নির্বাচনে ভোটারদের কাছে পছন্দের প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হচ্ছে বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে কোন প্রার্থী কোন অবস্থানে আছেন সেটির পর্যালোচনা। এতে প্রার্থীদের অবস্থানের সঙ্গে ভোটারের স্বার্থ মিলে পছন্দের প্রার্থী নির্বাচন সহজ হয়ে যায়। প্রার্থীরাও ভোটারদের স্বার্থ মাথায় রেখেই নিজেদের আলোচ্যসূচি তৈরি করেন। বিশেষত ইস্যুগুলোয় প্রার্থীর জনমুখী অবস্থান নির্বাচনে আনডিসাইডেড তথা সুইং ভোটারদের কাছে টানতে সহায়তা করে।
অর্থনীতি ও অভিবাসন ছাড়াও এবারের নির্বাচনে যেসব বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে সেগুলো হলো- গর্ভপাতের অধিকার, পররাষ্ট্রনীতি, বাণিজ্য, জলবায়ু, স্বাস্থ্যসেবা, আইনশৃঙ্খলা, গাঁজা ও বন্দুক ব্যবহার। এ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোয় দুই প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিসের নীতি কী, চলুন তা জেনে নেওয়া যাক।
গর্ভপাত: কমলা হ্যারিস গর্ভপাতের অধিকারকে তার প্রচারের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছেন এবং তিনি এ নিয়ে আইন প্রণয়নের পক্ষে যুক্তি দিয়ে চলেছেন, যা দেশব্যাপী নারীর প্রজনন অধিকার নিশ্চিত করবে।
অন্যদিকে, ট্রাম্প গর্ভপাতের বিষয়ে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থান খুঁজে পেতে সংগ্রাম করছেন। প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তিনি যে তিনজন বিচারপতিকে সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ করেছিলেন, তারা গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকারকে বাতিল করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
পররাষ্ট্রনীতি: কমলা হ্যারিস ইউক্রেনকে ‘যতদিন প্রয়োজন’ সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, নির্বাচিত হলে একবিংশ শতাব্দীর প্রতিযোগিতায় চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জয় নিশ্চিত করবেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে ছিলেন এবং গাজা যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে ইসরায়েল রাষ্ট্রের রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের চিরায়ত দায়িত্ব পালন করে যাবেন বলেও আশ্বস্ত করেন তিনি।
ট্রাম্পের অবশ্য একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী পররাষ্ট্রনীতি রয়েছে। তিনি চান, বিশ্বের অন্য যেকোনো জায়গার দ্বন্দ্ব থেকে যুক্তরাষ্ট্র দূরে থাকুক। তিনি বলেছেন, রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউক্রেনের যুদ্ধ শেষ করবেন। কিন্তু এমন পদক্ষেপ ভ্লাদিমির পুতিনকে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে আরও মরিয়া হয়ে উঠতে উৎসাহিত করবে বলে মনে করেন ডেমোক্র্যাটরা। ট্রাম্প নিজেকে ইসরায়েলের কট্টর সমর্থক হিসেবে বারবার ঘোষণা করেছেন। তবে তিনি কীভাবে গাজা যুদ্ধ শেষ করবেন, সে সম্পর্কে খুব কমই বলেছেন। এ ছাড়া কমলা ক্ষমতায় আসলে ইসরায়েল রাষ্ট্র শেষ হয়ে যাবে বলেও সতর্ক করে বক্তব্য দিয়েছেন তিনি।
জলবায়ু: কমলা হ্যারিস ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস আইন পাস করতে ভূমিকা পালন করেছিলেন। যা নবায়নযোগ্য শক্তি, বৈদ্যুতিক গাড়ির ট্যাক্স ক্রেডিট ও রিবেট প্রোগ্রামে শত শত বিলিয়ন ডলারের প্রবাহ বাড়িয়েছে। গ্যাস ও তেল সংগ্রহে ফ্র্যাকিং (কঠিন শিলাস্তর থেকে গ্যাস ও তেল আহরণের কৌশল) কৌশলের বিরোধিতা করা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন কমলা। পরিবেশবাদীরা দীর্ঘদিন এ পদ্ধতির বিরোধিতা করে আসছেন।
