ঢাকা ৯ চৈত্র ১৪৩১, রোববার, ২৩ মার্চ ২০২৫
English

ভালোবাসা দিবসে যেখানে ঘুরতে যাবেন

প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:১১ পিএম
ভালোবাসা দিবসে যেখানে ঘুরতে যাবেন
ছবি: সংগৃহীত

ভালোবাসা দিবস উদযাপনের জন্য প্রিয় মানুষের সঙ্গে ঘুরতে যেতে পারেন। ঢাকার কাছেই কিছু দর্শনীয় জায়গা রয়েছে। যেখানে প্রিয়জনকে নিয়ে অল্প খরচের মধ্যে ঘুরতে গেলে সময় ভালো কাটবে। 

দোয়েল চত্বর ও কার্জন হল
কার্জন হল জায়গাটির একটি বিশেষ আকর্ষণ আছে। পুরো এলাকাটি পুরোনো স্থাপত্যের যে ছাপটি আছে, তা একটি প্রাচীন ভাব এনে দেয়। এখানকার বিভিন্ন ভবনের পুরোনো কাঠের সিঁড়িতে বসে খানিকটা সময় কাটিয়েই দেওয়া যায়। কার্জন হল থেকে বেরিয়েই দোয়েল চত্বর যেতে পারেন। সেখানে আপনি বিভিন্ন হস্তশিল্প কেনাকাটা করতে পারবেন। বেশ কিছু ছোট নার্সারি, যেখান থেকে বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় গাছ ও উপহার দিতে পারবেন।

আহসান মঞ্জিল ও লালবাগ কেল্লা
পুরান ঢাকায় বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত আহসান মঞ্জিল একসময় ঢাকার নবাবদের আবাসিক প্রাসাদ ও জমিদারির কাছারি হিসেবে ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। একই নদীর তীরে লালবাগ এলাকায় অবস্থিত মোগল স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন লালবাগ কেল্লা। মূল তিনটি ভবনের সমন্বয়ে (মসজিদ, পরী বিবির সমাধি এবং দেওয়ান-ই-আম বা দরবার হল) স্থাপনাটি গঠিত। আরও আছে কিছু ফোয়ারা এবং সর্বসাধারণের জন্য শায়েস্তা খাঁর বাসভবনে তৈরি করা জাদুঘর। চাইলে প্রিয়জনকে নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন এই ঐতিহাসিক জায়গাগুলোতে।

বইমেলা
বইমেলা জায়গাটা ঠিক ঘোরার জায়গা নয়, তবে ভালোবাসা দিবসে বইমেলায় থাকে তরুণ-তরুণীদের উপচে পড়া ভিড়। মেয়েরা লাল শাড়ি ও চুলের খোপায় ফুলের মালা পরে, তার সঙ্গে মিলিয়ে ছেলেরা পাঞ্জাবি পরে বইমেলায় ভিড় জমান। আপনার ভালো লাগার মানুষটিকে নিয়ে গিয়ে বই দেখতে বা কিনতে যেতেই পারেন।

মিরপুর বেড়িবাঁধ
মিরপুর বেড়িবাঁধে এলে হারিয়ে যেতে পারেন ট্রাফিক জ্যাম মুক্ত হাইওয়েতে। দেখতে পাবেন দুই পাশে গাছের সারি, দিগন্ত বিস্তৃত খোলা প্রান্তর, দূরে সবুজ গ্রাম আর রুপালি পানির নদী। এখানে রয়েছে বিভিন্ন ভাসমান রেস্তোরাঁ এবং বিনোদন পার্ক। সেখানেও সময় কাটাতে পারেন। রয়েছে অনেক পুরোনো কিছু বটগাছ। তবে আলো থাকতে থাকতে এখান থেকে চলে যাওয়াটা ভালো হবে।

মায়াদ্বীপ
নারায়ণঞ্জের বারদী ইউনিয়নের মায়াদ্বীপ হতে পারে সঙ্গীকে নিয়ে ঘুরে আসার ভালো জায়গা। দুজনে সুন্দর মুহূর্ত কাটাতে পারবেন। মেঘনা নদীর বুকে ভেসে ওঠা সুন্দর এক চরের নাম মায়াদ্বীপ। তবে মূল ভূখণ্ড থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন। রাজধানী ঢাকার গুলিস্তান থেকে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কয়েক মিনিট পরপর বিভিন্ন বাস ছেড়ে যায়। ভাড়া ৫০ থেকে ৬০ টাকা। বাসে গিয়ে সোজা নামতে হবে মোগরাপাড়ায়। তারপর সেখান থেকে ইজি বাইকে বৈদ্যের বাজার নেমে নৌকা ভাড়া করে যেতে হবে। সময় লাগবে ৪০ মিনিটের মতো।

নরসিংদী জমিদার বাড়ি
জমিদার বাড়ি ঘুরতে যাওয়া কিন্তু দারুণ অভিজ্ঞতা। নরসিংদীর জমিদার বাড়িটি বেশ সুন্দর। তাকালেই দৃষ্টি জুড়িয়ে যায়। শতবছরের ভবন ও ঐতিহ্যপ্রেমী এবং ভ্রমণপিপাসুদের মুগ্ধ করে বাড়িটি। উকিলবাড়ি বা লক্ষণ সাহার বাড়ি নামেই পরিচিত বাড়িটি। নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ডাংগা বাজার থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত লক্ষণ সাহার জমিদারবাড়ি। এর সামনে বিশাল পুকুর, শান বাঁধানো পুকুরঘাট, কারুকার্যখচিত মন্দির। ঢাকার গুলিস্তান সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের সামনে নরসিংদীগামী মেঘালয় বাস কাউন্টার আছে। মেঘালয় বাসে করে পাঁচদোনা মোড় নামবেন, ভাড়া নেবে ১২০ টাকা। পাঁচদোনা মোড় থেকে ডাংগা বাজারের অটোরিকশায় উঠবেন, ভাড়া ২০ টাকা। তারপর ডাংগা বাজার থেকে হেঁটে বা ৩০ টাকা রিকশা ভাড়ায় জমিদার লক্ষণ সাহার বাড়িতে যাওয়া যায়।

সোনার গাঁ
বাংলার এক প্রাচীন রাজধানী সোনার গাঁ, যেখানে প্রিয়জনকে নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন। সেখানে উপভোগ করার মতো আছে অনেক কিছুই। জাদুঘরের ভেতরে রয়েছে প্রধান ফটকে দুজন অশ্বারোহী, গরুর গাড়ির ভাস্কর্য, লাইব্রেরি ও ডকুমেন্টেশন সেন্টার, সদ্য নির্মিত জয়নুলের আবক্ষ ভাস্কর্য, ক্যান্টিন, লোকজ রেস্তোরাঁ, সেমিনার হল, ডাকবাংলো, কারুশিল্প গ্রাম, কারুপল্লি, জামদানি ঘর, কারু-মঞ্চ, কারু-ব্রিজ, মৃৎশিল্পের বিক্রয়কেন্দ্র। এ ছাড়া গ্রামীণ উদ্যান, আঁকাবাঁকা দৃষ্টিনন্দন লেক, বড়শিতে মাছ শিকার. নৌকায় ভ্রমণ ও বনজ, ফলদ, ঔষধিসহ শোভাবর্ধন প্রজাতির বাহারি বৃক্ষরাজি দিতে পারে অসাধারণ একটি সময়।

