
‘পোড়াদহ মেলা থেকে বড় মাছ-মিষ্টি কিনে নিয়ে যেতে হয় শ্বশুর বাড়িতে। তবে টাকা দেন শ্বশুর বা শ্বশুর বাড়ির লোকজন। এটাই রীতি। এবার আগেই শ্বশুর পাঠিয়ে দিয়েছেন ১৫ হাজার টাকা। শুধু আমি নই, এই এলাকার সব জামাইয়ের জন্য একই নিয়ম’ কথাগুলো বলেন বগুড়ার গাবতলী উপজেলার মহিষাবান গ্রামের আব্দুল মোমিন সরকার।
বগুড়ার গাবতলী উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নের পোড়াদহ এলাকায় এক দিনের ‘পোড়াদহ মেলা’ বা ‘মাছের মেলা’ বসে প্রতি বছর মাঘ মাসের শেষ বুধবার। সেই হিসেবে এবারের মেলা আজ বুধবার অনুষ্ঠিত হবে। মেলার মূল আকর্ষণ বড় বড় মাছ আর হরেক রকম মিষ্টির সমাহার। আয়োজকরা এবার ৫০ হাজার মণ মাছ এবং ২০ হাজার মণ মিষ্টি বিক্রির আশা করছেন।
উত্তরাঞ্চলের প্রাচীন এই মেলা কবে থেকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে তার সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেলার আয়োজক মো. আব্দুল মজিদ মণ্ডল দাবি করেন, অন্তত ৪০০ বছর আগে থেকে এই মেলা হয়ে আসছে। তখন থেকে মাঘের শেষ বুধবার বসে পোড়াদহ মেলা। পর দিন বৃহস্পতিবার হয় বউ মেলা। এলাকার মানুষ এই মেলাকে আগে সন্ন্যাসীর মেলা হিসেবেই চিনতেন কিন্তু মেলায় বিভিন্ন ধরনের বড় বড় মাছ আসায় এক সময় পরিচিতি পায় মাছের মেলা হিসেবে। মেলা মাছের হলেও পাওয়া যায় মিষ্টি থেকে শুরু করে পান-চুনও।
আয়োজন থাকে নাগরদোলা, মৃত্যুকূপে মোটরবাইক ও গাড়ি চালানোর মতো বিপদজনক খেলারও।
জানা গেছে, ঈদ বা অন্য কোনো ধর্মীয় উৎসব বা সামাজিক অনুষ্ঠানে বউ-জামাইকে দাওয়াত না করলেও সে বিষয়টি এই এলাকার মানুষের কাছে অপমানজনক কোনো বিষয় নয়। তবে মাছের মেলায় আমন্ত্রণ না জানানোর বিষয়টি এলাকার রীতি-নীতি লঙ্ঘন আর অপমানজনক মনে করেন সবাই।
আব্দুল মজিদ মণ্ডল দাবি করেন, তার বাবা ৬৫ বছর মেলার আয়োজক ছিলেন। ২০০৩ সালে তার বাবা মারা যান। এরপর গত ২০ বছর ধরে আয়োজকের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। আব্দুল মজিদ বলেন, এই মেলায় জামাইরা চেষ্টা করেন বড় মাছ আর মিষ্টি কেনার।
আব্দুল মজিদ জানান, মেলায় নানা ধরনের পণ্যের দোকান আছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার। মাছ, মিষ্টির পাশাপাশি পান-চুন, আসবাবপত্র এমনকি খেলার-সামগ্রীর দোকানও আছে অনেক। সবচেয়ে বেশি আছে মাছ আর মিষ্টির দোকান। মেলায় দুই শতাধিক মাছের দোকানে এবার তোলা হয়েছে কমপক্ষে ৫০ হাজার মণ মাছ। দেশি মাছের পাশাপাশি বিদেশি মাছও রয়েছে।
