
ঘড়ির কাঁটায় বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টা বেজে ১৫ মিনিট আর নেপাল সময় দুপুর ১টা, আমরা আছি নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সকালবেলা বাংলাদেশ বিমানের বিজি ৭০৭ চেপে হিমালয়কন্যার কাছে এসেছি। আসার অবশ্য কারণও আছে। আমারা এসেছি নেপাল-বাংলাদেশ ইয়ুথ কনক্লেভের অনুষ্ঠানে।
নেপাল এয়ারপোর্টে আমাদের নেপালের ঐতিহ্যবাহী টুপি আর উত্তরীয় দিয়ে বরণ করেন অনুষ্ঠানের প্রধান সমন্বয়ক অভিনব দাদা। আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে আরও অনেকেই উড়াল দিয়ে এসেছেন এই আয়োজনে অংশ নিতে। আমরা একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হলাম। মোবাইলের সিম কিনলাম এয়ারপোর্ট থেকেই। আনুষঙ্গিক সব কাজ শেষ করে এবার আমরা চেপে বসলাম চার চাকার বাহনে। সূর্যদেবের উষ্ণ অভ্যর্থনা আমাদের বেশ ভালোই লাগছিল। আমরা আসার আগে ভেবেছিলাম খুব ঠাণ্ডা পরে হয়তো নেপালে তবে এতটা ঠাণ্ডা অনুভূত হলো না। আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের হোটেল পানে। চলতি পথে আমাদের দেশের মতো রাস্তায় যানজটের দেখা পেলাম।
ধীরগতিতে চলছিল আমাদের চার চাকার বাহন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা চলে এলাম থামেলের প্রান্তে। থামেল জায়গাটি আমাদের শাঁখারীবাজার বা লক্ষ্মীবাজারের মতোই। বলা যায় যেকোনো পুরোনো জেলা শহরের বড় বাজার এলাকাটি যেমন, তেমনই। কিন্তু অনেক কালারফুল। পথে পর্যটকে ঠাসা। দেখে মনে হলো অধিকাংশই পশ্চিমা। ছোট ছোট দোকানঘর। হরেক রকম পসরা সাজানো। আমি এক দৃষ্টিতে গাড়ির বাইরে তাকিয়েছিলাম। অনুভব করছিলাম থামেল শহরের স্পন্দন। বেশির ভাগ হস্তশিল্পের জিনিস।
পিতলের, তামা, পাথর, মাটি, শোলা, কাঠ বিভিন্ন সহজলভ্য উপাদানে তৈরি এসব। হাতের নিখুঁত কারুকাজ, রঙের ছটা, তুলির আঁচড়, ঢালাইয়ের পেটা কাজ প্রভৃতি বিভিন্নভাবে শিল্প সৃষ্টি হয়েছে। অভিনব দা ঘোষণা দিলেন আমরা হোটেলের কাছে চলে এসেছি। এখন গাড়ি থেকে নেমে পদব্রজে যেতে হবে সামান্য একটু পথ। আমরা গাড়ি থেকে নেমে গলির পথে এগিয়ে চললাম। গলির ভেতরে ছোট ছোট দোকান যার বেশির ভাগই নারীরা পরিচালনা করছেন। আমরা প্রবেশ করলাম সাতকার হোটেল অ্যান্ড স্পা’তে। প্রবেশের পর আমাদের ওয়েলকাম ড্রিংকস পরিবেশন করা হলো। মনে হলো আসল তরমুজের স্বাদ। এরপর আমাদের প্রত্যেকের রুমের চাবি বুঝিয়ে দেওয়া হলো।

আমরা অস্থায়ী ডেরায় প্রবেশ করলাম। বেশ ছিমছাম গোছানো। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে বের হলাম দুপুরের পেটপূজার জন্য, যদিও নেপাল সময় তখন বিকেল ৫টা। আমরা চলে এলাম নেপালি এক খাবার হোটেলে। যার যেমন পছন্দ তেমনি এক:এক মেন্যু অর্ডার করলেন। আমরা নিলাম নেপালি ভেজ থালি। অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের খাবার পরিবেশন করা হলো। এক থালাতেই সব অল্প অল্প করে সাজানো। শাঁক, আলু ভর্তা, ডাল, বরবটি আলু দিয়ে তরকারি, বাদামের তরকারি, আচার, দই। তার ওপর খাঁটি ঘি দিয়ে গেলেন খাবার পরিবেশনকারী। পেটে চলছিল রাম-রাবণের যুদ্ধ, সেই সকাল বেলায় দানাপানি পড়েছিল। তাই আর ভদ্রতা না করে খাওয়া শুরু করলাম।
খাবার নয়, যেন অমৃত খাচ্ছি। নেপালিদের অথেনটিক খাবারের রেস্টুরেন্ট এটি। নেপালিরা ফ্রেশ রান্না করে, বাসি খাবার রাখে না, উচ্ছিষ্ট খায় না একদমই। বেঁচে যাওয়া খাবার ডিশে থেকে গেলে বা হাতের স্পর্শ ছাড়া বেড়ে নেওয়া হলে তা-ও উচ্ছিষ্ট বলে ধরে নেন। এজন্য খাবার আসতে সবখানেই সময় লাগে একটু বেশি। একদল পরিকল্পনা করল নাগরকোট যাবে, কেউ যাবে আবার চন্দ্রা গিরি হিল। পেটপূজা শেষ করে আমরা বের হয়ে পড়লাম থামেলের পথে প্রান্তরে। সূর্যদেব তখন অস্তাচলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সন্ধ্যা ক্রম আসন্ন। পাহাড়ের উপত্যকার শহর। রাত নামে দ্রুত, শহর ঘুমিয়ে পড়ে আগে আগে। যখন জেগে ওঠে অন্যরকম আরেকটি শহর। আমরা পদব্রজে এগিয়ে চলছি। থামেলের পথে প্রান্তরে বিভিন্ন ধরনের দোকানের দেখা পাওয়া যায়।
