যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল একযোগে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। বহু মানুষ হতাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলছে ইরান। দেশটির শাসকগোষ্ঠীর বিরোধীরাও এই মুহূর্তে দেশের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। জাতীয়তাবাদ জেগে উঠছে।
প্রায় ৪৫ বছর ধরে নিঃশব্দে চলছিল ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সংঘাত। মাঝে মাঝে উত্তেজনা চরমে উঠলেও দুপক্ষ কখনো সরাসরি একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি। সংঘর্ষ হয়েছে মূলত তৃতীয় দেশের ভেতর, বিশেষ করে ইরাকে। ইরাকের মাটিতে ইরানের সমর্থিত হামলায় ছয়জন মার্কিন সেনা নিহত হন। এই ঘটনা সামনে এনে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, সেটিই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা হামলার কারণ।
তিনি ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার ঘোষণা দিয়ে বলেন, এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এমন এক শাসকের বিরুদ্ধে, যিনি কখনো নিজের হাতে আক্রমণ চালাননি, বরং সব সময় অন্যদের ব্যবহার করে কাজ করিয়ে নিয়েছেন।
ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা ছিলেন দখলদার বাহিনী। সড়কে টহলের সময় তারা চলতেন ভারী বর্মে আচ্ছাদিত হামভিতে। কারণ ইরান-সমর্থিত বিদ্রোহীরা ব্যবহার করত এমন বোমা, যেগুলো তামার গোলক ছুড়ে এই বর্ম ভেদ করতে পারত। এম১ আব্রামস ট্যাংকও এসব থেকে রক্ষা পেত না। যারা বেঁচে যেতেন, তারা অনেক সময় হাত বা পা হারাতেন।
ইরাক যুদ্ধের মার্কিন সামরিক নথি অনুযায়ী, এই বিস্ফোরকে ব্যবহৃত তামার পাতের একটি চালান আটক করা হয়েছিল। যেগুলো ছিল ইরানের একটি ল্যাবে তৈরি।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা আগেই যুক্তরাষ্ট্রকে এসব অস্ত্র সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। তারা নিজেরাও লেবাননে হিজবুল্লাহর হামলায় এসব বোমা হামলার শিকার হয়েছিলেন। হিজবুল্লাহ গড়ে তোলে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ত্র দেয় ইরান। ২০০৩ সালে আমেরিকার ইরাক আগ্রাসনের পর তেহরান এসব প্রযুক্তি হিজবুল্লাহর মাধ্যমে মাঠে নামায়।
ইরান-যুক্তরাষ্ট্র বৈরিতার শুরু ১৯৭৯ সালে। তখন সাধারণ ইরানিরা বিদ্রোহ করেন যুক্তরাষ্ট্রপন্থি শাহের বিরুদ্ধে। এই শাহ ছিলেন সিআইএ ও ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের সহায়তায় ক্ষমতায় আসা একজন রাজা, যিনি হটিয়ে দিয়েছিলেন তেল জাতীয়করণের পক্ষে থাকা এক জনপ্রিয় নির্বাচিত সরকারকে। ওই সরকার এক ব্রিটিশ তেল কোম্পানিকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।
আজও তেহরানের একটি ভবনের দেয়ালে আঁকা আছে আমেরিকার পতাকা, যেখানে তারার জায়গায় খুলি ও ডোরাকাটা অংশে বোমার চিত্র। বহু বছর পরও দেয়ালচিত্রটি নতুন করে রং করা হয়। ওই স্থানে এখনো স্পষ্ট ‘আমেরিকার মৃত্যু হোক’- এই বিখ্যাত স্লোগান লেখা।
