখানে সকালের নাশতা হিসেবে লুচি, সবজিটা বেশ জনপ্রিয়; যদিও আমার কাছে এভারেজ লেগেছে। প্যারাডাইস সুইটসের মিষ্টিও জনপ্রিয়। কয়েক ধরনের মিষ্টিও কিনে নিলাম।

তাড়াশ জমিদার ভবন

সকালের নাশতা সেরে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম তাড়াশ ভবনে। পাবনা সদরে অবস্থিত অন্যতম একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা এটি। ১৮ শতকের দিকে তাড়াশের তৎকালীন জমিদার রায়বাহাদুর বনমালী রায় এটি নির্মাণ করেন।

অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি

যেতে যেতে বাইরে থেকেই দেখলাম পাবনার প্রসিদ্ধ পুরাতন একটি লাইব্রেরি। নাম ‘অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি’। ১৮৯০ সালে লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তৎকালীন পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার তাঁতিবন্দের জমিদার গঙ্গা গোবিন্দ চৌধুরীর দত্তক নেওয়া নাতি অন্নদা গোবিন্দ চৌধুরীর নামে পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখনো পাবনায় বিদ্যুৎ আসেনি। পাঠকদের সুবিধার জন্য ১৩ টাকা ৮ আনা মূল্যের পেট্রোম্যাক্স লাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৩৬ সালে ১০০ টাকা ব্যয়ে পাঠাগারটিতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়া হয়। বর্তমানে সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পাঠাগারটি উন্মুক্ত থাকে পাঠকদের পড়ার জন্য। জানতে পারলাম, প্রতিবছর একবার লাইব্রেরিটিতে প্রদর্শনী হয়। তখন বহু বছর আগে মানুষ যে তালপাতা আর নারিকেল পাতায় লিখত, সেসব সংরক্ষিত ঐতিহ্য দর্শনার্থীদের দেখানো হয় এবং সে সময় অনেক মানুষের ভিড় হয় পাবনার এই প্রসিদ্ধ লাইব্রেরিটিতে।

ইন্দুবালা ভাতের হোটেল

প্রথম দিন সঙ্গত কারণে পাবনার আর কোথাও ঘোরা হলো না। পরদিন সকালে আবার রেডি হয়ে বের হলাম। ইন্দুবালা ভাতের হোটেল- এ নামটির সঙ্গে অনেক মানুষ, বিশেষ করে সাহিত্যপ্রেমী মানুষ খুব পরিচিত। এই নামে কল্লোল লাহিড়ীর উপন্যাস বাংলাজুড়ে বেশ সাড়া পেয়েছে। ওয়েব সিরিজও তৈরি হয়েছে ভারতে। আর তা থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে পাবনায় গড়ে তোলা হয়েছে ইন্দুবালা ভাতের হোটেল। সকালের প্রথম গন্তব্য সেখানে।

আরও পড়ুন: পাবনার দর্শনীয় স্থানসমূহ

প্রথমে রিকশাযোগে চলে গেলাম পাবনার বাইপাস সড়কে। সেখান থেকে অটোতে চলে গেলাম ঢাকা-পাবনা মহাসড়কের পাশে (জালালপুর) অবস্থিত এই বিখ্যাত হোটেলে। রত্নদ্বীপ রিসোর্টের একদম বিপরীতেই এই হোটেলটির অবস্থান।

ইন্দুবালা ভাতের হোটেল এর মেন্যু

উপন্যাসটিতে যেমন অনেক হারিয়ে যাওয়া খাবারের কথা তুলে ধরা হয়েছে, এই হোটেলটিও তেমনই সেসব হারিয়ে যাওয়া বা হারাতে বসা ঐতিহ্যবাহী খাবার ফিরিয়ে আনার প্রয়াসে কাজ করে যাচ্ছে। একই সঙ্গে কিছু নরমাল খাবারের আয়োজনও থাকে। উপন্যাসের সঙ্গে মিল রেখে কালো বোর্ডে চক দিয়ে প্রতি বেলার মেন্যুও লেখা হয়। খাবার পরিবেশন করা হয় স্টিলের পাত্রে। আমি গিয়েছিলাম সকালবেলা। কী খাব কনফিউজড হয়ে খিচুড়ি আর ডিম ভাজা নিয়েছিলাম। স্বাদ ভালো, তবে এভারেজই ছিল।

