
কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকত, যেখানে সোনালি বালু আর নীল আকাশ মেলে ধরেছে এক অপূর্ব দৃশ্য, সেখানে এমন এক রিসোর্ট রয়েছে, যা আপনাকে এনে দেবে সম্পূর্ণ অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা। শরতের সোনালি রোদের আলিঙ্গনে যখন আমি প্রথম রিসোর্টে প্রবেশ করি, মনে হচ্ছিল যেন একটি পুরনো বইয়ের পাতায় পা রেখেছি। মৃদু-মন্দ সাগরের হাওয়া, সোনালি আভায় ভেসে থাকা বালুকাবেলা, আর চারপাশে অগণিত গাছপালা- এই দৃশ্য যেন কিছুটা কবিতার মতো, যেখানে সময় থেমে গেছে।
মারমেইড বিচ রিসোর্ট, যা মেরিন ড্রাইভ রোডের পাশে পেঁচার দ্বীপের কোনে অবস্থিত, কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্যই নয়, এখানে আসলে এক অনন্য প্রশান্তির ছোঁয়া পাওয়া যায়। শরতের সোনালি রোদ আর মৃদু বাতাসের মাঝে সেখানে দুই রাত কাটিয়ে, মনে হয়েছে সময় যেন থমকে গেছে, আর প্রকৃতি আপনাকে তার আদর-মাখানো গান শুনিয়েছে।
রিসোর্টের কটেজগুলো যেন নিজেই একেকটি ছোট্ট পৃথিবী। বাঁশ আর পুনর্ব্যবহৃত কাঠ দিয়ে তৈরি, কটেজগুলো আধুনিক সুবিধার পাশাপাশি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক নিখুঁত মেলবন্ধন। গাছের ছায়ায় ঘেরা আমার কটেজটি যেন এক পুরনো গল্পের অংশ, যার প্রতিটি কোনে লুকিয়ে ছিল কিছু অজানা রহস্য। খোদাই করা কাঠের দরজা, স্থানীয়ভাবে তৈরি সজ্জা, আর সোনালি আলোয় স্নিগ্ধ লণ্ঠন- সবকিছু যেন আহ্বান জানাচ্ছিল- ‘আর একটু থাকুন, এখানে আরও কিছু মধুর স্মৃতি তৈরি করুন।’
প্রকৃতির সিম্ফনি, পাখির গান আর সমুদ্রের দূরবর্তী আওয়াজ- এখানে সকালের শুরুটা যেন একদম আলাদা। প্রথম সকালে, ঢেউয়ের ছন্দের মাঝে চোখ মেলে দেখলাম সমুদ্রের অপরূপ দৃশ্য। কফির কাপ হাতে, বারান্দায় বসে আমি শুধু তাকিয়ে ছিলাম। শান্ত, মৃদু বাতাস আর সমুদ্রের লবণাক্ত গন্ধে মন যেন আরও বেশি প্রকৃতির সান্নিধ্যে চলে যাচ্ছিল। এক মুহূর্তে, সময় যেন থেমে গিয়েছিল।
কিন্তু মারমেইড বিচ রিসোর্ট শুধুই নিঃসঙ্গতার স্থান নয়। এখানে সক্রিয়তার খোঁজে থাকা মানুষের জন্যও অনেক কিছু আছে। কায়াকিং, সাইকেল রাইডিং, অথবা সৈকতের ধারে পায়ের তলায় বালির অনুভূতি- সবকিছুই অপেক্ষা করছে আপনাকে অভ্যর্থনা জানাতে। এক বিকেলে, আমি সাইকেল নিয়ে রিসোর্টের চারপাশে ঘুরতে বের হই, আর হঠাৎ অনুভব করি, যেন দিগন্তের সীমাহীনতা আমাকে এক নতুন জীবন দেখাচ্ছে। বাতাসের টানে মাথার চুল উড়ছে, আর সমুদ্রের ধারে এই অসীম দৃশ্য মনে হয় যেন কোনো শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা ছবি।