ছুটি রিসোর্ট
ঢাকা থেকে মাত্র ১৮ কিমি দূরে গাজীপুরে ছুটি রিসোর্ট অবস্থিত। ৫৪ বিঘা জমির ওপর তৈরি হয়েছে রিসোর্টটি। বিমানবন্দর থেকে এক ঘণ্টার কম সময়ে এখানে যেতে পারবেন। রিসোর্টে ঢুকেই নানা রকম গাছগাছালি ও বন্য প্রাণীর বিচরণ দেখা যায়। এখানে পরিবার বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে থাকার জন্য ৫০টির বেশি রুম আছে। বিশেষ করে উডেন কটেজ, ভাওয়াল কটেজ, ফ্যামিলি কটেজ নামের কটেজগুলো বেশ জনপ্রিয়।

পানাম নগর, নারায়ণগঞ্জ
যদি ঐতিহ্যের কাছাকাছি একটা দিন কাটাতে চান তবে নির্দ্বিধায় ঘুরে আসতে পারেন হারানো নগরীখ্যাত পানাম নগর বা পানাম সিটি থেকে। মূল সড়কের দুপাশ জুড়ে বেড়ে ওঠা প্রাচীন নগরীর মায়াজাল আপনাকে মুগ্ধ করে রাখবে। বার ভূঁইয়া প্রধান ঈসা খাঁ কর্তৃক নির্মিত এই পানাম নগরীতে হেঁটে বেড়ালে হয়তো আপনি নিজেকে ১৫ শতকে খুঁজে পেতে পারেন। ঢাকার গুলিস্তান থেকে দোয়েল, স্বদেশ কিংবা বোরাকের বাসে করে মোগড়াপাড়া চৌরাস্তায় নেমে ব্যাটারিচালিত রিকশায় কিংবা প্যাডেলচালিত রিকশায় করে পানাম নগরীতে যেতে পারবেন।

সাদুল্লাহপুর গোলাপ বাগান, ঢাকা
সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের সাদুল্লাপুর গ্রামটি বর্তমানে গোলাপ গ্রাম নামে পরিচিত। এখানে বছরজুড়েই গোলাপের ঘ্রাণে ভরে থাকে সারা গ্রাম। বিস্তীর্ণ গোলাপের বাগান ছাড়াও এখানে রজনীগন্ধা, জারভারা ও গ্লাডিওলাসের বাগান রয়েছে। ঢাকার সিংহভাগ গোলাপের চাহিদা এই গ্রামের উৎপাদন থেকেই মেটানো হয়। প্রিয়জনকে নিয়ে বেড়িয়ে আসতে পারেন গোলাপের এই রাজ্য থেকে। বিভিন্ন রুট দিয়ে গোলাপ গ্রাম যাওয়া যায়। এর মধ্যে ঢাকার মিরপুর বা উত্তরা দিয়ে যাওয়াটা সুবিধাজনক। উত্তরার হাউজ বিল্ডিং এলাকায় নর্থ টাওয়ারের কাছ থেকে লেগুনায় করে দিয়াবাড়ি আসতে হবে। সেখান থেকে মেইন রোডে  এগিয়ে লোকাল গাড়িতে বিরুলিয়া ব্রিজ পর্যন্ত গিয়ে আরেকটি অটো ভাড়া করে চলে আসুন সাদুল্লাহপুর গোলাপ গ্রামে।

বাহ্রা ঘাট
মিনি কক্সবাজারের মতো ঢাকার আশপাশেই আছে মিনি পতেঙ্গা। ঢাকার কাছে তেমনই একটি মনোমুগ্ধকর স্থান হলো বাহ্রা ঘাট। দোহার উপজেলায় অবস্থিত এই ঘাট বর্তমানে মিনি পতেঙ্গা নামে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ঢাকার কাছাকাছি হওয়ায় রাজধানীবাসী ডে লং ট্রিপের জন্য বেছে নেন দৃষ্টিনন্দন এই স্থান। নদীভাঙন ঠেকাতে পদ্মা নদীর পাড়ের দীর্ঘ এলাকাজুড়ে বসানো হয়েছে ব্লক। এই ব্লকের ওপর দিয়েই ঘুরে বেড়ান দর্শনার্থীরা। মৈনট ঘাটের মতোই মিনি পতেঙ্গার পাড় থেকে পদ্মা নদীতে নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়ানো যায় পাড় ধরে। ঢাকার গুলিস্তান থেকে প্রায় ৩৮ কিলোমিটার দূরে এটি অবস্থিত। ঢাকার গুলিস্তান থেকে বাসে সেখানে যেতে সময় লাগে মাত্র দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। গোলাপশাহ মাজার থেকে দোহারের মৈনট ঘাটে সরাসরি বাসে যেতে জনপ্রতি ভাড়া ১১০ টাকা।

 কলি

ঈদের ছটিতে ঘুরে আসুন নবাববাড়ি

প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৫, ০১:১৯ পিএম
আপডেট: ২২ মার্চ ২০২৫, ০১:২৩ পিএম
ঈদের ছটিতে ঘুরে আসুন নবাববাড়ি
ছবি:সংগৃহীত

অফিসে ঐচ্ছিক ছুটি শেষ হতে চলল কিন্তু অনেক পরিকল্পনা করে শেষ পর্যন্ত কোথাও না যাওয়ার উপক্রম। একটা না একটা ঝামেলা এসে উপস্থিত হচ্ছিল। কোনোভাবে ব্যাটে বলে মেলাতে পারচ্ছিলাম না। বন্ধের শেষ দিন আজ। ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৮টা বাজে নিদ্রাদেবীর আবেশ থেকে উঠেছি মাত্র। ঘুম থেকে উঠে ক্যালেন্ডারের পাতায় তাকাতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল, দেখতে দেখতে ছুটি শেষ হয়ে গেল। তখনই মনস্থির করলাম আজকেই বের হব।

 দূরে হোক বা কাছে, কোথাও ঘুরে আসতেই হবে। কিন্তু কোথায় যাই? এর মাঝে উপস্থিত হলো অনিক। বললাম কোথায় যাওয়া যায় বলত? অনিক বলল দাদা তুমি নবাবগঞ্জে কলাকোপা ইউনিয়নে যেতে পারো। সেখানে কয়েকটা রাজবাড়ি আছে শুনেছি। সঙ্গে সঙ্গে আমি গুগলে সার্চ দিয়ে দেখে নিলাম কীভাবে যাওয়া যায় দোহার। ফোন দিলাম গাড়ির জন্য, গাড়িও ঠিক করে ফেললাম। সকাল ১০টায় গাড়ি আসবে তাই সবাইকে বললাম দ্রুত তৈরি হয়ে নেওয়ার জন্য।

ঘড়ির কাঁটায় ১০টা হতেই গাড়ি এসে উপস্থিত কিন্তু আমাদের ভ্রমণসঙ্গীরা তখনো তৈরি হওয়াই শেষ হয়নি। অগত্যা ৩০ মিনিট বিলম্বেই যাত্রা শুরু করতে হলো। আমরা আমাদের অস্থায়ী ডেরার থেকে বের হলাম নতুন গন্তব্য পানে। গাড়িতে উঠে কিছুদূর যেতেই আমাদের পাইলট সাহেব ঘোষণা দিলেন আপনারা যেখানে যাচ্ছেন সেখানে কোনো পেট্রল পাম্প নেই তাই মহাসড়কের কাছের পেট্রল পাম্প থেকে তেল নিতে হবে। যাই হোক তেলের ট্যাংক পূর্ণ করে আমরা যাত্রা শুরু করলাম গন্তব্য পানে। আমাদের ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে আজ আমাদের পুরো পরিবার। সঙ্গে আরও আছেন পরিবারের নিকট বন্ধু তপন ঘোষ, বিশ্বনাথ কর্মকার কাকু। কিছু দূর যাওয়ার পর মহাসড়কের বেহালে আমাদের অবস্থা খারাপ হওয়ার উপক্রম। আমাদের অবস্থা দেখে পাইলট সাহেব অভয় দিলেন আরেকটু সামনে গেলেই ভালো রাস্তা পাবেন।

পদ্মা সেতুতে যাওয়ার জন্য সড়কের কাজ চলছে তাই এই অবস্থা। কিছুদিন গেলে পরে মসৃণ সড়ক পাবে নগরবাসী। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা চলছি দেখতে দেখতে দুই ঘণ্টা পেরিয়ে গেল সবার ছটফট দেখে বোঝা গেল সবারই পেটে কিছু দিতে হবে। কিন্তু রাস্তা তো আর শেষ হতে চায় না। নবাবগঞ্জে যেতে যেতে পথের ধারে বেয়ে চলা ইছামতী নদীর দেখা পেলাম। নদীর ঢেউয়ের শব্দ যেন বয়ে নিয়ে আসে প্রশান্তি।

এই ইছামতী নদীর তীর ছিল তৎকালীন ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র। এখন আর সেই বাণিজ্যিক তাৎপর্য না থাকলেও ইছামতীর সৌন্দর্যে কিন্তু একটুও ভাটা পড়েনি। নদীর পাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য এককথায় অসাধারণ। যত দূর চোখ যায় দেখা যায় সবুজ প্রান্তর। অসংখ্য গাছগাছালি আর পাখির ডাক যেন মনে করতেই দেয় না ঢাকা থেকে খুব বেশি দূরে নেই। হঠাৎ আমাদের পাইলট সাহেব ঘোষণা দিলেন আপনাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে চলে এসেছেন। আমরা এসে উপস্থিত হলাম প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো জমিদার ব্রজেন সাহার জমিদার বাড়ির সদর দরজায়।  এলাকার লোকজন জানান, ব্রজেন সাহা আশির দশকে বাড়িটি স্বনামধন্য এক উকিলের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার পর বর্তমানে জজবাড়ি হিসেবেই পরিচিত । তবে এই বাড়িতে প্রবেশের ক্ষেত্রে অনুমতি নিতে হবে।

আমরা গাড়ি থেকে নেমে প্রবেশদ্বার অতিক্রম করে প্রবেশ করলাম। দোতলা বাড়িটি দেখলেই বোঝা যায় সেকালের জমিদারদের সৌখিনতা। অসম্ভব সুন্দর বাড়িটির চারদিকে রয়েছে সুবিশাল বাগান এবং দুটি মনোরম পুকুর। সেই সঙ্গে এখানে দেখা পেলাম পোষা কিছু চিত্রা হরিণের। এরপর আমরা গেলাম পাশেই অবস্থিত উকিলবাড়িতে। এখানে আবার ২০ টাকা দিয়ে টিকিট কিনতে হলো আমাদের।

ভেতরে প্রবেশ করে দেখতে পেলাম নান্দনিক কারুকাজ মণ্ডিত ভবনের। আমরা পদব্রজে ঘুরে বেড়াচ্ছি আর ছবি তুলছি। হঠাৎ লক্ষ করলাম আমাদের ভ্রমণসঙ্গী বাবা, তপন ঘোষ, বিশ্বনাথ কাকু উধাও। দিলাম ফোন কোথায় তোমরা প্রত্যুত্তরে বলা হলো তোমরা ঘুরতে থাকো আমরা আসছি। কিছু সময় পরে উপস্থিত বাবা আর তার বন্ধুরা হাতে শুকনো খাবার-দাবার। খাবার পেয়ে সবাই খুশি সেই কখন দানাপানি পড়েছে পেটে। এবার আমরা সামনে এগিয়ে যেতে থাকলাম। গ্রামের রাস্তায় প্রবীণ এক বিক্রেতা বসেছেন পাঁপড় বিক্রির জন্য। গরম গরম ভেজে দিচ্ছেন আগ্রহী ক্রেতাদের।

আমরাও গিয়ে ভাগ বসালাম সেখানে। গরম গরম পাঁপড়ের অসাধারণ স্বাদ। বেশ কয়েকজন বিক্রেতা তাদের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। কেউ বিক্রি করছেন নিমকি, কাটাগজা, চানাচুর আবার কেউবা ছোটদের খেলনা। আমরা এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। দেখা পেলাম আরও একটি কারুকার্যময় দোতালা বাড়ি। এটি বর্তমানে কলাকোপা কোকিল প্যারী উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসস্থল। ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা ছবি ও তুললাম। এদিকে গরমে প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত চলতি পথে দেখা পেলাম একজন আইসক্রিম বিক্রি করছেন। গলা ভেজাতে আইসক্রিম কেনা হলো। যেহেতু গন্তব্য পথে নতুন তাই স্থানীয় একজনের কাছে জানতে চাই আর কী কী আছে দেখার মতো। প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, আরেকটু সামনে গেলে পাবেন আনসার ক্যাম্প।

সেখানে গেলে কয়েকটি পুরোনো ভবন এবং ইছামতী নদী দেখতে পাবেন। তবে ওই জায়গায় অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে হবে। সামনের দিকে এগিয়ে আমরা দেখা পেলাম আনসার ক্যাম্পের। অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করলাম। সেখানে আছে কয়েকটি পুরোনো ভবন। অসাধারণ কারুকার্যময় সব ভবন। প্রতিটি ভবনের পুরোনো ঐতিহ্যের ছাপ। পাশে বয়ে গেছে ইছামতী নদী। ঈদের বন্ধ তাই বেশ ভালোই পর্যটকের আগমন ঘটেছে এখানে। দেখতে পেলাম জরাজীর্ণ অবস্থায় একটি সমাধি মন্দির। তাতে লেখা আছে লোকনাথ সাহা। দেখে মনে হলো এটি এই এলাকার কোনো প্রভাবশালীর সমাধি মন্দির। কিছু দূর গিয়ে আরও একটি ভবন দেখতে পেলাম কিন্তু সেখানে প্রবেশ নিষেধ। দূর থেকে ভবনটি দেখে লোভ সামলাতে পারছিলাম না। এত কষ্ট করে এসে সব পুরাকীর্তি দর্শন করতে না পারি তাহলে কি হয়। আনসার ক্যাম্পের এক সদস্যের সঙ্গে গিয়ে কথা বললাম। অনেক দূর থেকে এসেছি শুনে একটু সহানুভূতিশীল হলেন।

আবার যেই শুনলেন আমার বাড়ি সিলেটে শুনে খুব খুশি হলেন কারণ তার বাড়িও সিলেটেই। তিনিই পরে ভেতরে নিয়ে যান ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাদের দেখান। ঢাকা থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে ইছামতীর তীরে অবস্থিত ঢাকার এই উপজেলায় রয়েছে নবাবী ছোঁয়া। ইতিহাস আর ঐতিহ্যে টইটম্বুর এ শহর। প্রায় ১৯ শতক পর্যন্ত এখানে ছিল নবাবদের অস্তিত্ব। ২০০ বছরেরও পুরোনো স্থাপত্য নকশার নবাববাড়ির খোঁজ মেলে এখানে। পুরোনো স্থাপত্যবিদ্যার প্রতি যাদের আকর্ষণ রয়েছে তাদের জন্য ভ্রমণের এক উপযুক্ত জায়গা হতে পারে নবাবগঞ্জ। তবে দুঃখের বিষয় হলো পুরোনো স্থাপত্য নকশার নবাববাড়ির যত্নের অভাবে কোনো দিন হয়তো আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাবে।