পাবনা মানসিক হাসপাতাল

ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে নাশতা সেরে আবার অটোতে করে বাইপাস বাসটার্মিনালে চলে এলাম। তারপর রিকশা নিলাম হেমায়েতপুরে যাওয়ার জন্য। উদ্দেশ্য সেখানকার মানসিক হাসপাতালটি দেখব, যা ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তী সময়ে আরও বড় পরিসরে হাসপাতালটির কার্যক্রম শুরু হয় এবং সেই বিস্তৃত পরিসরের অধিকাংশ জমি আধ্যাত্মিক সাধক অনুকূল ঠাকুরের। হাসপাতালটিতে মানসিকভাবে অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। এখানে একটি জনকল্যাণ সংস্থা রয়েছে। সংস্থাটি সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষদের পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে থাকে। হাসপাতালে থাকাকালীন কেউ কর্মক্ষম অবস্থায় থাকলে তার কাজের ব্যবস্থা করে থাকে। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রও সরবরাহ করে থাকে।

অনুকূল চন্দ্রের আশ্রম

পাবনা মানসিক হাসপাতালের পাশেই আধ্যাত্মিক সাধক অনুকূল চন্দ্রের আশ্রম। চলে গেলাম সেখানে। মা-বাবার স্মৃতি রক্ষার্থে তিনি এখানে মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। অনুকূলচন্দ্র ‘সৎসঙ্গ’ নামে একটি জনহিতকর সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। প্রকৃত অর্থে অনুকূল ঠাকুর মানবকল্যাণে তার জায়গা-জমি যথাসর্বস্ব উৎসর্গ করে গেছেন। এখানে শ্রীশ্রী অনুকূল চন্দ্রের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ওই সময় লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয় বলে জানা যায়। ভারত থেকেও লোকজন এখানে আসেন।

পাবনা শহরে আমার সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ছিল ভারতের প্রখ্যাত অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের সংগ্রহশালা দেখা। ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল জন্ম হয় এই কিংবদন্তি নায়িকার। ধারণা করা হয়, তার জন্ম হয়েছিল ভারতের বিহার রাজ্যের পাটনায় মামা বাড়িতে। ১৯২২ সালে তার বাবা পৌরসভার স্বাস্থ্য পরিদর্শকের চাকরি পেয়ে যশোরের আদি নিবাস ছেড়ে পাবনা চলে আসেন। পাবনা শহরের গোপালপুরের হেমসাগর লেনে একতলা বাড়ি তৈরি করেন। সেই বাড়িটির গা ঘেঁষেই ছিল হেমসাগর দীঘি। ইছামতি নদী আর সেই হেমসাগর দীঘির সঙ্গে বড় হয়ে উঠতে থাকেন সুচিত্রা।

সুচিত্রা সেন এর বাড়ির উঠোন ও ভেতরের দিক

এ বাড়িটি ঘিরে সুচিত্রাদের ভরপুর সোনালি জীবন ছিল। ১৯৪৭ সালে বিয়ের পর এ বাড়ি ছেড়ে কলকাতা চলে যান সুচিত্রা। ১৯৬০ সালে সুচিত্রার বাবাও বাড়িটি জেলা প্রশাসনের কাছে ভাড়া দিয়ে সপরিবারে কলকাতা চলে যান। আস্তে আস্তে বাড়িটি দখল হতে থাকে এবং ১৯৯০ সালে পুরোপুরি দখল হয়ে যায়। ২০০৯ সালে বাড়িটি দখলমুক্ত করতে পাবনা জেলার সাংস্কৃতিককর্মী এবং সুধীজনেরা একত্রিত হন। গড়ে তোলেন ‘সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ’। তাদের তুমুল প্রতিবাদের মুখে ২০১৪ সালের জুলাইতে বাড়িটি দখলমুক্ত হয় এবং সেখানে স্বল্প পরিসরে সংগ্রহশালাটি গড়ে তোলা হয়।

