দেখতে দেখতে এসে গেল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। দুই দিন পরই মার্কিনিরা ভোট দিয়ে তাদের পছন্দের প্রেসিডেন্টকে নির্বাচিত করবেন। কমলা হ্যারিস অথবা ডোনাল্ড ট্রাম্প হতে চলেছেন পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট। সর্বশেষ দেশব্যাপী জরিপে দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্পের তুলনায় কমলা হ্যারিস সামান্য এগিয়ে আছেন। দুজনেই শেষ মুহূর্তে ভোটারদের মন জয় করার জন্য দোদুল্যমান রাজ্যগুলো চষে বেড়াচ্ছেন।
নির্বাচনি পরিবেশ দেখতে আজ (গত শুক্রবার) বাইরে বেরিয়েছি। আমাদের দেশে তো এ রকম সময়ে, নির্বাচনের দুই-তিন দিন আগে, প্রচারের ধূম পড়ে যায়। কিন্তু এই দেশে সবকিছুই অনেক আলাদা। দেশজুড়ে নির্বাচনি প্রতিদ্বন্দ্বিতার হাওয়া বইছে ঠিকই, তবে জনপদগুলোতে সেটা খুব একটা বোঝা যাচ্ছে না। মার্কিনিরা হয়তো এ রকম নিস্পৃহ, ভোট হচ্ছে হোক। ভোট দিতে গেলেই হলো। অন্য যা কিছু, অর্থাৎ জীবনযাপনে বড় রকমের হেরফের নেই। এটা আরও স্পষ্ট হলো আজকের হ্যালোইন উৎসবকে কেন্দ্র করে।
আজ, হ্যাঁ, হ্যালোইনের বিকেল। আমি ব্রুকলিনের যে অ্যাপার্টমেন্টে আছি, সেই ভবনের সামনের চত্বরে দেখছি লাতিনো দুই তরুণী ধূমপান করছেন। তাদের হাতে ট্যাটু আঁকা। সঙ্গে এক লাতিনো কিশোরী। হ্যালোইন উপলক্ষে তারা যে সাজপোশাক পরেছেন, তা আমাদের চোখে খানিকটা দৃষ্টিকটু মনে হতে পারে। পরিচিত হতে আমি নিজেই ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম। জানা গেল, ওই দুই তরুণীর একজনের নাম মেরি, অন্যজন জেমি। জিজ্ঞেস করতেই জানালেন তারা ট্রাম্পকে ভোট দেবেন। লাতিনো হলেও তারা ট্রাম্পকে ভোট দেবেন শুনে অবাকই হলাম। ১৬ বছরের কিশোরীটি অবশ্য এখনো ভোটাধিকার পায়নি।
এ রকমই আরেক লাতিনো তরুণ মেক্সিকোর হোসে। আজ সন্ধ্যায় অ্যাপার্টমেন্টের সামনে দিয়ে চিঠিপত্র ডেলিভারি করে চলে যাচ্ছিলেন। অল্প কিছুদিন হয় সে এ দেশে এসেছে। এখনো নাগরিকত্ব পাননি। আশপাশ দিয়ে মূলধারার মার্কিনিদের দেখে তিনি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন আর আমার কথায় বারবার বলছিলেন, ‘দ্যাখো, আমি ভালো ইংরেজি জানি না। এখানে নির্বাচন কেমন হচ্ছে, বুঝিয়ে বলতে পারব না।’ হোসেকে অনায়াসে গড়পরতা বাঙালি তরুণ বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। ওর কথা শুনে আমি একটু থমকে গেলাম। এ রকমই তো হওয়ার কথা। সদ্য আমিরকায় আসা একজন লাতিনোর ভোটাভুটি নিয়ে আগ্রহ থাকার কথা নয়।
