নিজের প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অদ্ভুত এক কূটনীতি সামনে নিয়ে এসেছিলেন। প্রকাশ্যেই তিনি উষ্ণ হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার দিকে। অন্যদিকে পৃথকভাবে চাপ তৈরি করেছিলেন ইরান ও চীনের ওপর।
কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে এসে ওই একই কূটনীতি অনুসরণ করা হয়তো সম্ভব হবে না ট্রাম্পের পক্ষে। এবার তার জন্য অপেক্ষা করছে আরও বড় চ্যালেঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা রাষ্ট্রগুলো এখন আরও ঐক্যবদ্ধ। ২০২২ সালে শুরু হওয়া ইউক্রেন যুদ্ধ তাদেরকে এই পরিস্থিতিতে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
ট্রাম্প গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি নির্বাচনি প্রচারের সময় থেকেই ঘোষণা দিয়ে এসেছেন যে ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান হবে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির লাগাম টানা হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার সময়টিতে চীনকে জবাব দেওয়া হবে।
কিন্তু গত কয়েক বছরে সম্পর্কের সমীকরণ অনেকটাই বদলে গেছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং গড়ে তুলেছেন ‘সীমাহীন অংশীদারত্ব’। রাশিয়াকে সরাসরি অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করছে চীন, যা দেশটির ইউক্রেন যুদ্ধে টিকে থাকার পেছনে ভূমিকা রাখছে।
ট্রাম্পের শপথ নেওয়ার পর গত মঙ্গলবারও পুতিন ও শি নিজেদের কৌশলগত অংশীদারত্ব আরও সুদৃঢ় করা নিয়ে দীর্ঘ ফোনালাপ করেছেন। এ ছাড়া উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ২০২৪ সালের জুনে কৌশলগত অংশীদারত্ব চুক্তি স্বাক্ষর করেছে রাশিয়া। ইরানের সঙ্গেও গত শুক্রবার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে দেশটি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণকারী এই চার দেশের এভাবে একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলাকে চীনে নিযুক্ত বাইডেন প্রশাসনের দূত সম্প্রতি ‘অপবিত্র জোট’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। বিশ্লেষণকারীরাও বলছেন, ওই চার দেশের একত্র হওয়া যুক্তরাষ্ট্র ও তার অংশীদারদের জন্য ক্ষতি ছাড়া আর কিছু বয়ে আনবে না।
ওয়াশিংটনভিত্তিক এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের ড্যানিয়েল রাসেল বলেন, ‘ট্রাম্পের মূল দ্বিধা হলো রাশিয়ার সঙ্গে তিনি তাল মেলাতে চান, আবার বাণিজ্যেও তিনি চীনকে চাপে ফেলতে চান। যেখানে মস্কো ও বেইজিংয়ের সম্পর্ক রাশিয়াকে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সেভাবে জড়াতে দেবে না। আবার চীনও মার্কিন চাপের মুখে নতি স্বীকার করবে না।’
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার ওপর পশ্চিম যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, তা অনেকটাই তারা পাশ কাটাতে পেরেছে চীনের সহায়তায়। চীন রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনেছে। এ ছাড়া মস্কোর প্রতিরক্ষা শক্তিকে বলিষ্ঠ করতে পারে এমন কিছু রসদ বেইজিং সরবরাহ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে চীন বরাবরই সে অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
উত্তর কোরিয়া রাশিয়াকে ইউক্রেন যুদ্ধে সেনাসদস্য ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে। পাশাপাশি দ্রুতগতিতে নিজেদের পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আঞ্চলিকভাবে ইসরায়েলের হামলায় দুর্বল হয়ে গেলেও ইরান তাদের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা পুনরায় শুরু করতে পারে।
ট্রাম্প প্রশাসনের সদস্যরাও চ্যালেঞ্জের বিষয়টি জানেন এবং তারা এই বাস্তবতাকে এরই মধ্যে স্বীকারও করে নিয়েছেন।
শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্ব নেবেন মাইক ওয়াল্টজ। তিনি নভেম্বরেই ফক্স নিউজকে বলেছেন, চীন ইরানের কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে তেল কিনছে। ইরান তা ব্যবহার করে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন পাঠাচ্ছে রাশিয়ায়। সেগুলো পরে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে আঘাত হানতে ব্যবহার করা হচ্ছে।’
গত সপ্তাহেই যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সামনে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিটাই হলো চীন। এ ছাড়া রুবিও ‘বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতার’ জন্য মস্কো, তেহরান ও পিয়ংইয়ংকে অভিযুক্ত করেন।
আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ জ্যাক কুপার ধারণা করছেন, ট্রাম্পের টিম চীনের বলয় থেকে অন্যান্য দেশকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করবে।
কুপার বলেন, ‘তারা হয়তো রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া ও ইরানকে চীনের কাছ থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করবে।’
তিনি আরও বলেন, পিয়ংইয়ংয়ের সঙ্গে একটি এবং মস্কোর সঙ্গে আরেকটি চুক্তির চেষ্টা করা যেতে পারে বলে মনে করি আমি।
ওবামা প্রশাসনে বাণিজ্য প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী মাইকেল ফ্রোম্যান মনে করছেন, উত্তর কোরিয়ার সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িত হওয়ার জন্য যথেষ্ট কারণ নেই।
তিনি জানান, ট্রাম্প প্রশাসন পিয়ংইয়ংয়ের সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছাতে পারবেন বলে মনে করলেও উত্তর কোরিয়া এখন তাদের সঙ্গে জড়াবে কি না, তা অস্পষ্ট। কারণ দেশটি এখন রাশিয়া ও চীনের ব্যাপক সমর্থন পাচ্ছে।
রয়টার্সের বিশ্লেষণ বলছে, দেশগুলোর সম্পর্কে কিছুটা ফাটল দেখা যাচ্ছে। বাইডেন প্রশাসনের আমলে জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন দূত রবার্ট উড প্রশ্ন রেখেছেন, তেহরান মস্কোর ওপর সহায়তার জন্য নির্ভর করতে পারবে কি না? রাশিয়া যে মিত্রদের সেভাবে সহায়তা দিতে পারে না, সে বিষয়টিও উল্লেখ করেন তিনি। এক্ষেত্রে সর্বশেষ উদাহরণ হলো সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সরকার। রাশিয়া সেভাবে শেষ মুহূর্তে তাকে সমর্থন দিতে পারেনি।
এ প্রসঙ্গে উড বলেন, আমি যদি ইরান হতাম, তা হলে দেখতাম রাশিয়া আসাদকে কীভাবে পরিত্যাগ করেছে এবং বিষয়টি নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হতাম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের ক্ষেত্রে ট্রাম্প আবার আগের মেয়াদের নীতি ফেরত নিয়ে আসতে পারেন। চেষ্টা করতে পারেন তাদের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি এবং আঞ্চলিক কর্মকাণ্ডের লাগাম টানতে।
উডের মতে, নতুন প্রশাসনের জন্য অনেক কিছুই সহজ হবে, যদি নতুন প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে মনোযোগী হয়, যে মার্কিন সম্পদকে প্রথম মেয়াদে সে রকমভাবে মূল্যায়ন করেননি ট্রাম্প।
এদিকে, দায়িত্ব নেওয়ার পর গত মঙ্গলবার ট্রাম্প বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের জন্য পুতিন আলোচনায় বসতে রাজি না হলে রাশিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। তবে মোটা দাগে ট্রাম্পের কাছ থেকে যেসব আভাস মিলছে, তাতে তিনি পুতিনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই সব মিটিয়ে ফেলার পক্ষে। সূত্র: রয়টার্স