সুচিত্রা সেন সংগ্রহশালায় সুচিত্রা সেন এর স্মৃতিফলক(বাঁয়ে) এবং মঞ্জুশ্রী চাকির বাড়ি(ডানে)

ছোটবেলা থেকেই সুচিত্রা পড়াশোনার পাশাপাশি নাচ, গান, পেইন্টিংয়ে খুব উৎসাহী ছিলেন। এই উৎসাহের পেছনে অন্যতম অবদান ছিল সংস্কৃতমনা একটি পরিবারের। সে পরিবারের বাসিন্দা ছিলেন মঞ্জুশ্রী চাকি; যিনি একজন বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী হয়ে উঠেছিলেন পরবর্তীকালে। তার বাড়িটি একদম সুচিত্রা সেনের বাড়ির পাশেই। প্রথমে সে বাড়িটি দেখে নিলাম। বেশ পুরোনো আর জমিদারবাড়ির মতো বিশাল বাড়ি। ওই বাড়ির বারান্দায় নাচ, গান, নাটকের মহড়া সব চলত। তখন থেকেই স্কুলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অভিনয় করতে থাকেন সুচিত্রা এবং অভাবনীয় সাড়াও পান।

সুচিত্রা সেন কর্ণার(বাঁয়ে) এবং সুচিত্রা সেনের বিভিন্ন ছবির অনস্ক্রিন প্রদর্শনী(ডানে)

সুচিত্রার নাম ছিল রমা দাশগুপ্ত, ডাকনাম রমা, পাবনার মেয়ে। আজ সুচিত্রা নেই। কিন্তু পাবনা তার স্মৃতি ধরে রেখেছে যতটা সম্ভব। সুচিত্রা সেনের সংগ্রহশালায় তার বিভিন্ন বয়সের ছবি, তার অভিনীত সিনেমার তালিকা, সিনেমার পোস্টার, তার ব্যবহৃত কিছু জিনিস ইত্যাদি রয়েছে। সেখানে প্রবেশ করলে শোনা যায়, তার অভিনীত সিনেমার গান বাজছে। সেই গানের সুর অন্যরকম আবেশ তৈরি করে। জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক জানালেন, ‘কলকাতায় যোগাযোগ করা হয়েছে তার আরও কিছু নিদর্শন পাঠানোর জন্য। সেসব নিদর্শন দিয়ে সংগ্রহশালাটি সাজালে তা আরও সমৃদ্ধ হবে।’ পাবনার রূপকথা রোডে ‘রূপকথার কাব্য’ নামে একটি রেস্টুরেন্ট আছে। সেখানে রয়েছে সুচিত্রার পোর্ট্রেইট, তাকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন বই। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে রয়েছে ‘সুচিত্রা সেন ছাত্রী নিবাস’। অন্নদা গোবিন্দ লাইব্রেরিতে তাকে নিয়ে লেখা বই ও আর্টিকেল সংরক্ষণ করা আছে। রূপকথা রিসোর্টের রুমগুলো তার সিনেমা এবং গানের নাম দিয়ে নামকরণ করা, রুমে রুমে তার ছবি রাখা। একজন মানুষ চলে গিয়েও কী দারুণভাবে থেকে যায়, তাই নাহ্!

সুচিত্রা সেন অভিনীত চলচ্চিত্রের তালিকা

ওহ হ্যাঁ, জাদুঘরটির প্রবেশমূল্য মাত্র ২০ টাকা। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সাপ্তাহিক বন্ধ সোমবার।

সেদিনের মতো পাবনা ভ্রমণ সেখানেই সমাপ্ত করে ফেরার পথ ধরলাম। মনের ভেতর জেগে রইল বাংলার মেয়ে সুচিত্রা সেনের ঐশ্বর্যভরা মুখ।

