
মায়ের ভাষার অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সারা দেশ তখন উত্তাল। রাজশাহীতেও তার উত্তাপ ছড়িয়েছে। ১৯৫২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি; তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে রাজশাহী নগরীর ভুবন মোহন পার্কে জনসভার ডাক দেওয়া হয়। জনসমাবেশের সভাপতি ছিলেন তমদ্দুন মজলিসের সাধারণ সম্পাদক আনসার আলী। তিনি পরে বলেছিলেন, ভাষা আন্দোলনের দাবিতে ১০ ফেব্রুয়ারির সমাবেশ ছিল প্রথম কোনো জনসমাবেশ।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনের ক্ষেত্রে ঢাকার পর রাজশাহী শহরের ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ করে রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে নিয়মিত মিটিং-মিছিল হতো। এসব আয়োজনে নেতৃত্ব দিতেন বাম দলগুলোর নেতা-কর্মীরা।
রাজশাহী কলেজের দিশারী পত্রিকাও ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছিল। বিশেষ করে তরুণদের দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করত এই পত্রিকা।
ঢাকা থেকে প্রতিদিন একটি মেইল ট্রেন যেত রাজশাহীতে। ঢাকা থেকে আসা যাত্রীদের কাছ থেকে ভাষা আন্দোলনের খবর পাওয়া যাবে, সে আশায় স্টেশনে বসে থাকতেন ছাত্ররা।
২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ রফিক, শহিদ জব্বাররা যে মিছিল বের করবেন, তা আগে থেকেই জানতেন রাজশাহীর ছাত্ররা।
নিয়মমাফিকভাবে একজন ছাত্র প্রতিনিধি বসে রইলেন রাজশাহী স্টেশনে। বিকেলে যথারীতি মেইল ট্রেন এল। একজন খবর দিলেন, ঢাকায় মাতৃভাষার দাবিতে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়েছে। অনেক ছাত্র মারা গেছেন। শুনে রাজশাহীর সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর রাজশাহী কলেজের নিউ হোস্টেলের সামনে ছাত্ররা জড়ো হলেন।
রাজশাহীর যত ছাত্রাবাস আছে, সবগুলো থেকে ছাত্ররা বের হয়ে গেলেন। স্কুল-কলেজের ছাত্ররা বাড়িঘর থেকে বের হলেন। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সিনিয়র ছাত্র এস এম গাফফারের সভাপতিত্বে সভা ডাকা হলো রাজশাহী কলেজের নিউ হোস্টেলের সামনের মাঠে। সবাই মিছিলে স্লোগান তুললেন- ‘শহিদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।
২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় রাজশাহী কলেজ মুসলিম হোস্টেলের ‘এফ’ ব্লকের সামনে ইট-কাদা দিয়ে নির্মিত হলো এক স্মৃতিস্তম্ভ। সেটি ছিল দেশে ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহিদ মিনার। শহিদ মিনারের নামকরণ করা হলো ‘শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ’। শহিদ মিনারের গায়ে লেখা ছিল- ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ ভয় নাই ওরে ভয় নাই/ নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’
রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলো। এতে সভাপতির দায়িত্ব পান রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সিনিয়র ছাত্র এস এম গাফফার। যুগ্ম আহ্বায়ক করা হলো রাজশাহী কলেজের সিনিয়র ছাত্র গোলাম আরিফ টিপু ও হাবিবুর রহমানকে।
২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে হরতাল পালিত হলো রাজশাহীতে। হরতালের সমর্থনে শহরজুড়ে পোস্টারিং শেষ করে যখন ছাত্ররা শহিদ মিনারে এলেন, দেখলেন তা গুঁড়িয়ে দিয়েছে মুসলিম লীগ ও পুলিশ।