বহু বছর ধরেই এই মেলায় মাছ বিক্রি করেন আবুল কাসেম। গত বছর মেলায় মাছ এনেছিলেন ৭-৮ মণ। এবার এনেছেন ১০ মণ। বড় মাছের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে আবুল কাসেম জানান, এবার মেলায় বিক্রির জন্য যেসব মাছ সংগ্রহ করেছেন তার মধ্যে আছে ২৭ কেজি ওজনের একটি কাতলা মাছ, ২২ কেজি ওজনের বোয়াল আর ১০ কেজি ওজনের আইড়।
ছোট বেলা থেকেই এ মেলায় আসতেন মো. আব্দুল লতিফ। তবে মিষ্টির দোকান করছেন গত ৪০ বছর ধরে। তিনি মাছের আকৃতি দিয়ে ১২ কেজি ওজনের একটি মিষ্টি বানিয়েছেন। যার দাম ৬ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ‘মেলায় বিক্রির জন্য মিষ্টি তৈরির কাজ শুরু করা হয় ৩-৪ দিন আগে থেকে। দোকানে মিষ্টি তোলা হয়েছে ২০০ মণ, আশা করছি সবই বিক্রি হয়ে যাবে।’ আব্দুল লতিফের মতোই শ্রী ফেলু চন্দ্র মহন্তসহ মেলায় আসা অন্যান্য মিষ্টির বিক্রেতারা জানান, শতাধিক দোকানে বিক্রির জন্য আনা হয়েছে অন্তত ২০ হাজার মণ মিষ্টি।
মায়ের সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই মাছের মেলায় আসতেন চুড়ি-ফিতার দোকানদার মো. শরিফ। গত বছর মেলায় দোকান দিয়েছিলেন তিনি। এক দিনের মেলায় বিক্রি হয়েছিল ৫০ হাজার টাকা। এবার তিনি ১ লাখ টাকা বিক্রির লক্ষ্য নিয়ে দোকানে তুলেছেন কাঁচের চুরির পাশাপাশি কানের দুল, নাকের নোলক আর বিভিন্ন ধরনের চুলের ফিতা। শরিফ বলেন, ‘মাছের মেলার পরদিন বউ মেলায় চুরি ফিতা দুলের চাহিদা থাকে বেশি। সে বিষয়টি মাথায় রেখে মেয়েদের জিনিসপত্রই দোকানে তুলেছি বেশি।’
ক্রিকেট ব্যাট বিক্রেতা আবু বক্কর সিদ্দিকের সঙ্গে কথা হয় তার দোকানে। তিনি জানান, গত বছর এ মেলায় বিক্রি হয়েছে ৪০০ ব্যাট। এবার তিনি আরও বেশি মাল তুলেছেন। তার ধারণা মেলাকে কেন্দ্র করে এবার যে ৪৬৭টি ছোট-বড় ব্যাট এনেছেন তার সবই বিক্রি হয়ে যাবে।
দা-বঁটিসহ লোহার তৈরি গৃহস্থালির নানা ধরনের জিনিস নিয়ে মেলায় এসেছেন আকুল কর্মকার। তিনি জানান, আকার ও জিনিসের ধরন অনুযায়ী দা-বঁটিসহ বিভিন্ন জিনিস বিক্রি হবে ৫০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত দরে।
টমটম বা স্থানীয়ভাবে টরটরি হিসেবে পরিচিত খেলনার দোকানও বসেছে অনেকগুলো। বগুড়ার দুঁপচাচিয়া উপজেলার ধাপেরহাট এলাকা থেকে প্রায় ১ হাজার খেলনা টমটম নিয়ে এসেছেন গোলাম সাগিদার। কত দাম টমটমের এ প্রশ্নের জবাবে গোলাম বলেন, ‘প্রতিটি টমটম বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা দরে। তবে রকেটের দাম কিছুটা বেশি।’
স্থানীয়রা জানান, মেলাকে কেন্দ্র করে কয়েকদিন আগেই স্বজন আর জামাই-বউরা বাড়িতে আসা শুরু করেন। থাকবেন আরও ৪-৫ দিন। এক সময় এ মেলাকে কেন্দ্র করে ছুটি দেওয়া হতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বন্ধ রাখা হতো বাজারের দোকানপাট।