ভারতশাসিত জম্মু-কাশ্মীরের পাহালগামে জঙ্গি হামলার তৃতীয় দিনের মাথায় নিয়ন্ত্রণরেখায় পাকিস্তানি ও ভারতীয় সেনাদের মধ্যে গোলাগুলি হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর গোলাগুলির খবর পাওয়া গেছে। এদিকে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভারত-পাকিস্তানকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন।
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ভারতে বসবাসরত পাকিস্তানিদের ধরে ফেরত পাঠানোর জন্য সব রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন। আর স্কেচ প্রকাশ করা হামলাকারীদের ব্যাপারে তথ্য দিতে অর্থ পুরস্কার ঘোষণা করেছেন তিনি।
এ ছাড়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদি শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) শ্রীনগরে পৌঁছেছেন। সেখানে পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে কাশ্মীরের নিরাপত্তাব্যবস্থা পর্যালোচনা করেন তিনি।
ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পাহালগামে বন্দুকধারীদের হামলার সঙ্গে পাকিস্তান জড়িত বলে ভারত যে অভিযোগ করছে, তা নাকচ করে দিয়েছে পাকিস্তান। গতকাল শুক্রবার পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটে সর্বসম্মতিক্রমে এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস হয়েছে।
নিয়ন্ত্রণরেখায় গোলাগুলি
ভারতের সেনাবাহিনীর একটি সূত্র আল-জাজিরাকে জানায়, পাকিস্তানের পক্ষ থেকেই প্রথম গুলি ছোড়া হয়। পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরের একজন সরকারি কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এএফপিকে দুই দেশের সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের ব্যাপারে নিশ্চিত করেছেন। কে আগে গুলি ছুড়েছে, ভারত না পাকিস্তান, তা তিনি বলতে পারেননি।
তবে পাকিস্তানি কর্মকর্তা সৈয়দ আশফাক গিলানি এএফপিকে জানান, বেসামরিক লোকজনের ওপর কোনো গুলি ছোড়া হয়নি। ভারত-পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণরেখার কোন অংশে গোলাগুলি সংঘটিত হয়েছে, সে ব্যাপারেও স্পষ্ট হওয়া যায়নি।
ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে আল-জাজিরার সংবাদদাতা উমার মেহরাজ জানান, বান্দিপোরা এলাকায় পৃথক এনকাউন্টারে দুই বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছেন। আর রয়টার্সের খবরে ‘লিপা ভ্যালি’তে দুই দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে গুলিবর্ষণের কথা জানানো হয়।
এনডিটিভি জানায়, ভারতীয় চৌকি লক্ষ্য করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অনুমাননির্ভর গুলির পাল্টায় ভারতীয় সেনাবাহিনীও গুলি চালিয়েছে। ভারতের সামরিক সূত্র বলছে, নিরাপত্তা বাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ‘কার্যকর জবাব’ দিয়েছে। তবে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
এনডিটিভির খবরে বলা হয়, বৃহস্পতিবার রাতে নিয়ন্ত্রণরেখার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানের তরফে ছোট অস্ত্র ব্যবহার করে গুলি ছোড়া হয়। সেই গুলির কার্যকর জবাব দেওয়া হয়েছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে গোলাগুলির ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে
কাশ্মীরের পাহালগামে পর্যটকদের ওপর হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক এখন একেবারেই তলানিতে এসে পৌঁছেছে। হামলার প্রতিক্রিয়ায় গত বুধবার ভারতের তরফে সার্ক ভিসা স্কিমের অধীনে পাকিস্তানিদের ভিসা দেওয়া বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই সঙ্গে এই ভিসার অধীনে ভারতে থাকা পাকিস্তানিদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আটারি স্থলসীমান্ত বন্ধের পাশাপাশি ঐতিহাসিক সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দেয় ভারত। পাশাপাশি দুই দেশের হাইকমিশনে কর্মকর্তা কমানো ও ফিরে যাওয়াসহ একাধিক নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এর পাল্টা হিসেবে গত বৃহস্পতিবার ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি স্থগিত এবং ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে ইসলামাবাদ। ভারতের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য স্থগিতের পাশাপাশি নয়াদিল্লিকে পাকিস্তানের মাটি ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাকিস্তান। ভারতীয় বিমানের জন্য আকাশসীমা বন্ধেরও ঘোষণা এসেছে।
সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জাতিসংঘের
পাহালগামে মঙ্গলবারের জঙ্গি হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত ও ডজনের বেশি আহতের ঘটনা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা তীব্র করেছে। তবে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস হামলার পর সৃষ্ট উত্তেজনা প্রশমনে ভারত ও পাকিস্তান কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফান দুজারিক বলেছেন, ‘আমরা দুই দেশের সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছি সংযম প্রদর্শনের। পরিস্থিতির আর যাতে অবনতি না ঘটে, সেদিকে আমরা নজর রাখছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার উত্তেজনা আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলা যেতে পারে এবং সেটাই করা উচিত তাদের।’
নিরাপত্তার গাফিলতি নিয়ে প্রশ্ন
কাশ্মীরের নিরাপত্তাব্যবস্থায় ভারত সরকারের গাফিলতির বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে। সামাজিক মাধ্যমে ভারতে অনেক মানুষের ক্ষোভের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন- হামলার সময়ে নিরাপত্তা বাহিনী কোথায় ছিল?
