
প্রাচীন স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন ঐতিহ্যবাহী শালবন বিহারের পর কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ে প্রাচীন স্থাপনার খোঁজ মিলতে শুরু করেছে। জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলার বারপাড়া ইউনিয়নের ধর্মপুর গ্রামের ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি জায়গার মাটি খননের সময় এই পুরাকীর্তির সন্ধান মেলে। পরে লালমাই পাহাড়ের দক্ষিণাংশে ‘বালাগাজীর মুড়া’ হিসেবে পরিচিত স্থানটিতে পুরাকীর্তি অনুসন্ধানে কাজ শুরু করে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। খননের পর সেখান থেকে প্রাচীন স্থাপনা ও প্রত্নবস্তু বেরিয়ে আসছে। ধারণা করা হচ্ছে, ১০ থেকে ১২ একর এলাকাজুড়ে খনন করা গেলে শালবন বিহার, আনন্দ বিহার কিংবা রূপবান মুড়ার মতো আরও একটি নিদর্শন উন্মোচিত হতে পারে। এমনকি ব্যতিক্রমী কোনো নিদর্শন পাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা।
ময়নামতি জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান ও খননকার্য পরিচালনার সদস্য শাহীন আলম বলেন, ‘পরিদর্শনকালে দেখা যায়, বড় বড় ইট দিয়ে তৈরি প্রায় ছয় ফুট চওড়া প্রাচীন একটি দেয়ালের অংশবিশেষ উন্মোচিত হয়েছে, যা হয়তো কোনো স্থাপনার কর্নার। খননকালে মৃৎপাত্রের ভগ্ন টুকরোবিশিষ্ট তিন-চার ফুট পুরু একাধিক মাটির স্তর সরানোর পরে সন্ধান মেলে প্রাচীন সভ্যতার ঐতিহ্যবাহী দেয়ালের এ ধ্বংসাবশেষ।’
প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও অনুসন্ধান দল প্রাথমিকভাবে মনে করছে, বালাগাজীর মুড়া নামে পরিচিত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটিতে উন্মোচিত প্রাচীন স্থাপনার এই ধ্বংসাবশেষটি লালমাই, ময়নামতিতে আবিষ্কৃত হাজার বছর আগের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান শালবন বিহার, আনন্দ বিহার, ভোজ বিহার, ইটাখোলা ও রূপবান মুড়ার প্রাচীন মন্দির ও বিহারের ধ্বংসাবশেষের সমসাময়িক হতে পারে।
দলের অন্যতম সদস্য শাহীন আলম বলেন, ‘বালাগাজীর মুড়ায় মাত্রই তো খনন ও অনুসন্ধান কাজ শুরু করা হয়েছে। প্রকৃত সময় সম্পূর্ণ খনন ও গবেষণা কাজ সম্পন্ন করার পর জানা যাবে। বালাগাজীর মুড়া স্থানীয়দের কাছে চারা বাড়ি নামে সুপরিচিত। মূলত এ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটির ওপরিভাগে প্রচুর চারা অর্থাৎ মৃৎপাত্রের ভগ্ন টুকরো থাকায় স্থানীয়ভাবে এ নামকরণ হয়।’
বালাগাজী মুড়ায় খনন-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাস্টোডিয়ানের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক ড. মোছা. নাহিদ সুলতানা বলেন, ‘প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রায় ৮০ বছর আগে বালাগাজীর মুড়াকে সংরক্ষিত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ঘোষণা করা হয়, যা ১৯৪৫ সালের শিমলা গেজেটে প্রকাশ করা হয়। নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে এ বছর বালাগাজীর মুড়ায় খনন ও অনুসন্ধান কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে।’
খনন ও অনুসন্ধান কাজের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ফিল্ড অফিসার) আবু সাইদ ইনাম তানভীর বলেন, ‘এপ্রিল মাসের প্রথম দিক থেকে বালাগাজীর মুড়ায় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও অনুসন্ধান কাজ শুরু করা হয়েছে, যা আগামী জুন মাস পর্যন্ত চলবে।’
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত মাসের (এপ্রিল) প্রথম সপ্তাহে ধর্মপুর গ্রামের জসিম উদ্দিন বসতভিটা নির্মাণের জন্য তার মালিকানাধীন জায়গার মাটি খনন শুরু করেন। এ সময় সেখানে লাল ইটের প্রাচীন স্থাপনাটি দেখতে পেয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কুমিল্লা আঞ্চলিক কার্যালয়কে জানানো হয়। খবর পেয়ে তাদের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এবং খনন ও অনুসন্ধান শুরু করে। গতকাল সোমবার সকালেও সেখানে খনন কাজ চলমান থাকতে দেখা গেছে।
জমির মালিক জসিম উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘মাটি সমান করার সময় শ্রমিকদের কোদালের কোপে শক্ত ইটের গাঁথুনির বিষয়টি টের পাওয়া যায়। পরে একটু খুঁড়ে দেখা গেছে, প্রাচীন আমলের ইটের স্থাপনা। এমন ইট কুমিল্লা কোটবাড়ির শালবন বিহারে দেখা যায়। এরপর বিষয়টি জানতে পেয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের লোকজন খননের সিদ্ধান্ত নেয়। যদি নতুন কোনো প্রত্নস্থাপনা পাওয়া যায়, তাহলে এটি হবে আনন্দের সংবাদ।’