
ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক তার ‘একুশের মুহূর্তগুলো’ গ্রন্থে লিখেছেন, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পাকিস্তান শিক্ষা কমিশনের সুপারিশের পর ঢাকার ছাত্রসমাজে যে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের সূচনা হয় তাতে ঢাকা শহরের অধিকাংশ স্কুল, প্রতিটি কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্রাবাসের ছাত্ররা অংশগ্রহণ করে। তবে তখন পর্যন্ত এই আন্দোলন (বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার) পুরোনো ঢাকার যুব-মানসে সাড়া জাগাতে পারেনি। তাদের সমর্থন লাভ করেনি। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষের নানা অপপ্রচার, ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি এবং সেই সঙ্গে ঢাকার নবাববাড়ীর উর্দুর পক্ষে অবস্থান ও তাদের প্রচার-প্রভাবই ছিল এর কারণ। তবে আরও একটি কারণ কিছুটা হলেও কাজ করে থাকতে পারে। পুরোনো ঢাকার বাসিন্দা যাদের ‘ঢাকাইয়া’ নামে ডাকা হয়, তাদের কথ্যভাষা ছিল বাংলা-উর্দু মেশানো এক রকম দো-আঁশলা ভাষা। তাই তাদের উর্দুর পক্ষে টানা সহজ হয়েছিল।
শিক্ষা কমিশনের একপেশে নীতি এবং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবি উপেক্ষা করার প্রতিক্রিয়ায় এর আগে ছাত্রদের যে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সংঘটিত হয়, তা সীমাবদ্ধ ছিল উত্তর ঢাকা তথা বৃহত্তর রমনা এলাকায়। পুরোনো ঢাকায় বাংলা ভাষাবিরোধী প্রচারণার ফলে রক্ষণশীল চেতনার স্থানীয় যুবকদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। তাদেরই কয়েকজন ১৯৪৭ সালের ৯ ডিসেম্বর কয়েকটি বাস ও ট্রাকে চড়ে উর্দুর পক্ষে স্লোগান দিতে দিতে রমনা এলাকায় এসে পড়েন। তারা পলাশী ব্যারাক এবং পার্শ্ববর্তী মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রদের ওপর হামলা চালায়। পলাশী ব্যারাক তখন ছিল বেশকিছুসংখ্যক মেডিকেল ছাত্রের আবাসস্থল। অন্যরা সলিমুল্লাহ কিংবা ফজলুল হক হলে থাকতেন। মেডিকেল ছাত্রদের হোস্টেল তখনো তৈরি হয়নি।
ঢাকাই যুবাদের এই হামলার খবর দ্রুত আশপাশে ছড়িয়ে পড়লে পলাশী ব্যারাকের সরকারি কর্মচারী, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা আক্রান্ত ছাত্রদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। তাদের প্রতিরোধের মুখে দুর্বৃত্তরা দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। তবে পালানোর আগে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হোস্টেলের যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করে।
ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় স্থানীয় নাগরিকদের মধ্যে যথেষ্ট ক্ষোভ ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে সচেতনতা বাড়তে থাকে। ইতোমধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ মাঠে ঘটনার প্রতিবাদ এবং এই হামলার প্রতিকার চেয়ে বিরাট ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে বহু স্থানীয় মানুষ অংশগ্রহণ করেন। সভায় ঘটনার নিন্দা এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।