পাবনায় আরও যা দেখার আছে

সদর উপজেলায় কাচারিপাড়া জামে মসজিদ, কবি বন্দে আলী মিয়ার বাড়ি, জোড় বাংলা মন্দির বা গোপীনাথ মন্দির, রত্নদ্বীপ রিসোর্ট, রূপকথা ইকো রিসোর্ট, এডরুক লিমিটেড এসব দেখতে পারেন। আটঘরিয়া উপজেলায় আছে চন্দ্রাবতীর ঘাট ও বংশীপাড়া স্মৃতিসৌধ, বেরুয়ান জামে মসজিদ, চাচকিয়ার তাঁতশিল্প, চন্দ্রনাথ সেনের জমিদারবাড়ি। ঈশ্বরদী উপজেলায় আছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রাশিয়ান সিটি, ঈশ্বরদী রেল জংশন, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, লালন শাহ সেতু, ঈশ্বরদী বিমানবন্দর, ঈশ্বরদী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, ফুরফুরা শরিফ, বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্র, চিনিকল। চাটমোহর উপজেলায় আছে প্রমথ চৌধুরীর পৈতৃক নিবাস, শাহী মসজিদ, মথুরাপুর মিশন। ফরিদপুর উপজেলায় আছে রাজা রায় বাহাদুরের বাড়ি বা বনওয়ারী নগর রাজবাড়ি। বেড়া উপজেলায় আছে হাটুরিয়া জমিদারবাড়ি বা ১৩ জমিদারবাড়ি। সাঁথিয়া উপজেলায় আছে ক্ষেতুপাড়া জমিদারবাড়ি। সুজানগর উপজেলায় আছে গাজনার বিল, তাঁতীবন্দ জমিদারবাড়ি, পাবনার ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প, আজিম চৌধুরী জমিদারবাড়ি।

কীভাবে যাবেন

সড়কপথে- কল্যাণপুর, গাবতলী বা টেকনিক্যাল মোড় থেকে ঢাকা-পাবনা রুটে বাস চলাচল করে। ভাড়া ৫০০-৯০০ টাকা।
রেলপথে- কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠতে পারেন। ভাড়া ১১৫-৫২৭ টাকা।

কোথায় থাকবেন

পাবনা সদরে হোটেল নিতে পারেন। তা হলে দর্শনীয় জায়গাগুলো সহজে ঘুরে দেখতে পারবেন।

কী খাবেন

ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে খেতে পারেন। প্যারাডাইস সুইটসের মিষ্টি, জলযোগ হোটেলের খাবার, সেতু হোটেলের গরুর বট ও কালাভুনা এবং রাশিয়ান সিটির খাবার খেতে পারেন। পাবনার ঘি খুব ভালো। ঘি নিয়ে আসতে পারেন।

জাহ্নবী

মাদার হাউজে একদিন

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩২ পিএম
আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫৬ এএম
মাদার হাউজে একদিন
ছবি: সংগৃহীত

কলকাতা সময় সকাল ৬টা হবে। সাত সকালে মামি ডাকা শুরু করলেন এই তাড়াতাড়ি ওঠ। আজ আমাদের অনেক জায়গায় যেতে হবে। মা প্রায় ১৮ বছর পর কলকাতায় এসেছেন। ব্যাংক থেকে পাঁচ দিনের ছুটি নিয়ে এসেছি এক ঢিলে দুই পাখি মারার জন্য। একদিকে ভ্রমণ অন্যদিকে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ। সময়ও হাতে কম, তাই আগে থেকেই আমরা কোন দিন কোথায় যাব ঠিক করে নিয়েছিলাম।

ভেবেছিলাম আরও কিছু সময় ঘুমাব কিন্তু মামি আর মায়ের ডাকাডাকির চোটে সুখের ঘুম থেকে উঠতেই হলো। ঘুম থেকে ওঠার পর আবার অত্যাচার শুরু করলেন মামি। এবার খাবারের টেবিলে নাশতা করতে যেতে হবে। এমনি আমি সকালবেলায় তেমন কিছু খাই না। অগত্যা খাবারের টেবিলে গিয়ে বসতে হলো। গরম গরম লুচি, আলুর দম, মিষ্টান্নের ঘ্রাণে মন ভরে গেল। এদিকে টুকুনদার ফোন জলদি নিচে নামার জন্য। টুকুন দা আমাদের কলকাতা ভ্রমণের প্রতিদিনের সঙ্গী। আমরা সিথির মোড়ের ডেরা থেকে বের হলাম। এই সাত সকালেই কলকাতা শহরের রাস্তায় যানজট। ঠিক আমাদের ঢাকা শহরের মতো, গাড়ি যেন এগোতেই চায় না। রাস্তার দুই ধারে পুরোনো আমলের বাড়ি। চুন সুরকি খসে বাড়িগুলো অপূর্ব রূপ ধারণ করেছে। আমার শিয়ালদহ রেলস্টেশন পেরিয়ে এগিয়ে চলছি। শিয়ালদহ রেলস্টেশনে চোখে পড়ল অনেক মানুষের ভিড়।

এই কক্ষে থেকেছেন মাদার তেরেসা  

পথে ট্রামের দেখা মিলল। ছোটবেলায় মায়ের কাছে অনেক গল্প শুনেছি এই ট্রামের। প্রথমবারের মতো দর্শন মিলল ট্রামের। আমাদের আজকের গন্তব্যস্থল মিশনারিজ অব চ্যারিটি। যেখানে শায়িত আছেন মাদার তেরেসা। মাত্র পাঁচ টাকা এবং দশ জনকে নিয়ে শুরু এই মিশনারিজ অব চ্যারিটি। ধীরে ধীরে শহর থেকে রাজ্যে, দেশ ছাড়িয়ে বহির্দেশে। তার তৈরি মিশনারিজ অব চ্যারিটি ছড়িয়ে পড়েছে ১৩৯টি দেশে। সঙ্গে রয়েছেন সেই দুঃখী মানুষ যাদের জন্য এই ‘বিপুল’ কর্মকাণ্ড। 

সেই ‘বিপুলে’র টানে এই শহরে ছুটে এসেছেন মোহম্মদ আলি, ডমিনিক ল্যাপিয়ের, ইয়াসির আরাফাত, যুবরাজ চার্লস, ডায়নাসহ তাবড় তাবড় খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। আমরা যাচ্ছি সেই মাদার হাউজে। আমাদের পথ নির্দেশক মামি নিজেও কখনো যাননি মাদার হাউজে। শুধু শুনেছেন বোস রোডে রয়েছে মাদার হাউজ। আমরা বোস রোডে এসে পৌঁছালাম। রাস্তা চিনতে না পারায় অগত্যা ট্রাফিক পুলিশের সাহায্য নিতে হলো। সামনে যেতেই দেখা পেলাম সেই কাঙ্ক্ষিত মাদার হাউজের। চারতলা ভবন, দেয়ালে মার্বেল পাথরে খোদাই করা লেখা MISSIONARIES OF CHARITY। বাঁ দিকে গলির ভেতর ঢুকতেই চোখে পড়ল মাদার তেরেসার মূর্তি। বড় সাইনবোর্ডে লেখা The Mother House। পুরোনো দিনের ভবন আর সেই আগের দিনের জানালা। প্রবেশপথে বাইরের দেশের অনেক লোকের দেখা পেলাম। আমরা নগ্ন পায়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম।

অসাধারণ পরিবেশ, নিঃশব্দ নীরবতা। একটি ঘরের দিকে সবাই যাচ্ছে, আমরাও তাদের পথ অনুসরণ করলাম। আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম। শান্তির দূত শায়িত আছেন। সবাই বসে নীরবে প্রার্থনা করছেন, কেউ কেউ অঝোরে চোখের জল ফেলছেন। ধূপকাঠির মোহিত গন্ধ আর পরিবেশ যে কারও খুব ভালো লাগবে। মাদারের সমাধির পাশে বসে প্রার্থনা করার অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না। আমরা বসে কিছু সময় প্রার্থনা করলাম। চোখে পড়ল একপাশে লেখা ‘These flower were placed on Mother tomb. You are most welcome to take them as a blessing।’