কীভাবে যাবেন
যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ বা গুলিস্তান থেকে সরাসরি বাসে করে যেতে পারেন নবাবগঞ্জে। তবে গুলিস্তান থেকে যাওয়াটা যাত্রাবাড়ী ও সায়দাবাদের চেয়ে তুলনামূলক সহজ কেননা এখানে গুলিস্তান থেকে এন মল্লিক, দ্রুতি, যমুনা, বাংলালিংক ও শিশির পরিবহনের বাস কিছুক্ষণ পরপর নবাবগঞ্জের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এসব বাসে করে সরাসরি নবাবগঞ্জে চলে যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ভাড়া গুনতে হবে কেবল ৫০-৬০ টাকা। যেহেতু নবাবগঞ্জে দিনে এসে দিনেই ফেরা যায় তাই সকালে রওনা হওয়া উচিত। তবে বাসে যেতে না চাইলে সিএনজি অথবা মাইক্রোবাস ভাড়া করে যেতে পারেন তবে তখন খরচ একটু বেশি পড়বে।

 কলি

শিমুলবনে একদিন

প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:০৬ পিএম
আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:০৭ পিএম
শিমুলবনে একদিন
ছবি:সংগৃহীত

ঘুম থেকে উঠেই ঝটপট তৈরি হয়ে বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছি মাহফুজের অপেক্ষায়। আগের দিন মাহফুজের সঙ্গে কথা হয়ে ছিল সাতসকাল আমরা রওনা দেব নতুন ভ্রমণ গন্তব্যে, কিন্তু আমার সঙ্গীর দেখা নেই। তবে ভোরের মিষ্টি হাওয়াতে দাঁড়িয়ে থাকতে মন্দ লাগছে না।

কিছুক্ষণ পর দেখা মিলল মাহফুজের। চোখ কচলাতে কচলাতে আমার সামনে এসে উপস্থিত। আমরা তিন চাকার গাড়িতে ওঠে যাত্রা শুরু করলাম।

বন্দরবাজার থেকে চৌহাট্টা অভিমুখে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। চৌহাট্টা এসে দেখি কোনো গাড়ির দেখা নেই। আমাদের ভ্রমণ গন্তব্যে যেতে হলে প্রথমে কার অথবা বাসে করে পৌঁছাতে হবে সুনামগঞ্জে। অনেক পরে একটি গাড়ির দেখা পেলাম কিন্তু আমরা দুজন ছাড়া কোনো যাত্রী নেই।

এদিকে দ্রুতগতিতে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলছে। এদিকে মাহফুজ বলল আমরা এখানে অপেক্ষা করি। সময় বাঁচানোর পথ ধরে আমরা চললাম কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডের দিকে। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি একটি বাস আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কালক্ষেপণ না করে উঠে পড়লাম বাসে।

আমাদের আজকের ভ্রমণ গন্তব্য তাহিরপুরের শিমুলবন। ফেসবুকের কল্যাণে খোঁজ পেয়েছি শিমুলবনের। আমার আবার নতুন কোনো গন্তব্যের খোঁজ পেলে তা না দেখার আগ পর্যন্ত মনে শান্তি পাই না। আমাদের বাস চলছে ছুটে গন্তব্য পানে। আমি জানালা দিয়ে দৃষ্টি সীমানায় যতটুকু দেখা যায় প্রকৃতির খেলা তা দেখতে থাকলাম। পথে রাস্তার কাজ চলছিল তাই বেশ কিছু সময় নষ্ট হলো আমাদের। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আমরা এসে পৌঁছালাম সুনামগঞ্জ শহরে। নতুন ব্রিজের কাছে এসে দেখতে পেলাম মোটরসাইকেলের লাইন। বলে রাখা ভালো সুনামগঞ্জ শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাওয়ার মাধ্যম হলো মোটরবাইক। 

তবে, হিউম্যান হলার করে যেতে পারবেন তাহিরপুরের শিমুলবনে। আমি মাহফুজ আর নাম না জানা মোটরসাইকেলচালক রওনা দিলাম। গ্রামের ধূলিময় রাস্তা, দমবন্ধ হয়ে আসে। তবু চারপাশের সৌন্দর্য দেখে আমরা থ। আমাদের পাইলট দ্রুতগতিতে ছুটে চললেন। আর আমি মোটরসাইকেলে বসেই ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। লাউড়ের গড় বিজিবি ক্যাম্পের কাছে আসতেই দূরে দেখা গেল লাল টকটকে শিমুলবন সঙ্গে অপরূপ জাদুকাটা।

যেন আগুন লেগেছে সে বনে। তবে তখনো পথ বেশ দূরের। আমাদের পাড়ি দিতে হবে জাদুকাটা নদী। নদীতে পানি কম, যতদূর চোখ যায় ধু-ধু বালুচর। প্রখর রোদ। আমরা মোটরসাইকেল থেকে নেমে জাদুকাটা নদীর শীতল পরশ বুলিয়ে নিলাম। নদীর ওপাশেই সবুজ বারিক টিলা। তারপর কুয়াশায় মোড়ানো মেঘালয় পাহাড়। বর্ষার দিনে সবুজ পাহাড়ের বুক চিড়ে এই নীল নদীটি বয়ে যায়। জাদুময় জাদুকাটা নদী দেখতে পর্যটকরা তখন ভিড় করেন। তবে ফাল্গুন মাসে নদীর তলঘেঁষে প্রায় এক মাইল হেঁটে আমরা পৌঁছালাম শিমুলবনে। টকটকে লাল শিমুল ফুলে ছেয়ে গেছে, পুরো বাগান। এক ডাল থেকে অন্য ডালে খুনসুটিতে ব্যস্ত পাখিরা। বাসন্তী হাওয়ায়; নতুন প্রাণের স্পন্দনে প্রকৃতি। ১৪ বছর আগে ২ হাজার ৪০০ শতক জমিতে এই শিমুল বাগান গড়ে তোলেন, জয়নাল আবেদীন।

মাত্র ১২ বছর বয়সে জয়নাল আবেদীন তার পরিবারের সবার সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ভৈরব থেকে সুনামগঞ্জের বিচ্ছিন্ন জনপদ বাদাঘাট ইউনিয়নের সোহালা গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। কিশোর বয়স থেকেই তিনি ছিলেন উদ্যমী। সংগ্রামমুখর জীবনে অল্প বয়সেই ইতি টানেন পড়ালেখার। নানা পেশা বদলে একসময় জড়িয়ে পড়েন মৎস্য ব্যবসায়। নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ইনল্যান্ড ফিশারিজের মাধ্যমে ইজারা নেন টাঙ্গুয়ার হাওর। আবার বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন।

কিন্তু শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যে মন ভরল না তার, ইচ্ছা আরও কিছু করার। যা মানুষের কল্যাণে আসবে। গাছপালার প্রতি ছিল তার অপরিসীম মমতা। গাছ লাগাতেই তিনি বেশি পছন্দ করতেন। তার এই পছন্দের সঙ্গে একাত্ম হলো তাহিরপুরের সাধারণ মানুষের ভাবনা।