পথে এবার বেশ স্বাস্থ্যবান এক শ্বেতাঙ্গ পুরুষকে দেখতে পেলাম। আমি যেদিক দিয়ে হাঁটছি, সেদিক লক্ষ করেই এগিয়ে আসছেন। সন্ধ্যার অন্ধকারে, কিছুটা সংকোচে আমি তার সামনে এগিয়ে গিয়ে নিজেকে বাংলাদেশ থেকে আসা একটি পত্রিকার প্রতিবেদক হিসেবে পরিচয় দিলাম। নির্বাচন নিয়ে কিছু কথা বলতে পারি কি না জিজ্ঞেস করলাম। ভদ্রলোক সন্দেহবাতিক মুক্ত মানুষ। প্রেস কার্ড দেখতে চাইলেন না। জানা গেল তার নাম ‘রবার্ট’ এবং তিনি শিক্ষকতা করেন। ভোট দিয়েছেন কি না জিজ্ঞাসা করায় মাথা নেড়ে বললেন যে দিয়েছেন। আমতা আমতা করে পছন্দের দল বা প্রার্থী কে জিজ্ঞেস করায় মুচকি হেসে বললেন, সে কথা তো বলা যাবে না। ঠিক, আমাদের দেশের একজন ভোটারের মতোই কথা। কাকে ভোট দিয়েছেন অপরিচিত একজনকে বলতে চাইলেন না। এবার আমি কৌশল প্রয়োগ করলাম। জানতে চাইলাম, তিনি কি এবারের নির্বাচনে কোনো ‘ইতিবাচক পরিবর্তন’ আশা করছেন। না কি ‘স্ট্যাটাস কো’-ই থাকবে, অর্থাৎ পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকবে। এবার তার ঝটপট উত্তর, ‘ইতিবাচক পরিবর্তন’ আশা করছেন। আমার মনে হলো, আমি বোধহয় উত্তর পেয়ে গেছি। একগাল হেসে বললাম, এবার দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের অনেকেই বিশ্বে যে দুটি যুদ্ধ চলছে সেটা চাচ্ছেন না। বললাম, গাজা আর ইউক্রেনের যুদ্ধ বন্ধ হওয়া উচিত। ভদ্রলোক প্রচণ্ড খুশি হয়ে বললেন, ‘গ্রেট। ইওর অবজারভেশন ইজ সো পারফেক্ট।’ আমি মনে মনে খুশি হয়ে ভাবলাম, এই শিক্ষক নিশ্চয়ই রিপাবলিকানদের ভোট দিয়েছেন! ভদ্রলোক ধন্যবাদ জানিয়ে হাত নেড়ে বিদায় নিলেন। সম্ভবত আমার মতো একজন ‘বাদামি’ নারীর মুখে এমন কথা শুনবেন, ভাবতে পারেননি।
আমার কথা বলার সাফল্যে এবার আমি এক শ্বেতাঙ্গ নারীর দিকে এগিয়ে গেলাম। আসলে আমি চাইছি, সাধারণ মার্কিনিদের ভোট নিয়ে ভাবনাটা বুঝতে। কিন্তু এই নারী আমার প্রশ্নে মুচকি হেসে রাজনীতি বা নির্বাচন নিয়ে কিছু না বলে চলে গেলেন। ভোট নিয়ে তার আগ্রহ আছে বলে মনে হলো না।
এবার এক কালো পুরুষ, তবে মেয়েদের মতো চুল বাঁধা, পোশাক পরা। দু-তিনটি শিশুকে নিয়ে ‘মায়ের ভঙ্গি’তে হেঁটে যাচ্ছেন। এ দেশে সত্যিই লৈঙ্গিক পরিচয়, পোশাক-আশাক… সব ব্যাপারেই মানুষের ভাবনাটা খুব মুক্ত! কিন্তু আমি তো এসেছি পিছিয়ে থাকা এক জনপদ থেকে। কাজেই নারীর পোশাক পরা পুরুষদেহী এই পুরুষটির পিছু নিয়ে কাকে ভোট দেবেন জিজ্ঞাসা করব কি না বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
আমি হাঁটছি। এক কালো তরুণ এবং এক সাদা তরুণী বা প্রেমিক দম্পতি প্রেমে মশগুল হয়ে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। এ রকম সময়ে নির্বাচন নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করাটা বেরসিকের মতো হয়ে যায়। মনে হলো, নির্বাচন তো দূরের কথা, চারপাশের কোনো কিছু সম্পর্কেই তাদের আগ্রহ নেই।
ধবধবে সাদা দুই প্রৌঢ়া আরব নারীকে আসতে দেখলাম এবার। দুজনেরই বয়স ষাটের কাছাকাছি। ঢিলেঢালা পশ্চিমা পোশাক ও কেডসের সঙ্গে মাথায় রুমাল বাঁধা। আমি তাদের সামনে গিয়ে জোরেশোরে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বললে তারা থামলেন। এদের একজনের নাম ‘ফরিদা’, অন্যজন ‘মালিকা’। দুজনেই আলজেরীয় বংশোদ্ভূত। এবার কাকে ভোট দেবেন জিজ্ঞাসা করায় বললেন, ভোট দিতেই যাবেন না, ‘ইউ নো হোয়াট দে ডিড ইন প্যালেস্টাইন’ বলে দুজনেই হাত দিয়ে জবাই করার ভঙ্গি করলেন। আমার মন খারাপ হয়ে গেল। সংক্ষেপে তারা যা বললেন তাতে বোঝা গেল, প্রতিবার ডেমোক্র্যাটদেরই ভোট দিতেন। কিন্তু ডেমোক্র্যাটরা এবার ফিলিস্তিনে এত মানুষ হত্যায় সহায়তা করেছে যে কাউকেই ভোট দেবেন না। দুজনেই গৃহবধূ। ইংরেজিতে খুব দক্ষ না হলেও দুজনেই কাজ চালানোর মতো ইংরেজি বলতে পারেন। এই দুই আরব নারী চলে যেতেই দেখা গেল চশমা চোখের এক কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ে একাই রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন। তাকে ধরতেই জানালেন, নির্বাচন নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন না।
রাত হতে চলেছে। ঘরে ফিরছি। অ্যাপার্টমেন্টের চত্বরে ঢুকেই দেখি দোতলার সাদা প্রৌঢ় মার্ক তার কুকুর নিয়ে নিচে নামছেন। পেশায় মার্ক একজন ফিটনেস ট্রেনার। স্ত্রী গৃহবধূ। তাদের সাতটি সন্তান। ইতস্তত করে নির্বাচনের প্রসঙ্গ তোলায় যথারীতি তার উত্তর, ‘কাকে ভোট দেব সেটা বলা যাবে না হে।’ এবার আমার কৌশল প্রয়োগের দ্বিতীয় চেষ্টা। জিজ্ঞেস করলাম তিনি ইতিবাচক পরিবর্তন আশা করছেন, না কি সবকিছু আগের মতোই থাকবে বলে মনে করেন। মার্কও উত্তরে বললেন, ইতিবাচক পরিবর্তন আশা করছেন। আমিও মনে মনে কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারলাম। সংখ্যাগরিষ্ঠ হোয়াইটদের বড় একটা অংশ শ্বেতাঙ্গ ট্রাম্পকেই ভোট দেবেন। তবে এদের পেটের কথা বের করতে হলে প্রশ্ন করতে হয় উল্টো দিক থেকে। মনে মনে ভাবলাম, ‘ইউরেকা’! আরও তো দুই দিন আছে, নির্বাচনি হাওয়ার অনেকটাই এ দুই দিনে হয়তো স্পষ্ট হবে। তবে এ তো বাংলাদেশ নয় যে টাকা-পয়সা খরচ করে সাধারণ ভোটারদের ভোট কেনা যাবে। ভোটারদের মন জয় করতে হলে রাষ্ট্র কীভাবে চালাবেন, একজন প্রার্থীকে সেসব কথা পরিষ্কারভাবে ভোটাদের জানাতে হয়। তাদের মন জয় করা গেলেই জয়ী হওয়া যায় ভোটে। তবে পূর্বাভাস এমনই যে তিল পরিমাণ ব্যবধানের দুই প্রান্তে অবস্থান করছেন দুই প্রার্থী। হ্যারিস সামান্য এগিয়ে থাকলেও শেষ মুহূর্তে দোদুল্যমান রাজ্যগুলোই হয়ে উঠবে জয়-পরাজয়ের কারণ।