প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আগামীকাল (৯ জুন) যুক্তরাজ্য সফরে যাচ্ছেন। এই সফরের সময় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়ে চিঠি দিয়েছেন সাবেক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগনি সাবেক ব্রিটিশ মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে লেখা এই চিঠিতে টিউলিপ তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে সৃষ্ট ‘ভুল বোঝাবুঝি’তে চলমান বিতর্ক নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ চেয়েছেন।
চিঠিতে টিউলিপ লিখেন, তিনি আশা করেন এই বৈঠক দুর্নীতি দমন কমিশনের সৃষ্টি করা ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে সাহায্য করবে।
রবিবার (৮ জুন ) বৃটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।
পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রতিবেদনটি এখানে প্রায় হুবহু তুলে ধরা হলো। এছাড়া এই প্রতিবেদনের নিচে দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত মূল প্রতিবেদনের লিংক সংযুক্ত করে দেওয়া থাকছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে একটি চিঠি লিখেছেন টিউলিপ। আগামী সপ্তাহে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস লন্ডন সফরে যাচ্ছেন। এ সময় তিনি রাজা চার্লস ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। ড. ইউনূসের এই সফরকালে তার সঙ্গে একটি আলোচনার সুযোগ চেয়েছেন টিউলিপ।’
চিঠিতে টিউলিপ লিখেন, ‘বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; যিনি আমার খালা, তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ও জড়িত থাকার বিষয়ে আমাকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে - দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযোগ থেকে এই যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে তা এই সাক্ষাৎ দূর করতে পারবে বলে আমি আশা করি।’
তিনি আরও লিখেন, ‘আমি যুক্তরাজ্যের নাগরিক। আমার জন্ম লন্ডনে এবং আমি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গত এক দশক ধরে হ্যাম্পস্টেড ও হাইগেটের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে আসছি।’
টিউলিপ সিদ্দিক আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে আমার হৃদয়ের টান রয়েছে ঠিকই কিন্তু সেখানে আমার কোনো সম্পত্তি বা ব্যবসায়িক স্বার্থ নেই। আমি ওই দেশে জন্মাইনি, থাকি না, এমনকি সেখানে আমার পেশাগত জীবনেরও কোনো সম্পর্ক নেই।’
টিউলিপ সিদ্দিক বলেন, ‘দুদককে আমি আগেও এ বিষয়ে পরিষ্কার করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমার লন্ডনের আইনজীবীদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগে আগ্রহ না দেখিয়ে বরং তারা বারবার ঢাকার একটি ঠিকানায় এলোমেলোভাবে চিঠিপত্র পাঠাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই কাল্পনিক তদন্তের প্রতিটি ধাপ গণমাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অথচ আমার আইনি দলের সঙ্গে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ করা হয়নি।’
প্রধান উপদেষ্টার প্রতি লেখা চিঠিতে টিউলিপ সিদ্দিক আরও বলেন, ‘আমি জানি, আপনি নিশ্চয়ই বোঝেন; এই প্রতিবেদনগুলোর কারণে আমার নির্বাচনী এলাকার জনগণ ও আমার দেশের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে যেন কোনো ব্যাঘাত না ঘটে সেটি নিশ্চিত করা কতটা জরুরি।’
টিউলিপের দাবি, তিনি তার খালা শেখ হাসিনাবিরোধীদের পরিচালিত একটি ‘রাজনৈতিক অপপ্রচার ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আক্রমণের’ লক্ষ্যে পরিণত হয়েছেন।
ইতোমধ্যে দুর্নীতির অভিযোগের জেরে ব্রিটিশ মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয়েছে টিউলিপকে। তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
গার্ডিয়ানের এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যরা সরকারি অবকাঠামো খাত থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন কি না - এ অভিযোগের তদন্ত করছে দুদক। এই অভিযোগের সূত্রপাত করেন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ।
দুদক এবং একাধিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, টিউলিপ সিদ্দিক বা তার মা শেখ রেহানা ‘ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়ে’ ৭ হাজার ২০০ বর্গফুট আয়তনের একটি জমি দখল করেছেন।
যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন টিউলিপ সিদ্দিক। তার আইনজীবীরা এসব অভিযোগকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ ও ‘ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেন।
এদিকে গত মাসে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো থেকে জানা যায়, টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
তবে টিউলিপ জানান, এমন কোনো পরোয়ানা বা আদালতে হাজিরার আদেশ সম্পর্কে তার জানা নেই। যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ ‘২ বি’ প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতাভুক্ত দেশ হওয়ায়, যুক্তরাজ্যে কাউকে গ্রেপ্তার করতে হলে বাংলাদেশ থেকে স্পষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ দেখাতে হয় - যা মন্ত্রী বা বিচারক পর্যায়ে যাচাই করে অনুমোদন দিতে হয়।
গত বছর যুক্তরাজ্যে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ওঠার পর টিউলিপ নিজেই ব্রিটিশ মন্ত্রীদের আচরণবিধি তদারক কর্মকর্তা লরি ম্যাগনাসের কাছে রিপোর্ট করেন। টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে তাকে সব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
লরি ম্যাগনাস জানান, তদন্তে তিনি কোনো প্রমাণ পাননি যে টিউলিপের সম্পদ অবৈধভাবে অর্জিত। তবে তিনি মত দেন, টিউলিপের উচিত ছিল - বাংলাদেশে তার পারিবারিক সম্পৃক্ততা থেকে উদ্ভূত ভাবমূর্তির ঝুঁকির বিষয়ে আগে থেকেই আরও সতর্ক থাকা।
এ ছাড়াও এই তদন্তে ২০১৩ সালে মস্কোতে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি পারমাণবিক চুক্তির সময় টিউলিপ সিদ্দিকের উপস্থিতি বিষয়টি খতিয়ে দেখা হয়। সে সময় টিউলিপের বিরুদ্ধে এই চুক্তিটির মধ্যস্থতাকারী হিসেবে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়।
তবে টিউলিপ জানান, তিনি তখন মস্কোতে পর্যটক হিসেবে অবস্থান করছিলেন। পরে তার এই ব্যাখ্যা যুক্তিযুক্ত মনে করে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
তবুও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ইকোনমিক সেক্রেটারি ও সিটি মিনিস্টারের পদ থেকে পদত্যাগ করেন টিউলিপ। এর পেছনে যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, এসব বিতর্ক কিয়্যার স্টারমারের নতুন সরকারের জন্য ‘বিভ্রান্তি’ তৈরি করছে। সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
সুলতানা দিনা/অমিয়/