হাওরাঞ্চলের মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছিলেন কয়েকটি গুরুতর সমস্যায়। বর্ষা এলেই আমূল বদলে যায় এখানকার দৃশ্যপট। ঢেউয়ের তোড়ে প্রতিনিয়ত ভাঙতে থাকে পাড়। হাওরের আশপাশে যে ক’টি বাড়িঘর আছে সেগুলোও ঢেউয়ের তোড়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত। এমন গুরুতর সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? শেষ পর্যন্ত গ্রামের মানুষরাই ঠিক করে নিলেন তাদের করণীয়। শক্ত শিকড়ের জলসহিষ্ণু গাছপালাই এর একমাত্র সমাধান। সংখ্যায় কম হলেও এমন দু-একটি প্রজাতি সেখানে আগে থেকেই ছিল। যার অন্যতম হিজল এবং করচ। গলা সমান পানিতেও এরা দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। কিছুদিন পর স্থানীয়দের এই ভাবনার সঙ্গে যুক্ত হলো আরেকটি নতুন মাত্রা। এসব গাছের একাধিক উপযোগিতার মধ্যে তারা জ্বালানি সংগ্রহের গুরুত্বও উপলব্ধি করতে পারলেন। শুধু হিজল ও করচ লাগালেই একসঙ্গে অনেকগুলো সমস্যার সমাধান মিলবে।

কিন্তু এই বিশাল কর্মযজ্ঞের শুরুটা কীভাবে, আর করবেই বা কে? স্থানীয় মানুষ যখন এসব নিয়ে ভাবছিলেন তখন অনেকটা পরিত্রাতা হিসেবেই আবির্ভূত হলেন বাদাঘাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন। তিনি ১৯৮৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত মোট ১৩ বছর টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকায় ৯০ হাজার করচ গাছ লাগিয়েছেন। পাশাপাশি হিজল গাছও লাগিয়েছিলেন বেশ কিছু। চারাগুলো সংগ্রহ করেছিলেন স্থানীয়ভাবেই। শুধু গাছ লাগিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি।

গাছের পুরো যত্নআত্তির দায়িত্বও নিজের কাঁধে নেন। শুকনো মৌসুমে নিজেই গাছে পানি দিতেন। টানা ১৩ বছর তিনি সত্যিকার অর্থেই অসাধ্য সাধন করেছেন। টাঙ্গুয়ার হাওর যেতে দুই পাশে চোখে রাখলে যে কারও মনে প্রশ্ন জাগবে, এমন বিচ্ছিন্ন জনপদে কোথা থেকে এল এত গাছ? কিন্তু তিনি আজ নেই। পৃথিবীর মোহমায়া ছেড়ে অনেক আগেই চলে গেছেন জয়নাল আবেদীন।

কিন্তু রয়ে গেছে তার অনন্য কীর্তি। সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ টাঙ্গুয়ার হাওরজুড়ে তার সন্তানসম বৃক্ষগুলো এখন একদিকে যেমন প্রকৃতিপ্রেমীদের চোখের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে, অন্যদিকে বাড়িয়েছে হাওরের সৌন্দর্য। আবার হাওরের মাটি সুরক্ষায়ও রাখছে বিরাট ভূমিকা। বলছিলেন ওই এলাকার প্রবীণ শেখর দাস। আমি আর মাহফুজ পুরো এলাকা ঘুরে বেড়ালাম পদব্রজে। অসাধারণ পরিবেশ। এ যেন কল্পনার রঙে সাজানো এক শিমুলের প্রান্তর। ওপারে ভারতের মেঘালয় পাহাড়, মাঝে জাদুকাটা নদী আর এপাড়ে শিমুলবন। সব মিলে মিশে গড়ে তুলেছে প্রকৃতির এক অনবদ্য কাব্য। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। শিমুলবন তার সৌন্দর্যের ডালি মেলে ধরে তখন। সোনালি আলোতে লাল টকটকে ফুল এক মোহনীয় আবেশ তৈরি করে। 

যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাস চলে যান সুনামগঞ্জ। অথবা ট্রেনে যেতে চাইলে প্রথমে ট্রেনে করে সিলেট যেতে হবে সেখান থেকে বাস অথবা গাড়ি ভাড়া করে সুনামগঞ্জ শহরে। সুনামগঞ্জের নতুন ব্রিজের গোড়া থেকে বাইক অথবা লেগুনায় সরাসরি লাউড়ের গড় চলে যেতে পারবেন। বাইকে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ২০০ টাকা ও লেগুনায় ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা রিজার্ভ। চাইলে প্রাইভেট গাড়ি নিয়েও চলে যেতে পারেন লাউড়ের গড়। তারপর বালু চর দিয়ে হেঁটে চলে যান শিমুলবনে।

কলি

 

যেতে যেতে বানিয়াচং

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬:২৫ পিএম
আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬:২৮ পিএম
যেতে যেতে বানিয়াচং
ছবি: লেখক

প্রথমে জানতাম বাংলাদেশ। পরে শুনলাম দক্ষিণ এশিয়া। এর পর মাত্র কিছুদিন আগেই জানা যায়, সারা পৃথিবীর মধ্যে বানিয়াচং হলো সবচেয়ে বড় গ্রাম। বলছি সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার অন্তর্গত বানিয়াচং গ্রামের কথা। এত বড় গ্রাম বাংলাদেশে, আর সেখানে যাব না ঘুরতে, তা কী করে হয়! অধিক সদস্য সংখ্যার ভয়ে চুপেচাপে দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের সাত ভ্রমণবন্ধু এক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মাইক্রো করে ছুটলাম। যেতে যেতে শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভা কার্যালয়ে ব্রেক।

রাত তখন প্রায় দেড়টা। আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন পৌর নির্বাহী অফিসার কাজী কামাল মনির ভাই। উনি আরেক পাগলু ট্রাভেলার। আমাদেরকে পেয়ে পাগলামির পারদ তার তুঙ্গে। এ যেন  হরেকরকম পাগল দিয়া মিলাইছিল মেলা! গভীর রাতেই আমাদেরকে নিয়ে বের হয়ে গেলেন। মনে মনে ভাবি, আমি আর কি পাগল! তার চেয়ে বড় পাগলের পাল্লায় পইড়া রাতের ঘুম হারাম। হা হা হা। প্রথমে নিয়ে গেলেন বিরামচরের সাহেববাড়ির পুকুরে। সারি সারি সুপারি গাছের ফাঁক গলে অর্ধচন্দ্রের আলোতেও পুকুরের চারপাশটা বেশ আলোকিত ছিল। চাঁদ-তারা- এসব নক্ষত্রের আসল সৌন্দর্য অন্ধকারেই বেশ বোঝা যায়।

এর পর নিয়ে গেলেন জমিদার গিরিশ চন্দ্র বিশ্বাসের বাড়িতে। চমৎকার স্থাপত্য। দারুণ সব নকশা। তবে দীর্ঘদিন অযত্ন-অবহেলায় পরিত্যক্ত হয়ে উঠেছিল। এর পর ইউএনও মিনহাজুল সাহেবের তৎপরতায় জমিদারবাড়িটি সংস্কার করা হয়। যা বর্তমানে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাড়ির সামনে শান বাঁধানো পুকুরটাও বেশ দৃষ্টিনন্দন। পুকুরঘাটেও চলল একচোট আড্ডা। ওদিকে বানিয়াচংয়ের তরুণরা আমাদের অপেক্ষায় প্রায় নির্ঘুম। তাই আড্ডার ছেদ টেনে পৌর কার্যালয়ের ফ্লোরে বেডিং বিছিয়ে কিছুটা সময়ের জন্য সবাই চিতপটাং।

