
সম্প্রতি এক প্রকার ফ্লু ছড়িয়ে পড়েছে চীনজুড়ে। বিশেষত শিশুরা এই ফ্লু দ্বারা বেশি সংক্রমিত হচ্ছে। এই রোগের সম্ভাব্য বিস্তার নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়েছে বিশ্বজুড়ে। ইতোমধ্যে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও যুক্তরাজ্যেও এই ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসের নাম দিয়েছেন হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি)।
এটি মূলত শ্বসনযন্ত্রের একটি রোগ, যেটি কোভিড-১৯ এবং অন্যান্য ফ্লুর মতো ছড়িয়ে পড়ে। এই ভাইরাস সম্পর্কে এ পর্যন্ত যা জানা গেছে, তা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা।
এইচএমপিভি কী?
হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস ব্যক্তির ফুসফুসকে আক্রমণ করে। এটি সাধারণত ঠাণ্ডাজাতীয় রোগের মতো উপসর্গ তৈরি করে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের মতে, সাধারণত শীতের শেষ দিকে এবং বসন্তকালে এই ভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। ২০০১ সালে ইউরোপের দেশ নেদারল্যান্ডসে এটি প্রথম শনাক্ত হয়। রোগটি খুবই সাধারণ, পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে প্রায় সব শিশু এই রোগে আক্রান্ত হয়।
এই রোগের পরীক্ষা পদ্ধতি করোনাভাইরাসের মতোই। নাক বা গলা থেকে শ্লেষ্মা সংগ্রহ করে হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাসের অস্তিত্ব পরীক্ষা করা হয়। আরটি-পিসিআর টেস্ট ও অ্যান্টিজেন টেস্টের মাধ্যমে এটি নির্ণয় করা যায়।
কীভাবে সংক্রমিত হয়?
এইচএমপিভি শরীরে প্রবেশ করে সাধারণত নাক, মুখ বা চোখ দিয়ে। এটি এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মধ্যে ছড়ায় যখন আক্রান্ত ব্যক্তি কাশি বা হাঁচি দেয়। ফলে বাতাসে ভাইরাসের অণু ছড়িয়ে পড়ে এবং অন্য ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করে। এ ছাড়া কোনো দূষিত বা সংক্রমিত জায়গায় হাত দিলে এবং পরে সেই হাত দিয়ে নাক, মুখ বা চোখ স্পর্শ করলেও এর সংক্রমণ ঘটতে পারে।
এইচএমপিভি শরীরে কী করে?
এ ভাইরাস শরীরে প্রবেশের পর এটি আমাদের শ্বাসনালি এবং ফুসফুসের কোষগুলোতে আটকে যায়। এই কোষগুলো এপিথিলিয়াল কোষ নামে পরিচিত। এপিথিলিয়াল কোষগুলো শ্বসনতন্ত্রের জন্য একটি প্রতিরোধক তৈরি করে, যা শ্বাসনালির ভেতরে শ্লেষ্মা, ধূলিকণা এবং অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। এটি শ্বসনতন্ত্রের সুস্থতা বজায় রাখতে এবং বাইরের ক্ষতিকর পদার্থ থেকে আমাদের রক্ষা করতে সাহায্য করে।
ভাইরাস যখন শরীরের কোষে প্রবেশ করে, তখন এটি নিজের অনেক কপি তৈরি করতে শুরু করে। এর ফলে দ্রুত শরীরে ভাইরাসের বিস্তার ঘটে। এরপর এই নতুন ভাইরাসগুলো পাশের কোষগুলোকে আক্রান্ত করে এবং শ্বসনতন্ত্রের কোষগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। শরীরের ইমিউন সিস্টেম (রোগ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা) ভাইরাসটি শনাক্ত করে এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে একটি প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়া শুরু করে। যদিও এই প্রতিক্রিয়া ভাইরাসটি শরীর থেকে বের করার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তবু এটি শরীরে সর্দি ও কাশির মতো কিছু উপসর্গ তৈরি করে। এই উপসর্গগুলো আসলে শরীরের প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়ার কারণে হয়।
এই রোগ কি ছোঁয়াচে না বিপজ্জনক? কারা বেশি ঝুঁকিতে?
এই ভাইরাস খুব সহজে ছড়ায়। তবে সাধারণত এটি সুস্থ মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে না। বেশির ভাগ মানুষের সাধারণ ঠাণ্ডা বা ফ্লুর মতো হালকা উপসর্গ দেখা দেয় এবং রোগী ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন।
এই রোগে মৃত্যুর হার সঠিকভাবে নির্ধারণ করা কঠিন। কারণ এর বিপরীতে পর্যাপ্ত তথ্য নেই এবং এটি শ্বসনতন্ত্রের অন্য রোগ, যেমন- নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস ইত্যাদির সঙ্গে মিলে যেতে পারে। তবে যেসব এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা সীমিত অর্থাৎ চিকিৎসা সুবিধা কম, সেসব জায়গায় এইচএমপিভির কারণে মৃত্যুর ঘটনা কিছুটা বেশি দেখা গেছে।
এ ছাড়া কিছু মানুষের শরীরে ভাইরাসটি গুরুতর জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। যেমন ব্রংকাইটিস (শ্বাসনালির প্রদাহ) ও নিউমোনিয়া (ফুসফুসের সংক্রমণ)। এই ধরনের সমস্যা সাধারণত শিশু, বৃদ্ধ এবং যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম তাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এদের জন্য ভাইরাসটি প্রাণঘাতীও হয়ে উঠতে পারে। সূত্র: আল-জাজিরা