
নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজীপুর এলাকায় অবস্থিত চলনবিল জাদুঘর একসময় ছিল এ অঞ্চলের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণের প্রাণকেন্দ্র। দেশের সর্ববৃহৎ বিলের নামানুসারে এই জাদুঘরটি ১৯৭৮ সালে সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চলনবিলের কিংবদন্তি শিক্ষক আবদুল হামিদ। তবে অব্যবস্থাপনা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও সরকারি অনীহার কারণে জেলার একমাত্র এই জাদুঘরটি এখন ধ্বংসের মুখে। জাদুঘরটিতে রক্ষিত দুর্লভ প্রাচীন নিদর্শনগুলোর অনেক কিছুই আর নেই। নিদর্শন না থাকায় লোকসমাগমও নেই আগের মতো। মুঘল আমলের কিছু পুরোনো নিদর্শন নিয়ে জরাজীর্ণ ভবনে ঝুঁকিপূর্ণভাবে কালের সাক্ষী হয়ে আছে জাদুঘরটি । অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই এমন অবহেলা বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
এদিকে এই জাদুঘরের দেখভাল ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য থাকা একমাত্র ব্যক্তি আবু বকর সিদ্দিকও দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে চাকরি স্থায়ী করতে না পেরে অনেক কষ্টে জীবনযাপন করছেন। মাস্টাররোল কর্মচারী হিসেবে কর্মরত এই ব্যক্তি অল্প কিছু বেতনে পরিবার নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। বয়সে ততটা প্রবীণ না হলেও তার চোখেমুখে কষ্টের স্পষ্ট ছাপ। তাকে ও জাদুঘরটিকে দেখলেই মনে হয় তারা অযত্ন আর অবহেলায় ন্যুব্জ হয়ে পড়েছেন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলনবিলের কোল ঘেঁষে খুবজীপুর গ্রামে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত জাদুঘরটি। এটি ১৯৮৯ সালের ২ জুলাই প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় আসে। চলনবিল জাদুঘর নামে এই সংগ্রহশালাটি শুরুতে দ্বিতল ভবনে যাত্রা শুরু করে। পরে দোতলার কিছু অংশ ভেঙে যাওয়ায় বর্তমানে নিচতলার মাত্র দুটি কক্ষেই সীমাবদ্ধ জাদুঘরটি। ওই কক্ষগুলোতেই রাখা হয়েছে উপমহাদেশের প্রাচীন ও দুর্লভ কিছু নিদর্শন। ভবনটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়ায় নিরাপত্তার অভাবে ও সংস্কার-সংরক্ষণের নামে মূল্যবান অনেক জিনিস নিয়ে যাওয়া হয়েছে বগুড়ার মহাস্থান জাদুঘরে। পরে সেগুলো আর ফিরে আসেনি। চলনবিল জাদুঘরের স্যাঁতসেঁতে কক্ষগুলোতে রক্ষিত বাকি মূল্যবান দুর্লভ প্রত্নসম্পদগুলোও ক্ষতির মুখে পড়েছে। ফলে কালের সাক্ষী বহন করেই কোনো রকমে টিকে রয়েছে জাদুঘরটি। যেন দেখার কেউই নেই। তাই এতে নেই আগের মতো পর্যটকদের পদচারণ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গুরুদাসপুর উপজেলা থেকে চার কিলোমিটার উত্তরে খুবজীপুর ইউনিয়নে অবস্থিত অধ্যক্ষ আবদুল হামিদ কমপ্লেক্স নামে একটি ফটক। ভেতরে বিশাল খেলার মাঠ। মাঠের চারদিকে বড় বড় বেশ কিছু ভবন। এর মধ্যে খুবজীপুর বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় ও খুবজীপুর নজরুল প্রগতি সংঘের মাঝে এক কোণে ছোট্ট একটি সাইবোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চলনবিল জাদুঘর। আধুনিক ভবনগুলোর মাঝে জাদুঘরটিকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেউ যদি পেয়েও যান প্রথম দেখায় মনে হবে এটা কোনো পরিত্যক্ত ভবন। সাদামাটা একতলা সেই ঘরের প্রথম কক্ষে ঢুকেই চোখে পড়ে চলনবিলের বিভিন্ন পুকুর খননে পাওয়া ৩০০ বছরের পুরোনো মনসামঙ্গল ঘট। প্রায় প্রতিটি ঘটের গায়েই সাপের প্রতিকৃতির মতো নকশা। রয়েছে শিলপাটা, ধাতব তৈজসপত্র ও কড়ি। দেয়ালে সাঁটানো উটের চামড়ার ওপর ১৪০০ শতকের ইসলামি জলসার বর্ণনা। আলমারিগুলো সাজানো বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক ঝিনুক, ১৯৭২ সালে হাতে লেখা বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান এবং মিসরের পিরামিড পাথর। ওই কক্ষের তাকে থরে থরে রাখা সত্যপীরের পাঁচালিসহ গাছের বাকলে লেখা সংস্কৃত পুঁথি। পাশেই রয়েছে বাদশাহ আলমগীর ও সম্রাট নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহের নিজ হাতে লেখা দুটি কোরআন শরিফ, তুলট কাগজে হাতে লেখা ৩০০-৪০০ বছরের পুরোনো ৮টি সম্পূর্ণ ও ৭টি আংশিক কোরআন শরিফ, ১৫টি হাদিস শরিফ ও মহারানি ভবানীর নিজ হাতে লেখা দলিলসহ ২৫৭টি ধর্মগ্রন্থ। এসবই বন্দি করে রাখা হয়েছে কাচের আলমারিতে। এ ছাড়া রয়েছে ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর হাতে লেখা ব্যক্তিগত ডায়েরিও আছে।
আরেকটি কক্ষে রাখা মানুষের প্রাচীন খুলি, শত বছরের পুরোনো ইটের ওপর মাটির তৈরি তামবুড়া ফল এবং চলনবিলে প্রাচীনকালে ডাকাতদের ব্যবহৃত তলোয়ার এবং ছুরি। এ ছাড়া চার মাথা ও তিন মাথাওয়ালা বাঁশ দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে।
সরেজমিনে আরও দেখা যায়, জাদুঘরের মূল ভবনটি এখন অরক্ষিত। জানালা-দরজা দুর্বল হয়ে ভেঙে যাচ্ছে, ছাদে ধরেছে ফাটল। এতে পানি চুইয়ে পড়ে দেয়ালগুলোতে শ্যাওলা জমেছে। এ ছাড়া সংগ্রহশালাটির দুটি কক্ষই স্যাঁতসেঁতে। ফলে অধিকাংশ মূল্যবান দুর্লভ প্রত্নসম্পদগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে, বাকিগুলোও ক্ষতির মুখে পড়েছে। শুধু তাই নয়, নাজুক এই জাদুঘরে নিজস্ব কোনো বৈদ্যুতিক সংযোগ নেই, নেই ফ্যানের কোনো ব্যবস্থাও। আবার নেই কোনো টয়লেটও। ফলে নেই আগের মতো পর্যটকদের পদচারণ। এতে ইতিহাসের গর্ভে বিলীন হওয়ার শঙ্কায় রয়েছে চলনবিল জাদুঘর।
জাদুঘরটির কর্মচারী আবু বকর সিদ্দিক জানান, নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে ও সংস্কার-সংরক্ষণের নামে জাদুঘরে রক্ষিত লক্ষ্মী, সরস্বতী ও কৃষ্ণ মূর্তিসহ বেশ কিছু মূল্যবান নিদর্শন ঢাকা ও বগুড়ার মহাস্থান জাদুঘরে নেওয়া হয়। যেগুলো আর ফিরে আসেনি। আবার জাদুঘরটিরও কোনো সংস্কার না হওয়ায় দিন দিন পরিত্যক্ত ভবনে পরিণত হচ্ছে। তিনটি কক্ষবিশিষ্ট দোতলা অনেক আগেই ভেঙে ফেলা হয়েছে। এখন একতলা নিয়ে টিকে থাকা ভবনটির ছাদের পলেস্তরা খসে খসে পড়ছে। জানালার গ্রিলগুলো মরিচা পড়ে দুর্বল হয়ে ভেঙে যাচ্ছে। এতে মহামূল্যবান দুর্লভ প্রত্নসম্পদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
জাদুঘরটির মতো নিজেও কষ্টের মধ্যে আছেন জানিয়ে আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘২০০১ সালে জাদুঘরটির দেখভালের জন্য দৈনিক মজুরিভিত্তিতে কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ পাই। দীর্ঘ ২৪ বছরেও চাকরি স্থায়ী না হওয়ায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি।’
খুবজীপুর উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘খুবজীপুর একটি অজপাড়াগাঁ হলেও এখানকার অনেক আলোকিত মানুষ নিজ নিজ ক্ষেত্রে আলো ছড়াচ্ছেন। তেমনি একজন ব্যক্তি মরহুম কিংবদন্তি শিক্ষক আবদুল হামিদ নিজ উদ্যোগে চলনবিল জাদুঘরটি করেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে নানা অজুহাতে জাদুঘরটি অন্যত্র স্থানান্তরের চেষ্টা করছে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর। কিন্তু এলাকাবাসীর দাবির মুখে তা এখনো সম্ভব হয়নি। কিন্তু তাদের অসহযোগিতার কারণে দিন দিন ঐতিহ্য হারিয়ে পরিত্যক্ত ভবনে পরিণত হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী এই জাদুঘরটি। তবে এলাকাবাসীর প্রাণের দাবি, জাদুঘরটি যেন কোনোভাবেই কালের গর্ভে বিলীন না হয়। বরং এটা যেন আরও বিকশিত হয়। সে ক্ষেত্রে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।’
গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাহমিদা আফরোজ বলেন, ‘গুরুদাসপুর তথা নাটোর জেলার ঐতিহ্যবাহী সংগ্রহশালা চলনবিল জাদুঘর। বর্তমান এই জাদুঘরটি অনেক সংকটে রয়েছে বলে জেনেছি। আমাদের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ আছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব সরেজমিনে পরিদর্শন করে এটি সুরক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হবে।’