
সাতচল্লিশে দেশ ভাগের পর থেকে প্রগতিবাদী রাজনীতিবিদ, সংস্কৃতিকর্মীদের উদ্যোগে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বেগবান হলেও তা থমকে যায় আটচল্লিশের শুরুতে।
১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ সাল- এ তিন বছর রাষ্ট্রভাষার দাবিতে বলিষ্ঠ কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। ভাষাসংগ্রামীদের ভাষ্য অনুযায়ী, ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন মূলত ডানপন্থিরা। তাদের রাজনৈতিক অভিলাষের সুযোগ নেয় তৎকালীন সামরিক জান্তা। শাসকের দমন নীতির পাশাপাশি যুক্ত হয় নানা ষড়যন্ত্রের খেলা। ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিকের ভাষ্যে, সাধারণ মানুষ তখনো ‘জিন্নাহ ফ্যাক্টর’-এ মুগ্ধ।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে বেগবান করতে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটিকেও নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন উঠেছিল সেই সময়। মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে ছাপিয়ে তাদের রাজনৈতিক অভিলাষই তখন প্রকট হয়ে উঠেছিল বলে নানা প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন ভাষাসৈনিক, গবেষকরা। ভাষা আন্দোলনবিষয়ক বিক্ষোভগুলোকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে আর এগোনো যায়নি।
রাজপথে বা প্রকাশ্যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন তেমন সংগঠিত হতে না পারলেও পাকিস্তানের গণপরিষদে রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গ নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড বেধে যায়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। অধিবেশনে কংগ্রেস-দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকেও গণপরিষদের ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান তো বটেই; পূর্ববঙ্গের প্রতিনিধিরাও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবে অসম্মতি জানান। এ নিয়ে পরে ২৬ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন দানা বাঁধে ঢাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
সেই আন্দোলনকে ফলপ্রসূ করতে ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ১১ মার্চ ভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয় সংগ্রাম পরিষদ। এই আন্দোলনের তীব্রতায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন। কারণ গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসবেন ১৯ মার্চ। তাই তড়িঘড়ি করে খাজা নাজিমুদ্দীন শান্তিচুক্তির প্রস্তাব দেন সংগ্রাম পরিষদকে।
সাধারণ ছাত্ররা আন্দোলন স্থগিত করার পক্ষে মতো জানালেও সংগ্রাম পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা শান্তি চুক্তি মেনে নেন। তাদের সঙ্গে ৮ দফা চুক্তি স্বাক্ষর করেন খাজা নাজিমুদ্দীন। এতে সংগ্রাম পরিষদের ভাঙন অনিবার্য হয়ে ওঠে। এ ছাড়াও এই পরিষদের সদস্যদের মধ্যে নানা বিষয়ে মতানৈক্য ছিল।
একপর্যায়ে এই কমিটির আহ্বায়ক শামসুল আলমও পদত্যাগ করেন। পরে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনটি চলে যায় বামপন্থিদের হাতে, যার নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্রনেতা মোহাম্মদ তোয়াহা।
২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের নাগরিক সংবর্ধনা সভায়, ২৪ মার্চ কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনে জিন্নাহ বলেন, পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। এর প্রতিক্রিয়ায় ছাত্রসমাজ জোরালো প্রতিবাদ জানালেও তমদ্দুন মজলিস, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নীরবতা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। শেষ পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের গতিপথ বদলে যায়।