ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ গাজার ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক সরানোর পরিকল্পনা উত্থাপন করেছেন। তার পরিকল্পনা অনুসারে, সব ফিলিস্তিনিকে রাফার ধ্বংসস্তূপের মাঝে একটি আশ্রয়শিবিরে স্থানান্তর করা হবে। তবে আইনি বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপকরা এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। তারা বলছেন, এটি আসলে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের একটি ‘নীলনকশা’।
ইসরায়েল কাৎজ এরই মধ্যে নিজেদের সামরিক বাহিনীকে আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করতে বলেছেন। তিনি এর নাম দিয়েছেন ‘মানবিক শহর’। ইসরায়েলের হারেৎজ সংবাদপত্রের খবরে বলা হচ্ছে, পুরো আশ্রয়কেন্দ্রটিই গড়ে তোলা হবে রাফার ধ্বংসস্তূপের ওপর।
সেখানে ফিলিস্তিনিদের প্রবেশ করানোর আগে ‘সুরক্ষা নজরদারির’ মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আর একবার প্রবেশের পর সেখান থেকে তারা বের হতে পারবেন না বলেই ইসরায়েলি সাংবাদিকদের এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন কাৎজ।
ইসরায়েলি বাহিনী ওই আশ্রয়কেন্দ্রের চারপাশ নিয়ন্ত্রণ করবে। প্রাথমিকভাবে সেখানে ছয় লাখ ফিলিস্তিনিকে সরানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এদের বেশির ভাগই গাজার আল-মাওয়াসি এলাকা থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে গাজার সব মানুষকেই সেখানে পাঠানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে এভাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চলতি বছরের শুরুর দিকে বলেছিলেন, ফিলিস্তিনিদের বড় একটি অংশকে গাজা থেকে সরাতে হবে, যাতে উপত্যকাটি পরিষ্কার করা যায়। সে সময় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুসহ দেশটির অন্যান্য আইনপ্রণেতা বিষয়টিকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক সরানোর বিষয়টি প্রচারও করেছিলেন।
তবে খোদ ইসরায়েলের প্রধান সারির মানবাধিকার গোষ্ঠীর আইনজীবী মাইকেল সফার্ড বলেছেন, কাৎজের পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক আইন ভাঙছে। কাৎজ এমন একটি পরিকল্পনা সামনে নিয়ে এসেছেন, যা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ছাড়া আর কিছু নয়। এটি মূলত গাজা উপত্যকার জনগোষ্ঠীকে দক্ষিণের অংশে নিয়ে যাওয়ার এক পরিকল্পনা, যাতে পরে তাদের গাজার বাইরে বের করে নিয়ে যাওয়া যায়।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী এর আগে দাবি করেছিল, ফিলিস্তিনিরা গাজার ভেতরে নিজেদের সুরক্ষার জন্যই বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। সামরিক বাহিনীর ওই দাবিকেও প্রত্যাখ্যান করেছেন মানবাধিকার গোষ্ঠীটির আইনজীবী।
এ আইনজীবী আরও বলেছেন, ‘সরকার এটিকে স্বেচ্ছায় সরে যাওয়া হিসেবে দেখালেও গাজাবাসী আগে থেকে এতটা চাপে রয়েছে যে উপত্যকা থেকে তাদের চলে যাওয়াকে বৈধতা দেওয়ার কোনো উপায় নেই।’
সফার্ড আরও বলেন, ‘আপনি যখন কাউকে তার মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করবেন, সেটি যুদ্ধাপরাধের শামিল হবে। যদি এটি তার পরিকল্পনা অনুসারে এত বড়মাপে করা হয়, তা হলে তা হবে মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ।’
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজার যুদ্ধ নিয়ে আলোচনার জন্য ওয়াশিংটন ডিসিতে পা রাখার পরপরই নিজের পরিকল্পনা প্রকাশ করেন কাৎজ। ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে নেতানিয়াহুকে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে আসতে বা ২১ মাসের যুদ্ধ সাময়িকভাবে থামাতে ব্যাপক চাপ দেওয়া হবে।
কাৎজের পরিকল্পনা অনুসারে, তাদের ওই ‘মানবিক শহরের’ কাজ শুরু হবে যুদ্ধবিরতি চলাকালে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী আরও বলেছেন যে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে নেতানিয়াহু আলাপ করছেন, যাতে ফিলিস্তিনিদের তারা আশ্রয় দেয়।
এদিকে, হোয়াইট হাউস থেকে গত সোমবার নেতানিয়াহু বলেন, ফিলিস্তিনিদের জন্য আরও ভালো ভবিষ্যৎ নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে কাজ করছে।
ট্রাম্পের সঙ্গে নৈশভোজের আগে নেতানিয়াহু বলেন, ‘যদি মানুষ থাকতে চায়, তারা থাকতে পারবে। তবে তারা যদি বের হতে চায়, তা হলে তাদের বের হতে দেওয়া উচিত।’ নেতানিয়াহুর প্রশাসনের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মটরিচসহ অন্যান্য রাজনীতিবিদ একে সাধুবাদ জানিয়েছেন। তারা গাজায় ইসরায়েলি অবকাঠামো গড়ে তোলার বিষয়েও কথা বলেছেন।
২০০ কোটি ডলারের এ পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) নামও রয়েছে। যদিও জিএইচএফ এরই মধ্যে জানিয়েছে, তারা এ পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত নয়।
ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় হামলার মাত্রা বৃদ্ধি করেছে। সেখানে সোমবার (৮জুলাই) এক বিস্ফোরণে তাদের পাঁচ সেনা ও ১৪ জন আহত হয়েছে। এর পরপরই তারা পুরো উপত্যকায় হামলার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি হামলায় গাজায় অন্তত ৫৭ হাজার ৫২৩ জন মারা গেছে। আহত হয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬১৭ জন।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, আল-জাজিরা