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, প্রায় ২০ মিনিট হামলা চলার পর যখন নিরাপত্তা বাহিনী সেখানে পৌঁছায়, ততক্ষণে বন্দুকধারীরা পালিয়ে গেছে। ওই হামলায় বেঁচে যাওয়া একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
মহারাষ্ট্রের পুনের বাসিন্দা আশাবরী সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে জানিয়েছেন, হামলার সময় তিনি তার মা-বাবা ও আত্মীয়দের সঙ্গে ছিলেন। ওই হামলায় তার বাবা ও এক আত্মীয় নিহত হয়েছেন। পিটিআই আশাবরীকে উদ্ধৃত করে লিখেছে, ‘আমাদের সাহায্য করার জন্য সেখানে কেউ ছিল না।’ তিনি দাবি করেন, হামলার ২০ মিনিট পর নিরাপত্তা বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছায়।
অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল কে জে এস ধিলো ভারতীয় সেনাবাহিনীর শ্রীনগরভিত্তিক ১৫ কোরের সাবেক কমান্ডার। তার ভাষ্য, ‘আপাতত আমি এটাই বলব, কাশ্মীরের নিরাপত্তাব্যবস্থা গতিশীল বা ডায়নামিক পদ্ধতিতে কাজ করে। সেটার নিয়মিত পর্যালোচনা করা হয়। সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট থেকে দেখেছি, বৈসরন উপত্যকায় নিরাপত্তা বাহিনীর কোনো উপস্থিতি ছিল না। যে এলাকায় এত পর্যটকের ভিড়, সেখানে নিরাপত্তা বাহিনী থাকা উচিত ছিল।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিশ্লেষক বলেন, ‘জম্মু-কাশ্মীরে সরকারের কৌশল পুনর্বিবেচনা করা দরকার।’
সেনাবাহিনীর ডিরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশনস (ডিজিএমও) অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘পাহালগামে হামলার পর পর্যটন নিয়ে সরকারকে কিছু দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।’
গত বৃহস্পতিবার সর্বদলীয় বৈঠকেও নিরাপত্তার গাফিলতি নিয়ে সরকারকে তোপের মুখে পড়তে হয়।
পাকিস্তানিদের খুঁজতে সব রাজ্য সরকারকে নির্দেশ
ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কোনো পাকিস্তানি নাগরিক যাতে ভারতে থাকতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে গতকাল শুক্রবার সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ভিসা বাতিলের পর পাকিস্তানিদের শনাক্ত করে যেন দ্রুত ফেরত পাঠানো হয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই নির্দেশ প্রসঙ্গে মন্ত্রণালয় থেকে অবশ্য কোনো মন্তব্য করা হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বিবৃতিও জারি করা হয়নি।
তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, অমিত শাহ নিজে ফোন করে মুখ্যমন্ত্রীদের ওই নির্দেশ দিয়েছেন। হামলাকারীদের খোঁজ দিতে পারলে প্রত্যেকের জন্য ২০ লাখ ভারতীয় রুপি পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে।
রয়টার্স জানায়, ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী পাহালগামে হামলায় সন্দেহভাজন তিন বন্দুকধারীর স্কেচ প্রকাশ করেছে। ওই তিন সন্দেহভাজন হচ্ছেন আসিফ ফাউজি, সুলেমান শাহ ও আবু তালহা। তারা কোড নেম হিসেবে মুসা, ইউনূস ও আসিফ ব্যবহার করতেন। লস্কর-ই-তৈয়বার সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
শ্রীনগরে ভারতের সেনাপ্রধান
জম্মু-কাশ্মীর পরিস্থিতি দেখতে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদি গতকাল শুক্রবার শ্রীনগরে পৌঁছেছেন। সেখানে পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে কাশ্মীরের নিরাপত্তাব্যবস্থা পর্যালোচনা করেন তিনি। শ্রীনগরে ভারতীয় সেনাবাহিনী ‘সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয়’ নামে এক সামরিক অভিযান শুরু করেছে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে। গতকাল ভোরে ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীরে সন্দেহভাজন দুই জঙ্গির বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদি শ্রীনগরে যাওয়ার পরই সেখানে সামরিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকেই ভারতীয় বিমান ও নৌবাহিনী বড় তৎপরতা শুরু করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, তাদের এই তৎপরতা সামরিক অভিযানের দরজা খুলে দিতে পারে।
পাকিস্তানের সিনেটে প্রস্তাব পাস
ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পাহালগামে বন্দুকধারীদের হামলার সঙ্গে পাকিস্তান জড়িত বলে ভারত যে অভিযোগ করছে, তা নাকচ করে দিয়েছে পাকিস্তান। হামলার সঙ্গে ইসলামাবাদকে জড়ানোর বিরুদ্ধে গতকাল শুক্রবার পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে।
উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার প্রস্তাবটি সিনেটে উত্থাপন করে বলেন, ‘পানি-সন্ত্রাসবাদ বা সামরিক উসকানিসহ যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজেদের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করতে পাকিস্তান পুরোপুরি প্রস্তুত।’
প্রস্তাবে ‘ভারতনিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরে ২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল সংঘটিত হামলার সঙ্গে পাকিস্তানকে জড়িত করার সব অসার ও ভিত্তিহীন প্রচেষ্টা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।’
এতে বলা হয়েছে, নিরীহ বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা পাকিস্তান-সমর্থিত মূল্যবোধের পরিপন্থি। প্রস্তাবে নিন্দা জানিয়ে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের মর্যাদাহানি করতে ভারত সরকার পরিকল্পিতভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে। সংকীর্ণ রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্যই সন্ত্রাসবাদের ঘটনাকে ব্যবহার করা হচ্ছে। সিনেটে পাস হওয়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তানের জনগণ শান্তির বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু কাউকে দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও স্বার্থ লঙ্ঘন করতে দেবে না।’