
রেলসেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজের বয়স ১১০ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ ৪ মার্চ। বিট্রিশ শাসন আমলে রেলপথ নির্মাণের সময় উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপনে পাবনার ঈশ্বরদীর পাকশী পদ্মা নদীর ওপর নির্মাণ করা হয় এ ব্রিজ। ১৯১৫ সালের এই দিনে রেল চলাচলের জন্য ব্রিজটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রেলসেতু।
পাকশী রেলওয়ে বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯১৫ সালের ৪ মার্চ ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ ব্রিজটির নির্মাণ শেষে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এরপর ব্রিজের ওপর দিয়ে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। পরে তার নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ।’ এই ব্রিজের নির্মাণশৈলী দৃষ্টিনন্দন অপূর্ব। ১৫টি গার্ডার সংবলিত ব্রিজটি শত বছর আগের প্রকৌশলীদের দক্ষতার স্বাক্ষর বহন করে।
পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে সেতু প্রকৌশল কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯০৯ সালের শুরুতে প্রাথমিক জরিপ, জমি অধিগ্রহণ ও প্রয়োজনীয় পাথর সংগ্রহের কাজ শুরুর মধ্য দিয়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নির্মাণকাজ শুরু হয়। এ কাজ শেষ হয়েছিল ১৯১৪ সালের ডিসেম্বরে। ব্রিজটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর পরীক্ষামূলকভাবে ১৯১৫ সালের ১ জানুয়ারি ব্রিজের ওপর দিয়ে মালবাহী ট্রেন চালানো হয়। একই বছরের ৪ মার্চ যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলের জন্য ব্রিজটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। ব্রিজটির ওপর দুটি ব্রডগেজ রেললাইন রয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘতম এই রেলসেতুটিতে রয়েছে ১৫টি স্প্যান। স্প্যানগুলোর উচ্চতা ৫২ ফুট। প্রতিটি স্প্যানের ওজন ১২৫০ টন। প্রধান ১৫টি স্প্যান ছাড়াও সেতুর উভয় পাশে রয়েছে ৩টি করে অতিরিক্ত ৬টি ল্যান্ডস্প্যান। ল্যান্ডস্প্যানগুলোর প্রতিটির বিয়ারিংয়ের দৈর্ঘ্য ৭৫ ফুট। নির্মাণশৈলী ও নান্দনিক দৃশ্যপটে চোখজুড়ানো হার্ডিঞ্জ সেতুটি সেই সময়ের বর্ষা মৌসুমের হিসাব অনুযায়ী সর্বোচ্চ পানির লেভেল থেকে ৪০ ফুট এবং গ্রীষ্মে সর্বনিম্ন পানি প্রবাহ থেকে ৭১ ফুট উচ্চতায় নির্মিত হয়। পানির উচ্চতা হিসাব করে সেতুটি নির্মাণ করা হয় এ কারণে যে, সেতুর নিচ দিয়ে স্টিমারসহ বড় বড় নৌকা যাতে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে।
শৈল্পিক কারুকাজের দৃষ্টিনন্দন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ঈশ্বরদী উপজেলার একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। এই ব্রিজ শুধু ঈশ্বরদী, পাবনা নয়, বাংলাদেশের অহঙ্কারের প্রতীক। ঈশ্বরদী উপজেলা শহর হতে প্রায় ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে পাকশী ইউনিয়নে পদ্মা নদীর ওপর ব্রিজটির অবস্থান। ব্রিজটির পাশে যানবাহন চলাচলে লালন সেতু নির্মাণ করায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই সৌন্দর্যের আরও বিস্তৃতি ঘটেছে ব্রিজটির পাশ ঘেঁষে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার জন্য। এই ত্রি-মাত্রিক সৌন্দর্য মিশ্রণের অপরূপ দৃশ্য দেখার জন্য এ এলাকায় প্রতিদিন প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটছে। এ কারণে দাবি উঠেছে বিস্তীর্ণ এলাকা ঘিরে পরিকল্পিতভাবে মনোরম পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আজ থেকে ১৩৪ বছর আগে ১৮৮৯ সালে ব্রিটিশ সরকার তৎকালীন অবিভক্ত ভারত সরকার আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড ও উত্তরবঙ্গের সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ সহজতর করার লক্ষ্যে পদ্মা নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণের প্রস্তাব করেন। ১৯০৮ সালে ব্রিজ নির্মাণের অনুমতি পাওয়ার পর বৃটিশ প্রকৌশলী স্যার রবার্ট গেইলস হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরে তার নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ।’
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উত্তর-দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে পাকহানাদার বাহিনী রেল যোগাযোগ বন্ধ করতে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর একটি বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করা হয়। বোমার আঘাতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ১২ নম্বর গাডার স্প্যানটি ভেঙে নিচে পড়ে যায়। দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। এতে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরের বছর ১৯৭২ সালে একই নকশায় তৈরি করে গাডার স্প্যানটি পুনঃস্থাপন করা হয়।
রেলওয়ে পাকশী বিভাগীয় কার্যালয়ের প্রকৌশলী-২ বীরবল মন্ডল বলেন, দেশের ঐতিহ্যবাহী হার্ডিঞ্জ ব্রিজটি ১১০ বছরেও এখনো পূর্ণ যৌবনা। তখন থেকেই বলা হয়েছে ১২০ বছর পর্যন্ত ব্রিজের ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচলে সমস্যা হবে না।
তিনি বলেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ ব্রিজটি পর্যবেক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ কাজ নিয়মিত হয়ে থাকে।