চাঁদে বেসরকারি মিশনে আবারও ব্যর্থ হলো জাপানি মহাকাশ কোম্পানি আইস্পেস। চাঁদে অবতরণের চেষ্টার সময় বৃহস্পতিবার রাতে (০৫ জুন) জাপানের বেসরকারি মহাকাশযান ‘রেজিলিয়েন্স’-এর সাথে পৃথিবীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
বৃহস্পতিবার (৫ জুন) হঠাৎ করেই এই মহাকাশযানের সাথে স্থল নিয়ন্ত্রণের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এটি ইউরোপের প্রথম চন্দ্র রোভার বহনকারী একটি বেসরকারি জাপানি ল্যান্ডার। ঠিক চাঁদে অবতরণের চেষ্টা করার সময় এটির সাথে মিশন কন্ট্রোলার (যা ‘রেজিলিয়েন্স’ নামে পরিচিত) ল্যান্ডারের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
টেনাসিয়াস নামে পরিচিত এই রোভারটি জাপানি কোম্পানি আইস্পেস দ্বারা তৈরি এবং পরিচালিত দ্বিতীয় হাকুটো-আর ল্যান্ডার, রজিলিয়েন্সে বহন করা বেশ কয়েকটি পেলোডের মধ্যে একটি। মহাকাশযানটি চাঁদের কক্ষপথে এক মাসেরও বেশি সময় কাটানোর পর চাঁদের উত্তর গোলার্ধের একটি অনাবিষ্কৃত অঞ্চলে, যা মারে ফ্রিগোরিস বা "শীতল সমুদ্র" নামে পরিচিত, অবতরণের চেষ্টা করছিল ।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার বেশ কয়েক ঘন্টা পরেও, স্থল নিয়ন্ত্রণ ল্যান্ডারের সাথে আর যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেনি এবং এর পেলোডের অবস্থা বর্তমানে অজানা।
আইস্পেসের প্রতিনিধিরা এক্স-এ পোস্ট করা এক বিবৃতিতে লিখেন, ‘আমরা এখনও রেজিলিয়েন্সের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারিনি, তবে আমাদের মিশন কন্ট্রোল সেন্টারের আইস্পেস ইঞ্জিনিয়াররা ল্যান্ডারের সাথে যোগাযোগের জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা আগামী কয়েক ঘন্টার মধ্যে সর্বশেষ তথ্য সহ একটি আপডেট শেয়ার করব।’
রেজিলিয়েন্স হলো চাঁদে অবতরণের চেষ্টাকারী তৃতীয় জাপানি ল্যান্ডার, যা আইস্পেসের প্রথম হাকুটো-আর ল্যান্ডারের পরে, যা ২০২৩ সালের এপ্রিলে কক্ষপথে তার অপারেটরদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়।
এর আগে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সির স্লিম ল্যান্ডার বা মুন স্নাইপা্র উল্টে অবতরণ করে। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে এটি দুই চন্দ্র রাত বেঁচে যায়।
টেনাসিয়াস প্রায় ২১ ইঞ্চি (৫৪ সেন্টিমিটার) লম্বা এবং মাত্র ১১ পাউন্ড (৫ কিলোগ্রাম) ওজনের ছোট একটি পেলোডে। কিন্তু এটি সবচেয়ে আলোচিত হয় এটির পেলোড -‘দ্য মুনহাউস’ নামে পরিচিত ছোট একটি লাল ঘরের কারণে। এইলাল ঘর মাত্র ৪ ইঞ্চি (১০ সেমি) লম্বা। ‘চাঁদের প্রথম বাড়ি’ নামে পরিচিত এই শিল্পকর্মটি তৈরি করেছেন সুইডিশ শিল্পী মিকেল জেনবার্গ। তিনি এই প্রকল্পটির প্রথম ১৯৯৯ সালে কল্পনা করেন।
রেজিলিয়েন্স ল্যান্ডারটি আরও বেশ কয়েকটি পেলোড বহন করছে, যার মধ্যে রয়েছে ওয়াটার ইলেক্ট্রোলাইজার এক্সপেরিমেন্ট। যার লক্ষ্য ছিল চাঁদের পানি থেকে অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন উৎপাদনের সম্ভাব্যতা প্রদর্শন করা এবং শৈবাল-ভিত্তিক খাদ্য উৎপাদন মডিউল, যা চন্দ্র মহাকাশচারীদের জন্য সম্ভাব্য ভবিষ্যতের খাদ্য উৎস হিসাবে সালোকসংশ্লেষণকারী জীবকে বৃদ্ধি করার চেষ্টা করবে।
টোকিওভিত্তিক এই কোম্পানিটি জানায়, ল্যান্ডারটি চাঁদের পৃষ্ঠের উচ্চতা সঠিকভাবে পরিমাপ করতে না পারায় নির্ধারিত গতিতে অবতরণে ব্যর্থ হয় এবং এর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
আইস্পেসের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা রিও উজিইয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এখানে বিভিন্ন ধরণের প্রযুক্তিগত সমস্যা হয়ে থাকতে পারে। যেমন, প্রপালশন সিস্টেম, সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার কিংবা সেন্সরের ত্রুটি।