অন্যদিকে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে থাকাকালে পরিবেশগত সুরক্ষার অনেকগুলো বিষয় পাল্টে দিয়েছিলেন, যার মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও যানবাহন থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের সীমাও রয়েছে। এবারের প্রচারাভিযানে তিনি আর্কটিক ড্রিলিং (বরফাবৃত মেরু অঞ্চল থেকে তেল ও গ্যাস আহরণ) সম্প্রসারণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং বৈদ্যুতিক গাড়ির বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলা: কমলা হ্যারিস একজন আইনজীবী হিসেবে তার জীবনাচারকে অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত ট্রাম্পের বিপরীত বলে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি ট্রাম্পকে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও গণতন্ত্রের জন্য হুমকি বলে উল্লেখ করেছেন। ২০২০ সালের নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির ভুয়া অভিযোগ তুলে ট্রাম্প তার সমর্থকদের উসকে দিয়ে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন তা দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দেন কমলা। এ ছাড়া যৌন হেনস্তা অভিযোগ রয়েছে সাবেক প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে।
অন্যদিকে, ট্রাম্প মাদকের কার্টেল ধ্বংস, গ্যাং সহিংসতা দমন করার পাশাপাশি অপরাধে আচ্ছন্ন শহরগুলোকে গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত করতে পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি বিরোধীদের মোকাবিলা করতে সামরিক বা ন্যাশনাল গার্ড, রিজার্ভ ফোর্স ব্যবহার করবেন, যদি তারা নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করে। তাদের তিনি ‘অভ্যন্তরীণ শত্রু’ এবং ‘উগ্র বামপন্থি পাগল’ হিসেবে অভিহিত করেন। শিকাগোর মতো সহিংসতাপ্রবণ রাজ্যগুলোয় ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবেন বলে জানিয়েছেন। এ ছাড়া অবৈধ অভিবাসীদের গণনির্বাসনে পাঠালে দেশে অপরাধ অনেকাংশে কমে আসবে বলেও মনে করেন তিনি।
বন্দুক: কমলা হ্যারিস বন্দুক সহিংসতা প্রতিরোধকে অন্যতম অঙ্গীকার হিসেবে তুলে ধরছেন এবং প্রায়শই এর বিরুদ্ধে কঠোর আইনের পক্ষে কথা বলেছেন। যদিও তিনি ও তার রানিংমেট টিম ওয়ালজ উভয়েরই বন্দুক আছে। ট্রাম্প নিজেকে অস্ত্র বহনের সাংবিধানিক অধিকারের কট্টর রক্ষক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মে মাসে জাতীয় রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনের সমাবেশে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি তাদের সেরা বন্ধু।
গাঁজা: কমলা হ্যারিস বিনোদনের উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য গাঁজাকে অপরাধ তালিকার বাইরে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, গাঁজা বহনের জন্য অনেক লোককে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ ও ল্যাটিনোদের সংখ্যাই বেশি।
ট্রাম্প তার সুর নরম করে বলেছেন, ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য অল্প পরিমাণ গাঁজা ব্যবহারের জন্য প্রাপ্তবয়স্কদের অপ্রয়োজনীয় গ্রেপ্তার ও কারাগারে পাঠানো বন্ধ করার সময় এসেছে।
জেন্ডার ইস্যু: এলজিবিটিকিউ প্লাস ইস্যুতে ডেমোক্র্যাটরা উদারপন্থি হিসেবে পরিচিত। কমলা তাদের অধিকারের পক্ষে বেশ সরব। নির্বাচনি প্রচারে কমলা বলেছেন, ‘আপনি যাকে ভালোবাসেন খোলাখুলি বাসুন, গর্বের সঙ্গে বাসুন।’ যুক্তরাষ্ট্রে এলজিবিটিকিউ প্লাস সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতাকে দমন করতে বেশ সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে বাইডেন প্রশাসন। এ ছাড়া সামরিক বাহিনীতে ট্রান্সজেন্ডারদের অন্তর্ভুক্তি বাতিলবিষয়ক ট্রাম্পের এক নির্বাহী আদেশ বাতিল করেছিল বাইডেন প্রশাসন। এদিকে ট্রাম্প বলেছেন, তিনি নির্বাচিত হলে ‘কেবল দুই জেন্ডার’ নীতি বাস্তবায়নের জন্য কংগ্রেসকে আহ্বান করবেন।
এ ছাড়া তিনি রূপান্তরিত নারীদের ওপর সাধারণ নারীদের সঙ্গে খেলাধুলাসহ অন্য প্রতিযোগিতার অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন।