সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সের মালিক, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান টেসলার সিইও, মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্পেস এক্সের সিইও, বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি- অনেক পরিচয় আছে মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্কের। তবে সাম্প্রতিক আলোচনায় মাস্কের বিষয়টি তার কর্মক্ষেত্রের চেয়ে বড় পরিসরে গিয়ে ঠেকেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মাস্ক সম্প্রতি মার্কিন প্রশাসনে ‘বিশেষ সরকারি কর্মকর্তার’ দায়িত্ব পেয়েছেন। ক্ষমতার অর্ধমাসেই সমালোচনা কুড়িয়েছেন অনেক। অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত মাস্ক দেশটির সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন কমানোর পাশাপাশি মার্কিন ত্রাণ সংস্থা ইউএসএইড বন্ধের পেছনে মূল হোতা। বেশকিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্তের জেরে তিনি এখন ওয়াশিংটন পাড়ার হট টপিক।
তবে ইলন মাস্কের বিরূপ প্রভাব শুধু ওয়াশিংটন প্রশাসনেই আটকে থাকছে, নাকি তার অনভিপ্রেত নীতিমালা প্রণয়ন ক্ষতি করছে বিশ্বেরও। এ বিষয়ে বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আল-জাজিরা।
মার্কিন উগ্র ডানপন্থি রাজনীতির বিস্তারে ইলন মাস্কের প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সরাসরি সমর্থনের পর ক্ষমতা পেয়ে এখন ইউরোপেও নিজের প্রভাব ছড়ানোর চেষ্টা করছেন তিনি।
তার এই চেষ্টার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী যুক্তরাজ্য। দেশটির রাজনীতিতে উগ্র ডানপন্থি নেতা টমি রবিনসন ও নাইজেল ফারাজের মতো উগ্র ডানপন্থি নেতাদের উত্থান নিশ্চিত করতে উঠেপড়ে লেগেছেন তিনি। গেল জানুয়ারিতে এক্সের এক টুইটে রবিনসনের ডকুমেন্টারি ‘সাইলেনসড্’-এর লিংক শেয়ার করে টমি রবিনসনের মুক্তি দাবি করেন মাস্ক।
জানা গেছে, এই ডকুমেন্টারি তৈরিতে সহায়তা করেছে মার্কিন ডানপন্থি রেডিও হোস্ট অ্যালেক্স জোনসের প্রতিষ্ঠান ইনফোওয়ার্স।
বিতর্কিত এই ডকুমেন্টারিতে রবিনসন দাবি করেন, সিরীয় শরণার্থী জামাল হিজাজিকে অসম্মান করার দায়ে প্রায় ১ লাখ পাউন্ড জরিমানা গুনতে হয় তাকে। তবে এই দাবি মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় ভুল তথ্য ছড়ানোর দায়ে রবিনসনকে ১৮ মাসের কারাদণ্ড দেন আদালত।
এতদসত্ত্বেও, রবিনসনকে সমর্থন করে অভিবাসনবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন মাস্ক।
এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কেইর স্টারমারের বিরুদ্ধে মাস্ক কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। স্টারমার ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিসের প্রধান থাকাকালীন বিভিন্ন অভিযোগ টেনে ব্রিটিশ রাজা চার্লস তৃতীয়কে বিদ্যমান পার্লামেন্ট ভাঙার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কেইর স্টারমারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছেন মাস্ক। ছবি: সংগৃহীত
এদিকে জার্মানিতে মাস্কের প্রভাবও চিন্তার ভাঁজ এনেছে বিশ্লেষকদের কপালে। দেশটির উগ্র ডানপন্থি দল অল্টারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ডের (এএফডি) সমর্থনে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছেন এই ধনকুবের। গেল বছর ডিসেম্বরে জার্মানির জনপ্রিয় রাজনীতিবিষয়ক ম্যাগাজিন ওয়েল্ট আম সোন্ট্যাগকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এএফডিকে জার্মানির ‘শেষ আশার আলো’ আখ্যায়িত করার মাধ্যমে অভিবাসনবিরোধী অবস্থান স্পষ্ট করেছেন তিনি।
গেল জানুয়ারিতে এএফডির প্রধান অ্যালিস ওয়েইডলের সঙ্গে একটি ভার্চুয়াল আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন মাস্ক। এই আলোচনায় ফ্যাসিস্ট জার্মান নেতা অ্যাডলফ্ হিটলারের প্রতি অ্যালিসের সুপ্ত সমর্থনের বিষয়টিও উঠে আসে। পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়ংকরতম গণহত্যার মূলহোতা হিটলারকে তিনি ‘একজন সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট’ হিসেবে দেখেন।
জানুয়ারির শেষ দিকে এফএফডির র্যালিতে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করে তাকে দলটির সমর্থকদের জার্মানির জন্য যুদ্ধ করার পরামর্শ দিতে দেখা যায়।
এ ছাড়া ইতালি, আর্জেন্টিনা ও এল সালভাডোরের উগ্র ডানপন্থি রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে জোট বেঁধেছেন ইলন মাস্ক। তার প্রভাবের তীব্রতা সবচেয়ে স্পষ্ট পোল্যান্ডে। দেশটিতে পরিচালিত সাম্প্রতিক জরিপে উঠে এসেছে, ৪৫ শতাংশ মানুষ মাস্কের মদদপুষ্ট প্রার্থীর সমর্থক।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিশ্ব রাজনীতিতে আভিজাত্যবাদের বিরূপ প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। সব ক্ষমতা দখল করে রেখছেন ধনকুবেররা। জনমানুষের ভাতের পাত থেকে শুরু করে হোয়াটসঅ্যাপের কনভার্সেশন পর্যন্ত সবকিছুই দখলে নিচ্ছেন মাস্কেরা। উল্টেপাল্টে দেখছেন আমাদের দুটো শব্দে তাদের ক্ষমতায় ভাগ বসাচ্ছে কি না। এভাবে ইলন মাস্কের প্রভাব ওয়াশিংটন থেকে আটলান্টিক পেরিয়ে ইউরোপ হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার জমিনে কবে শেকড় গাড়বে -সাধারণের এ খবর টের পাওয়ার পর ফিরে তাকিয়ে বোধহয় আর ফেরার ঘরই থাকবে না। সূত্র: আল-জাজিরা।
নাইমুর/