কেউ ঠাণ্ডার কাপড় বিক্রি করছেন, কেউবা পিতলের সামগ্রী, কেউ আবার হিমালয় ট্র্যাকিং করার সামগ্রী আবার কেউ কেউ বিভিন্ন ধরনের চা। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবকিছুই পাবেন এই থামেলে। আমরা একটি দোকানে প্রবেশ করলাম। দোকানে গৃহসজ্জার সামগ্রী বিক্রি হয়, সবই পিতলের। কিছু নিকেল করা। আমাদের দেশের এলিফ্যান্ট রোডের পিতলের দোকানগুলোর মতোই। অসাধারণ কারুকাজ দেখলেই কিনতে মনে চাইছিল। পরে ভাবলাম আরেকটু দেখি অন্য দোকান আরও ভালো কিছু পাব হয়তো। আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম পরের দোকানের দিকে।
এবার একটি মেডিটেশন বোল দেখে চোখ আটকে গেল। মেডিটেশন বোলের শব্দ আপনাকে নিয়ে যাবে এক অন্য ভুবনে। দামাদামি করে কিনে নিলাম। রাতের গভীরতা বাড়ছে পাহাড়ের উপত্যকার শহরে। রাতের গভীরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে থামেলের চিত্র পরিবর্তিত হতে লাগল। তখন সে এক অন্য থামেল। বিদেশিদের আনাগোনা বাড়ছে।
পাব ও নাইট ক্লাব খুলে গেছে। ক্লাবগুলোর বাইরে মানুষের ভিড়। মিউজিকের উত্তাল তরঙ্গে যে কাউকেই ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। থামেল শহরের পুরোনো অংশ। ঘরবাড়ি অধিকাংশই পুরোনো। আমাদের জমিদার বাড়িগুলোর মতো। ভবনগুলোর প্রধান দরজা কাঠের, নকশা করা। মনে হয় একেকটি রাজবাড়ির প্রবেশদ্বার। এরই রেপ্লিকা স্বর্গের দরজা নামে এখানকার দোকানে বিক্রি হয়। স্থানে স্থানে সমদ্বিবাহু ত্রিভুজের রঙিন কাগজ বা পলিমার দড়িতে টাঙানো।
কোনো কোনোখানে এর সঙ্গে মরিচবাতি দেওয়া। ছবি বিক্রির দোকানের সামনে গিয়ে আমরা দাঁড়ালাম। বেশির ভাগ ছবিই হিমালয়, হিমালয়ের পাদদেশে জনজীবন, বুদ্ধদেব ও বুদ্ধচক্রের। হিমালয়ে সূর্যোদয়, পাহাড়ে চমরি গাইয়ের দল, পাহাড়ি পরিশ্রমী মানুষের ঋজু চেহারা, তাদের জীবিকার সুকঠিন সংগ্রামের ছবি…। এই শহরে পর্যটকের অভাব নেই। বিশেষ করে থামেলে তো বিদেশিই বেশি। সেই বিদেশি পর্যটকের মধ্যে তরুণী, বৃদ্ধা, সুন্দরী, অসুন্দরী সব রকম নারীই আছেন। পোশাকও তাদের বিচিত্র রকম।
কীভাবে যাবেন
বাংলাদেশ থেকে নেপালে বিমানযোগে যাওয়া যায়। যাওয়া-আসার টিকিট নিয়ে ১৮ থেকে ২২ হাজার টাকার মতো খরচ পড়বে। আগে টিকিট কাটতে পারলে ১৭ হাজার টাকার মতো হতে পারে। বাই রোডে নেপাল যেতে হলে খরচ কমে যাবে অনেকটা। সেক্ষেত্রে ভারতের ট্রানজিট ভিসা নিতে হবে যেখানে পোর্টের নাম দিতে হবে চ্যাংরাবান্ধা বা রানীগঞ্জ। এখানে বা বিমানে কোনোটাতেই নেপালের ইমিগ্রেশনে কোনো ভিসা ফি’র দরকার নেই যদিনা আপনি একই বছরে দুবার ভ্রমণ করতে চান। এসআর পরিবহন সরাসরি বাই রোডে নেপালের বাসের সেবা দিচ্ছে। চাইলে ভেঙে ভেঙে ভারতের বর্ডার পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে নেপালের কাঁকড়ভিটা পর্যন্ত যেতে পারেন। এতে খরচ পড়বে প্রায় ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকার মতো।
কোথায় থাকবেন
থাকতে হলে থামেলের চেয়ে উপযুক্ত স্থান আর দ্বিতীয়টি নেই। কারণ, পুরো থামেলের গলি-ঘুপচিতে অসংখ্য হোটেল/ব্যাকপ্যাকার হোস্টেল রয়েছে। ১০০০ থেকে ১৮০০ রুপির মধ্যে ভালো ডাবল রুমের বাজেট হোটেল এখানে পাওয়া সম্ভব। ৪০০ রুপিতে সিঙ্গেল রুমের হোটেলও এখানে আছে। বাজেট আরেকটু বেশি যেমন ৩০০০ রুপি বা তার বেশি হলে ডিলাক্স রুমের খাবারসহ অনেক ভালো হোটেল পাওয়া যায়। তবে থামেলের হোটেল এবং তাদের দরদাম ও চেহারা এত বেশি বৈচিত্র্যময় যে, আগে থেকে বুকিং না দিয়ে বরং হেঁটে ঘুরে কয়েকটি হোটেল ঘুরে যাচাই-বাছাই করলে সস্তায় ভালো হোটেল পাওয়া সম্ভব।
কলি