দুটো ভয়ানক বিশ্বযুদ্ধের পর সারাবিশ্বে ভূমি দখল ও উপনিবেশায়নের বিরুদ্ধে একমত হন মোড়লস্থানীয় দেশগুলোর নেতারা। এরপর থেকে বিদেশের জমি দখল করে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার চর্চা অন্তত সরাসরি বন্ধ হয়েছিল। তবে স্নায়ুযুদ্ধে জয়লাভ করার পর যুক্তরাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ থেমে থাকেনি। বরং অন্তরীপ ফল্গুর মতো তুলনামূলক ছোট ও কম ক্ষমতাশালী দেশ ও সংস্কৃতিগুলোকে ক্রমশ গিলে নিয়েছে মার্কিন মুল্লুকের ভদ্রবেশী পিরানহারা। তবে দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট তার দ্বিতীয় মেয়াদের ক্ষমতার সব রাখঢাকের বালাই ছেড়ে খোলাখুলি অন্য ভূখণ্ড আক্রমণের হুমকি দিচ্ছেন। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা থেকে শুরু করে ডেনমার্কের অধীন দ্বীপ গ্রীনল্যান্ড- সবই দখল করে নিতে চান তিনি। চীনা হস্তক্ষেপের অযুহাত দেখিয়ে পানামা খালের প্রশাসনিক দায়িত্বও হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা আছে তার। এ পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতিতে শঙ্কিত বিশ্ব।
জাতিসংঘের ১৯৪৫ সালের সনদ মোতাবেক, সংস্থাটির ‘সব সদস্য অন্য দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে হুমকি বা ক্ষমতা প্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য।’ তবে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বক্তব্যে এই নিয়ম মানার কোনো ইঙ্গিত দেখা যায় না। এখনো পর্যন্ত ট্রাম্প মৌখিক হুমকি দিলেও, বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, যেকোনো দিন মুখের কথা বাস্তবায়নে তিনি বলপ্রয়োগ করতে পারেন।
ট্রাম্পের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে সারাবিশ্বে। মধ্য আফ্রিকায় ‘গ্রেটার রোয়ান্ডা’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কঙ্গোর বিরুদ্ধে অভিযানরত জঙ্গিগোষ্ঠী এম-২৩কে সহায়তা করছে রোয়ান্ডা প্রশাসন। মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে চলমান ইসরায়েলি গণহত্যা নতুন খবর নয়। তবে ট্রাম্পের সহায়তায় তেল আবিব গাজায় অমানবিক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর বৈধতা পেয়ে ধ্বংসোল্লাসে মেতে উঠেছে। এদিকে, তাইওয়ানকে নাস্তানাবুদ করে দক্ষিণ চীন সাগরে একাধিপত্য কায়েমে উঠে পড়ে লেগেছে চীন। নব্য উপনিবেশায়নের ঘৃণ্য প্রচেষ্টা ঢুকে পড়েছে ‘সভ্য’ মহাদেশ ইউরোপেও। রাশিয়া তার প্রতিবেশী ইউক্রেনে সহিংসতার কায়েমের মাধ্যমে দেশটির সার্বভৌমত্বে আঘাত করতে চেষ্টার কমতি রাখছে না।
এ প্রসঙ্গে পশ্চিমা ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর জোট ন্যাটোর সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত আইভো দালদের বলেন, ‘প্রশাসনে যতক্ষণ ট্রাম্প আছেন, ততক্ষণ নিয়ম-কানুনের আশা না করাই ভালো।’
বিশ্লেষকরা ট্রাম্পের অর্থনৈতিক প্রত্যাশা ও জমি দখলের আকাঙ্ক্ষাকে ঊনবিংশ শতাব্দীর বর্বর সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে তুলনা করছেন। বিশেষত, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ম্যাকিনলির সঙ্গে ট্রাম্পের মিল খুঁজে পাচ্ছেন তারা। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই নেতা প্রতিবেশী কিউবা, পুয়ের্তো রিকো, হাওয়াই ও ফিলিপাইনে আগ্রাসন চালিয়েছেন।
চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ নিয়ে ট্রাম্পকে দায়ী করে কানাডার প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডোর অভিযোগ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট শুল্কারোপের মাধ্যমে কানাডার অর্থনীতিকে ‘পঙ্গু’ করার পাঁয়তারা করছেন।
ট্রাম্প প্রসঙ্গে ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর অধ্যাপক মাইকেল অ্যালবার্টেস বলেন, ‘ট্রাম্প যে ধরনের আগ্রাসী ভূরাজনীতি প্রতিষ্ঠা করছেন, শীঘ্রই বিশ্বমোড়লরা দুর্বল রাষ্ট্রগুলো দখলের প্রতিযোগিতা শুরু করবে।’
একই সুরে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ মাইকেল বেকার। তার অভিযোগ, ট্রাম্পের অবস্থানের কারণে রাশিয়া ও ইসরায়েলের মতো দেশগুলো ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। অন্যদিকে, তুলনামূলক ছোট দেশগুলো আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব নিয়ে সংকটে পড়ছে।
ট্রাম্পের এই কূটনৈতিক আগ্রাসনকে ‘অনানুষ্ঠানিক সাম্রাজ্যবাদ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন বিশ্লেষক কেরি গোয়েটলিচ।
এই পরিস্থিতিতে ট্রাম্প গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে ফেলে মধ্যযুগীয় কায়দায় ভূমি দখলের প্রচেষ্টা করছেন অভিযোগ করে বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান বিশ্লেষকরা। সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
নাইমুর/