আমি একটি কাগজে আমার প্রার্থনা মাদারের কাছে লিখে নির্ধারিত স্থানে দিলাম। এক পাশে একটি কাপড়ের মধ্যে দেখতে পেলাম বিভিন্ন দেশের মানুষের অনুভূতিগুলো নানান ভাষায় লিপিবদ্ধ করা। আমি বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম। পাশের কক্ষে প্রবেশ করলাম। এখানে বেশ বড় লাইব্রেরি কক্ষ। এখানে ছবি তোলা নিষেধ। এই কক্ষে মাদার তেরেসার ব্যবহৃত সামগ্রীগুলো সুন্দর করে সাজানো আছে। সেখান থেকে মাদার তেরেসার জীবনী নিয়ে একটি বই উপহার পেলাম। বইটি তিনটি ভাষায় রচিত। এরপর আমরা গেলাম শান্তির দূত যেখানে তার জীবনের বেশির ভাগ সময় পার করেছেন। দোতালার ছোট্ট একটি কক্ষ। তার মাঝে একটি খাঁটিয়া পাশে একটি টেবিল আর চেয়ার। বাইরে থেকে ভেতরে প্রবেশ নিষেধ তাই আমরা বাইরে দাঁড়িয়েই দেখলাম। আমি মনে মনে ভাবলাম এই দালানের প্রতিটি স্থানে মাদার তেরেসার পদধূলি পড়েছে। এ রকম একটি স্থানে আসতে পারা ভাগ্যের ব্যাপার। নিচে আমরা মাদার তেরেসার জীবনী নিয়ে রচিত বিভিন্ন কথামালার দিকে মনোনিবেশ করলাম। দেখা মিলল সিস্টার সিজের।

তিনি আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে খুব খুশি হলেন। তিনি বললেন, তিনিও বাংলাদেশ এসে ঘুরে গেছেন। তিনি আরও বললেন, বিশ্বে মানবসেবায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করা মানবাধিকার কর্মী মাদার তেরেসাকে সন্ত ঘোষণা করেছেন পোপ ফ্রান্সিস। গত ৪ সেপ্টেম্বর ভ্যাটিকান সিটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে মাদার তেরেসাকে সন্ত ঘোষণা করেন পোপ। সন্ত হওয়ার প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করেছেন মাদার তেরেসা। দুটি ঘটনাকে অলৌকিক বলে স্বীকৃতি দেয় ভ্যাটিকান এবং সর্বশেষে পোপ। সন্ত হওয়ার শর্ত হিসেবে প্রথম ঘটনা ঘটে ১৯৯৮ সালে। পশ্চিমবঙ্গের এক আদিবাসী নারী মণিকা বেসরার পেটের টিউমার সেরেছিল মাদার তেরেসার নামে প্রার্থনা করে। অন্যটি ঘটে ২০০৮ সালে ভ্যাটিকানের দাবি, ওই বছর ব্রাজিলে মাদার টেরেসার নামে প্রার্থনা করে সুস্থ হন এক যুবক যার মস্তিষ্কে একাধিক টিউমার ছিল।

আরও পড়ুন: ফরাসিদের স্মৃতিবিজড়িত শহর চন্দননগর

৫ সেপ্টেম্বর মাদারের ১৯তম মৃত্যুদিন। তার ঠিক আগের দিন রোমে ‘বিয়েটিফিকেশন’ অনুষ্ঠানে মাদারকে ‘সন্ত’ ভূষিত করবেন পোপ ফ্রান্সিস। তার কথার সঙ্গে চোখে জল চলে এল। এ অশ্রু আনন্দের, তার সঙ্গে আমরা ছবি তুললাম। দেখতে দেখতে আমাদের বিদায় নেওয়ার পালা চলে এল আমরা চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের দিকে। বলে রাখা ভালো মাদার হাউজের দর্শন পেতে হলে আপনাকে যেতে হবে সকাল ৮টা থেকে ১২টার ভেতর আর বিকেল বিকেল ৩টা থেকে ৬টার মধ্যে। বৃহস্পতিবার মাদার হাউজ বন্ধ থাকে।

যাবেন কীভাবে
কলকাতা বিমানবন্দর, রেলস্টেশন, সড়কপথে মাদার হাউজের যেতে আপনাকে ট্যাক্সি অথবা অটো ভাড়া করে এজিসি বোস রোডে পৌঁছাতে হবে। সেখনে যে কাউকে বললে দেখিয়ে দিবে মিশনারিজ অব চ্যারিটি অথবা মাদার হাউজ।

 কলি