
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী পাহাড়ি উপজেলা কলমাকান্দা ও দুর্গাপুরে। নৈসর্গিক ভূ-প্রকৃতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বাসস্থান হিসেবে দর্শনার্থীদের কাছে এ দুই উপজেলার বিশাল আকর্ষণ রয়েছে। এখানকার একটি সম্প্রদায়ের নাম হাজং। তাদের রয়েছে আলাদা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যমণ্ডিত মাতৃভাষা। তাদের এ ভাষার নাম ‘হাজং’ ভাষা। তবে নানা কারণে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে তাদের প্রিয় এ মাতৃভাষা।
হাজংদের আক্ষেপ, তাদের মাতৃভাষা আজ অস্তিত্বসংকটের শিকার। সেদিন দূরে নয়, যেদিন নতুন প্রজন্মের শিশুরা জানতেই পারবে না তাদের পূর্বপুরুষদের মাতৃভাষা কেমন ছিল? কীভাবে তারা তাদের ভাষায় কথা বলত? কী করে তাদের নিজস্ব ভাষায় গান গাইত? কীভাবে নিজেদের মাতৃভাষায় ধর্মীয় উৎসব উদযাপন করত?
পৃথিবীজুড়ে বিলুপ্ত হওয়া ভাষার মধ্যে অধিকাংশই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের ভাষা। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীর সাড়ে ছয় হাজারের বেশি ভাষার মধ্যে আড়াই হাজারেরও ওপর বিলুপ্তির পথে। ‘হাজং’-এর মধ্যে একটি। এই গোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষ এখন বাংলা ভাষায় কথা বলেন। তাদের শিশুদের অনেকের কাছে মাতৃভাষা হাজং অজানা। অনেক শিশু হাজং ভাষায় কথা বলতে পারে না। এ ভাষায় লিখিত বই না থাকায় শিক্ষার্থীদের চর্চা করার জন্যও তেমন কোনো সুযোগ নেই।
মাতৃভাষা বিলুপ্তির প্রধান কারণ হিসেবে এ ভাষায় কোনো প্রকার বইপত্র না থাকাকে তারা চিহ্নিত করেন। সরকারি কোনো জোরদার পদক্ষেপ নেই বলেও অনেকে অভিযোগ করেন। ভাষা বিলুপ্তির কারণ হিসেবে কেউ কেউ বাংলা ও ইংরেজি ভাষার প্রভাবকে নিয়ামক হিসেবে উল্লেখ করেন। হাজংদের ভাষা নিয়ে গবেষণা করার মতো তেমন কোনো প্রতিষ্ঠানও নেই বললেই চলে।
অতীতে সীমান্তবর্তী এলাকায় হাজং নৃগোষ্ঠীর সবাই মাতৃভাষায় কথা বলতেন। সেই ভাষা বিভিন্ন কারণে আজ লোকমুখে নেই বললেই চলে। কেউ কেউ এ ভাষায় কথা বলতে পারলেও অফিস-আদালতে ব্যবহার নেই। ফলে তাদের বাধ্য হয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা দিয়েই বিভিন্ন কাজকর্ম করতে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে বাংলা ভাষা শিখতে হচ্ছে, লিখতে-পড়তে হচ্ছে। শহরে যারা পড়ালেখা করেন, তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। এ ভাষা বাঙালি জাতির কেউ বোঝে না।
কলমাকান্দার সজীব হাজং বলেন, ‘হাজং সম্প্রদায়ের ভাষা সমাজে প্রচলিত নেই। এ ভাষা শুনে বাঙালিরা হাসাহাসি করে। হাজং ভাষায় আর কথা বলা সম্ভব নয়। যে জন্য এটি লোপ পেয়েছে। কারণ আমরা সংখ্যায় কম। অবশ্য আমরা অনেকেই এ ভাষা ভালো করে জানি না। এর কোনো লিখিত রূপ নেই। ফলে এটি মৃত ভাষায় পরিণত হয়েছে।’
দুর্গাপুরের বাসিন্দা মহিম হাজং বলেন, ‘নতুন প্রজন্মের শিশুরা হাজং ভাষায় কথা বলে না। তারা বাংলা ভাষায় লেখাপড়া করে ও কথা বলে। অনেক শিশু কেজি স্কুলে ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করছে। তারা এই যুগে বাংলা ও ইংরেজিতে কথা বলে। হাজং ভাষা টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এ ভাষায় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা দরকার।’
বাংলাদেশ হাজং ছাত্রসংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক অন্তর হাজং বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে হাজংদের ভাষা নিয়ে কাজ করছি। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি ভাষা সাহিত্য চর্চা কেন্দ্র গড়ে তুলেছি, যা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। সরকারি উদ্যোগে হাজং ভাষা সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য বর্তমান সরকারের কাছে সবিনয়ে দাবি জানাচ্ছি। এতে হাজংদের ভাষা বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে।’
বাংলাদেশ প্রেসক্লাব নেত্রকোনা জেলা কমিটির উপদেষ্টা সাংবাদিক শ্রী অরবিন্দ ধর বলেন, ‘হাজং নৃগোষ্ঠীর ভাষা দেশের ঐতিহ্য। এখন তাদের অধিকাংশ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। তবে কোনোমতেই হাজংদের ভাষা হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না। এ বিষয়ে সরকারিভাবে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।’
জেলা উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, হাজং নৃগোষ্ঠীর ভাষা টিকিয়ে রাখতে হলে তাদের নিজেদের মাতৃভাষায় বই লেখা প্রয়োজন। এ ভাষায় কথা বলা ও চর্চাকেন্দ্র স্থাপন করা প্রয়োজন। সরকার ইচ্ছা করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। এতে একটি ভাষা বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে।