ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইলন মাস্কের বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক এখন ব্যক্তিগত লড়াইয়ের দিকে মোড় নিয়েছে। মাস্ক অভিযোগ করেছে, প্রয়াত যৌন অপরাধী এবং পাচারকারী জেফ্রি অ্যাপস্টেইনের সঙ্গে সম্পর্কিত ফাইলগুলোতে ট্রাম্পের নাম আছে। যদিও এ সম্পর্কে কোন প্রমাণ তিনি প্রকাশ করেননি।
মাস্কের এই অভিযোগের পরপরই ট্রাম্প কড়া প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি মাস্কের বক্তব্যকে ‘ভিত্তিহীন’ এবং ‘উন্মাদনার বহিঃপ্রকাশ’ হিসেবে আখ্যা দেন। ট্রাম্প বলেন, ‘মাস্ক নিজের মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। এ ধরনের দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা।’
মাস্কের এই অভিযোগ আসার পর ডেমোক্র্যাটরা আবার নড়েচড়ে বসেছে। ফলে অ্যাপস্টেইনের ফাইলগুলো আবার আলোচনায় এসেছে এবং ইতোমধ্যেই সেগুলো সম্পূর্ণরূপে প্রকাশের দাবি উঠেছে। ডেমোক্র্যাটরাও সবগুলো নথি প্রকাশের জন্য চাপ অব্যাহত রেখেছে।
এরপরই ৫ জুন ক্যালিফোর্নিয়ার প্রতিনিধি রবার্ট গার্সিয়া এবং ম্যাসাচুসেটস প্রতিনিধি স্টিফেন এফ. লিঞ্চ , তদারকি ও সরকার সংস্কার সংক্রান্ত হাউস কমিটির ডেমোক্র্যাটিক সদস্য মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডি ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) এর পরিচালক ক্যাশ প্যাটেলকে একটি চিঠি পাঠান।
এই চিঠিতে বলা হয়, ‘আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লিখছি যে, অভিযোগ উঠেছে যে দোষী সাব্যস্ত যৌন অপরাধী জেফ্রি অ্যাপস্টেইন সম্পর্কিত ফাইলগুলি প্রকাশ করা হয়নি এবং আমেরিকান জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করা হয়নি কারণ সেগুলি ব্যক্তিগতভাবে রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের সাথে জড়িত । তাহলে কি ট্রাম্প কি অ্যাপস্টেইনের ফাইলগুলি আটকে রাখছেন?
চিঠিটি পড়ে হোয়াইট হাউস প্রতিক্রিয়া হিসেবে জানায়, এই পদক্ষেপ আরেকটি স্টান্ট যা ভিত্তিহীন এবং বাস্তবতার সাথে কোনও মিল নেই।
অ্যাপস্টেইনের ফাইল সম্পর্কে যা জানা যায়
গত বছরের ২৭শে ফেব্রুয়ারি - ট্রাম্প প্রশাসনের হাই-প্রোফাইল মামলার বিষয়ে আরও স্বচ্ছ হওয়ার অঙ্গীকারের অংশ হিসেবে, বন্ডি অ্যাপস্টেইন সম্পর্কিত ১০০ পৃষ্ঠারও বেশি গোপন নথি প্রকাশ করা হয় ।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ট্রাম্প, ২০১৯ সালে অ্যাপস্টেইনের গ্রেপ্তার এবং পরবর্তীতে আত্মহত্যার পর থেকে তার ক্লায়েন্ট তালিকা নিয়ে যে দাবি উঠে তা স্পষ্ট করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ।
যদিও তখন বলা হয়, এটি গোপন নথি প্রকাশের ‘প্রথম পর্যায়’। কিন্তু প্রকাশিত পৃষ্ঠাগুলো দেখে মানুষ হতাশ হন কারণ বেশিরভাগ লেখাই সম্পাদনা করা ছিল।
এছাড়া এসময় নিউ ইয়র্ক টাইমস এক রিপোর্টে জানায়, বন্ডির প্রকাশনায় অ্যাপস্টেইনের ‘কালো বই’ নামে যে বই প্রকাশ করা হয়েছিল তাতে ট্রাম্প এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মতো ব্যক্তির নাম ছিল। তাছাড়া বইটিতে এমন কিছু ব্যক্তির নাম উল্লেখ ছিল যাদের সাথে অ্যাপস্টেন কখনও দেখাও করেননি, এবং তালিকাভুক্ত নামগুলো অ্যাপস্টেইনের কার্যকলাপের সাথে সম্পর্কিত নয়।
ট্রাম্প ও অ্যাপস্টেইনের কয়েক দশকের সম্পর্ক
ট্রাম্প ও অ্যাপস্টেইনের বন্ধুত্ব শুরু হয় ১৯৮০-এর দশকে। তারা নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন অভিজাত অনুষ্ঠানে একসঙ্গে যেতেন। তবে ২০০৪ সালের পর একটি রিয়েল এস্টেট চুক্তিতে মতবিরোধের কারণে তাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
২০০২ সালে নিউ ইয়র্ক ম্যাগাজিনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প জানান , এপস্টাইনের সাথে তার খুব মজার সম্পর্ক ছিল। এমনকি তিনি আরও জানান, তিনি আমার মতোই সুন্দরী মহিলাদের পছন্দ করেন, এবং তাদের অপেক্ষাকৃত তরুণদের দিকে তার আগ্রহ একটু বেশি।
২০১৯ সালের জুলাই মাসে, এনবিসি নিউজ টুডে ১৯৯২ সালের একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে, যেখানে ট্রাম্পকে তার মার-এ-লাগো এস্টেটে এপস্টাইনকে অভ্যর্থনা জানাতে দেখা যায়। এ সময় দুজনকে কথা বলতে বলতে হাসতে দেখা যায়।
তবে ২০১৯ সালে ফেডারেল যৌন পাচারের অভিযোগে এপস্টাইন গ্রেপ্তার হওয়ার পর, ট্রাম্প নিজেকে তার থেকে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নেন।
২০১৯ সালে ওভাল অফিসে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় ট্রাম্প জানান, তার (এপস্টাইনের) সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছিল। আমি ১৫ বছর ধরে তার সাথে কথা বলিনি। তাছড়া আমি তার ভক্ত ছিলাম না, এটা আমি আপনাদের বলতে পারি।
এদিকে ২০১৪ সালে ইলন মাস্ককেও অ্যাপস্টেইনের সহযোগী ঘিসলেন ম্যাক্সওয়েলের সঙ্গে একটি পার্টিতে দেখা গিয়েছিল। ঘিসলেন ম্যাক্সওয়েল ২০২২ সালে যৌন পাচারে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ২০ বছরের কারাদণ্ড পান। তার আপিল ২০২৪ সালে খারিজ হয়।
কে এই জেফরি অ্যাপস্টেইন ?
জেফরি অ্যাপস্টেইন ছিলেন একজন প্রভাবশালী মার্কিন ফাইন্যান্সিয়াল উদ্যোক্তা। ২০০০-এর দশকে তিনি অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের যৌন নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্ত হন। তবে প্রথম দফায় মাত্র ১৩ মাস জেল খেটে মুক্তি পান।
এরপর ২০১৯ সালে নতুন করে যৌন পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন এবং নিউইয়র্কের একটি কারাগারে আত্মহত্যা করেন। মার্কিন বিচার বিভাগ পরে জানায়, তার মৃত্যু ছিল নজরদারির ঘাটতি, অবহেলা এবং জেল কর্মীদের ব্যর্থতার ফল।
অ্যাপস্টেইনের মৃত্যুর পর একাধিক মামলার সূত্রে এবং তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমে হাজার হাজার পৃষ্ঠা নথি জনসমক্ষে আসে। এসব নথিতে মার্কিন ও বিদেশি রাজনীতিক, ব্যবসায়ী এবং গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের নাম উঠে আসে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে এ সংক্রান্ত সর্বশেষ নথিপত্র প্রকাশিত হয়।
ফাইলগুলোতে ডোনাল্ড ট্রাম্প, সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, ব্রিটিশ প্রিন্স অ্যান্ড্রু, ম্যাজিশিয়ান ডেভিড কপারফিল্ড এবং এক ভুক্তভোগীর বয়ানে মাইকেল জ্যাকসনের নামও আসে। তবে কারও বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ প্রমাণ হয়নি।
এই মুহূর্তে মাস্ক ও ট্রাম্পের মধ্যে সম্পর্কে ব্যাপক ফাটল দেখা দিয়েছে। মাস্কের এই অভিযোগ ট্রাম্পের জনসমর্থনের ওপর কতটা প্রভাব ফেলবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
সুলতানা দিনা/