এই ভবনটিই একসময় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস, এখন পরিচিত ‘গোয়েন্দাদের গুহা’ নামে। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের সময় এখানেই হামলা চালায় খোমেনির অনুসারীরা। আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি ছিলেন ওই বিপ্লবের নেতা। তাকেই টাইম ম্যাগাজিন ১৯৭৯ সালের বর্ষসেরা ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা করেছিল। (তাকে যেন মিলিয়ে না ফেলা হয় বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা ৮৬ বছর বয়সী আলী খামেনির সঙ্গে। যিনি এখন নাকি নিজের উত্তরসূরি বেছে নিচ্ছেন)।
দূতাবাস ভবনটি এখন একটি জাদুঘর। যুক্তরাষ্ট্রের ভ্রমণবিষয়ক তথ্য এবং বুকিং ওয়েবসাইট ট্রিপঅ্যাডভাইজার একে কার্যকর জাদুঘর হিসেবে বর্ণনা করেছে। বিপ্লবীরা যখন দেয়াল ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকছিলেন, তখন মার্কিন কূটনীতিকরা গোপন নথি কুচিয়ে ফেলছিলেন। ওই এক-আধ ইঞ্চি টুকরো করা কাগজ এখন টেবিলে সাজানো, অনেক কাগজ জোড়া লাগানো হয়েছে-গোটা দৃশ্যেই ধরা পড়ে বিপ্লবের উত্তেজনা।
৪৪৪ দিন ধরে ৫০ জনের বেশি মার্কিন কূটনীতিক সেখানে বন্দি ছিলেন। ওই অপমানের ইতিহাসে আমেরিকা এখনো ক্ষুব্ধ। এবার তাদের হামলায় ইরানও একই রকম অপমানবোধ করছে।
তবে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক জায়গা হলো- যখন যুদ্ধ ইরানের ভেতরে শুরু হয়, তখন তা ২ হাজার ৫০০ বছরের পুরোনো এক জাতিকে জাগিয়ে তোলে।
ইরানের অনেক নাগরিক শাসকদের ঘৃণা করলেও বিদেশি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক হয়ে দাঁড়ান। ১৩ জুন ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ঘাঁটি থেকে তেহরানে ড্রোন ও যুদ্ধবিমান হামলা চালানো হয়। অনেকে বিস্ময়ে দেখছিলেন। তেহরানে রসিকতা চলছে- ইরানের পাল্টা হামলায় লক্ষ্যবস্তু ছিল মোসাদের সদর দপ্তর, কিন্তু ওটা খালি ছিল। কারণ সব এজেন্ট তখন তেহরানেই!
২০০২ সালে ইরানের গোপন পারমাণবিক কর্মসূচি প্রথম প্রকাশ্যে আসে। সে সময় সংস্কারের পক্ষে একটি আন্দোলন হয়। তখন অনেকে ভেবেছিলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার বদলানো সম্ভব। কিন্তু ওই সংস্কারবাদী আন্দোলন ব্যর্থ হয়। সরকার বুঝে যায়, জনসমর্থন নেই। তখন তারা প্রতিবাদ দমন করা শুরু করে এবং গোপনে পরমাণু কর্মসূচি গড়ে তোলে।
ইরানের নানা প্রান্তেই বহু মানুষ শাসকবিরোধী। ছোট শহর থেকে রাজধানী পর্যন্ত প্রতিবাদের ঢেউ ওঠে। তবে বোমা আঘাত হানলে হিসাব বদলায়। প্রথম রাতে ইসরায়েল শুধু সামরিক স্থাপনায় হামলা চালালেও পরে তারা তেল শোধনাগার ও পানি সরবরাহ লাইনেও আঘাত হানে। রাজধানীর উত্তরের তাজরিশ স্কয়ারে এক বোমায় মারা যান খ্যাতনামা এক গ্রাফিক ডিজাইনার, যিনি সেই সময় ট্রাফিক সিগনালে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
গাজা যেন ছায়ার মতো তাড়া করছে ইসরায়েলের প্রতিটি অভিযানে। ইরানের পাল্টা হামলায় যখন ইসরায়েলিরা নিহত হন, তখন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুমকি দেন- ‘তেহরান পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।’
এদিকে ইরানের ভেতরে যারা সরকারের সমালোচক, তারাও এখন বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করছেন। টেলিগ্রামে এক বিবৃতিতে মানবাধিকারকর্মী ও রাজনৈতিক আন্দোলনকারীরা বলেন-
