
বরেন্দ্রভূমি আমার কাছে বুকের ভেতর জেগে থাকা একটা জায়গার নাম। এ ভূমির পরতে পরতে মায়ার বিস্তার। এই মায়াপুরে কাটানো দুদিনের গল্প বলব আজ। প্রতিবারই কাকতালীয়ভাবে শীত মৌসুমে রাজশাহী যাওয়া হয় আমার। অন্য মৌসুমে এই জেলা দেখতে কেমন, তা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়নি। এবারেও রাতের ট্রেনে করে চলে গেলাম রাজশাহী; পৌঁছালাম শীতের নরম ভোরে। তখন সুয্যিমামা তার সোনালি আলো ছড়াতে শুরু করেছে। সেই আলো এসে পড়েছে রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের গায়ে। কী যে অপূর্ব সেই সোনামাখা দৃশ্য!
আত্মীয়ের বাসায় উঠে সকালের নাশতা সেরে বিশ্রাম নিলাম কিছুক্ষণ। তার পর রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঘুরতে। প্রথমে গেলাম সদরে অবস্থিত বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে।
প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহের জন্য এ জাদুঘরটি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম। শুধু তাই নয়, এটিই বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর। এ জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় নাটোরের দিঘাপাতিয়া রাজপরিবারের জমিদার শরৎ কুমার রায়, আইনজীবী অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এবং রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক রামপ্রসাদ চন্দ্রের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে তারা বাংলার ঐতিহ্য ও নিদর্শন সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি গঠন করেন। ওই বছরে তারা রাজশাহীর বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান চালিয়ে ৩২টি দুষ্প্রাপ্য নিদর্শন সংগ্রহ করেন।
এই নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করার জন্য শরৎ কুমার রায়ের দান করা জমিতে জাদুঘরটির নিজস্ব ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। নির্মাণ শেষ হয় ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে। একই বছরের ১৩ নভেম্বর বাংলার তৎকালীন গভর্নর কারমাইকেল জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন। মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ছাড়াও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি এই জাদুঘরটি পরিদর্শন করেছেন। জাদুঘরটিতে অনেক পুরোনো দিনের নিদর্শন রয়েছে। মহেঞ্জোদারো সভ্যতা থেকে সংগৃহীত প্রত্নতত্ত, পাথরের মূর্তি, খ্রিষ্টীয় একাদশ শতকে নির্মিত বুদ্ধমূর্তি, গঙ্গামূর্তিসহ অসংখ্য মূর্তি এই জাদুঘরের অমূল্য সংগ্রহের অন্তর্ভুক্ত। মোগল আমলের রৌপ্য মুদ্রা, গুপ্তসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের গোলাকার স্বর্ণমুদ্রা, সম্রাট শাহজাহানের গোলাকার রৌপ্য মুদ্রাও রয়েছে সংগ্রহে। এখানে প্রায় ৫,০০০ পুঁথি রয়েছে, যার মধ্যে ৩,৬৪৬টি সংস্কৃত আর বাকিগুলো বাংলায় রচিত।
.jpg)
জাদুঘর দেখা শেষ করে গেলাম টি-বাঁধে। পেয়ারা মাখা খেয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর চলে গেলাম রুয়েটে। রুয়েট আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পাশাপাশি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাজ্জাদের লেবুচুরের বেশ সুনাম রয়েছে। তাই রুয়েট থেকে গেলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেবুচুর খেতে এবং তা খেয়ে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি। তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা আর বধ্যভূমি দেখে মন খুব ভার হয়ে গেল। সংগ্রহশালা দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে উঠেছিল জলে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল প্রায়। প্রথম দিনের ঘোরাঘুরি এভাবেই শেষ হলো।
