এই প্রতিবেদনটি যখন লিখছি তখন যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা ভোট দেওয়া শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু ভোটের পরিস্থিতি ভালো করে দেখার আগেই আমাকে এই রিপোর্টটি পাঠাতে হচ্ছে। আগামীকাল যখন এটি খবরের কাগজে প্রকাশিত হবে, তার আগেই আপনারা ভোট দেওয়ার বিষয়টি আরও অনেকখানি জেনে যাবেন। আমি বরং সোমবার যাদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছি, তাদের কথাই বলি।
আমি সম্ভাব্য ভোটারদের সঙ্গে আলাপ করার জন্য গতকাল বিকেলে বের হয়েই দেখি কনকনে শীতল হাওয়ার ছুরি যেন দাঁত বের করে শান দিচ্ছে।
সত্তরের মতো বয়সী এক শ্বেতাঙ্গিনী, পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। বিনীতভাবে তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলেন। তার নাম টেরিসা। গর্ভপাত ও নারীর অধিকারের প্রশ্নে ডেমোক্র্যাটদের কমলাই তার একমাত্র পছন্দ। অতীতে ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালিস্ট হিসেবে কাজ করলেও বর্তমানে তিনি অবসরপ্রাপ্ত।
নির্বাচনি লড়াইতে এখন পর্যন্ত অবস্থা প্রায় ৫০:৫০, অর্থাৎ ফিফটি-ফিফটি! তবে আশা করি কমলাই জিতবে, টেরিসা বললেন। এবারের নির্বাচনে তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ তিন ইস্যু হচ্ছে নারী অধিকার, অর্থনীতি এবং সামাজিক নিরাপত্তা।
এই ভদ্রমহিলা আমাকে পেরিয়ে যেতেই দেখলাম এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণীকে। এ দেশে আসার পর এই নির্বাচন কাভার করার কাজেই সাদা-ল্যাটিনো-আরব-দক্ষিণ এশীয়সহ যত জাতির মানুষকে প্রশ্ন করেছি, তারা সবাই উত্তর দিলেও কেন যেন আফ্রো-আমেরিকান বা কৃষ্ণাঙ্গদের কেউই কখনো মুখ খোলেননি, খোলাতে পারিনি। আজ একজন দক্ষিণ এশীয়ই জানালেন, এরা আমাদের বহু আগে থেকে এ দেশে বসবাস শুরু করলেও যেহেতু আমেরিকায় আজও কৃষ্ণাঙ্গরাই সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত জনগোষ্ঠী, তাই নিজেদের কম্যুনিটি ছাড়া বাইরের মানুষের কাছে তারা কম মুখ খোলেন। সব সময়ই তারা খুব ভয়ে থাকেন।
যা-ই হোক, টেরিসার পরই নানা জাতিসত্তার বেশ কয়েকজন পথচারী আমার কথায় সাড়া না দিয়ে বা মাথা ঝাঁকিয়ে, হাল্কা হেসে চলে গেলেন।
তারপরই অনেকটা আমাদের মতো মিশ্র বর্ণের ছিপছিপে, মাঝারি উচ্চতার সম্ভবত এক আরব নারীকেই দেখা গেল। বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের ভেতর হবে। তিনি অবশ্য কথা বলতে রাজি হলেন। শার্ট ও ট্রাউজারের সঙ্গে মাথায় হিজাব পরা, নাম কেরিমা। কেরিমা জানালেন তিনি মিসরের মেয়ে। গত নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের ভোট দিলেও এবার গাজা গণহত্যার কারণে ভোট দিচ্ছেন গ্রিন পার্টিকে।
কেরিমার সঙ্গে কথার পরপরই আলাপ হলো এমিলির সঙ্গে। তিনিও শ্বেতাঙ্গ। এমিলি জানালেন, নারীর গর্ভপাত প্রশ্নে ট্রাম্পের পুরুষতান্ত্রিক অবস্থান তিনি মানেন না। কাজেই ডেমোক্র্যাটদের ব্যালট বাক্সে ইতোমধ্যে তার ভোট তিনি পুরে দিয়েছেন। এমিলি পেশায় শিক্ষক। বোঝা গেল, চিরন্তন ব্লু স্টেট বা নীল প্রদেশ নিউইয়র্কের শিক্ষিত ও অগ্রসর চিন্তার নারীরা ক্ষোভে ফুঁসছেন।