‘এই দেশের ইতিহাসের সংকটময় মুহূর্তে, যখন আমরা একটি বর্ণবাদী ইসরায়েলি সরকারের আগ্রাসনের মুখে, তখন আমরা এই হামলার নিন্দা জানাই। আমরা যেকোনো বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করি। কারণ আমরা মনে করি, এটি আমাদের নাগরিক সমাজের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রয়াসকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আমরা আমাদের মাতৃভূমির অখণ্ডতা, স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ। আমরা এই অঞ্চলে শান্তির পক্ষেও।’
তেহরানে পারমাণবিক গবেষণা চুল্লির আশপাশে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। সরকার পটাসিয়াম আয়োডাইড ট্যাবলেট বিতরণ শুরু করেছে। যেটি তেজস্ক্রিয়তা থেকে গলা রক্ষা করতে সাহায্য করে। ফোর্দো, নাতাঞ্জ ও ইস্ফাহানে যেসব স্থাপনায় বোমা পড়েছে, সেগুলো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র। সেখানে রেডিয়েশন ছড়ানোর ঝুঁকি কম। কিন্তু তেহরানের চুল্লি ব্যতিক্রম। এটি ১৯৬৭ সালে আমেরিকা স্থাপন করেছিল। শহরের মাঝখানে ৯০ লাখ মানুষের আবাস। বলা হয়েছে, কেবল রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের নির্দেশ পেলে নির্দিষ্ট বয়সীদের এই ওষুধ খেতে হবে। অথচ ওই টেলিভিশন চ্যানেলেও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল।
এখন প্রশ্ন, এরপর কী হবে? এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে ইরানের শাসকদের আচরণের ওপর। তারা কখনো খুব জনপ্রিয় ছিলেন না। কিন্তু যখন ইরানের ভেতরে বিদেশি সেনা আসে, তখন জাতি একত্র হয়। ইরানে সরকারবিরোধিতা আছে, কিন্তু মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসাও প্রবল।
এই জাতীয় গর্ব ইসলামের আগের সময় থেকে চলে আসছে। ইরানের মালভূমিতে আজও কেউ কেউ পালন করেন প্রাচীন জরথ্রুস্ট ধর্ম- বিশ্বের প্রথম একেশ্বরবাদী ধর্ম, যার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল এক সাম্রাজ্য। এই ঐতিহ্য এখনো ইরানিদের মনে গেঁথে আছে।
এই গর্ব ধরা পড়ে নামের মধ্যেও- দারিওস, কাইরাস; যেটি পারস্য সম্রাটদের নাম। পার্সেপোলিসের ধ্বংসাবশেষে খোদাই করা চিত্রে দেখা যায়, বিশ্ববাসী নতজানু হয়ে পারস্য শাসকের সামনে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। অনেক ইরানি এখনকার পারমাণবিক কর্মসূচিকেই সেই ঐতিহ্যের অংশ মনে করেন। তাদের মতে, এটি ‘অপরিহার্য অধিকার’। কারণ পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তির সদস্যরাষ্ট্র শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে।
তেহরানে এখন দেখা যাচ্ছে, দীর্ঘদিন জনসমর্থনহীন সরকার নতুন করে কিছুটা সমর্থন ফিরে পাচ্ছে।
এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ব্যক্তিগতভাবে বন্ধুকে বলেন, ‘খামেনি যদি পুরো পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধও করতেন, তবু ইসরায়েল হামলা চালাত। তাদের উদ্দেশ্য ইরানের সামরিক শক্তিকে দুর্বল করা।’
লেখক: টাইম পত্রিকার জেরুজালেম ব্যুরোপ্রধান হিসেবে দায়িত্বে আছেন। টাইম থেকে অনুবাদ: এম আর লিটন