রেজিলিয়েন্স ব্যর্থ হওয়ার মাধ্যমে জাপানের বেসরকারি মহাকাশ অনুসন্ধানে আবারও বহু বছরের বিরতি দেখা দিলো। তবে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন আর্টেমিস কর্মসূচিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছে এবং বহু জাপানি প্রতিষ্ঠান এখনও চাঁদকে ব্যবসার নতুন দিগন্ত হিসেবে বিবেচনা করছে।
চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণের প্রায় দুই মিনিট আগেই ফ্লাইট ডেটা হারিয়ে যায়। ফলে টোকিওর সুমিতোমো মিৎসুই ব্যাংকের মিশন-অংশীদার কেন্দ্রে একত্রিত ৫০০-এর বেশি কর্মী, বিনিয়োগকারী ও সরকারি কর্মকর্তার মধ্যে হঠাৎ নীরবতা নেমে আসে।
আইস্পেসের শেয়ার বাজারে বিক্রির চাপ সামলাতে না পেরে লেনদেন স্থগিত করা হয়। দিনে শেয়ারের সর্বোচ্চ পতনের সীমা ছুঁয়ে ফেললে প্রায় ২৯ শতাংশ দাম পড়ে যাবে বলে পূর্বাভাস দেয় সংশ্লিষ্ট সূত্র।
বৃহস্পতিবার লেনদেন শেষ হওয়া পর্যন্ত কোম্পানিটির বাজারমূল্য ছিল ১১ হাজার কোটি ইয়েন (৭৬৬ মিলিয়ন ডলার)।
তবে কোম্পানির প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা জুমপেই নোজাকি জানান, এই দুর্ঘটনা সত্ত্বেও কোম্পানির সামনে কোনও আর্থিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা নেই, বরং তারা নিয়মিত বিনিয়োগকারীদের সহায়তা পাচ্ছে।
২০২৩ সালেও আইস্পেসের প্রথম চন্দ্র ল্যান্ডার একইভাবে দুর্ঘটনার শিকার হয়। তখন উচ্চতা নির্ধারণে ত্রুটি থাকায় সফটওয়্যার আপডেট করা হলেও রেজিলিয়েন্সের হার্ডওয়্যারে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়নি।
অবতরণ সফল হলে ২.৩ মিটার উচ্চতার ল্যান্ডার ও রোভারটি ১৪ দিনব্যাপী নমুনা সংগ্রহসহ বিভিন্ন অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করত। এই কাজ যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসার চুক্তির আওতায় করা হতো।
রেজিলিয়েন্স জানুয়ারিতে স্পেসএক্স রকেটের মাধ্যমে মহাকাশে যাত্রা শুরু করে। একই রকেটে যুক্ত ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ফায়ারফ্লাই এর ব্লু গোস্ট ল্যান্ডার, যা দ্রুতগতির কক্ষপথে যেয়ে মার্চে সফলভাবে অবতরণ করে।চ
এর আগে, বাণিজ্যিকভাবে চাঁদের মাটিতে প্রথম সফলভাবে অবতরণ করে যুক্তরাষ্ট্রের ইনটুইটিভ মেশিনস। চলতি বছর তাদের দ্বিতীয় ল্যান্ডার অ্যাথেনাও অবতরণ করে, যদিও সেটিও উল্টে পড়েছিল।
গত বছর জাতীয় মহাকাশ সংস্থা জাকসার মাধ্যমে ‘স্লিম’ ল্যান্ডারের সফল অবতরণের মধ্য দিয়ে জাপান বিশ্বের পঞ্চম দেশ হিসেবে সফট ল্যান্ডিং সম্পন্ন করে। এরপর জাপান ও নাসার মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষর হয়, যাতে জাপানি নভোচারীরা আর্টেমিস কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারবেন এবং বেসরকারি গবেষণার ক্ষেত্রেও সহযোগিতা চালানো হবে।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা এক্সে পোস্ট করে লিখেন, আইস্পেসকে ঘিরে আমাদের প্রত্যাশা শেষ হয়ে যায়নি।
তবে রিৎসুমেইকান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজুতো সাইকি মনে করেন, যেহেতু বেসরকারি মিশনে একাধিকবার ব্যর্থতা দেখা যাচ্ছে, তাই জাপানের কিছু প্রতিষ্ঠান এখন বিদেশি কোম্পানির সেবাও বিবেচনা করতে পারে।
আইস্পেস ২০২৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত বড় আকারের তৃতীয় ল্যান্ডার পাঠাতে চায়, যা হবে নাসার কমার্শিয়াল লুনার পে-লোড সার্ভিসেস প্রোগ্রামের অংশ। তারা ২০২৯ সাল পর্যন্ত জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র মিলিয়ে ছয়টি মিশনের পরিকল্পনা করছে।
সুলতানা দিনা/