
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তখন নতুন মোড় এসেছে। তমদ্দুন মজলিস আর মুসলিম ছাত্রলীগ নেতারা এই আন্দোলনে ক্রমেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। তবে সাধারণ ছাত্ররা আন্দোলন সংঘটনের জন্য নানা উপায় খুঁজছিলেন। ১৯৫১ সালের ১১ মার্চ ঢাকার রমনায় আন্দোলন দিবস পালন করতে রাজপথে নেমে আসেন ছাত্র ফেডারেশনের নেতা-কর্মীরা।
ছাত্রনেত্রী নাদেরা বেগম, বামপন্থি নেতা নাসির আহমেদ ও সৈয়দ আফজাল হোসেনের নেতৃত্বে ছাত্ররা রাজপথে স্লোগান তোলেন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘উর্দুর জুলুম চলবে না’। ছাত্র ফেডারেশনের ব্যানারে এই মিছিলে মূলত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরাই সামনের দিকে ছিলেন। যথারীতি পুলিশ সেই মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
ভাষা আন্দোলনকে দমিয়ে দিতে পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকরা রাজনৈতিক দমননীতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কূটকৌশল গ্রহণ করেন। আরবি হরফে বাংলা লেখা চালু করতে পূর্ববঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে বেশ কয়েকটি বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র চালু করা হয়। এর পেছনে মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান। তার নেতৃত্বে প্রাথমিক শিক্ষাকে ইসলামি আদর্শে ঢালাই করার চেষ্টাও চলে প্রবল উদ্যমে।
এ সময় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করে মূলনীতি কমিটি। এ কমিটির বৈঠকে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে সুপারিশ করা হয়। তবে প্রবল আন্দোলনের মুখে সেই সুপারিশ বাতিল হয়ে যায়।
১৯৫০ সালে ভাষা আন্দোলনের পালে আবার হাওয়া লাগে। ঢাকা ছাড়িয়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন মহকুমা শহরেও ছড়িয়ে পড়ে। ওই বছরের শেষভাগে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে ঢাকার শিক্ষিত সমাজ আরেকটি কমিটি গঠন করে। মধ্য ও বামপন্থি নেতাদের মধ্যে দূরত্ব এ সময় কমে আসতে থাকে। তারা একের পর এক সভায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে বেগবান করতে পূর্ববঙ্গের রাজনীতিবিদদের চাপে রাখেন।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের অবদান নিয়ে এ সময় বেশ কিছু প্রশ্ন ওঠে। তবে রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে তিনি করাচিতে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন।
১৯৫১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক-সাংবাদিকসহ নানা পেশাজীবীর পক্ষ থেকে ‘অবিলম্বে পূর্ববঙ্গে সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন’-এর দাবি জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের কাছে স্মারকলিপি পাঠানো হয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. কাজী মোতাহার হোসেনসহ দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের স্বাক্ষর ছিল স্মারকলিপিতে।
১৯৫১ সালে ভাষা সংগ্রাম কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১১ মার্চ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানানো হয়। ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে দিবসটি বৃহদাকারে পালিত হয়। ঢাকায় ছাত্র-জনতার বিশাল জনসমাবেশ আলোড়ন তোলে। রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন ঘিরে শিক্ষা ও সাহিত্য সম্মেলনেও তোলপাড় কাণ্ড ঘটে যায় সে সময়। ১৯৫১ সালে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে এক অনুকূল পরিবেশ গড়ে ওঠে।