চিত্রিত মৃৎপাত্র অর্থাৎ রং দিয়ে নকশা আঁকা একধরনের পাত্র হচ্ছে শখের হাঁড়ি। আকার-আকৃতির দিক থেকে সাধারণ হাঁড়ির মতোই, পার্থক্য শুধু গায়ে। সাধারণ হাঁড়িতে খুব একটা রং ও নকশা করা থাকে না, কিন্তু শখের হাঁড়ির গায়ে উজ্জ্বল রং দিয়ে দৃষ্টিনন্দন চিত্র আঁকা হয়। দৃশ্যমান করা হয় ফুল, লতা-পাতা, পাখি, মাছসহ নানা কিছু।
মাটির তৈরি বিভিন্ন আকারের হাঁড়িতে শৈল্পিক এমন কারুকার্য দেখে মন ছুঁয়ে যাবে যে কারও। প্রতিবছর বৈশাখে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়াগায় বিপুল চাহিদা থাকে এই শখের হাঁড়ির। আসন্ন বৈশাখী মেলাকে ঘিরে রাজশাহীর পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভার বসন্তপুর গ্রামে শখের হাঁড়িসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরির কারুশিল্পীদের ব্যস্ততা বেড়েছে। দিন-রাত সমানতালে কাজ করছেন তারা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পবার বসন্তপুরের পালপাড়ায় প্রতিটি পরিবার মাটির তৈরি নানান জিনিসপত্র তৈরি করছেন। এসব জিনিসপত্র বিক্রি করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। তাদের তৈরি করা পণ্যের বেশির ভাগই গৃহস্থালি ও সাংসারিক সাজসজ্জার পণ্য। তবে ব্যতিক্রম কিছু পণ্য তৈরি করে পালপাড়ার কয়েকটি পরিবার। তারা মূলত দেশের বিভিন্ন মেলাকে টার্গেট করে মাটি দিয়ে হাঁড়ি, পুতুল, মুখোশ, ঘোড়া, কচ্ছপ, ছোট-বড় পুতুল, মাছ, সিংহ, হাতি, কবুতর, পেঁচা, বাঘ তৈরি করে। এ পণ্যগুলো বিভিন্ন মেলায় বিক্রি করেন তারা। ফলে আসন্ন বৈশাখী মেলাকে ঘিরে কারুশিল্পীদের ব্যস্ততা বেড়েছে।
কারিগররা জানান, বৈশাখ এলেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গার মানুষ। এতে কাজের চাপ বাড়ে। তবে বৈশাখ শেষ হলে আর কোনো বিশেষ চাহিদা থাকে না। শখের হাঁড়ির কারিগর মৃত্যুঞ্জয় কুমার পাল জানান, বৈশাখী মেলার আয়োজন নিয়ে তাদের ব্যস্ত থাকতে হয়। সারা দেশ থেকে ক্রেতারা আসেন শখের হাঁড়ি কিনতে। ৪ পিসের শখের হাঁড়ি, ছোট পাতিল, সাজি, পঞ্চ সাজি, মাটির পুতুল, খেলনা এসব কিনে নিয়ে যান ক্রেতারা।
ওই গ্রামের আনন্দ কুমার পাল বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই দেখে আসছি শখের হাঁড়ি। আগে অনেক পরিবারই এ কাজ করত। এখন কারিগরের সংখ্যা কমছে। শৌখিন মানুষের কাছে শখের হাঁড়ির চাহিদা আছে। তবে আগের মতো নেই। তবে শুধু শখের হাঁড়িকে কেন্দ্র করে শখের হাঁড়ির কারিগর সুশান্ত কুমার পাল জায়গা করে নিয়েছেন চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ে। সেখানে তার ছবিসহ গল্প রয়েছে। আর রাষ্ট্রীয় পদক ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন পুরস্কার। ঘুরে বেরিয়েছেন জাপান, শ্রীলঙ্কা ও নেপালে।
সরেজমিনে সুশান্ত কুমার পালের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বৈশাখী মেলাকে কেন্দ্র করে শখের হাঁড়ি তৈরিতে সবাই ব্যস্ত। কেউ মাটি তৈরি করছেন, কেউবা শখের হাঁড়ি তৈরি করছেন। আবার কেউ কেউ সেগুলোতে রং চড়াচ্ছেন। রং আর শখের হাঁড়িগুলো শুকানোর কাজে সুশান্তকে সহযোগিতা করেন পরিবারের অন্য সদস্যরাও।
সুশান্ত কুমারের পুত্রবধূ করুণা রানী পাল বলেন, ‘হাতে সময় নেই। ঢাকার দুই জায়গায় বৈশাখী মেলা উপলক্ষে অর্ডার আছে। তাই সাতসকালে কাজে বসেছি। দুপুর গড়িয়ে গেছে। তাও কাজ শেষ হয়নি। সেখানে সাজসজ্জা ছাড়াও অনেক কাজ রয়েছে। তাই বাড়ির সবাই শখের হাঁড়ি তৈরির কাজে লেগে গেছি। সকাল থেকে ১০০ সেট রং-তুলি শেষ করেছি। একেকটা সেটে চারটি করে শখের হাঁড়ি আছে। এর মধ্যে ৪ পিসের শখের হাঁড়ি, ছোট পাতিল, সাজি, পঞ্চ সাজি, মাটির পুতুল, খেলনা।
তিনি আরও বলেন, এ বছর ২০ টাকা থেকে শুরু করে ১ হাজার টাকা দামের শখের হাঁড়ি রয়েছে। এখানে দামটা বিষয় নয়, শখের হাঁড়ি রাজশাহীর ঐহিত্য। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, রাজশাহীর শখের হাঁড়ি রাজশাহীর মানুষ তেমন চেনেন না। শখের হাঁড়িতে বিভিন্ন প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়। হাঁড়ির শরীরে লাল, নীল, সবুজ, বেগুনি বা খয়েরি রঙে আঁকা থাকে পদ্ম, মাছ, ধানের ছড়া, লক্ষ্মীপ্যাঁচা, সিঁদুরের কৌটা ইত্যাদি।
শখের হাঁড়ির কারিগর সুশান্ত কুমার পাল বলেন, ‘৩৭ বছর ধরে ঢাকার বিসিকে মেলা করছি। এবার আমাকে মেলার জন্য বলেনি। প্রতিযোগিতার জন্য ২৭ মার্চ শখের হাঁড়ি জমা দিয়েছিলাম। তবে মেলায় অংশগ্রহণের জন্য কর্তৃপক্ষ আমাকে কিছু বলেনি। বিসিক কর্তৃপক্ষ আমার সঙ্গে যোগাযোগও করেনি। সোনারগাঁও মেলায় যাওয়া-আসা আছে। সেখানে আমার দোকান আছে। বৈশাখে আমি ছয়টি মেলা করি। কিন্তু এবার মাত্র একটি মেলা করতে হবে।’
এ বিষয়ে সুশান্ত কুমার পাল বলেন, ‘শুধু শখের হাঁড়ির কারণে আমার এত পরিচিতি। আমি দক্ষতা পুরস্কার পেয়েছি ১৮টি, শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছি ৪টি। এ ছাড়া গত বছর লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন থেকে আজীবন সম্মাননা পেয়েছি।’