এদিকে গত শনিবারই যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে হাজার হাজার নারী ‘আমরা ফিরে যাব না’ বাণীসংবলিত স্লোগান এবং ব্যানারসহ সমবেত হয়েছিলেন। অবশ্য শুধু ওয়াশিংটন ডিসি নয়, দেশজুড়েই এই পদযাত্রার আয়োজন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সচেতন নারীরা।
ওয়াশিংটন ডিসিতে গত শনিবারের এই পদযাত্রায় বক্তা ও অংশগ্রহণকারীরা হোয়াইট হাউস অভিমুখে যাত্রা শুরু করার আগে ফ্রিডম প্লাজায় অংশ নেন এবং সেখানে তারা বন্দুক-সন্ত্রাস থেকে গাজা যুদ্ধসহ নানা বিষয়েই কথা বলেন।
‘এবারের নির্বাচন নিছক রাজনীতির বিষয় নয়। এটা আমাদের অস্তিত্বেরও বিষয়’, ২০১৯ সালে ফ্লোরিডার মার্জোরি স্টোনম্যান ডগলাস হাইস্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন করা আলায়াহ ইস্টমন্ড বলেন, ওই স্কুলে একজন বন্দুকধারী ঢুকে হুট করে ১৭ জন ছাত্র এবং স্কুল স্টাফকে হত্যা করেছিল।
‘আক্ষরিক অর্থেই আমাদের জীবন এখন ব্যালট বাক্সের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে’ আলায়াহ বলেন।
ফ্রিডম প্লাজায় সমবেত এই নারীরা’ বলেছেন হোয়াইট হাউসে একজন নারী যাতে আসীন হতে পারেন, সেই লক্ষ্যে ভোট দিন। ‘আপনার মেয়ের জীবন এর ওপর নির্ভর করছে’ জাতীয় স্লোগানসংবলিত ব্যান্ড হাতে পরে তারা জড়ো হয়েছিলেন। এ ছাড়াও নারীর জন্য গর্ভপাতের অধিকারসহ নানা টি-শার্ট, মোজাও কিছু টেবিল থেকে বিতরণ করা হয়েছে।
ওই পদযাত্রায় ৭০ বছরের মোনা ওয়েলস তার দুই বান্ধবীর সঙ্গে অংশ নেন এবং নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, আমি জানি না যে কীভাবে আমরা পেছনের দিকে হাঁটব। কেন হাঁটব।
গ্লোরিয়া অলরেড নামে নারী অধিকারের নামি প্রবক্তা বলেন, কীভাবে কয়েক দশক আগে ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভবতী হওয়ার পর এক হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে গর্ভপাত করাতে গিয়ে তিনি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের মুখে পড়েন। সে সময় একজন তরুণী, একক মা এবং শিক্ষক হিসেবে অলরেড জানতে পারেন, কোনো নারীকে গর্ভপাতে সাহায্য করাটা ডাক্তারদের জন্য বেআইনি ছিল। গর্ভপাতের পর ১০৬ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে হাসপাতালে থাকার সময় এক সেবিকা তাকে বলেছিলেন, ‘গ্লোরিয়া, আশা করি তুমি একটি শিক্ষা পেয়েছ।’
‘হ্যাঁ আমি যে শিক্ষা পেয়েছি সেটা হলো গর্ভপাতকে নিরাপদ, আইনসম্মত এবং সবার জন্য অভিগম্য করতে হবে’, অলরেড বলেন অপেক্ষমাণ জনতাকে।
তিনি ‘আপনারা কি মনে করেন ট্রাম্প নারীদের রক্ষা করবেন?’
‘না,’ নারীরা সমবেত কণ্ঠে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কথাটা উচ্চারণ করেছেন।
বক্তৃতা শেষে এই সমাবেশটি ‘নারীর অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করি’ এবং ‘নারীর অধিকার মানবাধিকার’, স্লোগান কণ্ঠে নিয়ে হোয়াইট হাউসের উদ্দেশে রওনা করেছিলেন।