
চা-বাগানের বাংলো সাধারণত টিনশেডের হয়। কোনোটি আবার সেমি-পাকা আসাম প্যাটার্নের। এ যেন সিলেট অঞ্চলে চা-বাগানের বাংলোবাড়ির রীতি। সেই রীতির মধ্যে ব্যতিক্রম ছিল কেবল সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার সীমান্তবর্তী লোভাছড়া চা-বাগানে। ব্রিটিশ আমলে ১৮৭৪ সালে ছনের চালায় নির্মাণ করা হয়েছিল নানকার বাংলোটি। কিন্তু আগামী বর্ষা মৌসুমের সতর্কতায় সংস্কার করতে গিয়ে শটসার্কিটের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে এটি।
বুধবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যার দিকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে। আগুনে পুড়ে বাংলোটি প্রায় ভস্মীভূত হয়েছে। এতে প্রায় অর্ধ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হলেও দেড়শ বছরের পুরোনো বাংলো পুড়ে যাওয়ার মনঃকষ্টে ভুগছেন চা-বাগান কর্তৃপক্ষ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা ঘটনাটি ‘শোকবার্তা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
জানা গেছে, সিলেট অঞ্চলে ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত পরিচালিত একমাত্র চা-বাগান লোভাছড়া। উত্তরাধিকার সূত্রে চা-বাগানটির মালিক জেমস লিও ফারগুসন নানকা। তিনি একজন স্কটিশ মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের একটানা তিনবারের চেয়ারম্যান ছিলেন। বর্তমানে তিনি স্কটল্যান্ডে অবস্থান করছেন।
চা-বাগান পরিচালনায় থাকা তার ভাগ্নে ইউসুফ ওসমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্ষা মৌসুম আসায় বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দৃষ্টিনন্দন ছনের ছাউনিযুক্ত বাংলো ঘরের চালা মেরামতের কাজ করছিলেন শ্রমিকরা। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বিদ্যুতের একটি লাইন বাংলোঘরের পাশে ছনের খড়ের ওপর ছিঁড়ে পড়লে সেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই আগুনের লেলিহান শিখা পুরো বাংলোয় ছড়িয়ে পড়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। স্থানীয় লোকজন ও চা-বাগানের শ্রমিকরা আগুন নেভানোর চেষ্টা করলেও বাংলো ঘরটি রক্ষা করতে পারেননি।’
তিনি জানান, ১৮৭৫ সালে বাগানটি চালু হওয়ার সময় সিলেট অঞ্চলের বসতবাড়ির আদি কাঠামোর স্মৃতি রক্ষায় বাংলোটির চালে টিন ব্যবহার না করে ছন দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই থেকে ছন দিয়ে নির্মাণকাঠামো রক্ষা করে চলছিল। ছনের বাংলোবাড়ি সিলেট ও ভারতের চা-বাগানগুলোর মধ্যে একমাত্র লোভাছড়ায় ছিল। আগুনে পুড়ে বাংলো ঘরে থাকা জেমস লিও ফারগুসন নানকার পূর্ব পুরুষদের অনেক দুর্লভ ছবি, দামি আসবাবপত্র এবং সমস্ত জিনিসপত্রসহ দুটি রান্নাঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তবে অগ্নিকাণ্ডের সময় বাংলোয় কেউ অবস্থান না করায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে কানাইঘাট ফায়ার সার্ভিসের একটি টিম ঘটনাস্থলে গেলেও বাংলোর যাতায়াতের রাস্তা উঁচু থাকার কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি সেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
সীমান্তঘেঁষা চা-বাগানটি লোভা নদীর তীরে হওয়ায় পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় ছিল। আদি ঐতিহ্যের স্মারক লোভাছড়া চা-বাগানের বাংলোটি জেমস লিও ফারগুসন নানকার নামেও পরিচিত ছিল। স্থানীয় লোকজন ‘নানকার বাংলো’ নামে ডাকতেন। বাংলোটির আগের ও পুড়ে যাওয়া ছবি বুধবার রাতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দর্শনার্থীদের মধ্যে এ নিয়ে আক্ষেপ ও হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থায় বাগান কর্তৃপক্ষ ফেসবুকে ‘শোকবার্তা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ’ শীর্ষক একটি পোস্ট দিয়েছেন।
এতে বলা হয়, ‘দুঃখের সঙ্গে জানানো যাচ্ছে যে লোভাছড়া চা-বাগানের ঐতিহ্যবাহী বাংলো, যা নানকার বাংলো নামে পরিচিত, একটি দুর্ঘটনাজনিত আগুনে পুড়ে গেছে। এটি আমাদের পরিবারের ও এলাকার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল, যা হারিয়ে যাওয়ায় আমরা গভীরভাবে শোকাহত। আমাদের এই কঠিন সময়ে পাশে থাকার জন্য এবং সমবেদনা জানানোর জন্য শুভাকাঙ্ক্ষী, বন্ধু ও এলাকাবাসীর প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই। আপনাদের ভালোবাসা ও সমর্থন আমাদের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান।’
বাংলোটি আগের কাঠামোয় নির্মাণ করার আকুতিও প্রকাশ পেয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে যোগাযোগ করলে চা-বাগানের মালিক পক্ষের প্রতিনিধি ইউসুফ ওসমান খবরের কাগজকে জানান, বিকেলে তারা একজন প্রকৌশলীকে দিয়ে আগের কাঠামোয় নির্মাণ সম্ভব কি-না, এতে ব্যয় কী পরিমাণ হবে, এসব নির্ধারণ করবেন। এরপর বাংলোটির নির্মাণকাঠামোর ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
টিন বা টালির দুষ্প্রাপ্যতায় সিলেট অঞ্চলে এক সময় ছনের ঘরের ব্যাপক প্রচলন ছিল বলে জানিয়েছেন স্থপতি রাজন দাশ। এরপর সেমি-পাকা আসাম প্যাটার্নের বাড়িঘর নির্মাণ শুরু হয়েছিল।
লোভাছড়া চা-বাগানটির ছনের বাংলোটি সেই আদি ঐতিহ্যের রীতি বহন করছিল জানিয়ে এই স্থপতি খবরের কাগজকে বলেন, ‘ছনের এমন বাড়ি পাহাড়-পাদদেশে খাসিয়াদের বসতবাড়িতে বেশি দেখা যেত। এটি হাজার বছরের পুরোনো একটি স্থাপনা-রীতি। কেবল ঐতিহ্যের প্রতি অনুরাগী হয়ে বর্তমান সময়ে এ রকম ঘর লালন করা অসাধারণ কর্ম। অবিকল ছনের বাংলো নির্মাণের মধ্য দিয়ে সেই ঐতিহ্য লালন করা সম্ভব। কারণ, ছনের ঘর বা বাড়ি প্রায় হারিয়ে গেছে। এটিই সম্ভবত সর্বশেষ নিদর্শন বা চিহ্ন ছিল।’
সালমান/