
পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত রেলসেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ গর্বিত এক ঐতিহ্য। তার বয়স ১০৯ বছর পূর্ণ হয়েছে গত মার্চ মাসে। ব্রিটিশ শাসনামলে রেলপথ নির্মাণের সময় এই সেতুর জন্ম। উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপনের জন্য পাবনার ঈশ্বরদীর পাকশীতে এটি নির্মাণ করা হয়। ১৯১৫ সালের ৪ মার্চ রেল চলাচলের জন্য ব্রিজটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।
পাকশী রেলওয়ে বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ ব্রিজটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এরপর ব্রিজের ওপর দিয়ে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। পরে এর নামকরণ করা হয় ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ’। এই ব্রিজের নির্মাণশৈলী নান্দনিক ও অপূর্ব। ১৫টি গার্ডার-সংবলিত ব্রিজটি শতবছর আগেকার প্রকৌশলীদের পেশাগত দক্ষতার স্বাক্ষর বহন করে।
সেতুটি নির্মাণের লক্ষ্যে ১৯০৯ সালের গোড়ার দিকে প্রাথমিক জরিপ, জমি অধিগ্রহণ ও প্রয়োজনীয় পাথর সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। শেষ হয়েছিল ১৯১৪ সালের ডিসেম্বরে। পরীক্ষামূলকভাবে ১৯১৫ সালের ১ জানুয়ারি ব্রিজের ওপর দিয়ে মালবাহী ট্রেন চালানো হয়। একই বছরের ৪ মার্চ যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলের জন্য ব্রিজটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।
ব্রিজটির ওপর রয়েছে দুটি ব্রডগেজ রেললাইন। রেলসেতুটিতে রয়েছে ১৫টি স্প্যান। স্প্যানগুলোর উচ্চতা ৫২ ফুট। প্রতিটি স্প্যানের ওজন ১ হাজার ২৫০ টন। প্রধান ১৫টি স্প্যান ছাড়াও সেতুর উভয় পাশে রয়েছে তিনটি করে অতিরিক্ত ছয়টি ল্যান্ড স্প্যান। ল্যান্ড স্প্যান প্রতিটির বিয়ারিংয়ের দৈর্ঘ্য ৭৫ ফুট। নির্মাণশৈলী ও নান্দনিক দৃশ্যপটে চোখ জুড়ানো হার্ডিঞ্জ সেতুটি সেই সময়ের বর্ষা মৌসুমের হিসাব অনুযায়ী সর্বোচ্চ পানির লেভেল থেকে ৪০ ফুট এবং গ্রীষ্মে সর্বনিম্ন পানিপ্রবাহ থেকে ৭১ ফুট উচ্চতায় নির্মিত হয়। পানির উচ্চতা হিসাব করে সেতুটি নির্মাণ করা হয় এ কারণে যে, নিচ দিয়ে স্টিমারসহ বড় বড় নৌকা যাতে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ঈশ্বরদী উপজেলার একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। এই ব্রিজ শুধু ঈশ্বরদী, পাবনা অঞ্চলবাসীই নয়, বাংলাদেশের অহংকারের প্রতীক। ঈশ্বরদী উপজেলা শহর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দক্ষিণে পাকশী ইউনিয়নে পদ্মা নদীর ওপর ব্রিজটি অবস্থিত। ব্রিজটির পাশে যানবাহন চলাচলের জন্য লালন সেতু নির্মাণ করায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের সৌন্দর্য আরও বেড়েছে। এই সৌন্দর্যের আরও বিস্তৃতি ঘটেছে ব্রিজটির পাশ ঘেঁষে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার জন্য। এই ত্রিমাত্রিক সৌন্দর্য মিশ্রণের অপরূপ দৃশ্য দেখার জন্য এ এলাকায় প্রতিদিন প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটে থাকে। এ কারণে এলাকাবাসীর তরফে দাবি উঠেছে বিস্তীর্ণ এলাকা ঘিরে পরিকল্পিতভাবে একটি মনোরম পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার।
আজ থেকে ১৩৪ বছর আগে ১৮৮৯ সালে ব্রিটিশ সরকার তৎকালীন অবিভক্ত ভারত সরকার আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড ও উত্তরবঙ্গের সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ সহজতর করার লক্ষ্যে পদ্মা নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণের চিন্তাভাবনা করে। ১৯০৮ সালে ব্রিজ নির্মাণের অনুমতি পাওয়ার পর ব্রিটিশ প্রকৌশলী স্যার রবার্ট গেইলস হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উত্তর-দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর রেল যোগাযোগ বন্ধ করতে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর একটি বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করা হয়। বোমায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ১২ নম্বর গার্ডার স্প্যানটি ভেঙে নিচে পড়ে যায়। দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। এতে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরের বছর ১৯৭২ সালে একই নকশায় তৈরি করে গার্ডার স্প্যানটি পুনঃস্থাপন করা হয়।
রেলওয়ে পাকশী বিভাগীয় কার্যালয়ের প্রকৌশলী-২ বীরবল মণ্ডল বলেন, দেশের ঐতিহ্যবাহী হার্ডিঞ্জ ব্রিজটি ১০৯ বছরেও এখনো পূর্ণ যৌবনা। তখন থেকেই বলা হয়েছিল যে ১২০ বছর পর্যন্ত ব্রিজের ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচলে কোনো সমস্যা হবে না। তিনি বলেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ ব্রিজটি পর্যবেক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ কাজ নিয়মিত করা হয়ে থাকে।