মরিচপোড়া ঘুম দিয়েই সাতসকালে সবাই রেডি। নাশতা সারতেই মাইক্রো চলল। যেতে যেতে বানিয়াচং সড়কে উঠতেই মায়াবী প্রকৃতির  দুই চোখে ধরা দিল। বড় বাজার পৌঁছার আগ পর্যন্ত বারংবার থামতে হলো। আসলে প্রকৃতি আমাদেরকে থামতে বাধ্য করেছে। চোখের সামনে ফুটন্ত লাল শাপলার বিল, দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠসহ আরও কত কী! এ রকম সব মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে দেখতেই বড় বাজার পৌঁছে যাই। সেখানে অপেক্ষমাণ স্থানীয় যুবক দিহানের সঙ্গে যৎসামান্য হাই-হ্যালো করেই ছুটলাম হান্নির হাওরে। যেতে যেতে পথে দেখা মিলল শুকিয়ে যাওয়া বিল ঝিল ডোবা নালা থেকে মাছ মারার দৃশ্য। হায়রে মাছ! মাছ আর মাছ। কত পদের যে মাছ! শহুরে বাজারগুলোতে এখন না আসা বিলুপ্তপ্রায় বিভিন্ন জাতের মাছেরও দেখা পেলাম। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গাড়ি হান্নির হাওরে পৌঁছে যায়। দৃষ্টির সীমা ছাড়িয়ে যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি। মাঝে মধ্যে দু-একটা গ্রাম মাথা উঁচু করে একপায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রাতটা এখানেই কাটাব। তাই যার যার দায়িত্ব অনুযায়ী কেউ তাঁবু গাড়তে লাগল, কেউবা বাজার-সদাই লেখার লিস্ট করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল।

এরই মধ্যেই রাতভর মাছ মারতে যাওয়া জেলেরা, নৌকাভর্তি মাছ নিয়ে ফিরতে শুরু করেছে। মাছের প্রাচুর্য দেখে চোখ আমাদের কপালে। নামমাত্র মূল্যে হরেক পদের মাছ কিনি। বোয়াল মাছের কেজি মাত্র ৩৫০ টাকা। সঙ্গে কাইক্কা, পুঁটি ফ্রি। মজার মজার মাছ খেতে চাইলে আর কেন দেরি! মাছ, কাঁচাবাজার ও রাত্রি নিবাসের তাঁবু টানানো শেষ।

যাই এবার লক্ষ্মী বাঁওড়। মাদ্দের বিলের গাঙ পাড়ি দিয়ে হাঁটা শুরু করি  হাওড়ের বুক চিরে। দেশি গরুর পিছু পিছু, কখনো-বা আবার মাছ ধরার ফাঁদে চোখ বুলাতে বুলাতে কোমরসমান পানি কেটে গিয়ে পৌঁছাই লক্ষ্মী বাঁওড়ের প্রান্তরে। যতই ভিতরে যেতে থাকি, ততই মুগ্ধতা ভর করতে থাকে। হিজল-কড়ই গাছের ছড়াছড়ি। গাছগুলোর আকার-আকৃতি অনেকটাই রাতারগুলের পরিবেশ লক্ষ্মী বাঁওড়ে ভর করেছে। হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে মেছো বিড়ালের পায়ের ছাপ। বর্ষায় পানি থাকে টইটুম্বর।

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ মিঠাপানির জলাবন। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে প্রায় সমান। এই বনের আয়তন সাড়ে তিন কিলোমিটার। আকার ও আয়তনে লক্ষ্মী বাঁওড় রাতারগুলের চেয়েও অনেক বড়। পর্যটকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে পারলে দেশ-বিদেশের প্রচুর ভ্রমণপিপাসুর সমাগম হবে নিশ্চিত। পেটে টান পড়তেই চলে যাই অস্থায়ী নিবাস নূরপুর। মৎস্যজীবীদের বাবুর্চি আমাদের করা বাজার দিয়ে আগেভাগেই রান্নাটা সেরে রেখেছিলেন। এসেই শুধু গপাগপ ভাতের লোকমা। কাইক্কা মাছের ভুনা এতটাই জোশ ছিল যে, অন্যান্য মাছের তরকারির স্বাদ পুরাই ম্লান।

সময় কম। খেয়েদেয়েই ছুটলাম কমলা রানীর দীঘি। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে যাই দীঘির প্রান্তরে। প্রথম দেখায় ভালো না লাগলেও কাছাকাছি যাওয়ার পর বিস্মিত হই এর সৌন্দর্যে। নীলাভ পানি। আসমানের রঙ আর পানির রঙ মিলেমিশে একাকার। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দীঘি। সাগরদীঘি নামেও এর পরিচিতি রয়েছে।

 
দ্বাদশ শতাব্দীতে রাজা পদ্মনাভ প্রজাদের পানির কষ্ট লাঘবের জন্য গ্রামের মধ্যভাগ দিয়ে দীঘিটি খনন করান। কিন্তু খননের পর পানি না ওঠায় রাজা চিন্তিত হয়ে পড়েন। একদা রাতে রাজার স্ত্রী রানী কমলাবতী স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে আত্মবিসর্জন দেন বলে এই অঞ্চলে জনশ্রুতি রয়েছে। এই দীঘির পাড়ে বসে পল্লীকবি জসীম উদদীন রানী কমলাবতীর দীঘি নামক একটি কবিতা লিখেছিলেন।

সূর্য হেলে পড়েছে। যাই এবার বানিয়াচং রাজবাড়ি। বর্তমানে রাজবাড়ির উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো ইমারত অবশিষ্ট নেই। যাও একটি ঘর রয়েছে, সেটাও থাকে তালাবদ্ধ। তবে বাড়ির উঠোনটা বেশ চমৎকার। রাজা গোবিন্দ সিংহ বানিয়াচং রাজ্যের অধিপতি হওয়ার পর এই বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছিল। চারপাশ ভর করে সন্ধ্যা এলো নেমে। মাগরিব আদায় করেই ফিরলাম তাঁবুতে।

ভাটিয়ালি গানের আসর বসল নাজমুলের তত্ত্বাবধানে। কিন্তু আকাশে জ্বলজ্বল করা তারার মেলা আমাদেরকে সেদিকেই বেশি আকৃষ্ট করে।  হাওড়ের প্রান্তরে নিঝুম এক পরিবেশে গাড়া তাঁবুতে বেশ একটা ফুরফুরে ঘুম দিয়ে, সুবহে সাদিকের অপার্থিব ও নজরকাড়া সৌন্দর্যের স্মৃতি নিয়ে ঢাকার পথ ধরি। 

কীভাবে যাবেন
ঢাকার সায়েদাবাদ হতে সরাসরি হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং বাস সার্ভিস রয়েছে।

থাকা-খাওয়া
সুবিধামতো স্থানে তাঁবু টানিয়ে অথবা বানিয়াচং বাজারে থাকা-খাওয়ার হোটেল রয়েছে।

কলি

কার্তাহেনাতে ফুর্তি

প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭:০৮ পিএম
কার্তাহেনাতে ফুর্তি
ছবি: লেখক

কলম্বিয়াতে এবার দ্বিতীয়বারের মতো আসা। দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর উপকূলে, ক্যারিবিয়ান সাগরের তীরে জ্বলজ্বলে রত্নের মতো ছোট শহর কার্তাহেনা। এয়ারপোর্টে সময় লেগে গেল বেশ খানিক, ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়েই দেশের কথা ভাবছি। দেশে এয়ারপোর্টে নামলেই ইমিগ্রেশনটাকে একটা যন্ত্রণা বলে মনে হয়।

এখন কার্তাহেনার লম্বা ধীরগতি সম্পন্ন ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়িয়ে ঢাকার যন্ত্রণাকে আর যন্ত্রণা মনে হচ্ছে না। এয়ারপোর্টে নেমে এ ধরনের যন্ত্রণা আর অভিজ্ঞতা ভ্রমণেরই অংশ। কাজেই হা হুতাশ না করে সেটাকেও কোনো একভাবে উপভোগ করছি। ইমিগ্রেশনে যারা কাজ করেছে তাদের জেনেটিক পরীক্ষা করা হলে আমি নিশ্চিত কচ্ছপের জিন পাওয়া যাবে। পৃথিবীটাকে দেখা, অন্য প্রান্তে মানুষের জীবনটাকে একটু কাছ থেকে দেখা। 

জীবনে কখনো জন্মবার্ষিকী পালন করা হয়নি, এই প্রথম ফুর্তি করতে ইচ্ছা হচ্ছে। শারমিন, আমার এয়ার ফোর্স ওয়ান (ফার্স্ট প্রায়োরিটি), সেও চাচ্ছে ইচ্ছামতো ফুর্তি করি। আর ফুর্তি হবে বলেই কার্তাহেনাতে আসা। বলতে গেলে কার্তাহেনা দক্ষিণ আমেরিকার ব্যাংকক।

এখন বছরের প্রায় শেষ সময়, বড়দিন সামনে, শহর আলোকিত, আনন্দের শ্রেষ্ঠ সময় এখনই। প্রায় সপ্তাহখানেকের জন্য এসেছি আমরা, খাবদাব, হাঁটব, মানুষ দেখব, শহরের আলো এসে পড়বে গায়ে– এই তো ভ্রমণ। আমার পঞ্চাশে যুক্ত হলো কার্তাহেনার নাম, অস্বীকার করা ঠিক হবে না, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একগাদা ফুর্তি। এখন থেকেই ঠিক করে ফেললাম, বাকিটা জীবন ফুর্তি করেই কাটিয়ে দেব। কী আছে দুনিয়ায়! এখানে ‘ফুর্তি’ শব্দটার অর্থ একটু পরিষ্কার করে বলি, নয়তো অনেকেই ভাববে ফুর্তি মানেই লাফালাফি, ফালাফালি, পার্টি, হিহি-হাহা টাইপ কাজকর্ম। আমি এখানে ফুর্তি বলতে যা বলি তা হলো অনেকটা এরকম, ভালো থাকা, দুশ্চিন্তার বাইরে চলে যাওয়া, সবকিছুতেই অংশ নেওয়া, কিন্তু গা না মাখানো। কোনো কষ্ট যাতে ছুঁয়ে যেতে না পারে। চারপাশে হচ্ছে, যা হওয়ার, হোক, আমার ভেতর থাকবে ফুর্তিতে।

কলম্বিয়ার কার্তাহেনা প্রাণবন্ত শহর ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য এক স্বপ্নের গন্তব্য। এসে দেখে যাও ঔপনিবেশিক ইতিহাসের গল্প, প্রাণচঞ্চল জীবন, এবং নীল সমুদ্রের নিরন্তর ডাক।

কার্তাহেনা পুরোনো শহর, সে যেন সময়কে ধরে রেখেছে। শহরের রঙিন বাড়ি, সংকীর্ণ পথ এবং প্রাচীন প্রাসাদগুলো স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক শাসনের এক নিখুঁত চিত্র। পুরোনো শহরের চত্বরে বসে গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে দেখা যায় ব্যস্ত জীবন পাশ কেটে যায় পলকে।

রাতের কার্তাহেনা আলোতে ছোঁয়া, অলিগলি, হাঁটা পথ, মানুষের সমাগম। রাস্তাগুলোতে ফুটে ওঠে জীবনের উচ্ছ্বাস। গেটসেমানি এলাকায় দেয়ালচিত্রের (স্ট্রিট আর্ট) মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বোঝা যায়, শিল্প এখানে জীবনেরই আরেকটি ভাষা।

শহরের আধুনিক দিক দেখতে চাইলে যেতে হবে বোকা গ্রান্ডে। এখানে ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের ধারে সারি সারি আধুনিক হোটেল আর রেস্টুরেন্ট। দিনভর সৈকতে রোদ পোহানোর পর সন্ধ্যায় অভিজাত রেস্টুরেন্টগুলোতে সি-ফুডের সঙ্গে স্থানীয় মিউজিকের তালে তালে নাচের আমেজে মেতে উঠে শহর।

পৃথিবীর যেকোনো ভূখণ্ডেই তার বড় সম্পদ সেখানকার মানুষগুলো। কার্তাহেনাতেও তাই, এখানেও মানুষ দরিদ্র অনেক, আছে অভাব-অনটন, তবু মুখে হাসি। আর প্রাণখোলা হাসি বারবার মনে করিয়ে দেয়, ভ্রমণ শুধু স্থান নয়, এ এক মানুষকে জানার গল্প।

কার্তাহেনা শুধু একটি শহর নয়, এটি ইতিহাস, প্রকৃতি, সংস্কৃতি এবং জীবনের এক মেলবন্ধন। কার্তাহেনার ইতিহাস আছে, মানুষ, শিল্প, সংস্কৃতি আছে, আছে আরও বহু কিছু। আমার ক্ষুদ্র সময় এখানে মনে করিয়ে দেয় আমি অর্ধশত বছরে পা ফেলেছি কার্তাহেনাতে। হাতে সময় নেই আর, আরও অনেকটা পথ যেতে হবে, হয়তো যাব, হয়তো থেমে যাবে সব। ঘটুক যা ঘটার। আমার আছে শুধু ‘আজ’, এই নিয়েই থাকব আমি। অতীত ছুঁয়ে দেখার নয়, ভবিষ্যৎ কারও কখনো আসেনি। আমরা যা কিছু, সব এখনই। কাজেই ঘরে বসে থেকে কী লাভ? চল ফুর্তি করি, এর চেয়ে ভালো কিছু নিজেকে উপহার দেওয়া প্রায় অসম্ভব।

 কলি 

প্রকৃতির মায়ায় মারমেইড বিচ রিসোর্ট

প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫২ পিএম
প্রকৃতির মায়ায় মারমেইড বিচ রিসোর্ট
ছবি: মারমেইড বিচ রিসোর্ট

কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকত, যেখানে সোনালি বালু আর নীল আকাশ মেলে ধরেছে এক অপূর্ব দৃশ্য, সেখানে এমন এক রিসোর্ট রয়েছে, যা আপনাকে এনে দেবে সম্পূর্ণ অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা। শরতের সোনালি রোদের আলিঙ্গনে যখন আমি প্রথম রিসোর্টে প্রবেশ করি, মনে হচ্ছিল যেন একটি পুরনো বইয়ের পাতায় পা রেখেছি। মৃদু-মন্দ সাগরের হাওয়া, সোনালি আভায় ভেসে থাকা বালুকাবেলা, আর চারপাশে অগণিত গাছপালা- এই দৃশ্য যেন কিছুটা কবিতার মতো, যেখানে সময় থেমে গেছে।

মারমেইড বিচ রিসোর্ট, যা মেরিন ড্রাইভ রোডের পাশে পেঁচার দ্বীপের কোনে অবস্থিত, কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্যই নয়, এখানে আসলে এক অনন্য প্রশান্তির ছোঁয়া পাওয়া যায়। শরতের সোনালি রোদ আর মৃদু বাতাসের মাঝে সেখানে দুই রাত কাটিয়ে, মনে হয়েছে সময় যেন থমকে গেছে, আর প্রকৃতি আপনাকে তার আদর-মাখানো গান শুনিয়েছে।
রিসোর্টের কটেজগুলো যেন নিজেই একেকটি ছোট্ট পৃথিবী। বাঁশ আর পুনর্ব্যবহৃত কাঠ দিয়ে তৈরি, কটেজগুলো আধুনিক সুবিধার পাশাপাশি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক নিখুঁত মেলবন্ধন। গাছের ছায়ায় ঘেরা আমার কটেজটি যেন এক পুরনো গল্পের অংশ, যার প্রতিটি কোনে লুকিয়ে ছিল কিছু অজানা রহস্য। খোদাই করা কাঠের দরজা, স্থানীয়ভাবে তৈরি সজ্জা, আর সোনালি আলোয় স্নিগ্ধ লণ্ঠন- সবকিছু যেন আহ্বান জানাচ্ছিল- ‘আর একটু থাকুন, এখানে আরও কিছু মধুর স্মৃতি তৈরি করুন।’

প্রকৃতির সিম্ফনি, পাখির গান আর সমুদ্রের দূরবর্তী আওয়াজ- এখানে সকালের শুরুটা যেন একদম আলাদা। প্রথম সকালে, ঢেউয়ের ছন্দের মাঝে চোখ মেলে দেখলাম সমুদ্রের অপরূপ দৃশ্য। কফির কাপ হাতে, বারান্দায় বসে আমি শুধু তাকিয়ে ছিলাম। শান্ত, মৃদু বাতাস আর সমুদ্রের লবণাক্ত গন্ধে মন যেন আরও বেশি প্রকৃতির সান্নিধ্যে চলে যাচ্ছিল। এক মুহূর্তে, সময় যেন থেমে গিয়েছিল।

কিন্তু মারমেইড বিচ রিসোর্ট শুধুই নিঃসঙ্গতার স্থান নয়। এখানে সক্রিয়তার খোঁজে থাকা মানুষের জন্যও অনেক কিছু আছে। কায়াকিং, সাইকেল রাইডিং, অথবা সৈকতের ধারে পায়ের তলায় বালির অনুভূতি- সবকিছুই অপেক্ষা করছে আপনাকে অভ্যর্থনা জানাতে। এক বিকেলে, আমি সাইকেল নিয়ে রিসোর্টের চারপাশে ঘুরতে বের হই, আর হঠাৎ অনুভব করি, যেন দিগন্তের সীমাহীনতা আমাকে এক নতুন জীবন দেখাচ্ছে। বাতাসের টানে মাথার চুল উড়ছে, আর সমুদ্রের ধারে এই অসীম দৃশ্য মনে হয় যেন কোনো শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা ছবি।

 

রিসোর্টের রেস্তোরাঁর খাবার ছিল এক চমৎকার রন্ধনশিল্পের উদাহরণ। স্থানীয় উপাদান দিয়ে তৈরি প্রতিটি পদ যেন এক নান্দনিক রচনা। এক সন্ধ্যায়, আমি গ্রিলড পমফ্রেট খেয়েছিলাম- এটির ধোঁয়ামাখা গন্ধ, আর ট্যাঞ্জি আম সালসার সঙ্গে তার সমন্বয় ছিল এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। পরের রাতে নারকেল থেকে তৈরি একটি ডিজার্ট খেয়েছিলাম, যা মনে করিয়ে দিয়েছিল- যত সহজই হোক না কেন, আন্তরিকতা দিয়ে প্রস্তুত করা যেকোনো খাবার অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে।

মারমেইড বিচের সন্ধ্যাগুলো যেন এক বিশেষ মায়ায় রঙিন। প্রথম রাতে, সৈকতে লাইভ মিউজিক ছিল, আর আগুনের নরম আলো ছড়ানো ছিল সুরে সুরে। গিটারিস্টের বাজানো সুর যেন তরঙ্গের ধ্বনির সঙ্গে মিলে এক অভূতপূর্ব সংগীত রচনা করছিল। দ্বিতীয় রাতে, পূর্ণিমার আলোতে সৈকতের ধারে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়েছিল, এ যেন এক অপার্থিব অভিজ্ঞতা। আমার পায়ের তলায় শীতল বালি সমুদ্রের অপরূপ আলোয় চমকাচ্ছিল।

মারমেইড বিচ রিসোর্টের একটি অতিরিক্ত সৌন্দর্য রয়েছে, যা সাধারণত এমন রিসোর্টগুলোর মাঝে দেখা যায় না- এটি পরিবেশবান্ধব একটি রিসোর্ট, যা প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে। রিসোর্টের স্থাপত্য নকশা থেকে শুরু করে তার কার্যক্রম পর্যন্ত- সবকিছুতে পরিবেশের সঙ্গে খাপখাইয়ে চলার ছাপ। সৌরশক্তি ব্যবহার করে আলোকসজ্জা, বৃক্ষরোপণ প্রকল্প, আর ইকো-ফ্রেন্ডলি কাঠামো- সবকিছুই রিসোর্টটির পরিবেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে। বিশেষ করে, পেঁচার দ্বীপের সবুজে ঘেরা প্রকৃতি, যা রিসোর্টের একেবারে কাছেই অবস্থিত, তা যেন প্রাণী ও গাছপালার একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে।

আরেকটি দিক যা আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে, তা হলো রিসোর্টের স্থানীয় সম্প্রদায়ের প্রতি দায়বদ্ধতা। অনেক কর্মী এখানকার আশপাশের গ্রাম থেকে আসে এবং রিসোর্টটি স্থানীয় কৃষক ও কারিগরদের সহযোগিতা করে, যা এ ধরনের পর্যটন ব্যবসায় খুবই বিরল। রিসোর্টের সাবান, যা স্থানীয় সমবায় থেকে তৈরি, অথবা আমার সালাদের সবজি, যা মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি খামার থেকে সংগ্রহ করা- এসব প্রমাণ করে যে পর্যটন শুধু আনন্দের জন্য নয়, বরং দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করলে এর মাধ্যমে ব্যবসার পাশাপাশি স্থানীয় ভূমি ও সংস্কৃতিকেও সহযোগিতা করা সম্ভব।

রিসোর্টের শেষ সকালে, যখন আমি সৈকতে বসে সূর্যোদয় দেখছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল, যেন এই স্থানে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তই এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। এটি শুধু একটি থাকার স্থান নয়, বরং এ এক নতুন জীবন যাপনের পদ্ধতি- প্রকৃতির সঙ্গে, নিজের সঙ্গে, আর জীবনের সরল আনন্দের সঙ্গে মেলবন্ধনের জায়গা।

 কলি