দ্বিতীয় দিনের ভ্রমণটা ছিল সবচেয়ে স্মরণীয়। আমার ইচ্ছে ছিল, রাজশাহীর কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে গরুর গাড়িতে চড়ব। হারিকেন জ্বালিয়ে ঝুলিয়ে দিব সেই গাড়িতে। আর সরিষাখেতের পাশে বসে মাটির সানকিতে করে খিচুড়ি খাব। আমার ইচ্ছে পূরণ করতে কিছু মাটির সানকি কেনা হলো। খুঁজে খুঁজে গরুর গাড়ি না পেয়ে মহিষের গাড়ি জোগাড় করা হলো। একটা হারিকেনের বন্দোবস্তও করা হলো। শুধু তাই নয়, আমার জন্য ভাপা পিঠাও বানানো হলো। আর খিচুড়ির সঙ্গে মুরগির মাংস, বেগুন ভাজা, ডিম ভাজা এসবের আয়োজন করা হলো। আমি ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম আমার ইচ্ছে পূরণে কাছের মানুষগুলোর এই কর্মযজ্ঞ দেখে।
প্রাইভেট কারে প্রথমে রাজশাহীর পবা উপজেলার এক গ্রামে গেলাম। খুব প্রত্যন্ত না হলেও খাঁটি গ্রাম বলা যায় অবশ্যই। গ্রামের নাম ভুগরইল। প্রথমে সরিষাখেতের পাশে বসে খিচুড়ি খেলাম আয়েশ করে। তখন বিকেল বেলা। এরপর ঠিক করে রাখা মহিষের গাড়িতে উঠে বসলাম। ফসলের মাঠের আলপথ ধরে যাচ্ছিলাম আর মুগ্ধচিত্তে অনুভব ঘনিয়ে এলে হারিকেন জ্বালানো হলো। সূর্য ডুবে গেল, অন্ধকার গাঢ় হতে লাগল। সবুজ ফসলের মাঠে ছন্নছাড়া অন্ধকার খেলা করতে শুরু করল রাত নামাবে বলে। জীবনে এত অভূতপূর্ব মুহূর্ত বারবার আসে না।
এক আকাশ স্বপ্ন পূরণের উচ্ছ্বলতা নিয়ে ফিরে এলাম রাজশাহী শহরে। সিঅ্যান্ডবি মোড়ে এক লেখকের সঙ্গে দেখা করে শিক কাবাবের বার্গার খেলাম আর কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে এবারের রাজশাহী ভ্রমণের সমাপ্তি টানলাম।
রাজশাহীতে আরও যা যা দেখার আছে
রাজশাহী সদরে আছে জিয়া শিশুপার্ক, পদ্মা গার্ডেন, মুক্তমঞ্চ, শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী পার্ক বা সেন্ট্রাল পার্ক। পবা উপজেলায় আছে শাহ্ মখদুম বিমানবন্দর, গরু-মহিষের বাজার, হস্তশিল্পপল্লী। পুঠিয়া উপজেলায় আছে পুঠিয়া রাজবাড়ি, রাজবাড়িসংলগ্ন একাধিক মন্দির, দোল মন্দির, হাওয়াখানা। মোহনপুর উপজেলায় আছে পানের বরজ। তানোর উপজেলায় আছে চোলকুরের জমিদারবাড়ি, কিশোর মোহন চৌধুরী জমিদারবাড়ির শত বছরের শিবমন্দির, সাঁওতালপল্লী, গরু-মহিষের গাড়ি, কামার-কুমারপল্লী, বাঁশের হস্তশিল্পপল্লী, নাইস গার্ডেন পার্ক। চারঘাট উপজেলায় আছে সারদা ক্যাডেট কলেজ, সারদা পুলিশ একাডেমি, হাজার বছরের পুরোনো বৃক্ষ, সরদহ রেলওয়ে স্টেশন, তাঁতপল্লী, নীলকুঠি, খয়ের প্রস্তুতকরণ এলাকা। গোদাগাড়ি উপজেলায় আছে বরেন্দ্র পার্ক, সাফিনা পার্ক, সরমংলা ইকোপার্ক, মৃৎপল্লী, সাঁওতালপল্লী, গরু-মহিষের গাড়ি, ধানসিঁড়ি খেত। বাগমারা উপজেলায় আছে হাজার দুয়ারী জমিদারবাড়ি (বীরকুৎসা নামেও পরিচিত), তাহেরপুর রাজবাড়ি, গোয়ালকান্দি জমিদারবাড়ি। বাঘা উপজেলায় আছে বাঘা শাহী মসজিদ ও তৎসংলগ্ন বাঘা দীঘি, উৎসব পার্ক, বাঘা জাদুঘর, বাঘা দরগাহ শরিফ ইত্যাদি।
কীভাবে যাবেন
ঢাকার কল্যাণপুর থেকে বাসে যেতে পারেন। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে যেতে পারেন। বিমানেও যেতে পারবেন রয়েছে এই সুন্দর শহরে।
কী খাবেন
কালাভুনা, সিঅ্যান্ডবি মোড়ের গরম মিষ্টি, বট পরোটা, বীরেন রেস্তোরাঁর কলিজা সিঙ্গারা, খাসির মাংসের চপ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাজ্জাদের লেবুচুর, টি-বাঁধের পেয়ারা ও আচার মাখা, শিক কাবাবের বার্গার, নবরূপা আর মৌচাকের মিষ্টি এবং আম।
কোথায় থাকবেন
রাজশাহী শহরেই থাকার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট হোটেল রয়েছে।
কলি