সিলেটের হজরত শাহজালাল (রহ.) মাজারে মুসাফিরদের সাহরি ও ইফতার করানোর ঐতিহ্য প্রায় ৭০০ বছর আগের। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। প্রথম রমজান থেকে শাহজালাল (রহ.) মাজারে মুসাফিররা আসছেন সাহরি ও ইফতার করতে। সাহরিতে খাওয়ানো হয় ভাত-তরকারি অথবা খিচুড়ি। ইফতারের প্রধান খাবার থাকে আখনি-পোলাও, বুটের পোলাও অথবা খিচুড়ি। সঙ্গে দেওয়া হয় খেজুর, জিলাপি, পেঁয়াজু শরবতসহ বিভিন্ন খাবার।
সারা বছরই সিলেটের হজরত শাহজালাল (রহ.) মাজারে থাকে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের ভিড়। রমজান মাসেও এর ব্যতিক্রম হয় না। দেশের নানা প্রান্ত থেকে এই মাজারে মানুষজন আসেন। তাই রমজান মাসে মাজারের ভক্ত-আশেকানদের জন্য রাখা হয় ইফতার আর সাহরির ব্যবস্থা। রমজানে আসরের নামাজের পরই মাজারের আঙিনায় জড়ো হতে থাকেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। ইফতারের আগমুহূর্তে মাজারে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরাও বসে পড়েন মাজারের আঙিনায়। সাইরেন বাজার সঙ্গে সঙ্গে সবাই ইফতার শুরু করেন।
গত শুক্রবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ইফতার করছেন পাঁচ শতাধিক মানুষ। ইফতার শুরুর আধা ঘণ্টা আগে মাজারের আঙিনায় সারি হয়ে বসে পড়েন মানুষজন। এরপর একদল স্বেচ্ছাসেবক এসে প্লেট ও গ্লাস বিতরণ করেন। আরেক দল স্বেচ্ছাসেবক এসে খাবার পরিবেশন করেন। ইফতারের আগে দোয়া পড়া হয়। দোয়া শেষে ইফতারের সময় হলে সাইরেন বাজানো হয়। এরপর ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবাই একসঙ্গে ইফতার করা শুরু করেন।
হজরত শাহজালাল (রহ.) মাজারের এই আয়োজনে সবচেয়ে বেশি খুশি হন স্থানীয় নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ। কারণ স্বল্প আয় করা রিকশাচালক, সবজি বিক্রেতা, ফেরিওয়ালারা চাইলেও ইফতারে ভালো খাবার খেতে পারেন না। কিন্তু মাজারে তারা বিনামূল্যে ভালো মানের ইফতারি খেতে পারেন। তবে স্থানীয়রা ছাড়াও মাজারের ইফতারির স্বাদ গ্রহণ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত মানুষজন ছুটে আসেন সিলেটে।
শুক্রবার ইফতার করতে আসা রিকশাচালক সুমন মিয়া বলেন, ‘আমি দরগার আশপাশেই রিকশা চালাই। পাঁচ বছর হয় প্রতি রোজায় আমি ইফতার করি এখানে। আমার মতো অনেক রিকশাচালক এখানে আসেন ইফতার করতে। কারণ আখনি-পোলাও কিনে খাওয়ার মতো সামর্থ্য আমাদের নাই।’
সিলেটের পার্শ্ববর্তী জেলা হবিগঞ্জ থেকে হজরত শাহজালাল (রহ.) মাজারে আসেন সুহেল মিয়া। তিনি বলেন, ‘অনেক দিন ধরে মাজার জিয়ারত করব বলে ভাবছি। কিন্তু ব্যবসায়িক ব্যস্ততার জন্য আসতে পারছিলাম না। তাই আজ এলাম। আমার এক বন্ধু বলেছিল তার বাসায় ইফতার করতে। কিন্তু আমি তাকে না করে দিয়েছি মাজারে ইফতার করব বলে। কারণ সবার সঙ্গে এভাবে মাজারে বসে ইফতার করার সুযোগ হয়তো আর না-ও পেতে পারি।’
ইফতার করতে আসা সিলেট নগরীর শিবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা নূরজাহান বেগম বলেন, ‘আমি প্রায় ৩০ বছর ধরে শাহজালাল মাজারে ইফতার করি। প্রতিবছর রোজার সময় মাজারে এক দিন হলেও ইফতার করি। এতে আমার মনে অন্য রকম শান্তি পাই। এখন বয়স হয়েছে, শরীরেও অনেক রোগ বাসা বেঁধেছে। তাই একা আসা অনেক কষ্টকর হয়ে যায়। হাঁটুর ব্যথায় হাঁটতে ও বসতে পারি না। বাসার সবাই বলছিল এতদূর না আসতে। কিন্তু আমার আগ্রহ দেখে নাতি এখানে নিয়ে এসেছে।’
শাহজালালের (রহ.) মাজার সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মাজারে সাহরি ও ইফতার করেন। তবে ইফতারের সময় বেশি মানুষ থাকেন। সাহরির সময় মানুষ তুলনামূলক কম থাকেন। প্রতিদিন প্রায় ২৫০ জন ইফতার করেন মাজারে। তবে শুক্রবার বেশি মানুষ ইফতার করেন। এর বাইরেও প্রতিদিন প্রায় ১৫০ প্যাকেট ইফতারি বিতরণ করা হয়। মাজারের আঙিনায় নারী-পুরুষ আলাদা সারিতে বসে ইফতার করেন। রান্না ও খাবার পরিবেশনের জন্য প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন স্বেচ্ছাসেবক রয়েছেন মাজারে।
হজরত শাহজালালের (রহ.) মাজারের খাদেম সামুন মাহমুদ খান বলেন, ‘মাজারের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য রমজানে মাসে মুসাফিরদের ইফতার করানো। প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৫০০ মানুষ মাজারে ইফতার করেন। রোজার প্রথম দিকে মানুষজন একটু কম আসেন। তবে এরপর থেকে মুসাফিরদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। আমরা আমাদের সাধ্য অনুযায়ী খাবারের ব্যবস্থা করি। ইফতারে থাকে আখনি-পোলাও, খেজুর, জিলাপি, পেঁয়াজু, শরবত। সাহরিতে পোলাও বা সাদা ভাতের সঙ্গে কখনো আলু দিয়ে গরুর মাংস অথবা আলু দিয়ে খাসির তরকারি। এর সঙ্গে মানুষজন মাজারে যেসব খাবার দেন সেসবও পরিবেশন করি।’