
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর ডাকে ইউরোপের নেতারা গত সোমবার ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে নিরাপত্তা সম্মেলনে অংশ নেন। ইউরোপের নেতৃস্থানীয়রা যে বেশ বিপাকে পড়ে গেছেন, তা ওই তাড়াহুড়া করে ডাকা নিরাপত্তা সম্মেলন থেকে অনেকটাই স্পষ্ট।
দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন ইস্যুতে তাদের এড়িয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, ইউরোপের দেশগুলো রাজনৈতিক মতপার্থক্য ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক উদ্বেগকে পাশে রেখে নিজেদের প্রয়োজনে ঐক্য গড়তে পারবে কি না।
বিবিসির প্রতিবেদন বলছে, ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে সম্ভাব্য আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র যে তাদের বাইরে রেখেছে, সেটা হয়তো ইউরোপীয় নেতারা এখনো পুরোপুরি মেনে নিতে পারছেন না। গত রবিবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানান যে তিনি ‘খুব শিগগিরই’ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন। ইউরোপকে ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের আলোচনায় অংশ নিতে দেওয়ার ইচ্ছা নেই তার- এমন ইঙ্গিতও সাম্প্রতিক সময়ে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জানিয়েছেন, গোটা বিষয়টিই এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। পরবর্তী সময়ে ইউরোপকে যুক্ত করা হতে পারে।
ট্রাম্পের প্রস্তাব অনুসারে, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে সেখানে সেনা পাঠানোর মতো পদক্ষেপ নিতে হতে পারে ইউরোপের দেশগুলোর। এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কেইর স্টারমার জানিয়েছেন যে শান্তিচুক্তির অধীনে ইউক্রেনে সেনা পাঠাতে তিনি প্রস্তুত।
এদিকে জার্মানিতে সামনে নির্বাচন। তার আগে দেশটির সিডিইউ পার্টির বিদেশনীতিবিষয়ক মুখপাত্রও বলেছেন, আন্তর্জাতিক নিয়মরীতির মধ্যে থেকে তারা বিদেশে সৈন্য মোতায়েন করতে আগ্রহী। নির্বাচনে দলটি বেশির ভাগ আসন পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিবিসির প্রতিবেদনের বরাতে জানা গেছে, ইউরোপ আপাতত দুটি বড় ইস্যুর বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা ভাবছে। প্রথমত, ইউরোপ প্রতিরক্ষা খাতে আরও ব্যয় বাড়াবে এবং যুদ্ধবিরতির পর তারা ইউক্রেনে সেনাবাহিনী পাঠাবে।
ইউরোপের নেতারা চাইছেন যুদ্ধবিরতিসংক্রান্ত আলোচনায় কিয়েভ সরাসরি অংশ নিক। ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে ইউক্রেন সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত হতে পারে না- এমন দৃষ্টিভঙ্গিই পোষণ করেন তারা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া নিরাপত্তাবলয়ের ওপর নির্ভর করে আসছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক কিছুই নির্ভর করছে ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা কোন দিকে গড়ায়, সেটির ওপর।
তবে প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়ে সবার একমত হওয়াটা কঠিন হবে। পোল্যান্ড ২০২৫ সালে তার জিডিপির ৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করার পরিকল্পনা করেছে। যুক্তরাজ্য এই দিক থেকে চেষ্টা করেও জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রাতেও পৌঁছাতে পারেনি এখনো। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার প্রতিরক্ষা প্রচেষ্টা আরও জোরদার করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এদিকে যুদ্ধবিরতির পর ইউক্রেনে সেনা পাঠানো হবে কি না, তা নিয়েও নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। ইউরোপ তিন কারণে সেনা পাঠাতে পারে। প্রথমত, নিজ মহাদেশের প্রতিরক্ষার জন্য তারা যে করণীয় সবই করছে, সেটা যুক্তরাষ্ট্রের সামনে তুলে ধরার জন্য।
দ্বিতীয়ত, ইউক্রেনবাসীর কাছে এই বার্তা পাঠানো যে তারা একা নয়। আর তৃতীয়ত, মস্কোর প্রতি বার্তা। ইউরোপ তাদের সতর্ক করে দিয়ে বলতে চায় যে রাশিয়া যদি চূড়ান্ত যুদ্ধবিরতির শর্ত ভঙ্গ করে, তাহলে তাদের মোকাবিলা এবার শুধু কিয়েভের সঙ্গে হবে না।
তবে সেনা পাঠানো এত সহজ হবে না। এটিকে ঘিরে বিতর্ক রয়েছে। ভোটারদের কাছে এটি জনপ্রিয় না-ও হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইতালির ৫০ শতাংশ মানুষ ইউক্রেনে আর অস্ত্র পাঠাতে চান না। ফলে দেশটিতে তাদের সন্তান, কন্যা, বোন বা ভাইদের পাঠানোর প্রস্তাব তারা সহজে মেনে নেবে না।
এ ছাড়া বহু প্রশ্ন রয়েছে। যেমন- ইউরোপের প্রতিটা দেশকে কতসংখ্যক সৈন্য পাঠাতে হবে, কত সময়ের জন্য পাঠাতে হবে এবং তারা কার অধীনে থাকবে? তাদের মিশনের বিবৃতি কী হবে?
আবার রাশিয়া যদি তাদের সম্মত হওয়া যুদ্ধবিরতির শর্ত ভঙ্গ করে, তাহলে ইউরোপীয় সৈন্যরা সরাসরি রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে দেবে কি না? এবং যদি তাই হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কি তাদের পাশে থাকবে? এমন একগুচ্ছ প্রশ্ন রয়েছে।
ইউক্রেনে সেনা মোতায়েন করার আগে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ‘নিরাপত্তাসংক্রান্ত নিশ্চয়তা’ চাইতে পারে ইউরোপ। তবে তারা সেটা পাবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। সূত্র: বিবিসি