
১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাঙালিদের ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুর সঙ্গে ইংরেজিতে লেখা খাম, পোস্টকার্ড, ডাকটিকিট, রেল টিকিট, মানি অর্ডার ফরম ইত্যাদি প্রকাশ করা হয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের তদানীন্তন সচিব গুড ইন ১৯৪৭ সালের ১৫ নভেম্বর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা সম্পর্কে একটি সার্কুলার পাঠান। এ সার্কুলারে ওই পরীক্ষার জন্য সর্বমোট ৩১টি বিষয় দেওয়া হয়, যার মধ্যে ৯টি ছিল ভাষা; এসব ভাষার মধ্যে হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি, জার্মান, ফরাসি এমনকি লাতিন ও সংস্কৃতও স্থান পায়। কিন্তু স্থান পায় না পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগণের মাতৃভাষা বাংলা। এই পটভূমিতে ১৯৪৭ সালের ১৭ নভেম্বর বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা করার দাবি জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে করাচিতে (পাকিস্তানের তৎকালীন রাজধানী) একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ‘মর্নিং নিউজ’ এই শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে মর্মে সংবাদ প্রকাশ করে। এর প্রতিবাদে ওই দিনই বেলা ২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ও অন্যান্য কলেজসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এক প্রতিবাদ সভা করেন। এতে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা আবুল কাসেম। বক্তৃতা করেন মুনীর চৌধুরী, এ কে এম আহসান প্রমুখ এবং প্রস্তাব পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের ভিপি ফরিদ আহমদ। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এটাই ছিল সর্বপ্রথম সাধারণ ছাত্রসভা।
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সমর্থনে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। তমদ্দুন মজলিসের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে পরিষদ সদস্যদের উর্দু বা ইংরেজিতে বক্তৃতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের কংগ্রেস দলের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এ প্রস্তাবে সংশোধনী এনে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা করার দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখই পূর্ব পাকিস্তানের, যাদের মাতৃভাষা বাংলা।’ ওই অধিবেশনে পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন সদম্ভে ঘোষণা করে বলেন যে, ‘পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীরই এই মনোভাব যে, একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে।’ নাজিমুদ্দিনের এই বক্তব্যের প্রতিবাদে ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ শুরু হয়। এ সময় তমদ্দুন মজলিস, গণ-আজাদী লীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও বিভিন্ন ছাত্রাবাসের যৌথ উদ্যোগে ২ মার্চ ফজলুল হক হলে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের এক সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ওই দিন এক প্রস্তাবে সারা পূর্ব পাকিস্তানে ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘটের একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ভোরে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছাত্ররা বের হয়ে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদসহ ৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করলে ঢাকায় ১৩-১৫ মার্চ ধর্মঘট পালিত হয়। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ১৫ মার্চ ৮ দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে নাজিমুদ্দিনের এ রকম চুক্তি করতে বাধ্য হওয়ার কারণ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯ মার্চ, ১৯৪৮ ঢাকা সফর করেন। ১৫ মার্চ ভাষা আন্দোলনের বন্দি ছাত্র ও কর্মীদের মুক্তি দেওয়া হয়।
তার (মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ) সফর উপলক্ষে ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক সমাবেশের আয়োজন করা হয়। ওই সমাবেশে জিন্নাহ বলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে, অন্য কোনো ভাষা নহে। যে কেহ অন্য পথে চালিত হইবে, সে-ই পাকিস্তানের শত্রু।’