রিসোর্টের রেস্তোরাঁর খাবার ছিল এক চমৎকার রন্ধনশিল্পের উদাহরণ। স্থানীয় উপাদান দিয়ে তৈরি প্রতিটি পদ যেন এক নান্দনিক রচনা। এক সন্ধ্যায়, আমি গ্রিলড পমফ্রেট খেয়েছিলাম- এটির ধোঁয়ামাখা গন্ধ, আর ট্যাঞ্জি আম সালসার সঙ্গে তার সমন্বয় ছিল এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। পরের রাতে নারকেল থেকে তৈরি একটি ডিজার্ট খেয়েছিলাম, যা মনে করিয়ে দিয়েছিল- যত সহজই হোক না কেন, আন্তরিকতা দিয়ে প্রস্তুত করা যেকোনো খাবার অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে।
মারমেইড বিচের সন্ধ্যাগুলো যেন এক বিশেষ মায়ায় রঙিন। প্রথম রাতে, সৈকতে লাইভ মিউজিক ছিল, আর আগুনের নরম আলো ছড়ানো ছিল সুরে সুরে। গিটারিস্টের বাজানো সুর যেন তরঙ্গের ধ্বনির সঙ্গে মিলে এক অভূতপূর্ব সংগীত রচনা করছিল। দ্বিতীয় রাতে, পূর্ণিমার আলোতে সৈকতের ধারে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়েছিল, এ যেন এক অপার্থিব অভিজ্ঞতা। আমার পায়ের তলায় শীতল বালি সমুদ্রের অপরূপ আলোয় চমকাচ্ছিল।
মারমেইড বিচ রিসোর্টের একটি অতিরিক্ত সৌন্দর্য রয়েছে, যা সাধারণত এমন রিসোর্টগুলোর মাঝে দেখা যায় না- এটি পরিবেশবান্ধব একটি রিসোর্ট, যা প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে। রিসোর্টের স্থাপত্য নকশা থেকে শুরু করে তার কার্যক্রম পর্যন্ত- সবকিছুতে পরিবেশের সঙ্গে খাপখাইয়ে চলার ছাপ। সৌরশক্তি ব্যবহার করে আলোকসজ্জা, বৃক্ষরোপণ প্রকল্প, আর ইকো-ফ্রেন্ডলি কাঠামো- সবকিছুই রিসোর্টটির পরিবেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে। বিশেষ করে, পেঁচার দ্বীপের সবুজে ঘেরা প্রকৃতি, যা রিসোর্টের একেবারে কাছেই অবস্থিত, তা যেন প্রাণী ও গাছপালার একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে।
আরেকটি দিক যা আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে, তা হলো রিসোর্টের স্থানীয় সম্প্রদায়ের প্রতি দায়বদ্ধতা। অনেক কর্মী এখানকার আশপাশের গ্রাম থেকে আসে এবং রিসোর্টটি স্থানীয় কৃষক ও কারিগরদের সহযোগিতা করে, যা এ ধরনের পর্যটন ব্যবসায় খুবই বিরল। রিসোর্টের সাবান, যা স্থানীয় সমবায় থেকে তৈরি, অথবা আমার সালাদের সবজি, যা মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি খামার থেকে সংগ্রহ করা- এসব প্রমাণ করে যে পর্যটন শুধু আনন্দের জন্য নয়, বরং দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করলে এর মাধ্যমে ব্যবসার পাশাপাশি স্থানীয় ভূমি ও সংস্কৃতিকেও সহযোগিতা করা সম্ভব।
রিসোর্টের শেষ সকালে, যখন আমি সৈকতে বসে সূর্যোদয় দেখছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল, যেন এই স্থানে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তই এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। এটি শুধু একটি থাকার স্থান নয়, বরং এ এক নতুন জীবন যাপনের পদ্ধতি- প্রকৃতির সঙ্গে, নিজের সঙ্গে, আর জীবনের সরল আনন্দের সঙ্গে মেলবন্ধনের জায়গা।
কলি