২৩ বছর বয়সী সাবিহার বাবা প্যালেস্টাইন থেকে এ দেশে এসে থিতু হন। সেই অর্থে সাবিহা দ্বিতীয় প্রজন্মের অভিবাসী। নিউইয়র্কের ব্রুকলিন কলেজে ‘শিক্ষা’ বিভাগে মাস্টার্স ডিগ্রিতে অধ্যয়নরত এই তরুণী তার পড়ার খরচ বহন করতে চাকরিও করেন।
গাজায় গত এক বছরে ৪২ হাজার ফিলিস্তিনির মৃত্যু নিঃসন্দেহে সাবিহাকে বেদনার্ত করেছে। কিন্তু নারী হিসেবে সাবিহা মেয়েদের গর্ভপাতসহ পুনরুৎপাদনমূলক স্বাস্থ্য অধিকারের প্রশ্নে ডেমোক্র্যাটদেরই সমর্থক। তবে গত চার বছরে মার্কিনিদের অর্থনৈতিক অবস্থা যে বেশ খারাপ হয়েছে, সেটা সাবিহা অস্বীকার করেন না।
সাবিহার মতোই অসংখ্য মার্কিনি ভোটার এবারের নির্বাচনে যে কয়েকটি প্রধান ইস্যু নিয়ে চিন্তিত বা বিড়ম্বিত, সেগুলো সংক্ষেপে এ রকম-
বৈদেশিক নীতি
ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ন্যাটো প্রশ্নে ডেমোক্র্যাটরা যখন রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মার্কিনি সাহায্য অব্যাহত রাখার কথা বলছে, ট্রাম্প তখন এই প্রশ্নে ঠাণ্ডা পানি ছুড়ে মারেন। ডেমোক্র্যাটরা যখন রাশিয়া ও চীনের মতো পরাশক্তিগুলোর বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময়ের মতোই প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সামরিক জোট ন্যাটোকে সক্রিয় রাখতে চান, ট্রাম্প তখন ন্যাটোর সমালোচনা করে চলেছেন এবং বৈশ্বিক পরিসরে যুক্তরাষ্ট্রকে অন্যের বদলে ‘নিজের চরকায় তেল’ দেওয়ার নীতি গ্রহণে উন্মুখ। সম্প্রতি তিনি এমনটিও বলেছেন, ‘রাশিয়া যা খুশি তাই করুক।’
গত বছরের ৩১ আগস্ট মার্কিন নাগরিক হার্শ গোল্ডবার্গ-পলিনসহ হামাস কর্তৃক ধৃত ও জিম্মি ছয়জনের লাশ উদ্ধার হওয়ার পর কমলা হ্যারিস লিখেছিলেন, ‘ইসরায়েলের জনতা এবং ইসরায়েলে বসবাসরত মার্কিনিদের যে আতঙ্কের ভেতর হামাস ফেলে দিয়েছে, তাকে অবশ্যই নির্মূল করতে হবে এবং হামাস গাজাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ফিলিস্তিনি জনতাও প্রায় দুই দশক ধরে হামাসের শাসন সহ্য করে আসছে।’ ডোনাল্ড ট্রাম্প তখন এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তার এক্স-হ্যান্ডেলে জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিস উভয়ের হাতেই ‘রক্ত লেগে আছে’ বলে মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। ২০২৪-এর আগস্ট নাগাদ ফিলিস্তিনে ৪০ হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন, যাদের ভেতর আছে ১৬ হাজার শিশু। অন্যদিকে আজ (১ নভেম্বর) ‘দিওয়ালি টুইট’-এ ট্রাম্প ডেমোক্র্যাটদের উদ্দেশে ‘তারা ইসরায়েল থেকে ইউক্রেন হয়ে আমাদের নিজেদের দক্ষিণ সীমান্তে সর্বত্র সর্বনাশ ডেকে এনেছে’ বলে মন্তব্য করেছেন।
গর্ভপাত
২০২০-২৪ নাগাদ ডেমোক্র্যাট সরকার ‘উইমেনস হেলথ প্রটেকশন অ্যাক্ট’ বা যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি প্রদেশে ফেডারেল আইনের আওতায় নারীর গর্ভপাতের অধিকার সুরক্ষা এবং গর্ভপাতের অধিকার পেতে অপ্রয়োজনীয় বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন যেন তাদের হাসপাতাল বা অন্যত্র কোথাও না হতে হয়, সে বিষয়ে একটি বিল আনেন। অন্যদিকে রক্ষণশীল ক্রিশ্চিয়ান নৈতিকতায় বিশ্বাসী রিপাবলিকানরা নারীর গর্ভপাতের অধিকারকে স্বীকার করতে চান না।
এ বছর লাতিন বা হিস্পানি পুরুষরা অনেকেই তাদের সমাজের চিরায়ত ‘মাচিসমো’ বা ‘আলফা মেল’ সত্তাকে স্বীকৃতি দিতেই যেন অনেকেই ট্রাম্পের দিকে ‘গর্ভপাত’ প্রশ্নে ঝুঁকছিলেন। তবে দু-তিন দিন আগে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে লাতিনোদের সম্পর্কে ট্রাম্প সমর্থকদের কটু মন্তব্যের কারণে তারা এখন বিরক্ত।
অভিবাসন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যমান সীমান্ত আইনকে ট্রাম্প বহুবারই দেশের জন্য একটি ‘অস্তিত্বগত হুমকি’ বলে উল্লেখ করেছেন এবং এমনকি অভিবাসীরা ‘আমাদের দেশের রক্তকে বিষাক্ত করছে’ এবং নতুন ‘ভাষাগুলো’ নিয়ে আসছে বলেও হতাশা ব্যক্ত করেন। ডেমোক্র্যাটরা সীমান্তের প্রশ্নে যে দুর্দশার সৃষ্টি করেছে, তা তিনি দূর করবেন বলেও ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচারাভিযানের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে।
গত চার বছরে ডেমোক্র্যাটরা ট্রাম্পের সময়কার অভিবাসন-সম্পর্কিত অনেক নীতিই বদলে দেয়। ‘ইউএস সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট’-এর মাধ্যমে, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাস করা মানুষেরাও ঠিকমতো কর প্রদান এবং পরিপ্রেক্ষিত যাচাইয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়।
ট্রাম্প যখন দেশে কম অভিবাসীর আগমন চান, কমলা নিজেই তখন অভিবাসী পিতা-মাতার সন্তান এবং ডেমোক্র্যাটরা বিশ্বাস করে যে, অভিবাসীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আরও ভালো দেশ হিসেবে গড়বে।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা
স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রশ্নে সেই ২০১০ সালে বারাক ওবামার সময়েই ডেমোক্র্যাটরা ‘অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন পাস করেন, যা দেশজুড়ে জনপ্রিয়। এই আইনটিকে ‘ওবামা কেয়ার’ও বলা হয়। ভর্তুকির মাধ্যমে এই আইনটি সারা দেশে ৪৫ মিলিয়ন বা ৪ কোটি ৫ লাখ মানুষকে সুরক্ষা দেয়। ক্ষমতায় থাকাকালীন ট্রাম্প এই আইনটি বারবার বাতিল করার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছিলেন।
কর
২০১৭ সালে ট্রাম্পের গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কর কর্তনের নীতি ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ সমাপ্ত হবে। কিন্তু গত চার বছরের ডেমোক্র্যাট শাসনের সময় জো বাইডেন ৪ লাখ মার্কিন ডলারের বেশি আয়সম্পন্ন পরিবারগুলোর ওপর বিভিন্ন ধরনের কর বাড়ানোর আহ্বান জানান। এ বিষয়ে কংগ্রেস ও ২০২৪-এর নির্বাচনে বিজয়ী দলই সিদ্ধান্ত নেবে। সম্প্রতি দিওয়ালি টুইটে ট্রাম্প কর কর্তনের মাধ্যমে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সম্প্রসারিত হতে দেবেন বলেছেন। তবে ডেমোক্র্যাট শিবিরের অভিযোগ, এই কর কর্তনের নীতি ধনীদের আরও ধনী করবে এবং গরিবদের আরও গরিব করবে।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারক মনোনয়ন
রিপাবলিকানরা এবং বিশেষত ট্রাম্প যখন চাইছেন সুপ্রিম কোর্টে তরুণ, রক্ষণশীল বিচারকদের নিযুক্ত করতে; যারা অল্প বয়সে নিয়োগ পেয়ে দীর্ঘদিন ধরে আদালতে কাজ করতে পারবেন, তখন হ্যারিসের নেতৃত্বে ডেমোক্র্যাটরা চাইছেন নানা জাতিসত্তার বিচারকদের নিযুক্ত করতে, যাদের ভেতর থাকবেন নাগরিক অধিকার আইনজীবীরা।
বাণিজ্য
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন রিপাবলিকানরা যখন আমদানীকৃত সব পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক ধার্য করার পক্ষে এবং সম্প্রতি ফক্স নিউজকে তিনি চীন থেকে আমদানীকৃত সব পণ্যের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি শুল্ক ধার্য করার কথা বলেছেন, ডেমোক্র্যাটরা তখন শুল্ক বাড়ানোর পক্ষপাতী নন। যেহেতু এতে করে গড়ে প্রতিটি মার্কিনি পরিবারকে পরিবার পিছু ১ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার বেশি খরচ করতে হবে।
এই ইস্যুগুলোর সমাধান কে করতে পারবেন, তার ওপরই মার্কিন ভোটের গতি-প্রকৃতি নির্ভর করবে।